ছিন্নমুকুল/একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

বিজয়া

 নিদ্রার মত মনের ব্যাধির মহৌষধ আর কিছুই নাই। কিছুক্ষণ ঘোর নিদ্রামগ্ন থাকিয়া কনক যখন জাগিল, তখন যেন তাহার ভ্রংশ-বুদ্ধি অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছে। কিন্তু সহসা প্রমোদকে সেইরূপ আদরের ভাবে কথা কহিতে দেখিয়া সম্মুখে হিরণকুমারকে ম্লান বিষণ্নভাবে দাঁড়াইতে দেখিয়া, সে যেন কিছুই বুঝিতে পারিল না, তাহার মুখে কেবল আনন্দ বিভাসিত হইল। তাহাকে জাগরিত দেখিয়া প্রমোদ আহ্লাদে বলিলেন, “কনক, আমি তোর কাছে কত অপরাধে অপরাধী, কনক, দিদিটি আমার, আমি সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব; হিরণ যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোর বিবাহ দেব।”

 তখন সমস্ত ঘটনা কনকের মনে পড়িয়া গেল, ভ্রাতার নিষ্ঠুরতা, হিরণের নিষ্ঠুরতা পর্য্যন্ত মনে পড়িল। কতদিন পরে তাহার ভাই তাহাকে আদর করিয়া ডাকিলেন, আবার হিরণকুমার তাহার শয্যার পাশেই দাঁড়াইয়া, কনকের আহ্লাদ যেন সহ্য হইল না, কনক আবার অন্ধকার দেখিল, মস্তক আবার ঘুরিয়া আসিল, হৃদয়ে রক্তের প্রবাহ ভীষণ বেগে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, কনক বলিল, “দাদা, এরূপ আদরের কথা আমি যে তোমার মুখে কখনো শুনি নি? আমার ভাগ্যে যে এমন সুখ কখনো হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি—”

 কনকের উপাধান অশ্রুসিক্ত হইয়া প্রমোদের হাত ভিজিতে লাগিল। কনক সুখময়-বিষাদে অর্দ্ধ নিমীলিত-চক্ষে হিরণকুমারের দিকে চাহিল, চাহিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল,

 “হিরণকুমার, এ জনমে আর হৃদয়ের সাধ পূরল না—কিন্তু প্রার্থনার যদি ফল থাকে, বিশুদ্ধ-প্রেমের যদি পুরস্কার থাকে, তা হ'লে মরণে আমার দুঃখ নেই, তা হলে পরলোকে আমাদের মিলন হবেই।” অতি কষ্টে এ কথাগুলি কহিয়াই কনক থামিল। কনকের কথার মর্ম্ম যেন হিরণকুমার কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, যাতনাব্যঞ্জক শূন্যদৃষ্টিতে কেবল তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বহিলেন মাত্র। প্রমোদ, আর অশ্রুজল সম্বরণ করিতে পারিলেন না।

 কনক আবার কথা কহিবার ইচ্ছায় মুখ খুলিল, অতি ধীরে ধীরে অতি কষ্টে বলিল—“হিরণকুমার, কোথায় তুমি? একটিবার শেষবার—ভাল করে”

 এইটুকু বলিয়াই কনক আবার ঢুলিয়া পড়িল আর কথা কহিল না।

 প্রমোদ বলিলেন— “দিদি আমার অমন করছ কেন?” কনকের যন্ত্রণা বুঝিতে পারিয়া প্রমোদ কাঁদিয়া উঠিলেন। হিরণকুমার পাগলের মত প্রমোদকে বলিলেন “চুপ কর কনকের ঘুম আসছ, তুমি ঘুম ভাঙ্গিও না।”

 হিরণ কাছে বসিয়া শিশুর ন্যায় আস্তে আস্তে তাহাকে ঘুম পাড়াইতে লাগিলেন! কনক আর একবার চক্ষু খুলিয়া হিরণকে দেখিল, তাহার ওষ্ঠাধর মৃদু হাস্যে সুশোভিত হইল, মুখখানি একটি অপূর্ব্ব সুখের ভাবে পরিপ্লুত হইল, কনকের আবার চক্ষু মুদ্রিত হইয়া আসিল, ভ্রাতার হস্তে মস্তক রাখিয়া কনক অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া পড়িল, না ফুটিতেই মুকুল ঝরিয়া পড়িল, দীপ জ্বলিয়াই নির্ব্বাণ হইল। প্রমোদ বুঝিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন, হিরণকুমার আবার বালকের মত বলিলেন—

 “চুপ চুপ, কনকের ঘুম ভেঙ্গে যাবে।”

 হিরণের ইচ্ছাই পূর্ণ হইল, কনকের ঘুম আর কখনই ভাঙ্গিল না, অনন্ত নিদ্রায় সে চিরশান্তি লাভ করিল।