ছিন্নমুকুল/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ

হরিণী-জালে

 সন্ন্যাসী নৈমিষারণ্যে গিয়াছেন। নীরজা মন্দির হইতে কিয়দ্দূরে পাথরবাঁধান বকুল-তলে বসিয়া, ৩০/৩২ বয়স্ক একটি কৃষ্ণবর্ণ স্থূলকায় স্ত্রীলোকের সহিত হিন্দুস্থানী ভাষায় গল্প করিতেছিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে অস্ফুট জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়া বকুল-তলাটি ঈষৎ উজ্জ্বল হইয়াছিল, মৃদু মৃদু বাতাস বহিতেছিল, সেই বাতাসে একটি একটি করিয়া বকুল খসিয়া বৃক্ষতল ছাইয়া ফেলিয়াছিল।

 নীরজা সেই ফুলরাশির মধ্য হইতে কতকগুলি ফুল হস্তে লইয়া খেলিতে খেলিতে তাহার গল্প শুনিতেছিল। স্ত্রীলোকটি তাহার ঘরকন্নার কথা, দুঃখধান্ধার কথা, তাহার পুত্রকন্যার কথা বলিতেছিল, নীরজা কৌতূহলের সহিত তাহা শুনিতে শুনিতে মাঝে মাঝে দুই একটি প্রশ্ন করিতেছিল। কাঠুরিয়া রমণীর নববিবাহিতা কন্যার কথা শুনিয়া নীরজা বলিল “বসু, আজ তাকে সঙ্গে আনলে না কেন?”

 বসুমতী বলিল “সে শ্বশুর বাড়ী গেছে, মা।” এই কথায় নীরজা, ভূমি হইতে এক অঞ্জলি বকুল কুড়াইয়া বসুর অঞ্চলে দিয়া বলিল “আহা, সে ব’লেছিল তার স্বামী এলেই আবার সে এই বকুল ফুল নিয়ে যাবে, তুমি এই গুলি তাকে পাঠিয়ে দিও।”

 “বসু বলিল “মা! আমরা দুঃখ করে খাই, কে আবার কাল তার শ্বশুর বাড়ী ঐ ফুল দিতে যায় বল?” কথা কহিতে কহিতে সহসা পেচকের বিকট চীৎকারে তাহারা চমকিয়া উঠিল, নীরজা ত্রস্তে, একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, বসু অমঙ্গলসূচক পেচকশব্দে ভীত হইয়া “দূর দূর”করিয়া উঠিয়া বলিল “গাটা যেন চমকে উঠলো, সন্ন্যাসীমশয় নেই, অমনিতেই কেমন ভয় হয়। ঠাকুরকে ডাক্‌ব নাকি।”

 নী। “হ্যা একটা পেঁচা ডাক্‌ছে তাই ঠাকুরকে ডাকতে হবে! আমিও প্রথমটা চমকে উঠেছিলুম বটে। যাক্, তুমি তোমার মেয়ের গল্প কর। যমুনা তার স্বামীকে খুব ভালবাসে না?”

 আবার এই সময় পূর্ব্বের ন্যায় পেচক ডাকিয়া উঠিল, সেই অমঙ্গল সূচক কর্কশ স্বরে নীরজাও কেমন শিহরিয়া উঠিল, গল্প ছাড়িয়া সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল। অস্ফুট চন্দ্রালোকে সে দেখিতে পাইল, চারিজন লোক তাহাদের নিকটেই আসিতেছে, “দেখিতে দেখিতে লোকেরা নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। নীরজা অরণ্যপালিত হইয়াও তাহাদের এই ভীমমূর্ত্তি, সেই কঠোর কটাক্ষ দেখিয়া কেমন ভীত হইয়া পড়িল, বসুও সভয়ে তাড়াতাড়ি উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল “তোমরা কে?” কিন্তু এই সময় চকিতের ন্যায় এক ব্যক্তি নীরজাকে শূন্যে তুলিয়া লইল এবং দুইজন বসুকে গিয়া ধরিল। তাহারা ইহাতে চমকিত হইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল। কিন্তু সে শব্দ মন্দির পর্য্যন্ত পৌঁছিবার পূর্ব্বেই বস্ত্রদ্বারা উভয়ের মুখ বন্ধ হইয়া গেল। নীরজা দস্যুক্রোড়ে হস্ত পদ ছুঁড়িয়া বলপ্রকাশ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সেই বলবান ব্যক্তির হস্তপেষিত হইয়া ক্রমে সে শক্তির অবসান হইল। নীরজাকে লইয়া একজন দস্যু পলাইল, আর তিন জন সেই বলপ্রকাশকারী কাঠুরিয়া স্ত্রীলোককে রজ্জুদ্বারা বৃক্ষে বন্ধনপূর্ব্বক দ্রুতগতিতে জঙ্গল ছাড়াইয়া তাহাদের সহিত মিলিয়া নদীতীরে উপস্থিত হইল। নদীতীরে একখানি নৌকায় উঠিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিল; নৌকা চলিতে আরম্ভ করিলে তাহারা বালিকার মুখের বন্ধন মোচন করিয়া দেখিল—বালিকা অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে। মুখে জলসিঞ্চন করিতে করিতে কিছুক্ষণ পরে নীরজার জ্ঞানোদয় হইল; নীরজা চারিদিকে চাহিয়া দেখিল—ব্যাকুল ভাবে চাহিয়া দেখিল—কোথায় সে পরিচিত বনভূমি—কোথায় বা সে মন্দির! দেখিল— তাহার পরিবর্ত্তে চারিদিকে ভীমদর্শন অপরিচিত মুর্ত্তিসমূহ তাহাদের তীব্র কঠোর দৃষ্টি মেলিয়া তাহাকে যেন গ্রাস করিতে উদ্যত! পূর্ব্বঘটনা নিমেষে স্মরণ হইল, বালিকা ঠাকুরজি—ঠাকুরজি করিয়া চাৎকার করিয়া উঠিল, অমনি একজন বলবান লোক হস্ত দ্বারা তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “চীৎকারে কোন ফল নাই, চীৎকার করলেই মুখ বেঁধে ফেলব, কিন্তু ভালয় ভালয় চললে কিছু বলব না।” আর একজন বলিল— “আমরা কি তোমাকে খেয়ে ফেলব না কি? ভাল মানুষের মত চল—আমরাও ভাল মানুষ—নইলে আমরা সায়েস্তা করতে জানি।” বালিকার হৃদ্‌স্পন্দন যেন নিরুদ্ধ হইয়া আসিল, আতঙ্কে সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। তাহাকে নীরব নিস্তব্ধ দেখিয়া দস্যু তাহার মুখ হইতে হস্ত সরাইয়া লইল। যখন পুনরায় বালিকা চক্ষু খুলিল তখন নিকটে কাহাকেও দেখিল না। বালিকাকে নিদ্রিত ভাবিয়া একজনকে মাত্র লোককে প্রহরীরূপে নৌকার প্রকোষ্ঠ-দ্বারে রাখিয়া অন্য সকলে দাঁড় টানিতে বসিয়াছিল। উক্ত প্রহরী খানিকক্ষণ বসিয়া বসিয়া সেইখানেই শুইয়া পড়িয়াছিল। নীরজা তাহাকে নিদ্রামগ্ন ভাবিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া বসিল, নৌকার গবাক্ষে মুখ সংলগ্ন করিয়া নদীর দিকে চাহিয়া রহিল। সেই ভয়ানক অবস্থায় কিরূপ প্রচণ্ড ঝটিকা তাহার মনে বহিয়া যাইতেছিল, তাহা বর্ণনাতীত। কি প্রকারে দস্যু-হস্ত হইতে মুক্ত হইতে পারে, ক্রমাগত তাহাই সে ভাবিতে লাগিল কিন্তু কোনও উপায়ই দেখিল না। বুঝিল তাহার আশা নাই, ভরসা নাই, এই দস্যুদের হস্তে একাকী সে অসহায়! তাহার ভাবিতেও আর শক্তি রহিল না। সে তখন সেই নৌকা-গবাক্ষ হইতে নদীতে ঝাঁপ দিবার সঙ্কল্প করিয়া ধীরে ধীরে তাহার উপর উঠিয়া বসিয়া পদদ্বয় নির্গত করিয়া দিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রহরী ঘুমায় নাই; সে তাহার অভিসন্ধি বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ উঠিয়া গবাক্ষের নিকট হইতে নীরজাকে টানিয়া আনিল। নীরজা দস্যুহস্ত স্পর্শে শিহরিয়া উঠিয়া ছিন্নলতিকার ন্যায় পুনরায় নৌকা মধ্যে লুটাইয়া পড়িল।