ছিন্নমুকুল/ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়ােবিংশ পরিচ্ছেদ

দেব কি মানব

 এদিকে যামিনীনাথ দুই এক দিনের জন্য এলাহাবাদে আসিয়াই কনকের রূপলাবণ্যে মোহিত হইলেন। তাঁহার হৃদয়ে আর নীরজা স্থান পাইল না। সচরাচর এরূপ লঘু হৃদয় লােকের যেরূপ হইয়া থাকে এস্থলেও তাহার অন্যথা হইল না। নীরজাকে ছাড়িয়া তাঁহার এখন কনকের দিকে চক্ষু পড়িল। নীরজা বনফুল, যেখানে অন্য ফুল মেলে না, সেইখানে নীরজার আদর। নীরজা অরণ্যে একাকী ফুটিয়া তাহা শোভিত করে, কিন্তু কনক গােলাপ, সকল স্থানে সকল সময় তাহার সমান আদর। রাশি রাশি বিকশিত পুষ্পসমাকুল কাননের মধ্যেও গােলাপ পরম আরাধ্যা, গোলাপ ফুলরাণী। গোলাপটি দেখিয়া তিনি যে বনফুল নীরজাকে ভুলিবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? বিশেষত যত দিন নীরজাকে পাইবাব আশা ছিল না, তত দিন তাঁহার সে লালসা অত্যন্ত প্রবল ছিল, কিন্তু তাহাকে পাইবেন জানিয়া তাঁহার নিকট নীরজার মর্য্যাদা অনেক কমিয়া আসিয়াছিল। এখন তাঁহার নয়নে নীরজা মর্ত্ত্যজাত কুসুম, কনক স্বর্গের পারিজাত; সুতরাং যামিনী কনকের রূপে মুগ্ধ হইলেন।

 নীরজাতে আর এখন তাঁহার মন নাই, এখন আর বিবাহের নিমিত্ত কানপুর যাইতে তিনি ব্যস্ত নহেন। দু’দিনের জন্য এখানে আসিয়া পাঁচ ছয় দিন হইয়া গেল, তবু যামিনী কানপুর যাইবার নামও করেন না। যামিনীর এখন একমাত্র চিন্তা কি উপায়ে তিনি কনককে লাভ করিবেন। যামিনী মনে মনে জানিতেন প্রমোদ নীরজার প্রতি অনুরক্ত; ভাবিলেন যদি তিনি নীরজার সহিত প্রমােদের বিবাহ দিতে পারেন, তো প্রমোদ অনায়াসে তাঁহাকে ভগিনী সমর্পণ করিবেন। তিনি ভাবিয়া চিন্তিয়া একদিন কথায় কথায় প্রমোদকে বলিলেন—“প্রমোদ দু’দিনের জন্য এসে চার পাঁচ দিন কেটে গেল, শীঘ্র যেতে হবে, কিন্তু—” যামিনী এইখানে সহসা থামিলেন। প্রমোদ বলিলেন, “হ্যাঁ চার পাঁচ দিন ত কাটলো আমার ইচ্ছা আরো কিছু দিন কাটে; কিন্তু সে অনুরোধ করি আর কোন সাহসে?”

 যা। সাহসের অভাব আমারি। কদিন থেকে মনে করছি তোমাকে একটি কথা বলি, কিন্তু কেজানে কিছুতেই কেমন পেরে উঠছিনে।”

 প্রমোদ হাসিয়া বলিলেন—“আজকে তাহলে পারতেই হবে, কি কথাটা বল দেখি?”

 যামিনী না হাসিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তুমি অবশ্য জান নীরজার সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্যই সন্ন্যাসী আমাকে কানপুরে ডেকেছেন, কিন্তু তাকে আমার বিবাহ করতে একেবারে ইচ্ছা নেই, তাই সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে না। কি ক’রে এই অপ্রিয় সত্য কথাটা তাকে বলব —বড়ই মুস্কিলে পড়েছি। ভাই এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আগে একটা কথা কইতে চাই। ভেবেছিলাম সেখানেই প্রথমে সে প্রস্তাবটা করে— তবে তোমাকে বলব—” কিন্তু তাহাকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই প্রমোদ বলিয়া উঠিলেন, “নীরজাকে বিয়ে করতে তোমার ইচ্ছা নেই?”

 যা। না।

 এই উত্তরে বিস্ময়ে প্রমোদের যেন বাকরুদ্ধ হইয়া গেল। নিস্তব্ধভাবে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে যামিনীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। যামিনী কোমলস্বরে আবার বলিলেন, “তাকে বিবাহ করতে আমার ইচ্ছা নেই, সত্যই আশ্চর্য্যের কথা, কিন্তু এরও কারণ আছে—।”

 “এরও কারণ আছে! তাকে না ভালবেসে কি কেউ থাকতে পারে!”

 যা। তা ঠিক; তুমি ভেবো না যে তাকে আমি ভালবাসি নে কিন্তু আমি তার অযোগ্য; আমি তাকে বিবাহ করব না।

 প্র। তুমি নীরজার অযোগ্য! কি বল তুমি যামিনী! তাহলে তার যোগ্য যে কে তা তো জানি নে।

 যা। তুমি যাই বল ভাই, আমি বাস্তবিকই তার অযোগ্য, নীরজা আমাকে ভালবাসে না।

 এই কথায় প্রমোদ তাহার বিবাহের অনিচ্ছার কারণ বুঝিলেন, তাহার সেই বিষাদার্দ্র স্বরে তাহার হৃদয়ের গভীর যাতনাও অনুভব করিতে পারিলেন। বুঝিয়া মর্ম্মপীড়িত হইয়া তিনি নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। যামিনী কিছু পরে আবার বলিলেন, “প্রমোদ, তোমাকে বলব? নীরজা কার প্রতি অনুরক্ত শুনবে? নীরজা তোমাকেই ভালবাসে।”

 বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু এই কথা শুনিয়া বন্ধুর গভীর দুঃখের মধ্যেও প্রমোদের হৃদয় সহসা যেন আহ্লাদে কম্পিত হইয়া উঠিল। কিন্তু আপনাকেই যামিনীর কষ্টের কারণ ভাবিয়া তখনি আবার সে আহ্লাদ থামিয়া আসিল। যামিনী বলিলেন—

 “আমি কি কিছু বুঝি না, ভাই? তুমিও যে মনে মনে নীরজাকে ভালবাস তা আমি বুঝেছি। এখানে এসে সেটা বেশ ভাল ক’রেই বুঝেছি। বুঝে কি প্রতিজ্ঞা করেছি শোন—আমি তোমাদের পথের কণ্টক হব না। আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে তোমাদের বিবাহ দিয়ে দেব, এই আমার সংকল্প।

 যামিনীর নিঃস্বার্থ ভাবে প্রমোদ স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। যামিনী দেব কি মানব, তাহা তিনি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। অবশেষে বলিলেন “যামিনী তুমি মানুষ নও দেবতা; তোমার বন্ধুতা স্বর্গীয়। বাস্তবিকই আমি যে দিন থেকে নীরজাকে দেখেছি, সেই দিন থেকে তাকে ভালবাসি। সে ছবি এখন পর্য্যন্তও হৃদয় হতে মুছতে পারি নি। কিন্তু যা বলি বিশ্বাস করো; তাকে আমি যতই ভালবাসি নে কেন, নীরজাকে না পেলে যতই কষ্ট হােক না কেন, তােমাকে বঞ্চিত করে তাকে পেতে আমি কখনই ইচ্ছা করব না—সে লাভে আমি কখনই সুখী হব না।”

 যামিনী বলিলেন, “শােন আমি যা বলি? তুমি বিবাহ না করলেও আমি তাকে বিবাহ করব না! নীরজা আমাকে ভাল বাসে না জেনে আমি কি করে তা করব? বরং তােমার সঙ্গে বিবাহ হলে নীরজা সুখী হবে জেনে আমি সুখী হতে পারব।”

 প্রমােদ যামিনীর কথা বুঝিলেন,—বুঝিলেন যামিনীর মত অবস্থায় পড়িলে তিনিও ঠিক ঐরূপ করিতেন। আপন ইচ্ছানুসারে মন সহজেই বােঝে। যামিনীর কথা তাঁহার যুক্তিপূর্ণ বলিয়া বােধ হইল। তথাপি যামিনীকে সে সংকল্প ত্যাগ করাইবার নিমিত্ত তিনি অনেক বুঝাইলেন, কিন্তু যামিনী অটল ভাবে বলিলেন—“তুমি আমাকে তাহলে এখনও ভাল করে চেনো নি দেখছি। অতটা নীচ আমাকে মনে কোর না ভাই। আমি যেকালে এ বিবাহের প্রস্তাব নিজেই করছি, তুমি নিশ্চয় জেনো যে, এতে আমার একটুও অসুখ হবে না। যদি অসম্মত হও, তা হলেই বরঞ্চ কষ্ট হবে।”

 প্রমােদ নিস্তব্ধে আপন মনেই ভাবিতে লাগিলেন, নানা ভাবনায় তাঁহার মন তরঙ্গিত হইতে লাগিল, তিনি যামিনীর কথার কোন উত্তর করিলেন না। যামিনী মৌনই সম্মতির লক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন”আজই আমি তবে কানপুরে যাই, নিজে সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা কয়ে তােমার বিবাহ ঠিক করে আসি,—কি বল?”

 অনেক কথাবার্ত্তার পর যামিনী সেইদিনই কানপুর যাত্রা করিলেন। প্রমোদ সমস্ত দিন বিষাদময়-আহ্লাদে অভিভূত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। নীরজা তাঁহার হইবে এই তাঁহার আহ্লাদ; যাহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই, যাহা আশার অতীত সেই বিষয়ে আশার সঞ্চারেই তাঁহার আহলাদ। আবার বিষাদ এই, তাঁহার পরম বন্ধু যামিনীকে তাঁহার জন্য নিরাশ হইতে হইল।

 প্রমােদ ভাবিলেন, যামিনীর মত নিঃস্বার্থ লােক দ্বিতীয় আর সংসারে নাই।