আঠার

 দীর্ঘ-মেয়াদের পর জওহরলাল ১৯৩৩ সালের অগাষ্ট মাসে কারাগার হইতে ছুটি পাইলেন, তাঁহার জননীর শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন বলিয়া তিনমাস আগেই তাঁহার কারামুক্তি ঘটে। জননীর শরীর একটু ভাল হইবার পর পণ্ডিত জওহরলাল কলিকাতায় আসিলেন। কলিকাতা হইতে ফিরিয়া গিয়া তিনি বিহার ভূমিকম্পের সাহায্যের জন্য চারিদিকে ঘুরিয়া অর্থ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন।

 একদিন সারাদিন ঘুরিয়া বেড়াইবার পর সন্ধ্যার সময় আনন্দ-ভবনে ফিরিয়া আসিয়া সবে বসিয়াছেন, এমন সময় দরজায় এক পরিচিত গাড়ী আসিয়া থামিল। গাড়ী হইতে একজন পুলিশ কর্ম্মচারী নামিল।

 জওহরলাল হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে বলিলেন, বৃহৎ দিনো কো আপকা ইন্‌তাজার থা!

 পুলিশ-কর্মচারীটী একটু কুণ্ঠিত হইয়া বলিলেন, এবার আমরা ডাকি নি—ডাক এসেছে কোলকাতা থেকে—

 মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস বাহিরে থাকার পর আবার জওহরলালকে ফিরিয়া যাইতে হইল কারাগারে-এবার কলিকাতায়—এবারেও দণ্ড হইল- দীর্ঘ দুই বৎসর-এইবার লইয়া সাতবার হইল!

 প্রেসিডেন্সী জেলে কয়েকদিন রাখার পর তাঁহাকে আলিপুর সেন্‌ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হইল। একটা ছোট্ট সেল, দৈর্ঘ্যে দশ ফিট, গ্রন্থে ছ' ফিট। ঘরের সাননে ছোট্ট একটু বারাণ্ডা, বারাণ্ডার ধারে নীচে খানিকটা খোলা জায়গা। সেই খোলা জায়গাটী ঘিরিয়া সাত ফিট উঁচু একটা পাঁচিল।

 আলিপুরের কারাজীবন সম্পর্কে জওহরলাল তাহার আত্মচরিতে লিখিয়াছেন—

 “যেটুকু প্রাঙ্গন আমার ভাগ্যে জুটিয়াছিল, তাহার মধ্যে সবুজের কোন চিহ্ন ছিল না। একটীও গাছ না। গাছ জন্মাইবে কোথায়? সেই ছোট্ট প্রাঙ্গনটুকু আগাগোড়া সিমেণ্ট দিয়া গাঁথা, কঠিন-পাথরের মত প্রাণহীন। পাঁচিলের উপর দিয়া অদূরে দু' একটী গাছ নজরে পড়িত—একমাত্র প্রাণের চিহ্ন। কিন্তু আমি যখন প্রথম সেই ঘরে প্রবেশ করি, তখন সেই গাছগুলিও শুকাইয়া ছিল—পত্র-পুষ্পহীন। সারাদিন তাহাদের দিকে চাহিয়া থাকিতাম—হঠাৎ কখন দেখি তাহাদের পত্রহীন রিক্ততার দৈন্য ঘুচিয়া গিয়াছে, দু' একটী করিয়্য সবুজ পত্র দেখা দিয়াছে শুষ্ক শাখা আবার সবুজ রঙে সাজিয়া উঠিতেছে দেখিতে দেখিতে মনে হইত, একি সুন্দর বিস্ময়কর পরিবর্ত্তন।

 “যে দু'|একটী গাছ আমার নয়নের নিত্য-আকর্ষণ ছিল, তাহাদের একটীতে একটা চিলের বাসা ছিল। সেই পক্ষি-মাতা আমার অন্তর জুড়িয়া যেন ছিল। দূর হইতে দেখিতাম, পক্ষি-মাতা আহার সংগ্রহ করিয়া আনিয়া তাহার শিশুদের খাওয়াইত—একটু একটু করিয়া তাহাদের ডানা মেলিয়া উড়িতে শিখাইত, ক্রমশঃ তাহাদের মধ্যে দুঃসাহসী দু' একটি শিশু-পক্ষী আদিম অভ্যাসবশত নীড় ত্যাগ করিয়া তীরের মত নীচে উড়িয়া যাইত, হয়ত অতর্কিতে কাহারও হাত হইতে কিছু ছিনাইয়া লইয়া আবার নীড়ে ফিরিয়া আসিয়া বসিত দেখিতাম, কেমন ধীরে ধীরে তাহারা তাহাদের জাত-ব্যবসায় আয়ত্ত করিতেছে!

 “সূর্য্যাস্ত থেকে সূর্য্যোদয় পর্য্যন্ত আমাদের সেলের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখা হইত—শীতের দীর্ঘ রাত্রি পোহাইতে চাহিত না— ক্রমশঃ পড়িতেও আর ভাল লাগে না—তখন একা পা গুণিয়া গুণিয়া সেই সেলের ভিতর ঘুরিয়া বেড়াইতাম— পাঁচ-পা গুণিয়া অগ্রসর হইতাম আবার গুণিয়া পাঁচ-পা পিছাইয়া আসিতাম—মনে পড়িত, পশুশালায় লৌহ-পিঞ্জরের মধ্যে ভল্লুকদের সেই ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখিয়াছি। যখন কোন কিছুই ভাল লাগিত না, তখন কারাবাসের একঘেয়েমী-ব্যাধির যে ঔষধ আমি আবিষ্কার করিয়াছিলাম, তাহাই ব্যবহার করিতাম। সে ঔষধটীর নাম হইল “শিরাসন” মাটীর দিকে মাথা করিয়া দাঁড়াইয়া থাকা!”

 বিরাট প্রাণচাঞ্চল্য লইয়া যে এই জগতে আসিয়াছে তাহাকে যদি জীবনের এবং যৌবনের শ্রেষ্ঠ অংশ, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর কয়েক হাত পরিমিত ক্ষুদ্র রুদ্ধদ্বার প্রকোষ্ঠে একাকী কর্ম্মহীন অবস্থায় কাটাইতে হয়, তাহার সে বেদনা যে কি তীব্র ও মর্ম্মন্তুদ, তাহা উপরি-উক্ত অতিসংযত কথাগুলির আড়ালে উপলব্ধি করা যায়! একজন শ্রেষ্ঠ কথা-শিল্পীর মতই জওহরলাল তাহার অন্তরের সেই বেদনাকে রূপ দিয়াছেন।

 এই কথা উল্লেখ করিবার একটা বিশেষ তাৎপর্য্য এই যে, জওহরলালের মধ্যে যে সাহিত্যিক প্রতিভা তাহার রাজনৈতিক জীবনের আড়ালে চাপা পড়িয়া গিয়াছে, তাহা আমরা তাঁহার আত্মচরিতে এবং কন্যার নিকট লিপি আকারে লিখিত পৃথিবীর ইতিহাসে দেখিতে পাই।