ছবি/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 বিদ্যুৎপ্রকাশ প্রস্থান করিলে পর, আমি বলাই বাবুকে বলিলাম, “ডাক্তার! আর তোমায় কষ্ট দিতে ইচ্ছা করি না। হয়তো এই বিলম্বের জন্য তোমায় বাড়ী গিয়া অনেক কৈফিয়ৎ দিতে হইবে। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে পরশ্ব বেলা তিনটার সময় আমার এখানে আসিও।”

 ডাক্তার প্রস্থান করিলেন। আমিও অফিস ঘর বন্ধ করিতে গাদেশ করিয়া বাসায় প্রস্থান করিলাম।

 পরদিন জমীদার-পুত্রের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারি নাই। যে কার্য্যের ভার সেদিন গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহাই যথাসম্ভব শেষ করিলাম।

 পরদিন বেলা আটটার সময় এক কোচম্যানের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর নিকট ঘুরিতে লাগিলাম। অভিনেত্রীর প্রকাণ্ড বাড়ী। বাড়ীর পার্শ্বেই তাহার আস্তাবল। আস্তাবলে একজন সহিস ঘোড়ার গাত্র মলিতেছিল। আমি কথায় কথায় তাহার নিকট গমন করিলাম এবং তাহার কার্য্যে সাহায্য করিলাম। সহিস আমার কার্য্যে সন্তুষ্ট হইল। আমি তখন তাহার নিকট একটী কর্ম্মের প্রার্থনা করিলাম, সে সম্মত হইয়া বলিল যে, সুবিধা হইলেই সে আমার জন্য তাহার প্রভুকে বলিবে।

 আমি বাস্তবিক চাকরীর চেষ্টায় যাই নাই, সুতরাং সহিসকে অভিনেত্রী-সংক্রান্ত অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সহিস যে উত্তর করিল, তাহাতে সন্তুষ্ট না হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভাই সহিস! তোমার প্রভু কেমন?”

 সহিস উত্তর করিল, “অমন মনিব পাওয়া যায় না। তাঁহাকে দেখিতে যেমন সুন্দরী, তাঁহার গুণও ততোধিক। এখন অনেকেই তাঁহার জন্য পাগল।”

 আ। বটে! এমন সুন্দরী! আচ্ছা, তিনি কেন বিবাহ করেন না?

 আমার কথায় সহিস হাসিয়া উঠিল। বলিল, “এ কি মুসলমান যে, নিকা করিবে? হিন্দুরমণী বিধবা হইলে কি আর বিবাহ করে?”

 আমিও হাসিয়া বলিলাম, “আজিকাল ব্রাহ্মমতে অনেকের বিবাহ হইয়া থাকে।

 স। তা ত জানি না।

 আ। এখন ইহাঁর প্রিয় পাত্র কে?

 স। আগে একজন বড় জমীদারই প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু আজকাল আর তাঁহাকে দেখিতে পাই না। গণপত নামে এক মাড়োয়ারী ইহাঁর প্রিয়পাত্র হইয়াছেন। বোধ হয়, ইনি তাঁহাকে বিবাহ করিবেন।

 এই সংবাদ পাইয়া গণপতের সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা হইল। আমি তাঁহার ঠিকানা জানিবার জন্য প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইব, এমন সময়ে একখানি প্রকাণ্ড ল্যাণ্ডো অট্টালিকা দ্বারে লাগিল। সহিস সেই গাড়ী দেখিয়াই বলিয়া উঠিল, “ঐ যে গণপত বাবু স্বয়ং উপস্থিত!”

 গাড়ীখানি স্থির হইলে উহার মধ্য হইতে একজন সু-পরিচ্ছদধারী মাড়োয়ারী অবতরণ করিলেন এবং অবিলম্বে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে তিনি সহাস্যবদনে পুনরায় দ্বারদেশে উপনীত হইলেন এবং সেই গাড়ীতে আরোহণ করিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, “ব্রাহ্ম সমাজ। যত শীঘ্র পার যাও।”

 গণপতের মুখ হইতে কথা বাহির হইতে না হইতে কোচমান অশ্বে কশাঘাত করিল। গাড়ী সবেগে ব্রাহ্ম সমাজের দিক আসিতে লাগিল।

 পাঁচ মিনিট অতীত হইতে না হইতে সেই অভিনেত্রীও অট্টালিকা হইতে বহির্গত হইল। এক ভৃত্য ঠিক সেই সময়ে একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ী ডাকিয়া আনিল। অভিনেত্রী সেই গাড়ীতে উঠিয়া বলিল, “ব্রাহ্ম সমাজ। যদি দশ মিনিটের মধ্যে ঐ স্থানে লইয়া যাও, তাহা হইলে পাঁচ টাকা বক্‌সিস দিব।”

 গাড়োয়ান বেগে গাড়ী চালাইয়া দিল। আমি কি করিব, স্থির করিতে পারিলাম না। ঠিক সেই সময়ে আর একখানি খালি গাড়ী যাইতেছিল। আমি গাড়োয়ানের নিকট যাইয়া বলিলাম, “যদি আমায় ব্রাহ্ম সমাজে দশ মিনিটের মধ্যে পঁহুছাইয়া দিতে পার, তাহা হইলে দশ টাকা পুরস্কার দিব।”

 পুরস্কারের লোভে সে গ্রাণপণে অশ্বচালনা করিল। আমি অনেক গাড়ী চড়িয়াছি, কিন্তু এই কোচম্যান যেমন দ্রুত গাড়ী চালাইয়াছিল, তত দ্রুত আমি এ পর্য্যন্ত আর কখনও গমন করি নাই। কিন্ত আমি যতই তাড়াতাড়ি করি না কেন, আমার গাড়ী যখন ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারে আসিয়া লাগিল, তাহার পূর্ব্বে অপর দুইখানি গাড়ী আসিয়া পড়িয়াছে।

 গাড়োয়ানকে পুরস্কার দিয়া বিদায় করিয়া বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে তাঁহারা সমাজ হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলেন। আমি তখন সমাজের ভিতর গিয়া সন্ধান লইলাম।

 আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, বাস্তবিক তাহাই ঘটিয়াছিল। গণপত অভিনেত্রীকে ব্রাহ্মমতে বিবাহ করিয়াছেন। এই সংবাদে আমি কিছু চিন্তিত হইলায়। ভাবিলাম, যদি আজই উভয়ে পলায়ন করে, তবে বিদ্যুৎ প্রকাশের ফটো আদায় হইল না।

 এই চিন্তা করিতে করিতে আমি আমার অফিসে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বলা বাহুল্য, আমি তখনও ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করি নাই।

 অফিসে আসিয়া দেখি, ডাক্তার আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনিও প্রথমে আমায় চিনিতে পারিলেন না। অনেকক্ষণ আমার দিকে নির্নিমেষ-নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া, তিনি হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “এ আবার কি! সহিসের চাকরী কবে হইতে করিতেছ?”

 আমি হাসিয়া একটী প্রকোষ্ঠে গমন করিলাম এবং তথায় ছদ্মবেশ ত্যাগ করতঃ পুনরায় ডাক্তারের নিকট আগমন করিলাম। বলিলাম, “ডাক্তার! বড় বিপদ। এখন তোমার সাহায্য চাই।”

 ব। আমিও সেইজন্য এখানে আসিয়াছি।

 আ। কিন্তু কোম্পানীর আইন ভঙ্গ করিতে পারিবে?

 ব। নিশ্চয় পারিব।

 আ। যদি পুলিসের হাতে পড়?

 ব। সৎকার্য্য হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই।

 আ। আমি অসৎ কার্য্যে নাই, তুমি জান বোধ হয়?

 ব। নিশ্চয়ই জানি।

 আ। অবে আমায় সাহায্য করিতে অঙ্গীকার করিলে?

 ব। হাঁ, অঙ্গীকার করিলাম। এখন আমায় কি করিতে হইবে বল?

 আ। সেই অভিনেত্রী আজ সন্ধ্যা সাতটার পূর্ব্বে বাড়ী আসিবে জানি। সেই সময় আমরা উভয়েই তথায় হাজির থাকিব।

 ব। বেশ কথা। কিন্তু আমায় কি করিতে হইবে?

 আ। আমার যতই বিপদ হউক না কেন, তুমি কোনমতে ব্যস্ত হইবে না।

 ব। ভাল, তাহাই হইবে। কিন্তু তুমি কি করিতে বল?

 সম্ভবতঃ আমাকে সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর মধ্যে লইয়া যাইবে। একতলায় বাহিরের ঘরেই লোকজন যাতায়াত করে। খুব সম্ভব আমাকেও সেই ঘরে লইয়া যাইবে। তুমি বাহির হইতে আমায় লক্ষ্য করিবে এবং যখন দেখিবে যে, দুই হস্ত উত্তোলন করিয়াছি, তুমিও তখন এই দুই গোলা সেই ঘরের দেওয়ালে নিক্ষেপ করিবে এবং আগুন লাগিয়াছে বলিয়া চীৎকার করিবে। যখন দেখিবে, লোকজন সকলেই সেই অগ্নি নির্ব্বাপিত করিবার জন্য সেই বাড়ীতে প্রবেশ করিবে, তখনই তুমি তথা হইতে প্রস্থান করিয়া গোলদীঘিতে আসিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি তোমার সহিত যোগ দিব। বুঝিলে, তোমায় কি করিতে হইবে।

 ব। হাঁ, বেশ বুঝিয়াছি।

 আ। তবে তুমি কিছুকাল অপেক্ষা কর, আমি ছদ্মবেশ পরিয়া আসি।