ছিন্নমুকুল/একবিংশ পরিচ্ছেদ

একবিংশ পরিচ্ছেদ

বিভীষিকা

 সুশীলার পীড়ার অগ্রে যে একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা আমরা এই পরিচ্ছেদে বলিতেছি। কনকের শাস্তির ১২ দিন এখনও ফুরায় নাই। রাত্রি অন্ধকার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়িতেছে এবং মাঝে মাঝে মেঘের গর্জ্জন পৃথিবীকে কাঁপাইয়া তুলিতেছে। এই সময় দীপশূন্য একটি অন্ধকার কক্ষে, বালিকা কনক একাকী শুইয়াছিল। সহসা বজ্রের কড়মড় শব্দে কনক চমকিয়া উঠিল। অন্ধকারে ভীত হইয়া উঠিয়া বসিল, আলোক পাইবার নিমিত্ত বিছানা হইতে হাত বাড়াইয়া কক্ষের একটি বাতায়ন খুলিয়া দিল। অমনি সহসা সুমধুর সঙ্গীত ধ্বনি তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল, শুনিল—

রিমঝিম ঘন বরিষে—সখিলো,
বিরহী নয়ন পারা, ঢালিছে শ্রাবণ ধারা,
কি জ্বলে মরমে জ্বালা, নিভাই কেমনে সে,
গুরু গুরু গর্জ্জনে গর্জ্জে নবীন ঘন,
দলকে দামিনী বিকাশে।”

 এই সময় আর একবার বজ্রের কড়মড় শব্দ হইল, গান থামিয়া গেল, অমনই সুশীলা এই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। ঝড় বৃষ্টির প্রারম্ভে কনক একাকী আছে বলিয়া তাঁহার কষ্ট হইতেছিল। কিন্তু তিনি মনকে এই বলিয়া প্রবোধ দিয়াছিলেন যে কনকের দোষেই তো তাহাকে এইরূপ একাকী থাকিতে হইতেছে—তিনি কি করবেন? পরে, যখন একবার বজ্রধ্বনিতে বাড়ী কাঁপিয়া উঠিল, সুশীলার চক্ষু ঝলসিত করিয়া কনকের কক্ষের সম্মুখস্থ একটী বৃক্ষ বজ্রাগ্নিতে জ্বলিয়া উঠিল, তখন সুশীলার মনের পাষাণ বাঁধ অকস্মাৎ আমূল টুটিয়া পড়িল। সুশীলার ভয় হইল, কনকের কক্ষে তাহা হয়তো পড়িয়াছে। তিনি ব্যাকুল ভাবে সেই গৃহের দিকে ছুটিলেন, মনে হইল তিনি কনকের হত্যাকারী, তাঁহার নিমিত্তই বজ্রাঘাতে কনকের মৃত্যু হইল। বারাণ্ডা দিয়া আসিতে আসিতে আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিতে পাইলেন, যেন সেই বজ্র বৃষ্টি বিদ্যুতের মধ্যে কনকের মাতা দাঁড়াইয়া বলিতেছেন “তুমিই আজ কনককে মারিয়া ফেলিলে, তোমার কঠোরতাতেই তাহার জীবন বিনষ্ট হইল।” সুশীলা তখন সে দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া “কনক, কনক” করিয়া ছুটিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, কনক শয্যায় উপবিষ্ট। তাহাকে জীবিত দেখিয়া তিনি যেন পুনরায় জীবন প্রাপ্ত হইলেন, সকল দোষ ভুলিয়া গিয়া সহর্ষে বালিকার মুখচুম্বন করিলেন। এই সময় আবার গীতধ্বন উথলিয়া তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল—

“বুঝি গো সে এলনা”—

 গানটী শুনিবার জন্য সুশীল কাণ পাতিলেন, কিন্তু গান এইখানেই থামিয়া গেল। কে গান গাহিতেছে দেখিবার জন্য তিনি বাতায়নে দাঁড়াইলেন, কিছুই দেখিতে পাইলেন না, কেবল সম্মুখস্থ জাহ্নবী-নদীর তরঙ্গ উচ্ছাস সে অন্ধকারের মধ্যেও তাঁহার চক্ষে প্রতিভাত হইল। তীরে মনুষ্যের চিহ্নও দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু মনে হইল প্রাচীরের নিকট হইতে গীত-ধ্বনি উঠিতেছিল। থাকিয়া থাকিয়া আবার কে গাহিয়া উঠিল—

“চির দিন চির নিশি, জাগরণে গেছে মিশি
তাহারি বিরহ মাঝে ধরিয়া আশার কণা”!

 গান শুনিয়া সুশীলর মাথা ঘুরিয়া আসিল, তাঁহার কত কথাই মনে পড়িতে লাগিল, সেই বালিকাজীবন, বাল্যের সুখ দুঃখ সমস্তই মনে উদয় হইল। সুশীলা আশ্চর্য্য হইয়া নিস্পন্দে আবার সেই গানটির শেষ পর্য্যন্ত শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিলেন। কেহই আর গাহিল না,—কিন্তু সেই প্রাচীরের অভিমুখে একজন লোককে তিনি আসিতে দেখিলেন। ক্রমে সে নিকটে আগমন করিল। এই সময় বিদ্যুতালোকে সেই ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিতে পাইল, সুশীলাও তাহাকে দেখিতে পাইলেন, তাঁহাদের পরস্পর নয়নে নয়নে সংলগ্ন হইল, অমনি সুশীলা মূর্চ্ছিত হইয়া বাত্যাহত বৃক্ষের ন্যায় ভূমিশায়িত হইলেন।