ছিন্নমুকুল/সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

অঙ্কুর-বিকাশ

 প্রাতঃকালে মন্দ মন্দ সমীরণ ভরে কম্পিত হইতে হইতে একখানি সুদৃশ্য বজরা গঙ্গাবক্ষঃ তরঙ্গিত করিয়া চলিতেছিল। বজরার দুইটি কামরা, একটি কামরায় পার্শ্বস্থ উচ্চ তক্তার উপর একটি পীড়িতা রমণী শয্যাশায়ী, নিকটে দুইজন পুরুষ দুইখানি চৌকিতে আর নীচে পদপার্শ্বে একজন দাসী বসিয়া। ইহাদের মধ্যে যিনি যুবা তিনি প্রৌঢ় ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলেন “আজ কেমন দেখছ? ভরসা হয়?” উত্তর পাইলেন। “এ দুদিনের চেয়ে আজ কিছু ভাল, তবে আরো চার দিন না গেলে ঠিক বলা যায় না।”

 দিন যাইতে লাগিল; যুবা প্রায় সর্ব্বদাই রমণীর নিকট রহিয়াছেন, আবশ্যক না হইলেও ক্ষণে ক্ষণে নাড়ী টিপিয়া দেখিতেছেন, ক্ষণে ক্ষণে কপালের উষ্ণতা অনুভব করিতেছেন এবং “রমণী এখন কেমন আছেন?” এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়া মাঝে মাঝে চিকিৎসককে বিরক্ত করিয়া তুলিতেছেন, অথচ চিকিৎসকের সাহস বাক্যে তাঁহার কিছুতেই প্রত্যয় জন্মিতেছে না। যখন অন্য কোন কাজ নাই, তখন যুবা রমণীর সেই অজ্ঞান সুষুপ্ত মুখের দিকে চাহিয়াই আছেন, তাহার সেই অর্দ্ধনিমীলিত পদ্ম-কোরক-সদৃশ নয়নযুগলের দিকে চাহিয়াই আছেন, পলকহীন স্থির দৃষ্টিতে বিষণ্ণ ভাবেই চাহিয়া আছেন, দেখিয়া তাঁহার কি তৃপ্তি হইতেছে তিনিই জানেন।

 যুবক আর কেহ নহেন আমাদের পূর্ব্বপরিচিত হিরণকুমার।

 হিরণকুমার কিছু দিন হইতে পশ্চিম অঞ্চলে আবগারী তদারক কার্য্য করিতেছিলেন। এই উপলক্ষে কখন কখনও পশ্চিমের নানা স্থানে তাঁহাকে চৌর্য্য নিবারণেও যাইতে হইত। সম্প্রতি এই উদ্দেশ্যে তিনি জল পথে ঘুরিতেছিলেন। সুশীলার মৃত্যুর দিন দৈব বশতঃ তিনিও এলাহাবাদে ছিলেন। দিনের বেলা সেখানকার সরকারী কার্য্য শেষ করিয়া রাত্রি কালে তিনি সুশীলার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া তাঁহার মৃত্যু সংবাদে কাতর হইয়া যখন পুনরায় নৌকায় উঠিতে যাইবেন, তখনই তীরদেশে কনককে দেখিতে পান। বােটে তাঁহার এক জন সহকারী ছিলেন, স্বাভাবিক অনুরাগে ঘরে পড়িয়া তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় অনেকটা অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন বালিকা মৃত নহে। কিন্তু হাসপাতাল লইয়া যাইবার অপেক্ষা সহিবে না; যথাশীঘ্র বিশেষ যত্নশুশ্রূষা পাইলে রমণী প্রাণলাভ করিতেও পারে। এদিকে বিশেষ কার্য্যসূত্রে তখনি তাঁহাদের বােট না ছাড়িলেই নয়, তাঁহারা বালিকাকে বোটে তুলিয়া লইয়া, পুনর্জ্জীবিত করিতে সচেষ্ট হইলেন। মনে করিলেন আরোগ্য লাভ করিলে তাহার পরিচয় জানিয়া তাহাকে যথা স্থানে পৌঁছিয়া দিবেন।

 তিন চারি দিন অতীত হইল, রমণীর পীড়া ক্রমে উপশম হইয়া আসিতে লাগিল। আরাে তিন চার দিনে একটু একটু করিয়া তাহার চৈতন্য লাভ হইল। তিনি যখন মানুষ চিনিতে পারিলেন তখন এই অপরিচিত যুবাদিগের মধ্যে আপনাকে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কনকের সমস্ত ঘটনা অল্প অল্প স্মরণ হইতে লাগিল। সুশীলার মৃত্যু ও শবদাহের পর তাহার নদীতে পড়িয়া যাইবার কথা ক্রমে মনে পড়িল। তাহা ছাড়া যদিও আর কিছুই মনে করিতে পারিল না তবুও কনক বুঝিল তাহার পর ইহাঁরা তাহাকে বাঁচাইয়াছেন। কনক ভাবিল, ইহাঁরা কে? তাহাকে বাঁচাইলেন কেন? মরিলেই সব দুঃখ ফুরাইয়া যাইত, আবার তাহার যন্ত্রণা ভোগের জন্য ইহারা কেন বাঁচাইলেন? ভাবিতে ভাবিতে হিরণকুমারের করুণ দৃষ্টিতে কনকের বিষণ্ণ দৃষ্টি সংলগ্ন হইল, অমনি কনকের চক্ষু নত হইয়া পড়িল, সেই পাংশুবর্ণ মুখ-মণ্ডলও ঈষৎ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। হিরণ ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আজ কি আপনি ভাল আছেন?” চিকিৎসক তখন অপর কক্ষে ছিলেন। সহসা এই কক্ষে আসিয়া বলিলেন “বেশী কথা কইও না, এখনো বড় দুর্ব্বল।” কিন্তু হিরণকুমারের সেই সকরুণ সোৎসুক জিজ্ঞাসায় কনকের নতচক্ষু আবার উন্নত হইল, যেন বিস্মিত ও সন্দিগ্ধ চিত্তে সে তাঁহার দিকে আবার চাহিল। কনকের জন্য সুশীলা ছাড়া কেহ কখনো উৎসুক হন নাই, আজ এই অপরিচিত যুবা তাহার জন্য কাতর হইবেন, ইহা যেন কনকের স্বপ্নবৎ বোধ হইল।

 ক্রমে এক মাসের মধ্যে বালিকা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিল। সহকারী কার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন, হিরণকুমার বালিকার পরিচয় পাইয়া এলাহাবাদে বোট লইয়া যাইতে অনুমতি করিলেন। এলাহাবাদে পৌঁছিতেও প্রায় মাস খানেক লাগিল। এই একমাসে আস্তে আস্তে বালিকা যুবকের সহিত পরিচিত হইতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে তাহার লজ্জা ভাঙ্গিতে লাগিল। প্রথমে একটি কথা কহিতেও তাহার লজ্জা হইত, ক্রমে অল্পে অল্পে একটি দুইটি করিয়া তাহার কথা ফুটিল। একবার লজ্জা ভাঙ্গিয়া গেলে বালিকা একটী একটী করিয়া তখন কত গল্পই করিল। হিরণকুমারও তাহার সহিত আত্মীয়ের মতই ব্যবহার করিতে লাগিলেন। একদিন কনকের শয্যার নিকট বসিয়া হিরণকুমার একটা কথার পর একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বালিকার গল্প শুনিতেছিলেন। কথার মধ্যে তিনি একবার জিজ্ঞাসা করিলেন—

 “আচ্ছা, তোমার বাবা যখন মরেন তখন তোমার বয়স কত? তখনকার কথা তোমার কি মনে আছে?”

 কনক বলিল “কিছু কিছু মনে পড়ে বই কি। আমার বয়স আর তখন কত হবে—এই চার পাঁচ বছর।”

 যু। উঃ! তোমার তত ছোট বেলার কথা মনে আছে—আশ্চর্য্য তো?

 ক। আমার কষ্টের কথা গুলিই যেন বেশী মনে আছে— মা দাদাকে আদর করতেন—আমার এমন ইচ্ছা হোত—”

 হিরণকুমারের চক্ষে জল আসিল তিনি মনে মনে বলিতে লাগিলেন এই হৃদয়ে যতদিন শোণিত-ধারা বহিবে ততদিন শত সহস্র জনক জননীর আদর আমি তোমাকে দিতে পারি।” কনক তাঁহার বিষন্নতায় কিছু আশ্চর্য্য হইল। কনকের বাল্যদুঃখে যুবা এতদূর দুঃখিত হইলেন যে তাঁহার চক্ষু জলপূর্ণ হইল! কই কনকের দুঃখে তো কেহ কখনো কাঁদে নাই; কনক বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে যুবাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। যুবা তাহার এই সন্দেহের ভাব যেন কিছু বুঝিতে পারিয়া মনে মনে দুঃখিত হইলেন। কিন্তু, যুবার দিকে চাহিয়া কনক যখন তাঁহার সেই স্নেহপুর্ণ মুখকান্তি দেখিল, অবিশ্বাস করিয়াছিল বলিয়া তাঁহার সেই মমতাময় চক্ষের নীরব অথচ করুণ তিরস্কার দেখিতে পাইল, তখন আর কনকের সন্দেহ রহিল না, তাঁহার স্নেহে বালিকার সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মিল। এই বিশ্বাসই কনকের কাল হইল, এই স্নেহের পরিবর্ত্তে অজ্ঞাতভাবে সে আপন হৃদয় বিনিময় করিয়া ফেলিল।

 হিরণ ব্যাকুলভাবে চক্ষু মুছিয়া বলিলেন—“তোমার দুঃখের কথাই মনে আছে, সুখের কথা কিছুই কি মনে পড়ে না?”

 ক। পড়ে না যে তা না। ছেলে বেলা এক দিন একজন অচেনা লােক আমাকে আদর করেছিলেন, আমার এখনাে মনে আছে, মনে করতে এখনো এত ভাল লাগে!

 যুবক বলিলেন “সে লােকটি কে? যার আদরে তােমার মনে এতখানি সুখ দিয়েছে তার কি সৌভাগ্য”

 কনক তখন ছেলেবেলাকার সেই গল্পটি করিল। হিরণ দেখিলেন তিনিই সেই গল্পের নায়ক। তিনি বহুদিন পূর্ব্বে কনকের প্রতি করুণা-পরায়ণ হইয়া তাহার পক্ষ লইয়া প্রমােদকে যে ভর্ৎসনা করেন সেই স্নেহময় ক্ষুদ্র ঘটনাটি বালিকার হৃদয়ে এখনো গাঁথা রহিয়াছে দেখিয়া আশ্চর্য্য হইলেন।

 তিনি সে কথা আর না উঠাইয়া বলিলেন “কনক, তােমার দাদাকে চিঠি লিখেছি তা জান? প্রমােদের না জানি কতই আহ্লাদ হবে?”

 কনক একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল “তা কি হবে?”

 হি। ছিঃ! কেন কনক, তােমার এরূপ অকারণ সন্দেহ হয়?”

 এই তিরস্কার বাক্যে কনকের মুখটি যেন আরো ম্লান হইয়া পড়িল; হিরণকুমার বলিলেন—

 “কনক, বাড়ী যাবে, আবার তােমার সেই ভালবাসার ভাইটিকে দেখতে পাবে, কতদূর আহ্লাদ হচ্ছে, বল দেখি।”

 কনক একটু থামিয়া থামিয়া বলিল “হাঁ আহ্লাদ হচ্ছে বই কি।”

 হি। সেই স্নেহের রাজ্যে গিয়ে তােমার কি আর কখনাে এখানকার এই অপরিচিত পরের কথা মনে পড়বে!

 কনক এ কথার কিছুই উত্তর না করিয়া ভাবগর্ভ শূন্য-দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু এই কথাটি জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া হিরণের চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহা ঢাকিতে তিনি সেই কক্ষ হইতে উঠিয়া বােটের বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলেন।