ছিন্নমুকুল/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

দেবমন্দিরে রাক্ষস

 নীরজাকে সন্ন্যাসীর নিকট আনিয়া দিয়া যামিনী অন্য গৃহে গিয়া বসিলেন। হিরণের কথাবার্ত্তা শুনিয়া অবধি রাগে তাঁহার শরীর কাঁপিতেছিল। প্রমোদের সহিত নীরজার বিবাহ! আপনি নীরজাকে না পাইলেও বরঞ্চ সহ্য করিতে পারেন, কিন্তু নীরজা প্রমোদের হইবে ইহা তাঁহার অসহনীয়। যামিনী ইহার প্রতিকারের উপায় ভাবতে ভাবিতে অন্য গৃহে আসিয়া বসিলেন। সকলরূপ বাধা অবহেলা করিয়া তিনি নীরজাকে এতদিন বিবাহ করেন নাই বলিয়া এখন অনুতাপ করিতে লাগিলেন।

 এইস্থলে অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, নীরজাকে বিবাহ করিতে যামিনী যদি এতই উৎসুক তবে এতদিন তাহাদের বিবাহ না হইবার কারণ কি? কালবিলম্বে ব্যাঘাত ঘটিতে পারে বিবেচনায়, নীরজাকে আপন অধীনে পাইয়াও যামিনী কেন বিবাহ করিলেন না? যামিনীর মতন লোকের বল-পূর্ব্বক বিবাহে কি আপত্তি হইতে পাবে?

 ইহার উত্তর, যামিনীর এ বিবাহে বিলক্ষণ বাধা পড়িয়াছিল। যামিনী যখন প্রথমে বিবাহের অভিপ্রায়ে নীরজাকে বাড়ী আনেন, তখন তিনি ভাবেন নাই যে তাঁহার ইচ্ছার উপর জ্যেঠাইমা কোন কথা কহিবেন। আর প্রথমে যদিই বা ইহাতে আপত্তি প্রকাশ করেন, যামিনী বুঝাইয়া বলিলেও যে তাঁহার সে আপত্তি দূর হইবে না, ইহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই। কিন্তু বাড়ী আনিয়া বিবাহের অভিপ্রায় প্রকাশ করিবামাত্র জ্যেঠাইমা খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন। নীরজা অজ্ঞাতকুলশীলা, তাহার সহিত কখনও ভদ্র ঘরের ছেলের বিবাহ হইতে পারে! যামিনী বিশেষরূপ জেদ করাতে অবশেষে ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া বসিলেন, তাঁহার যে পাঁচ লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ আছে এ বিবাহ হইলে যামিনীকে কিছুই না দিয়া, যামিনীর ভগিনীকে তাহা দিয়া যাইবেন। এই কথায় যামিনী মুস্কিলে পড়িলেন। একদিকে ধন লোভ, অন্য দিকে নীরজার লোভ,—অবশেষে ধনলোভই জয়ী হইল। অতটা টাকায় মায়া তিনি সহজে ছাড়িতে পারিলেন না। কিন্তু নীরজার আশা যে ইহাতে তিনি একেবারেই ছাড়িলেন, তাহাও নহে—আপাততঃ বৃদ্ধা যত দিন বাঁচিয়া থাকেন ততদিন মাত্র বিবাহ বন্ধ রাখিতে স্থির করিলেন। বৃদ্ধা পীড়িতা বড় জোর আর এক বৎসর বাঁচিতে পারেন—এই অল্প দিনের জন্য অগত্যা নীরজাকে পাইবার লোভ সম্বরণ করিয়া থাকিতে বাধ্য হইলেন।

 আর এক কথা, নীরজাও এখন বিবাহে সম্মত নহে। জোর করিয়া বিবাহ করিতে গেলে যে কেবলমাত্র তাঁহার ধনক্ষতি হয় তাহা নহে, নীরজার ভালবাসা, নীরজার ভক্তিশ্রদ্ধাও তাহা হইলে হারাইতে হয়। যামিনী ভিতরে যাহাই হউন না কেন, বাহিরে লোকের নিকট সাধু সচ্চরিত্র বলিয়া পরিচিত হইবার আকাঙ্ক্ষা রাখিতেন। তিনি অত্যন্ত প্রশংসা-প্রিয় ছিলেন, নিন্দা সহ্য করিতে পারিতেন না। এমন কি, প্রশংসার জন্য তিনি লাভের অংশও কিছু পরিমাণে ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। নীরজা তাঁহাকে ভাললোক জানিয়া অতিশয় ভক্তি করিত, এখন বলপূর্ব্বক বিবাহ করিলে ধনক্ষতিও হইবে সঙ্গে সঙ্গে নীরজার ভক্তিও হারাইবেন। একেবারে এতটা ক্ষতি স্বীকার করিতে যামিনীনাথ প্রস্তুত ছিলেন না। ভাবিলেন আর কিছু দিনে যদি সকল দিকে সুবিধা হয়,—যদি ধনলাভও হয় এবং বালিকা আপনা হইতেই বিবাহ করে—তো অল্প দিন ধৈর্য্য ধরাই ভাল।

 কিন্তু বিবাহ স্থগিত রাখিয়াছেন বলিয়া এখন তাঁহার অনুতাপ হইতে লাগিল। কেন না ভাগ্য সহসা তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্ন। অনেক দিন ধরিয়া আর তাঁহাকে জ্যেঠাইমার মৃত্যুকামনাজনিত পাপ সঞ্চয় করিতে হইল না। সম্প্রতি তিনি কালাশৌচ হইতে মুক্তিলাভ করিয়া সমস্ত বাধার অবসানে যখন নীরজাকে বিবাহ করিবেন এই আশায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হইয়া উঠিয়াছেন তখনই সে আশায় তাঁহাকে নিরাশ হইতে হইল। আশাহত ঈর্ষাদগ্ধ ‘মরিয়া’র মত তিনি এই গৃহে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে একজন দ্বারবানকে ডাকিতে লাগিলেন। দ্বারবান আসিয়া যামিনীর আজ্ঞা শুনিয়া চলিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরে অন্য একজন লোক গৃহ-মধ্যে প্রবেশ করিল। যামিনীনাথ অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহার সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, কথা সমাপ্তে সে ব্যক্তি বলিল—

 “কসুর মাপ করবেন, এ কাজ এ অধীন হতে হবে না!” যামিনীনাথের বঙ্কিম নাসাগ্রভাগ রক্তিম বর্ণ হইল, কুটিল ভ্রূযুগল কুঞ্চিত করিয়া তিনি বলিলেন—“তোমার যেমন অভিরুচি। কিন্তু লাভ লোক্‌সানটা ভাব্‌ছ কি?”

 সে বলিল “এতদিন ধরে, লাভ লোকসান ভেবে কাজ করলাম, কিন্তু হিসাব কিতেব ত তার কিছুই বুঝলাম না, এখন ভগবানের হাতে সে ভার, তিনি যা করেন।” তাহাকে অটল দেখিয়া যামিনী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন—“আচ্ছা ভগবানই তবে তোমাকে রক্ষা করুন।” ইহার পর আর কোন উত্তর না দিয়া সে ব্যক্তি চলিয়া গেল, তখন যামিনী তাঁহার অন্য একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কি কথা কহিতে লাগিলেন। সেও যখন চলিয়া গেল তখন তিনি আপনমনে একাকী বসিয়া চিন্তা-নিমগ্ন হইলেন। পূর্ব্বদিকে দুই একটি তারা ফুটিল, গৃহ হইতে পূর্ব্বাকাশের এক প্রান্ত দেখা যাইতেছিল, যামিনী সেই দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন। এই সময় সন্ন্যাসী যামিনীর সহিত বিদায় লইতে আসিলেন। সন্ন্যাসী বলিলেন “যামিনীনাথ আমি ত নীরজাকে নিয়ে চল্লেম, নীরজার কথা বিশ্বাস করতে হ’লে তুমিই তার মুক্তিদাতা। ভগবান জানেন তুমি দোষী কি নির্দ্দোষ কিন্তু—”

 যা। মহাশয়, আমার একটি মিনতি শুনুন, আমি যে নীরজাকে উদ্ধার করেছি তা আপনি ভুলে যান, নীরজাকেও সে কথা ভুলতে শেখান, কিন্তু—

 বলিতে বলিতে সন্ন্যাসীর চরণ ধরিয়া বলিলেন, “কিন্তু বিনা অপরাধে আমাকে অপরাধী মনে করবেন না।”

 স। কি কর, যামিনীনাথ ওঠ ওঠ।

 যা। মহাশয়, কূট তর্কে যদি সকল সপ্রমাণ হ’ত, তা হ’লে দেখুন দেখি যার পর নাই ঈশ্বরের স্বরূপ পর্য্যন্ত নিয়ে এত গোল হবে কেন? পাষণ্ড চার্ব্বাকেরা কি না বলছে? আপনিও তো শাস্ত্রজ্ঞ বিজ্ঞ পুরুষ, আপনাকে আর অধিক কি বলব!

 স। না, আমি তোমাকে অপরাধী বলে মনে করতে পারছিনে। নীরজাকে তোমার এক তারের মধ্যে পেয়েও তাকে নিজের ভগিনীর মত যেরূপ সম্মানসহকারে রক্ষা করেছ সেজন্য আমি বরঞ্চ তোমার নিকট কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি—কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তোমাকেই কন্যা দান করব।

 এই সময় নীরজাকে অন্তঃপুর হইতে গৃহাগত হইতে দেখিয়া তাঁহারা নিস্তব্ধ হইয়া পড়িলেন। নীরজা তাহার হাতের কাকাতুয়াটী দেখাইয়া বলিল “বাবা আমি আমার কাকাতুয়াটিকেও নিয়ে এসেছি।” সন্ন্যাসী বলিলেন “চল তাহ’লে এইবার যাওয়া যাক; ষ্টেশনে যেতেও ত অনেকটা সময় লাগবে।” যামিনীর ঘরের গাড়ী প্রস্তুত ছিল, তাহারা তিন জনে গাড়ীতে আসিয়া উঠিলেন। যাইবার সময় যামিনী গোপনে দ্বারবানকে বলিয়া গেলেন “পাঠানকে শীঘ্র ফিরিয়ে আন, যে কাজে তাকে পাঠিয়েছি তার আর দরকার নেই, শীঘ্র যাও।” আদেশ দিয়া যামিনী তাহাদিগকে রেল গাড়ীতে তুলিয়া দিতে গেলেন। বাড়ী ফিরিয়া আসিবা মাত্র দ্বারবান খবর দিল “পাঠানকে খুঁজে পাওয়া গেল না।”