ছিন্নমুকুল/চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

পাপের ফল

 কিছুক্ষণ পরে রামধন কুটিরে প্রত্যাগমন করিল; তাহার মুখচক্ষু ক্রোধ-পরিতৃপ্তি-জনিত হর্ষ-বিকম্পিত। সে আসিয়া প্রমোদকে বলিল, “মহাশয় খুনীদের মধ্যে যে প্রধান সেই ধরা পড়েছে। তিনি কে শুনবেন?—তিনি আপনার বন্ধু যামিনী বাবু, আমার আগেকার মনীব।”

 শুনিয়া প্রমোদ ও নীরজা অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন, সন্ন্যাসী একটু শান্তি পাইয়া তখন অল্প ঘুমাইতেছিলেন, তিনি একথা শুনিতে পাইলেন না। প্রমোদের কিন্তু ও কথায় বিশ্বাস হইল না, তথাপি তিনি আশ্চর্য্যভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যামিনী বাবু এ ঘটনার মধ্যে কি করে আসবেন? তিনি তো কলকাতায়!”

 সে বলিল, “মশাই, সবটা শুনুন তো; আমি পুলিসে খবর দিলেই অমনি জন কতক পুলিসের লোক এসে হিরণবাবুর বাড়ীর দুই পাশে লুকিয়ে রইল, আমিও তাদের সঙ্গে রইলাম।”

 প্রমোদ বলিলেন, “একটা কথা আগে জিজ্ঞাসা করি হিরণকুমারটা কে?

 রাম। তিনি আলিপুরের ডিপুটিম্যাজিষ্টর, অল্পদিন হ'ল এখানে এসেছেন।

 প্রমোদও সেই সন্দেহ করিয়া এ প্রশ্ন করিয়াছিলেন। সে আবার বলিল,

 “আমরা লুকিয়ে আছি, কিছু পরে চারজন লোক আস্তে আস্তে বাড়ীর কাছে এসে দাঁড়াল, আর একজন একটু তফাতে রইল, তখনি আমরা সেই পাঁচজনকেই ধরে ফেল্লাম, তার ভিতর দেখি—যামিনী বাবু একজন।”

 প্রমোদ আশ্চর্য্যভাবে বলিলেন, “তিনি তবে সেই সময় আর কোন কারণবশতঃ হিরণের নিকট যাচ্ছিলেন, এক সঙ্গে ধরা পড়ে ঐ দলে মিশে গেছেন।

 প্রমোদের অবিশ্বাস বাক্যে সে ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “তাই বটে। রড় সাধু পুরুষ! কিন্তু তিনিই আপনাকে খুন করতে লোক পাঠিয়েছিলেন। আর আমি আপনাকে মারতে রাজি হইনি তাই আমার এই দশা করেছেন, তাঁর ভয়েই তো আমার দেশ, পরিবার ছেড়ে এখানে পালিয়ে আসতে হয়েছে।”

 তখন রামধন নীরজার অপহরণের কথা, প্রমোদকে হত্যা করিতে লোক প্রেরণের কথা, যাহা যাহা হিরণকুমারকে ইতিপূর্ব্বে সে বলিয়াছিল সমস্তই বলিল। বলিতে বলিতে আবার তাহার মুখচক্ষু দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। শুনিয়া নীরজার হৃদয় যেন স্তম্ভিত হইয়া আসিল, প্রমোদ বিস্মিত অথচ অপ্রত্যয় ভাবে বলিলেন, “তা কি ক'রে হবে, আমি যে স্বচক্ষে অন্য একজন ভদ্রলোককে পিস্তলহাতে ছুটে পালাতে দেখেছি।”

 রামধন বলিল, “বুঝেছি, আপনি কাকে দেখেছেন? হিরণবাবুর কথা বলছেন বুঝি?”

 প্রমোদ সবিস্ময়ে বলিলেন, “তুমি কি করে জানলে?”

 রামধন হিরণের বাড়ী গিয়া যাহা দেখিয়াছিল ও শুনিয়াছিল তখন সেই সকল বলিল।

 প্রমোদ বলিলেন,”হিরণ তো ওরূপ বলতেই পারে, তার কথায় বিশ্বাস?”

 রামধন রাগিয়া বলিল, “না ভদ্রলোকের কথায় বিশ্বাস নেই, খুনীর কথাই সত্যি। হিরণবাবু শুধু কি বলেছেন? আমাদের হরের কাছেই সব শুনেছি”।

 মনের ঝোঁকে হরির নামটা আর সে ঢাকিয়া রাখিতে পারিল না। এবং একবার তাহার নামটা প্রকাশ করিবার পর তখন অসঙ্কোচে ভাল করিয়া আগাগোড়া সব কথা খুলিয়া বলিল।

 শুনিয়া প্রমোদ স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন, তথাপি কেন সম্পূর্ণরূপে যামিনীকে দোষী ভাবিতে না পারিয়া, পরে এই বিষয়ের সম্পূর্ণ অনুসন্ধান করিবেন স্থির করিলেন। এই সময় একজন বৃদ্ধা এই কুটিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। বৃদ্ধা সেই ভূতোর মাসী। কিছু দূরে পরপারে দেবদর্শনে গিয়াছিল, পথে ঝড় বৃষ্টি পাইয়া ভিজিতে ভিজিতে গৃহে ফিরিল। এখানে অনেক লোকজন দেখিয়া প্রথমে বিস্মিত হইল, কিন্তু ইহারা ঝড় বৃষ্টিতে এই কুটিরে আশ্রয় লইয়াছেন শুনিয়া তখন আশ্বস্তভাবে আস্তে আস্তে অগ্নির নিকট বসিয়া হস্তপদ সেঁকিতে সেঁকিতে অর্দ্ধেক আপনমনে অর্দ্ধেক প্রকাশ্যে বলিল,

 “তা বাপু বেশ—এই ঝড় বৃষ্টি—এ সময়ে কি পথ চলা যায় বাপু! তোমরা এসেছ বেশ করেছ—বাবা, কি এক্ রোখা মেয়ে গা?”

 নীরজা ভাবিল, বৃদ্ধা তাহাকে ভাবিয়াই বলিতেছে, ঈষৎ ক্রুদ্ধ, এবং অপ্রস্তুত ভাবে সে বলিল,”কেন, বাপু, আমি কি করেছি, আমাকে কিসে এক রোখা দেখলে?

 বৃদ্ধা। তুমি কেন গো? আজ এই দুর্য্যোগের সময় নৌকা থেকে কত কষ্টে বেঁচে যখন নদীব ধার দিয়ে বাড়ী আসছি, তখন দেখি একটি কাদের মেয়ে—ৎ আহা! এমন সুন্দর মেয়ে, কেউ কখনো দেখেনি— একেবারে যেন উন্মত্ত হয়ে ছুটে ছুটে বেড়াচ্চে। আহা! একরাশি চুল সব এলোথেলো, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে সব সোটা সোটা হয়ে পড়েছে, তা দিয়ে আবার ঝর ঝর জল ঝরছে।

 প্রমোদ ও নীরজা দুজনেই একত্রে বলিয়া উঠিলেন, “আহা! কাদের মেয়ে গা?”

 বৃদ্ধা। ওগো, কাদের মেয়ে জানিনা, কেবল গান গায়। আমি শোধালাম, ‘তুমি কাকে খুঁজছ গা?” তা সে বল্লে,

“হিরণ হিরণ সোণার বরণ,
যাঁরি হাতে বাঁচন মরণ।”

 এই কথায় প্রমোদ অত্যন্ত ব্যাকুল ভাবে বলিলেন, “এ তো আমাদের কনক নয়? তার বয়স কত গো?”

 বৃদ্ধা। এই বাপু পনর ষোল হবে।

 এই কথা শুনিয়া অত্যন্ত ব্যাকুলতার সহিত প্রমোদ নীরজাকে বলিলেন, “তুমি এইখানে থাকো। আমার নিশ্চয়ই মনে হচ্চে এ কনক, আমি একবার দেখে আসি।”

 নীরজা বলিল, “কনক যদি এতক্ষণে আরবারের মত জলেই বা পড়ে গিয়ে থাকে?”

 বৃদ্ধা। ওগো সে মেয়েটি জলে পড়েনি গো, আমি তাকে বল্লুম “আমার সঙ্গে আসবে,” তা সে অমনি গান গাইতে গাইতে ঐ কোটা বাড়ীর ভিতর ঢুকলো, তারপর কি হয়েছে জানিনা। বৃদ্ধা প্রমোদের সহিত কুটিরের বাহিরে আসিয়া সেই বাড়ীর দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিল। তখন বিদ্যুতের মত প্রমোদ সেইদিকে ছুটিলেন! অল্পক্ষণের মধ্যেই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে দ্বিতলে উঠিলেন। হিরণ ইহারই পদশব্দ শুনিয়া কক্ষের বাহির হইয়াছিলেন। হিরণকে দেখিবামাত্র প্রমোদ উন্মত্তের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কনক কোথায়?” কথার গোলে পাছে কনকের নিদ্রা ভঙ্গ হয়, এই ভয়ে হিরণকুমার তাহাকে ধীরে ধীরে বলিলেন, “এই ঘরে, কিন্তু চুপ! চুপ! কনক ঘুমোচ্ছেন, গোল ক’রনা ঘুম ভেঙ্গে যাবে, ও ঘরে যেওনা।” প্রমোদ সে কথা অগ্রাহ্য করিয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন। হিরণকুমার ব্যাকুল-ভাবে তাহার অনুসরণ করিলেন। কনকের শয্যাপার্শ্বে গিয়া প্রমোদ মনের ব্যগ্রতা ভরে ডাকিলেন,

 “দিদি আমার, কনক!” হিরণ তাহা শুনিয়া মৃদুস্বরে ব্যাকুল ভাবে বলিলেন, “চুপ! চুপ! কথা কয়োনা, গোল কোরোনা, এখনি কনকের ঘুম ভেঙ্গে যাবে।” প্রমোদ সে কথা না শুনিয়া কনকের গলদেশ বেষ্টন করিয়া আগ্রহ সহকারে আবার ডাকিলেন, “দিদি আমার, কনক, ওঠ ওঠ আমার সঙ্গে একটিবার কথা কও।”

 কনক জাগিয়া উঠিল।