ছিন্নমুকুল/একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

প্রস্তাব

 কনক জীবিত শুনিয়া যামিনীনাথ তাহার পরিণয়াকাঙ্ক্ষী হইলেন। তাহার মত স্বামী পাওয়া কনকের ত পরম সৌভাগ্য, এই ভাবিয়া প্রমোদ অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলেন, এবং কলিকাতায় গিয়া সমস্ত স্থির করিয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। এখন কেবল কনকের মত লইয়া দিন স্থির মাত্র বাকী রহিল। প্রমোদ নব্য তন্ত্রাবলম্বী, তিনি বাল্যবিবাহের বিরোধী, স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষপাতী সুতরাং বিবাহ সম্বন্ধেও স্ত্রাপুরুষের স্বাভিমত বিবাহ ইহার মনোনীত। অবশ্য তাঁহার ইচ্ছা জানিলে কনক যে প্রসন্ন হৃদয়ে ইহাতে সম্মত হইবে, এবিষয়ে প্রমোদের বিন্দুমাত্র সংশয় উপস্থিত হয় নাই।

 বাড়ী আসিয়া সেরাত্রিতে কনককে তাঁহার কিছু বলা হইল না, পরদিন প্রাতঃকালে বাহির বাটীতে তাঁহার বসিবার কক্ষে তিনি কনককে ডাকিয়া পাঠাইলেন। কনক যখন সেই কক্ষে প্রবেশ করিল তখন প্রমোদ একটী টেবিলের উপরে হস্তে মস্তক রক্ষা করিয়া চিন্তামগ্ন ছিলেন, কি ভাবিতেছিলেন জানি না, কিন্তু চক্ষু সমধিক চঞ্চল ও সমুজ্জ্বল, প্রফুল্ল মুর্ত্তি সমধিক ঔৎসুক্যপূর্ণ প্রফুল্লতাব্যঞ্জক, তিনি যে কোন সুখ-স্বপ্ন দেখিতেছিলেন তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। কনক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—

 “দাদা আমাকে ডেকেছ?” প্রমোদ হাসিয়া বলিলেন—“হুঁ। বোস্, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।”

 কনক টেবিলের নিকট চৌকিতে বসিয়া আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিল “কি কথা?”

 প্র। একটা বড় সুখের কথা। আচ্ছা আন্দাজ কর দেখি।

 কনক অনেক ভাবিয়া বলিল “না পারছি নে, তুমি ভাই বল।”

 প্র। বল্লে কি পুরস্কার দিবি?

 ক। যা চাও তাই দেব, তুমিতো আগে বল।

 কনকের কৌতূহল দেখিয়া প্রমোদ অনেকক্ষণ এ কথা ও কথা কহিয়া তাহাকে অনেক জ্বালাইয়া অবশেষে বলিলেন—“একটী বেশ ভাল বরের সঙ্গে তোর সম্বন্ধ করেছি, শীঘ্র বিয়ে হবে, কেমন সুখবর কিনা।” শুনিয়া কনক চমকিত হইল, তাহার শোণিত বেগে বহিতে লাগিল, মুখ ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিল। কনকের ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া প্রমোদ ভাবিলেন “উহা লজ্জার চিহ্ন।” প্রমোদ একটু একটু করিয়া বরের নামধাম রূপগুণ বর্ণনা করিয়া চলিলেন। বরটি কেমন দেখিতে, কেমন লেখাপড়া জানে, কেমন সৎস্বভাব, প্রমোদের কেমন হৃদয় বন্ধু, এই সকল পরিচয় দিয়া বলিলেন “কেমন?—শুনে কেমন মনে হ’ল? বেশ বর নয়? আরো ভাল করে জানতে চাস? যামিনী বাবু।”

 কনক যামিনীনাথকে এলাহাবাদে ইতিপূর্ব্বেই দেখিয়াছে।

 যতক্ষণ সহর্ষে প্রমোদ তাঁহার কল্পিত ভাবী ভগিনীপতি যামিনী বাবুর পরিচয় দিতেছিলেন, কনক ততক্ষণ কাতরচিত্তে ভাবিতেছিল—“বিবাহ! ইহা সুসংবাদ! কি সর্ব্বনাশ কনক অন্যের পত্নী হইতে চলিল! হিরণকে আর কখনও দেখিতে পাইবে না! হিরণের চিন্তা পর্য্যন্ত পাপ, উঃ! কি ভয়ানক!” বালিকার সমস্ত শোণিত চমকিয়া উঠিল। সমস্ত হৃদয় ভাবনায় আলোড়িত হইয়া পড়িল। বালিকা কখনও ভ্রাতার কথায় কথা কহে নাই, প্রমোদ যাহা বলেন তাহাই দেববাক্য-সদৃশ তাহার শিরোধার্য্য, কিন্তু আজ তাঁহার কথায় সে কথা না কহিয়া থাকিতে পারিল না, যন্ত্রণাকম্পিত স্বরে বলিল, “দাদা, আমি বিয়ে করব না।”

 প্রমোদ শুনিয়া আশ্চর্য্য হইলেন না, ভাবিলেন বিবাহের কথায় প্রথমে তো স্ত্রীলোকেরা ‘না’ বলিয়াই থাকে, তাহাকে লজ্জা হয় বৈকি?

 তিনি হাসিয়া বলিলেন, “কনক, তার আর লজ্জা কি? আজ হ'ক কাল হ’ক বিয়ে তো হবেই, তবে আর লজ্জা করে কি হ’বে?”

 কনক আবার বিষাদ-ব্যঞ্জক গম্ভীর-স্বরে বলিল, “দাদা, আমি বিয়ে করব না।”

 প্রমোদ দেখিলেন সে লজ্জার স্বর নহে, সে স্বরে কিছুমাত্র বেসুর নাই, তাহা সুস্পষ্ট, গম্ভীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা-ব্যঞ্জক। প্রমোদ বুঝিলেন, কনক যথার্থই তাহার মনের কথা বলিতেছে। প্রমোদ আশ্চর্য্য হইলেন, অথচ তাহার বিবাহের অনিচ্ছার বিশেষ কোন কারণ না পাইয়া ভাবিলেন, বিবাহ হইলে প্রমোদকে ছাড়িয়া শ্বশুরবাড়ী যাইতে হইবে, এই ভয়ে বুঝি কনকের বিবাহে আপত্তি। প্রমোদ বলিলেন “বিয়ে হ'লেই সব ছেড়ে শ্বশুর বাড়ী যেতে হবে বোলে বুঝি তোর যত ভয়? সে ভয় নেই, তোর যত দিন ইচ্ছা এখানে থাকিস্, শেষে তোকে থাকবার জন্য সাধাসাধি করতে না হলেই বাঁচি।”

 কনক মৃদু স্বরে বলিল “না, দাদা, আমার এখন বিয়ে কেন?”

 প্রমোদ হাসিয়া বলিলেন, “চিরকাল আইবড় থাকবি না কি? অত লজ্জায় কাজ নেই। এখন বল্‌ দেখি বিয়ের আগে তাকে এখানে ডাকব কিনা?” কনক তবুও আবার “বিয়ে কেন?” বলায় তাঁহার বিস্ময় ক্রমশঃ ক্রোধে পরিণত হইতে লাগিল। কনক কথনও তাঁহার মতে অমত প্রকাশ করে নাই; কখনও একটি সামান্য বিষয়েও কনকের নিকট হইতে তাঁহার প্রতিবাদ সহ্য করিতে হয় নাই; বাল্যকাল হইতে তাঁহার ইচ্ছাতেই কনকের ইচ্ছা গঠিত হইয়াছে, তাঁহার মতেই কনক মত দিয়া আসিতেছে। কনকের এই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অধীনতায় তিনি এতদূর অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে ইহাই তাঁহার ন্যায্য প্রাপ্য বলিয়া বোধ হইত। আজ বিনা কারণে তাঁহার ইচ্ছার বিপরীতে, বিবাহের বিরুদ্ধে কনকের ঐরূপ জেদ দেখিয়া প্রমোদ ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া পড়িতে লাগিলেন। তথাপি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া খানিক ক্ষণ ধরিয়া অনুনয় বিনয় যুক্তি উপদেশ দ্বারা তাহাকে স্বমতে আনিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোন প্রকারে কৃতকার্য্য, হইতে না পারিয়া অবশেষে অপ্রকৃতিস্থ হইয়া পড়িয়া রোষগম্ভীর-স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কেন? বিয়ে করবি নে কেন?

 ‘ইচ্ছা নাই’ এই উত্তর ছাড়া অন্য উত্তর বালিকা কি দিবে? সে আর কোন উত্তরই খুঁজিয়া পাইল না।

 প্রমোদ আবার বলিলেন, “কেন বিবাহ করবি নে আমাকে বুঝিয়ে দে, তোর আপত্তি কিসে?”

 বালিকাকে নিরুত্তর দেখিয়া উত্তরোত্তর অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বারবার করিয়া ঐ এক কথাই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। প্রমোদ স্বভাবতঃ উদ্ধত এবং চিত্তদমনে অপটু, মনের বেগ অনুসারেই কার্য্য করিতে অভ্যস্ত, ভগিনীকে এই প্রকার নিরুত্তর দেখিয়া সরোষে টেবিলে আঘাত করিয়া আবার বলিলেন,—

 “কেন বিবাহ করবে না বল।”

 বালিকা ভীত কম্পিত হইয়া পড়িল, তাহার মস্তক ঘুরিতে লাগিল, কি উত্তর দেওয়া উচিত, কি অনুচিত, তাহা ভাবিবার ক্ষমতাও রহিল না। হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে সেই একই উত্তর ধ্বনিত হইয়া উঠিল— “আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা নেই।”

 “তোমার ইচ্ছা! বাঙ্গালীর মেয়েদের আবার বিবাহে ইচ্ছা অনিচ্ছা কি? তোর ইচ্ছার উপর বিবাহের কি নির্ভর করছে? আমার ইচ্ছাই কি যথেষ্ট নয়?”

 বালিকা আর উত্তর দিতে পারিল না। যে উত্তর দিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতেই যেন অপ্রতিভ হইয়া পড়িল, শুষ্ক ওষ্ঠাধর ঘন ঘন কাঁপিতে লাগিল—বিশাল চক্ষুর শূন্যদৃষ্টি শূন্যেই সংলগ্ন হইল। তখন প্রমোদ ক্রোধকম্পিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন,

 “আমার ইচ্ছাই যথেষ্ট, আমি যে তোর ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করেছিলেম সে অনুগ্রহ মাত্র। তোর ইচ্ছা শুনতে চাই না, আমার ইচ্ছাতেই তোর বিবাহ করতে হবে।”

 তখন বালিকা যেন কোন দৈব শক্তিতে উত্তেজিত হইয়া, যেন নিরাশার অপ্রতিহত তেজে উত্তেজিত হইয়া বলিল,

 “দাদা অনিচ্ছায় বিবাহ করতে নেই, একি তোমার কাছেই শিক্ষা পাই নি! তুমি আজ নিজের কথার ব্যতিক্রম করবে?”

 প্রমোদ এই কথায় সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া বলিলেন, “হাঁ আমার সেই নির্বুদ্ধিতার ফল আজ পেলেম বটে। আচ্ছা তোর বিবাহ করতে ইচ্ছা নেই, আমারও আর তোকে খাওয়াতে পরাতে ইচ্ছা নেই। তোর যা ইচ্ছা তাই কর। আমি তোর মুখ দেখতে চাই নে, দূর হয়ে যা।”

 এই খাওয়া পরার কথাগুলি বালিকার হৃদয়ে বড়ই লাগিল, কথাগুলি হৃদয়ের স্তরে স্তরে বিদ্ধ হইল। সামান্য অন্নবস্ত্রের কথা লইয়া প্রমোদ তাহাকে আজ মর্ম্ম-পীড়িত করিতে পারিলেন! বালিকা আর মনোবেগ সামলাইতে পারিল না। কষ্টে দুঃখে তাহার মস্তক আপনিই নত হইয়া পড়িল। যন্ত্রণার অনলাশ্রুতে নয়ন ভাসিতে লাগিল। তাহা দেখিয়া প্রমোদ নরম হইয়া পড়িলেন—তাঁহার মায়া হইল। প্রথম রাগের মাথায় অন্ন বস্ত্রের কথা বলিয়াই পরক্ষণেই পশ্চাত্তাপ করিতে লাগিলেন। তিনি চৌকী হইতে উঠিয়া কয়েকবার গৃহে পদশ্চারণ পূর্ব্বক কনকের কাছে আসিয়া বলিলেন,

 “কনক, আর কাঁদিস নে। আপাততঃ এখনি আর তোর বিবাহের কথা তুলব না—যা ঘরে যা।”

 কনক আস্তে আস্তে সেখান হইতে উঠিয়া গেল। প্রমোদ রাগে দুঃখে অনুতাপে মুহ্যমান হইয়া খানিকক্ষণ সেই খানেই বসিয়া রহিলেন। তাহার পর নীরজার কাছে আসিয়া মনের জ্বালা নিবারণ করিলেন।

 প্রমোদ বাহিয়ে গেলে নীরজা আবার অনেকক্ষণ ধরিয়া বিবাহের পক্ষে কনককে বুঝাইতে বসিল, শেষে নিষ্ফল হইয়া সেও বিরক্তভাবে বলিল—

 “তুই ভাই, বড় একরোকা মেয়ে; সাধে কি উনি বকেছেন? সে তোর আপন দোষের শাস্তি। নে, বাবু, যা ইচ্ছা কর; তিনি যখন পারেন নি তখন কি আমি তোকে পারব? আমার চেষ্টা করাই বৃথা।”

 বালিকা নীরজা আজ প্রৌঢ়ার ন্যায় রোষভরে তাহাকে বকিল। প্রেমান্ধ নীরজা স্বামীর দোষ কিছুই দেখিতে পায় না। নীরজা জানে তাহার স্বামী যাহা করেন বা বলেন তাহা কখনই অন্যায় হইতে পারে না, অতএব কনক প্রমোদের কথায় অসম্মত হওয়াতে নীরজার কাছেও সে দোষী হইল।

 একটু পরে নীরজা বলিল, “কনক, আমি আসল কথা জানি, তুই হিরণকে চাস্।—না? কিন্তু এ কথা জানলে তোর দাদা তোর উপর আরো বিরক্ত হবেন তা’ জানিস? আমি এই ভয়ে তাঁর কাছে এ কথা এখনো বলি নি। যে লোক তোর দাদার পরম শত্রু, কনক তাকে তুই কি ক'রে ভাল বাসলি! এই কি তোর অসীম ভ্রাতৃস্নেহ? কনক, এখনো বল্ যামিনীনাথকে বিবাহ করবি, আমি এখনি তোর দাদাকে বলে আসি।

 কনক বলিল, “হিরণ কখনই দাদার শত্রু নন, কেমন করে তাঁর এ ভুল বিশ্বাস জন্মাল?” শুনিয়া আবার নীরজা ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “সকল জেনে শুনে তবুও বল্‌বি তোর দাদার ভুল বিশ্বাস! তোর কাছে আজ কাল তোর দাদারি যত দোষ, আর তোকে কিছু বলতে আসবনা, আমি চললেম, তোর যা ইচ্ছা কর।”

 যে নীরজা কনককে এত ভাল বাসিত সেও আজ স্বামীর অসন্তুষ্টিবশত কনকের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া চলিয়া গেল। কনক একাকিনী অন্ধকার গৃহে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল। ভৃত্য গৃহে দীপ জ্বালাইতে আসিয়া খবর দিল প্রমোদ ডাকিতেছেন।