ছিন্নমুকুল/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

অবিশ্বাস

 বিজন উদ্যানের অনতিদূরে একটি বাড়ী, সেই বাড়ীর একটি কক্ষে একাকী বসিয়া প্রমোদ অধ্যয়নে নিযুক্ত ছিলেন। প্রমোদ যে চৌকিতে বসিয়াছিলেন, তাহারি সম্মুখে একটি টেবিল, টেবিলের মধ্যভাগে একটি বাতি জ্বলিতেছিল এবং তাহার আশপাশ পুস্তক রাশিতে পূর্ণ হইয়া ছিল। কিন্তু এ কি জ্বালা? বই লইয়া পড়িতে বসিলেই মনে এত প্রকার ভাবনা আসিয়া পড়ে যে, চমকিয়া ক্ষণকাল পরে দেখিতে হয় খোলা পাতাটি তেমনিই খোলা আছে, তাহার একটুও পড়িয়া উঠিতে পারেন নাই। এদিকে নিকটেই তাঁহার বি-এ পরীক্ষা; পড়িতে না মন লাগিলেই বা চলিবে কেন? পড়া হৌক্‌ না হৌক্‌, সম্মুখে বই না রাখিলেও আবার মন বোঝে না। অনেকক্ষণ হইতে একখানি বিজ্ঞান পুস্তক লইয়া মাথা ঘোরাইতে চেষ্টা করিতেছিলেন, কিন্তু অবশেষে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া তিনি বই খানি মুড়িয়া দূরে ফেলিলেন। হাতের কাছেই একখানি কোলরিজ পড়িয়া ছিল, ভাবিতে ভাবিতে সেইখানি খুলিলেন, প্রথমেই যে কবিতাটিতে তাঁহার চক্ষু পড়িল তাহা যেন তাঁহার মনের প্রতিধ্বনি বলিয়া বোধ হইল, কথাগুলি তাঁহার হৃদয়ে যেন মিশিয়া গেল, তিনি পড়িলেন “Oft in my waking dreams do I live o'er again that happy hour;” তাঁহার আর পড়া হইল না— একজন ভৃত্য আসিয়া তাঁহার পড়ায় বাধা দিয়া বলিল “একজন সন্ন্যাসী এসেছেন, তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।” সন্ন্যাসীর নাম শুনিয়া প্রমোদ চমকিত হইলন, তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ উপরে আনিতে ভৃত্যকে আদেশ করিলেন, ভৃত্য বলিল “তিনি আসবেন না, বস্‌বেন না, পথে দাঁড়িয়ে আছেন, পথেই আপনার সঙ্গে কি কথা ক’য়ে চলে যাবেন। প্রমোদ কিছু আশ্চর্যা হইয়া বলিলেন “তবে চল।” এই বলিয়া ভৃত্যের সহিত প্রমোদ সন্ন্যাসীর নিকট আসিলেন। সন্ন্যাসীকে দেখিয়া চিনিতে পারিলেন এবং আহ্লাদের সহিত প্রণাম করিয়া বলিলেন, “যদি অনুগ্রহ কবে আমাকে মনেই করলেন, তবে একবার ভিতরে এসে বসুন।”

 সন্ন্যাসী মৃহুগম্ভীর স্বরে বলিলেন, “না আমার সঙ্গে একটু বিরলে এস, বিশেষ প্রয়োজন আছে।” বলিয়া সন্ন্যাসী অগ্রে অগ্রে গমন করিলেন, প্রমোদ তাঁহার অনুসরণ করিয়া বিজন উদ্যানের এক নিভৃত প্রান্তে গিয়া দাঁড়াইলেন।

 তখন রাত্রির প্রথম প্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, আকাশের ক্ষীণ চন্দ্র ক্ষীণালোকে এতক্ষণ পর্য্যন্ত পৃথিবীকে অল্প পরিমাণে উজ্জ্বল করিতেছিল, ক্রমে তাহাও আকাশের কোলে ডুবিয়া গিয়াছে। রজনী অন্ধকার, কিন্তু অসংখ্য খ্যাতমালা এই অন্ধকারে, বাগানের গাছপাতার মধ্যে নিবিয়া নিবিয়া জ্বলিতেছে, এবং সহরের দীপমালা শ্রেণীবদ্ধ তারকারাজির মত দূরে শোভা পাইতেছে। এই নিস্তব্ধ বিজনে আসিয়া, নিশার গভীর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া সন্ন্যাসী মেঘনির্ঘোষবৎ গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “প্রমোদ, তোমার এ কি আচরণ?”

 সন্ন্যাসীর স্বরে সন্ন্যাসীর কথায় প্রমোদ আশ্চর্য্যভাবে বলিলেন—

 "আমার কি আচরণ?”

 সন্ন্যাসী অধিকতর গম্ভীর স্বরে অধিকতর ক্রুদ্ধস্বরে বলিলেন—

 "পাষণ্ড! নরাধম! আমার নীরজা কোথায়?”

 “নীরজা কোথায়!” সে কি কথা! তখন বজ্র পড়িলেও প্রমোদ অধিকতর স্তম্ভিত হইতেন না। সন্ন্যাসী অধীরচিত্তে গর্জ্জন করিয়া আবার বলিলেন “আমার নীরজা কোথায়?” প্রমোদ তখন ধীরে ধীরে বিকম্পিতস্বরে প্রতিধ্বনির মত বলিলেন “নীরজা কোথায়!” সন্ন্যাসী আর সহিতে পারিলেন না, এই কথায় তাঁহার আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল, বিশাল নয়নে যেন বিজুলি ঝলসিত হইতে লাগিল, সরোষে প্রমোদের কণ্ঠদেশ দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া কহিলেন—


 “পামর! তুই কি কিছুই জানিসনে? বিশ্বাসঘাতক, আমার নীরজাকে হরণ ক’রে কোথায় রেখেছিস দে, নইলে তোর নিস্তার নেই।” প্রমোদ কষ্টে সন্ন্যাসীর হাত ছাড়াইয়া বলিলেন “মহাশয়, আপনি কি বলছেন? বাস্তবিক কি নীরজাকে তবে কেহ হরণ করেছে? নীরজা— নীরজা অপহৃত?” প্রমোদের আর বাক্য সরিল না, নীরজা অপহৃত হইয়াছে এই কথাটি তাঁহার মনে এতই লাগিল যে, প্রমোদ আর আপনাকে আপনি সামলাইতে পারিলেন না, চারিদিক অন্ধকার দেখিতে দেখিতে নত মস্তকে একটি বৃক্ষ শাখা ধরিয়া দাঁড়াইলেন। সন্ন্যাসীর সন্দেহ ইহাতে আরও বদ্ধমূল হইল; ভাবিলেন—দোষ প্রকাশ পাইয়াছে এই ভয়ে সহসা প্রমোদের মস্তক বিকম্পিত। আগে হইতেই সন্ন্যাসী মনে মনে প্রমোদকে দোষী ভাবিতেছিলেন। মনে মনে তাঁহার বিরুদ্ধে তিনি রাশি রাশি প্রমাণ পাইয়াছিলেন। প্রথমতঃ সেদিন কথাবার্ত্তায় নীরজার প্রতি প্রমোদকে অনুরক্ত বোধ হইয়াছিল; দ্বিতীয়তঃ প্রমোদের প্রতি নীরজারও অনুরাগ লক্ষ্য করিয়াছিলেন, এমন কি, প্রমোদ চলিয়া যাইবার পরেও নীরজা তাঁহার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রমোদেরই কথা কহিয়াছিল। তারপর সন্ন্যাসীর নৈমিষারণ্যে যাইবার কথা প্রমোদ বই কেহই জানিতেন না, প্রমোদই জানিয়াছিলেন সে সময়ে নীরজা একরূপ অরক্ষিতাবস্থায় থাকে। এই সব যুক্তিপরম্পরা দ্বারা সন্ন্যাসী প্রমোদকেই দোষী সাব্যস্ত করিয়াছিলেন। এখন আবার প্রমোদকে এতদূর অপ্রকৃতিস্থ হইতে দেখিয়া তিনি নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে, উগ্রগম্ভীর দৃঢ়ভাবে বলিলেন “নীরজাকে কোথায় রেখেছ? ভালয় ভালয় আমার হাতে সমর্পণ কর, আমি সমস্ত দোষ ক্ষমা করব, নইলে—”

 প্রমোদ উত্তেজিতস্বরে বলিয়া উঠিলেন “আপনি বিশ্বাস করবেন না কিন্তু নীরজা-হরণ শুনে আপনার কি আমার কার বেশী লেগেছে জানি না।” এই কথা, এই ভণ্ডামী, সন্ন্যাসীর অসহ্য হইল, তিনি বলিলেন, “আর কেন, যথেষ্ট হয়েছে, এখন নীরজা কোথায়?”

 “মহাশয় বাস্তবিক নীরজা কোথায় আমি জানি না। আমি নিরপরাধ। আপনি ত জানেন যে আপনাদের অরণ্যে শেষ যে দিন যাই, তার পরদিনই আমার এলাহাবাদ যাবার কথা ছিল, আমি পরদিনই কানপুর ছাড়ি, আপনার অরণ্যের সংবাদ সেই থেকে আমি কিছুই জানি না।”

 “অরণ্যের সংবাদ না জান্‌তে পার, কিন্তু নীরজা কোথায়?”

 প্রমোদ দেখিলেন, সন্ন্যাসীর সেই অটল সন্দেহ ভঞ্জন করা সহজ নহে। তিনি আপন নির্দ্দোষিতার পক্ষে যতদূর বলিতে পারেন তাহার কিছু ত্রুটি করিলেন না, কিন্তু সন্ন্যাসী সেই অস্বীকার বাক্যে নির্দ্দোষিতার প্রমাণ না পাইয়া বরঞ্চ তাঁহার ঘোর ভণ্ডামীরই প্রমাণ দেখিতে লাগিলেন। কোন উপায় না দেখিয়া প্রমোদ বলিলেন “আমিই যদি নীরজাকে এনে থাকি তাহলে আমার বাড়ীতেই ত রাখব, আপনি বরং আমার বাড়ী খুঁজে দেখুন।”

 “সে খবর আমি না নিয়ে তোমার কাছে আসিনি, তোমার বাড়ীতে তাকে তুমি রাখনি, তা হলে যে শীঘ্র ধরা পড়বে, আর কোথায় লুকিয়ে রেখেছ বল?”

 প্রমোদ ইহার কি উত্তর দিবেন? ক্রোধে, কষ্টে, হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। অন্য কেহ হইলে প্রমোদের অপরিসীম ক্রোধ হইত, ক্রোধান্ধ হইয়া কি করিতেন ঠিক নাই, কিন্তু সন্ন্যাসী বলিয়া — নীরজার পিতা বলিয়া, ক্রোধ অপেক্ষা কষ্টের ভাগই অধিক হইল। তাঁহাকে নিরুত্তর দেখিয়া সন্ন্যাসী আবার বলিলেন “আবার বল্‌ছি তুমি যদি ভালয় ভালয় তাকে ফিরিয়ে দাও তো আমি তোমার সকল দোষ মার্জ্জনা করব,—”

 প্রমোদ আর মৌন হইয়া থাকিতে না পারিয়া ঈষৎ রোষগর্ব্বিত স্বরে বলিলেন “মহাশয় নীরজা কোথায় আমি জানি না, আমি শপথ করে ঈশ্বর সম্মুখে আপনাকে বলছি, এতেও যদি আপনি বিশ্বাস না করেন তো আপনার যা ইচ্ছা—”

 সন্ন্যাসী সহিষ্ণুভাবে প্রমোদের বাক্য শেষ পর্য্যন্ত আর শুনিতে পারিলেন না। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন—

 “চুপ, আর কথা না, তোমার প্রত্যেক কথায় আমার আপাদ মস্তকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছুটছে, নরাধম! পাষণ্ড! আজ দেখছি এ হস্ত তোর রক্তে গ্লাবিত হবে, আজ দেখছি নরহত্যায় এ হস্ত কলুষিত হবে।”

 বলিয়া ক্রোধে অজ্ঞানবৎ প্রমোদের দিকে দুই এক পদ অগ্রসর হইলেন, কিন্তু দুই এক পদ চলিয়াই আবার যেন জ্ঞান হইল, তিনি সহসা থমকিয়া দাঁড়াইলেন, একবার সেই সহস্র তারকাপ্রজ্জ্বলিত আকাশের দিকে চাহিয়া একবার আপনার চারিদিকে সেই নিস্তব্ধ প্রকৃতির অন্ধকার মূর্ত্তির দিকে চাহিয়া—মুহূর্ত্তমাত্র সময় লইয়া সেই নীরব নৈশগগন কাঁপাইয়া প্রমোদকে চমকিত করিয়া বলিলেন—

 “না নরাধম, আমি তোর অপবিত্র রক্তে হস্ত কলঙ্কিত করব না, আমি তোকে মারব না, তোকে মারলে নীরজাকে পাবার উপায় নেই, তুই মরলে নীরজা কোথায় কে বলবে? না, তোকে মারব না, মৃত্যুতে তোর মত লোকের শাস্তি হবে না, তোকে মারলে আমারি কলঙ্ক। আমি বিচারালয়ে তোকে শাস্তি দিব, পৃথিবীর এক সীমা থেকে আর এক সীমা পর্য্যন্ত তোর নাম, তোর দুর্ণাম তোর জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা ঘোষণা করব, পৃথিবীর সকলে তোকে দেখবামাত্র সর্পের মত ঘৃণায় স’রে দাঁড়াবে। তোকে মারব না, মারলে তোর পাপের শাস্তি হবে না”—বলিয়া সন্ন্যাসী আর মুহূর্ত্তমাত্র না দাঁড়াইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকার রজনীকে কাঁঁপাইয়া, সেই কথাগুলি বজ্রের মত প্রমোদের কর্ণে প্রবেশ কবিল। সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন, প্রমোদ অনেকক্ষণ ধরিয়া বজ্রাহতের নায় স্তব্ধভাবে সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলেন। যখন তাঁহার চিন্তা করিবার শক্তি জন্মিল, তখন সন্ন্যাসীর সহিত যত কথা হইয়াছিল, পূর্ব্বাপর ক্রমে মনে পড়িতে লাগিল। কি করিয়া তিনি এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার পাইবেন ভাবিতে লাগিলেন। মন এতই চঞ্চল, যে তখনই কাহারও সহিত ঐ বিষয়ে পরামর্শ করিতে ব্যস্ত হইলেন। কিন্তু এ কথা কাহাকে বলেন? যাহাকে তাহাকে বলা যায় না, বলিতে ইচ্ছাও করে না। তিনি ভাবিতে ভাবিতে যামিনীনাথকে ছাড়া আর পরামর্শ করিবার লোক দেখিলেন না। প্রথমতঃ যামিনীনাথ তাঁহার হৃদয়বন্ধু, দ্বিতীয়তঃ যামিনীনাথও সেই অরণ্যে গিয়াছিলেন, তিনিও নীরজাকে দেখিয়াছেন, তিনি সকলই জানেন, তিনিই এ সম্বন্ধে একমাত্র পরামর্শ দিবার উপযুক্ত পাত্র। প্রমোদ সেই রাত্রেই ব্যাকুলভাবে যামিনীনাথের বাড়ী যাত্রা করিলেন।