ছিন্নমুকুল/অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
অন্ধকারে তারকা
রাত্রি অবসান প্রায়, ঝটিকাও প্রায় নিবৃত্তি হইয়াছে, আকাশও তেমন অন্ধকার নাই।
সমস্ত নিশার পর্য্যটনে অবসন্ন হইয়া, গাছে, শাখায়, কণ্টকে দেহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দীনবেশে আলুলায়িত কুন্তলে উন্মাদিনী বালিকা গান গাহিতে গাহিতে গঙ্গাতীরস্থ একটি মুক্ত অট্টালিকাদ্বারে প্রবেশ করিল। ভিতরে ঢুকিয়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিল, সেইখানে হিরণকুমারকে দেখিয়া বালিকা অস্ফুট চীৎকার করিয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। হিরণকুমার বাহিরে বারান্দায় বসিয়াছিলেন! সমস্ত রাত্রি তিনিও চক্ষুর পাতা বোজেন নাই, যতক্ষণ ঝড় বৃষ্টি হইতেছিল বারাণ্ডায় বসিয়া সেই অন্ধকার ঝটিকাময় নিশার সহিত আপনার অদৃষ্টের তুলনা করিতেছিলেন। মধ্যরাত্রে কেবল একবার তাঁহার সে চিন্তা ভঙ্গ হইয়াছিল। রামধন কতকগুলি পুলিসের লোক সঙ্গে কয়েক জন দস্যুকে ধৃত করিয়া তাঁহার নিকট আসিয়াছিল। আবার তাহারা আসিতে পারে এই ভাবিয়া সদর দ্বার খোলা রাখিয়াই তিনি উপরে গিয়া চৌকিতে বসিয়াছেন মাত্র এই সময় সহসা কনককে এই অবস্থায় দেখিয়া তিনিও আশ্চর্য্য হইলেন। কনক মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল, তিনিও অজ্ঞানবৎ তখনি তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া পালঙ্গে আনিয়া শয়ন করাইলেন এবং তাহার শয্যার পার্শ্বে বসিয়া শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। ক্রমে কনকের মোহ ভাঙ্গিল, হিরণকে দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিল,
“তুমি কে? দেবতা? আমি যে তোমাকে ধ্যানে দেখেছি। আমি কি গান গাচ্ছিলুম, মনে করে দেও তো, আমি গাই।”
হিরণ দেখিলেন, কনক উন্মাদিনী। তাহার কথা শুনিয়া তাহার সেই মোহময় আলুথালু বেশ দেখিয়া হিরণের বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
বলিলেন, “কনক আমার, আমি যে তোমার হিরণকুমার, আমাকে চিনতে পারছ না?”
উন্মাদিনী বলিল, “হিরণকুমার! কৈ তোমার মুখ আমাকে ভাল করে দেখাও দেখি। কনক শয্যা হইতে উঠিয়া বসিল, হিরণকুমারের মুখের দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া তাহার হাত খানি স্বহস্তে লইয়া দেখিয়া দেখিয়া বলিল, “ঠিক বলেছ, তুমিই হিরণকুমার; হিরণ, একটি গান কর না। আমি গাব? তুমি শুনবে?” বালিকা গাহিল,
“আঁধার নিশীথে একা আমি অভাগিনী—
না, একি! তুমি দেবতা! কৈ আমার হিরণ কোথায় গেলেন? হিরণ—হিরণ—চিরবিচ্ছেদ—চিরবিচ্ছেদ—কি?”
বালিকা চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। শয্যা হইতে উঠিয়া হিরণের পদ গ্রহণ করিয়া বলিল,
“দেব, আমি তোমার পূজা করব, আমাকে বর দাও, আমার হিরণ কোথা?”
হিরণকুমার তাহাকে উঠাইয়া রোদন করিতে করিতে বলিলেন,
“কনক, আমি যে তোমার হিরণ, কনক আমার, তুমি উন্মাদিনী!”
কনক বলিল, “তুমি দেবতা, তুমিও কাঁদ, সকলেই কি কাঁদে, তবে আমিও কাঁদি।” বালিকা হিরণের কণ্ঠলগ্ন হইয়া কাঁদিতে লাগিল। হিরণ তাহাকে শোয়াইবার জন্য হাত ধরিয়া বিছানায় বসাইয়া বলিলেন, “কনক, শোও দেখি।”
নিদ্রায় শান্তি পাইয়া যদি কনকের জ্ঞান জন্মে, সেইজন্য তাহাকে ঘুম পাড়াইতে হিরণ ব্যস্ত হইলেন।
কনক বলিল, “তুমি বসে থাকবে, আমি শোব কেন? তুমি দেবতা, তুমি আগে শোও।”
হিরণ নিরুপায় হইয়া বলিলেন, “তুমি না শুলে দেবতা রাগ করবে, তোমার কি ভয় হচ্ছে না।”
“রাগ করবে? তবে আমি পালাই।” বলিয়া বালিকা আপনার আর্দ্র চুল লইয়া খেলিতে খেলিতে গুণ গুণ করিয়া গাহিয়া গাহিয়া, বিছানা হইতে উঠিল। হিরণ বিপদে পড়িয়া বলিলেন “না, না, রাগ করব না, তুমি শোও দেখি।” বালিকা তাঁহার কথা না শুনিয়া আপন মনে হাসিয়া উঠিয়া উল্লাসে করতালি দিয়া বলিল,
“মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, সেই সুর! তোমার সেতার কৈ? বাজাও আমি গাই,
ধরি সুর তানে মরমের গানে,
অবাধে, লো সই, গাহিব আজ;
প্রাণ যারে চায়, মিলিবে লো তায়
লোকের কথায় পড়িবে বাজ।
হিরণ সেতার বাজাইতে জানিতেন, তাঁহার সেই ঘরেই সেতার ছিল, তিনি বলিলেন, “তুমি যদি শোও, তাহলে আমি সেতার বাজাব।” হিরণকুমার তাঁহার সেতারটি আনিলেন। বালিকা সেতার শুনিতে বড় ভালবাসিত, সে তাহা শুনিবার আশায় বিছানায় আসিয়া শয়ন করিল, বাজনার মধুর তানে কনককে ঘুম পাড়াইবার জন্য হিরণ আস্তে আস্তে সেতার বাজাইতে লাগিলেন। বালিকা শুনিতে শুনিতে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল,
“কই, কই, তোমার সে হাসি কই, তুমি আজ হাসবে না? তুমি যে আমার হিরণকুমাব, একটিবার হাস না হিরণকুমার।”
উন্মাদিনীর কথায় হিরণকুমারের ওষ্ঠাধর ঈষৎ বিষাদময় হাসির রেখায় অঙ্কিত হইল, তাহা দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে বালিকার চক্ষু বুঞ্জিয়া আসিল, ক্রমে ক্রমে সেই পদ্মনেত্র নিমীলিত হইল, বালিকা ঘুমাইয়া পড়িল। তাহার সেই ঈযৎ ভিন্ন ওষ্ঠাধরে মৃদু হাসির রেখা শোভিত হইয়াই রহিল।
হিরণকুমার তাহাকে নিদ্রিত দেখিয়া সেতার রাখিয়া তাহার সুষুপ্তমুখকান্তি দেখিতে লাগিলেন। পাছে নিদ্রা ভঙ্গ হয় সেই ভয়ে হিরণকুমার প্রতিক্ষণে ব্যাকুল হইতে লাগিলেন। প্রত্যেক বায়ুর শব্দে হিরণের মনে হইতে লাগিল, বালিকা উঠিয়া পড়িবে। তিনি ভয়ে ভয়ে যাহাতে তাহার ঘুম না ভাঙ্গে তাহা দেখিতে লাগিলেন। এই সময় সহসা মনুষ্য পদশব্দ হইল, হিরণ সৌৎসুক্যে সেই দিকে কাণ পাতিলেন। পদশব্দ আরো সুস্পষ্ট হইল, বুঝিলেন গৃহমধ্যে এখনই কেহ প্রবেশ করিবে। তিনি তাহা নিবারণ করিতে অতি ধীরে ধীরে পা টিপিয়া টিপিয়া গৃহ হইতে উঠিয়া গেলেন।