ছিন্নমুকুল/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

এই সে

 এ দিকে নালিশে বিচারের দিন উপস্থিত হইল। প্রমোদ যামিনীনাথের সহিত আলিপুরের বিচাবালয়ে যাত্রা করিলেন। আলিপুরে একজন ডিপুটী মাজিষ্ট্রেটের নিকট বিচার হইবে। বিচার আরম্ভ হইল, আসামী ফরিয়াদী সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। উভয় পক্ষের উকীল ও সাক্ষীরা যাহা বলিবার বলিতে লাগিল।

 কিন্তু প্রমোদ এখন স্থিরচক্ষু, চিন্তামগ্ন, প্রমোদের কানে সে সকল কথা কিছুই প্রবেশ করিতেছিল না, প্রমোদ বদ্ধদৃষ্টি হইয়া বিচারকের দিকেই চাহিয়াছিলেন, যেন বিচারককে তিনি আগে কোথায় দেখিয়াছেন, যেন সে মুখ তাঁহার পরিচিত অথচ তাঁহাকে চিনিতে পারিতেছেন না। তিনি তখন, পার্শ্বস্থ যামিনীনাথকে বিচারকের নাম জিজ্ঞাসা করিয়া শুনিলেন তাঁহার নাম হিরণকুমার। সহসা বাল্যকালের সেই অপমান-জনক ঘটনা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল—তিনি বিচারককে চিনিতে পারিলেন, চিনিলেন—ছেলেবেলায় যে হিরণকুমার তাঁহাকে কঁদাইয়াছিল—এ সেই হিরণকুমার। প্রমোদ জীবনে আর কখনও ততদূর অপমানিত বোধ করেন নাই; সেই জন্য ছেলেবেলার সেই ঘটনাটী তাঁহার শিরায় শিরায় বিঁধিয়া ছিল। তবে সেই কথা মনে রাখিয়া যে প্রমোদ হিরণের প্রতি চিরশত্রুতা পণ করিয়াছিলেন তাহা নহে, তিনি বাস্তবিক সেরূপ নীচ প্রকৃতির লোক নহেন, কিন্তু প্রমোদ সেই পর্য্যন্ত হিরণকে আর কেমন দেখিতে পারিতেন না। এক একজনকে দেখিবামাত্রেই কেমন অকারণে বিদ্বেষ জন্মে প্রমোদেরও হিবণের সম্পর্কে সেইরূপ হইয়াছিল। বিচারপতিকে চিনিতে পারিয়াই প্রমোদ যেন কিছু দমিয়া গেলেন, তাঁহার আর তেমন স্ফূর্ত্তির ভাব রহিল না। কে জানে কেন তাঁহার মনে হইল তিনি নিশ্চয় মকদ্দমায় হারিবেন, তাঁহার কোন দোষ প্রমাণ না হইলেও হিরণকুমার তাঁহাকে শাস্তি দিবেন।

 বাস্তবিক, বিচারে যামিনীর সহিত প্রমোদেরও দোষ সপ্রমাণ হইল। হিরণকুমার যামিনীর একশত এবং প্রমোদের ৫০ টাকা জরিমানার আদেশ করিলেন। প্রমোদ অবশ্য মনেই করেন নাই যে তাঁহার দোষ সাব্যস্ত হইবে। আর নিতান্তই যদি হয়, তাহা হইলেও যে এই সামান্য দোষে ১০।২০ টাকার অধিক অর্থদণ্ড হইবে তাহা তাঁহার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, সুতরাং তিনি ২০ টাকার একখানি নোট ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে আনেন নাই। উকীল খরচে তাহার অধিকাংশই ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। এখন একেবারে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হইবে শুনিয়া তিনি যেমন বিপদে পড়লেন তেমনি ক্রুদ্ধও হইলেন। তিনি ভাবলেন হিরণকুমার তাঁহাকে চিনিয়াই এইরূপ অবিচার করিলেন। কিন্তু বাস্তবিক হিরণ তাঁহাকে চিনিতেও পারেন নাই। যখন হিরণ তাঁহাকে দেখিয়াছিলেন তখন প্রমোদ দশমবর্ষীয় বালক মাত্র, এখন যৌবনাবস্থায় তাঁহার চেহারা কত পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। যাহা হউক, তখনই তো দণ্ডের টাকা দিতে হইবে, অগত্যা তাহা যামিনীর নিকট তাঁহার ধার করিতে হইল। কিন্তু তাহাতে প্রমোদ অত্যন্ত অপমান বোধ করিলেন এবং হিরণের প্রতি তাঁহার বদ্ধমূল ঘৃণা জন্মিল। ক্রুদ্ধ ও অপমানিত চিত্তে মনে মনে হিরণকুমারের শ্রাদ্ধ করিতে করিতে তিনি যামিনীর সহিত তাঁহার বাটী গমন করিলেন; সেখানে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত মুক্তকণ্ঠে বিচারকের অবিচারের প্রতি বাক্যবাণ বর্ষণ করিয়া যেন কথঞ্চিৎ শান্তি লাভ করিলেন।