ছিন্নমুকুল/সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ছিন্নতন্ত্রী

 ক্রমে অপরাহ্ন কাল আগত; অল্প অল্প মেঘ করায় বৈকালেই সন্ধ্যা সন্ধ্যা বোধ হইতেছে। বাতাস বেশী না থাকায় নদী এখন প্রশান্ত, নিস্তব্ধ, তাহাতে তরঙ্গ-উচ্ছাস নাই। নিঃশব্দে জাহ্নবী নদী মুমূর্ষু ব্যক্তির জীবনাশার ন্যায় বহিয়া যাইতেছে।

 নদীর ধারে বারান্দায় বসিয়া কনক একখানি পত্র পড়িতেছিল। পত্রখানি হিরণের। কিছু পূর্ব্বে পত্রখানি কনক পাইয়াছে। কনকের মুখখানি কি মলিন, কি বিষণ্ণ! দৃষ্টি কি ঘোরতর যন্ত্রণাব্যঞ্জক, অথচ শূন্যময়, যেন কি দেখিতেছে কি পড়িতেছে সে জানে না, কেবল তাহাতে একটি অসহা বেদনা অনুভব করিতেছে মাত্র। কনক চিঠিখানি দুই একবার মনে মনে পড়িল, তাহাতে যেন ভাল করিয়া বুঝিতে না পারিয়া আর একবার মৃদু-উচ্চারণে পড়িতে আরম্ভ করিল,—

“কনক, প্রেমময়ি, আমার কনক,

 “কিন্তু এ জীবনে আর তাহা হইল না। তবুও একবার তবুও এই শেষবার তোমাকে ‘আমার’ বলিয়া চিরজীবনের অতৃপ্ত সাধ মিটাইব। কনক, আমার হৃদয়ের কনক, কোন সম্বোধনেই আমার আশ মিটিতেছে না, পৃথিবীতে আমার ভালবাসার মত কোন সম্বোধনই খুঁজিয়া পাই না, আমার সর্ব্বস্বধন, আমি চলিলাম।

 হৃদয়ের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সম্বোধন করিয়া গেলাম, তুমি কি আমার স্পর্দ্ধায় দোষ লইবে? প্রিয়তমে, অভাগা দীন অসুখী বলিয়া অপরাধীর মুক্তকণ্ঠের এই শেষ উচ্ছ্বাসে দোষ লইও না। কনক, আমি তো মরমের নিভৃত বিজনে শত শতবার দিনে নিশীথে এইরূপ সম্বোধন করি, আজ, মুক্তকণ্ঠে তোমাকে তাহা বলিলাম বলিয়া কি তুমি দোষ লইবে?— আমার এই শেষ বিদায় বলিয়াও কি আমাকে ক্ষমা করিবে না? না, কনক, তুমি মমতাময়ী, তুমি দেবী, তুমি ইহাতে কখনই অপরাধ লইবে না। অভাগার এই শেষ চিহ্ন বলিয়াও অন্ততঃ মার্জ্জনা করিও। মুখে তোমাকে কখনো সাহস করিয়া প্রাণোত্থিত আদরের সম্বোধনে ডাকিয়া সাধ মিটাইতে পারি নাই; পত্রে আজ জনমের মত সে সাধ মিটাইলাম, কনক ক্ষমা করিও। কনক, আমি আজ সকালে তোমার ভ্রাতার সহিত সাক্ষাৎ কামনায় গিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমার সাক্ষাৎ প্রার্থনা অগ্রাহ্য করিলেন, আমার সহিত তাঁহার আর দেখা হইল না, সুতরাং তোমাকে পাইবার আমার যে বিন্দুমাত্র আশা ছিল, তাহাও অবসান হইল। এখন আমি দৃঢ়সঙ্কল্প; আমি চলিলাম। সমস্তই ঠিক, কাল প্রাতঃকালেই এই স্থান হইতে চলিয়া যাইব। কয়েক দিন ধরিয়া তোমাকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিতেছি কিছুতেই পারিতেছি না। যত চেষ্টা করি, তোমার সেই মধুর প্রসন্ন-মূর্ত্তি—তোমার সেই মমতাময়ী দেবীমূর্ত্তি আরও জ্বলন্তরূপে দেখিতে পাই, তোমাকে দেখিবার সাধ আরো বৃদ্ধি হয়। না, কনক আমি আর তোমাকে ভুলিতেও চেষ্টা করিব না— তুমি আমার হৃদয়সর্ব্বস্ব, তুমি আমার দেবতা, তোমাকে পাইলাম না বলিয়া তোমাকে ভুলিব! আমার কনককে ভুলিব! চিরজীবন কষ্টে কাটুক, হৃদয় চিরজীবন যন্ত্রণায় দহিতে থাকুক, তবুও কনক তোমাকে ভুলিব না, মনে মনে আজীবন তোমাকে পূজা করিয়া কাটাইব, —ঐ মধুর প্রতিমাখানি ধ্যান করিয়াই জীবন কাটাইব!

 কনক! আমি যে দিন হইতে তোমাকে দেখিয়াছি সেই দিন হইতে এ হৃদয় তোমার মূর্ত্তিতেই পূর্ণ রহিয়াছে, সেই দিন হইতে পৃথিবীর অন্য সকল সুখেই জলাঞ্জলি দিয়াছি, কেমন করিয়া সেই হৃদয়াঙ্কিত কনককে আজ আমি ভুলিব! একদিন আশা ছিল তোমাকে পাইয়া সুখী হইব, সে আশা আর নাই, তবে আমি আর কোন আশায় এখানে থাকিব! আমি চলিলাম, ঐ প্রতিমাখানি হৃদয়ে ধরিয়া চিরজীবনের সুখশান্তি বিসর্জ্জন দিয়া দেশান্তরে চলিলাম। কনক, অভাগা হিরণের একমাত্র এই বাসনা—একমাত্র এই প্রার্থনা, তুমি সুখে থাক!

জীবনে মরণে তোমারি।” 


 চিঠি পড়া শেষ হইলে কনক ভাবিতে লাগিল—“কনক অভাগিনী, কনক চিরদুঃখিনী। ভ্রাতার জন্য কনক চিরসুখ ত্যাগ করিল, ভাই তবুও কনককে ভালবাসিলেন না। প্রাণের হিরণ— হৃদয়সর্ব্বস্ব হিরণ তিনিও আর কনককে ভালবাসেন না, নহিলে কেমন করিয়া তাহাকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতেছেন! কনককে এই ঘোর যন্ত্রণাসমুদ্রে ভাসাইয়া কেমন করিয়া হিরণ তাহার সহিত চিরসম্বন্ধ লোপ করিবার কথা মনে আনিলেন! তাহাকে এইরূপে বিসর্জ্জন দিয়া না যাইলে তবু কালে তাহাদের মিলন-আশা থাকিত, তাহার ভ্রাতার কি ভ্রম আর কখনই ঘুচিত না? ঘুচুক না ঘুচুক সেই দূরকল্পিত আশাতেই কি তাহারা ধৈর্য্য ধরিয়া থাকিতে পারিত না? হিরণ কনককে তেমন ভালবাসেন না, তাই তিনি এরূপ সঙ্কল্প করিতে পারিলেন, কই কনক তো এমন কথা মনেও আনিতে পারে না! হিরণই যখন তাহাকে ছাড়িয়া যাইতেছেন, কনকের তখন আর বাঁচিয়া কি হইবে? কি আশায় আর সে এই অসীম যন্ত্রণা সহ্য করিবে।”

 সহসা এই সময় বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল। সেই অল্প অল্প মেঘরাশি গাঢ়তর হইয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকার করিয়া ফেলিল, বিকট গর্জ্জনে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, দেখিতে দেখিতে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ও আরম্ভ হইল। কনক সেই নিবিড়-মেঘাচ্ছন্ন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিবর্ষণশীল আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। শূন্যময় দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া আপন মনে কাঁদিয়া উঠিল; আবার তখনই অশ্রু-বারি মুছিয়া কি ভাবিতে লাগিল, কি যেন একটা কথা মনে আনিতে চেষ্টা করিল, পারিল না; সেই অন্ধকারময় আকাশ দেখিয়া যেন তাহার কি একটি গান মনে আসিয়াও আসিতেছিল না— তারপর সহসা গাহিয়া উঠিল—

আকাশের ঐ মেঘ এখনি তো ছুটিবে,
আবার জোছনা ভাতি এখনি তো ফুটিবে,
কিন্তু লো স্বজনি আর হৃদয়ের এ আঁধার,
এ জনমে অভাগীর কভু না ঘুচিবে।
জীবন বরষা যদি—বহায় শোণিত নদী
তবু এই আঁখিঁধার আর না মুছিবে।

 আবার সহসা বিকট গর্জ্জনে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, কনকের দৃষ্টি ঝলসিয়া দূরে বজ্রাঘাত হইল। বালিকা কখনও উচ্চৈঃস্বরে গান গাহিত না, আজ অজ্ঞানের মত উচ্চৈঃস্বরে আর একটি গান ধরিল, গাহিতে গাহিতে বজ্র ধরিবার আশায় যেন ছুটিয়া বারাণ্ডা হইতে উঠিয়া গেল।

আজ ওরে বজ্র তোরে কখনো না ছাড়িব,
আটকি হৃদয়ে তোরে এ হৃদয় দহিব।

হৃদয়ে কি কাজ আর, পুড়ে হো'ক ছারখার,
হৃদয় সর্ব্বস্ব ছেড়ে হৃদয় কেন রাখিব।
এ প্রাণ জীবন হৃদি তাহারি না হোল যদি
আমারি বা হবে কিসে, পর তারে ত্যেয়াগিব।

 কনক উদ্যানে আসিয়া গঙ্গাতীর দিয়া ছুটিয়া ছুটিয়া বাড়ীর সীমানা অতিক্রম করিল; অনাথিনী উন্মাদিনীবেশে সেই ঝড় বৃষ্টি দুর্য্যোগে একাকিনী গান গাহিয়া গাহিয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

 ঝড় বৃষ্টিতে দাসদাসীগণ কেহই তাহাকে বাটী ত্যাগ করিবার সময় দেখিতে পাইল না।