জওহরলাল/উনিশ
উনিশ
আলিপুর জেলে কয়েক মাস বাস করার পর জওহরলালের স্বাস্থ্য একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল। কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন হইয়া তাঁহাকে বায়ু পরিবর্ত্তনে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন, আলিপুর জেল হইতে ডেরাড়ুন জেলে। ডেরাডুন জেলের অভিজ্ঞতা জওহর লালের পূর্ব্ব হইতেই ছিল। তাই কলিকাতার ধূম্রল বায়ু হইতে পার্ব্বত্য পরিবর্ত্তনের আশায় তাঁহার মন উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু ডেরাডুনে গৌঁছাইয়া দেখিলেন, আগে আগে তাঁহাকে যেখানে যেভাবে রাখা হইত, এবার তাহার পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। একটা অতি পুরাতন জীর্ণ গোশালা—একটু পরিষ্কার করিয়া তাঁহার বাসের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
অন্য সব কারাগার হইতে ডেরাডুনের কারাগারটীকে জওহরলাল পছন্দ করিতেন, তাহার কারণ তাহার কুঠরীর প্রাঙ্গন হইতে অদূরে পাহাড়ের চূড়াগুলি দেখা যাইত। কারাপ্রাচীরের বাহিরে উন্নতশির সেই গিরিশৃঙ্গগুলি তাঁহার মনকে টানিয়া রাখিত— দেহ আবদ্ধ থাকিলেও মন সেইটুকু দৃষ্টিসুখের মধ্য দিয়া একটা মুক্তির স্বাদ পাইত। কিন্তু এই নূতন পারিপার্শ্বিকের মধ্যে আসিয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, কোথাও পাহাড়ের কোন চিহ্নই দেখা যাইতেছে না!
কিন্তু সকলের চেয়ে বেশী তাঁহার মানসিক উদ্বেগের কারণ হইল—স্ত্রী কমলার স্বাস্থ্য। এখানে আসিয়া তিনি খবর পাইলেন যে স্ত্রীর স্বাস্থ্য আবার ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং পুরাতন ব্যাধি আবার তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। এই সময় যদি তিনি তাঁহার নিকটে থাকিতে পারিতেন, তাহা হইলে হয়ত সেই রোগক্লিষ্টা নারী ব্যাধির সহিত সংগ্রাম করিবার শক্তি পাইত।
এই রকম মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে যখন তাঁহার দিন কাটিতেছিল, সেই সময় হঠাৎ একদিন জেলের কর্তৃপক্ষ আসিয়া জানাইলেন যে, তাঁহাকে এলাহাবাদে যাইতে হইবে—পুলিশ পাহারায়। বাড়ীতে তাঁহার স্ত্রীর অবস্থা শঙ্কটাপন্ন। প্রয়াগ ষ্টেশনে নামিলে স্থানীয় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আসিয়া তাঁহাকে জানাইলেন যে, স্ত্রীর অসুস্থতার দরুণ কয়েকদিনের জন্য তিনি ছুটি পাইয়াছেন!
জওহরলালের আত্মচরিত পাঠে তাহার এই নিদারুণ মানসিক দ্বন্দ্বের কথা অতি সকরুণ ভাবে পাঠকের অন্তরে আঘাত করে। এই দ্বন্দ্ব তাঁহার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে তাঁহার সাংসারিক জীবনের সংঘর্ষ। বাহিরের কর্ম্মময় জগৎ তাঁহাকে এমন ভাবে ঘরের বাহিরে টানিয়া আনিয়া ছিল যে, তিনি স্বামী হিসাবে স্ত্রীর প্রতি যে গভীর ভালবাসা ও কর্ত্তব্য পোষণ করিতেন, তাহা প্রকাশ করিবার অবকাশটুকুও পাইতেন না।
এই অনিচ্ছাকৃত কর্ত্তব্যহীনতা অতি নিদারুণ ভাবে তাঁহার অন্তরকে পীড়িত করিয়া তুলিত। বিশেষ করিয়া কমলার রুগ্ন অবস্থায় এই মানসিক দ্বন্দ্ব তাঁহার মনে তীব্র বেদনার আলোড়ন জাগাইয়া তুলিল। হয়ত, যাহারা দেশকে ভালবাসে, বিশেষ করিয়া সে দেশ যদি পরাধীন হয়, তাহাদের ভালবাসার আর কোন সামগ্রী থাকিতে নাই!
স্ত্রীর সম্বন্ধে তাঁহার মনের এই দ্বন্দ্ব-সম্পর্কে তিনি আত্মচরিতে লিখিতেছেন—
“বাড়ী আসিয়া দেখিলাম, কমলা শয্যায় যেন মিশাইয়া গিয়াছে—অসহায় রোগদুর্ব্বল দেহ—সে যদি আমাকে ত্যাগ করিয়া এই পৃথিবী ছাড়িয়া চলিয়া যায়! মন হইতে এই ভাবনা দূর করিয়া দিতে যত চেষ্টা করি, ততই নিষ্ঠুর ভবিতব্যতার মত তাহা মনকে পাইয়া বসে। মনে পড়ে, আজ হইতে প্রায় সাড়ে আঠারো বৎসর আগে—নব-বধূর বেশে সে আমাদের বাড়ীতে আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল —একে একে দীর্ঘদিনের সব কথাই মনে পড়িতে লাগিল—
“তখন আমার বয়স ছাব্বিশ আর কমলা সতেরো বৎসরের তন্বী বালিকা—একান্ত সরলা—জগতের ধারার সহিত তাহার বিন্দুমাত্র পরিচয় নাইআমাদের দু’জনার মধ্যে বয়সের পার্থক্য তো যথেষ্টই ছিল—কিন্তু সকলের চেয়ে বেশী পার্থক্য ছিল, আমাদের উভয়ের মানসিক গঠনের। জগতের কোন কিছুই সে জানিত না, আর আমি তখন রীতিমত সজ্ঞান। কিন্তু আমার বয়স হওয়া সত্ত্বেও মনের এক দিক থেকে আমি ছিলাম বালকেরই মত।
“আমাকে ঘিরিয়া এই যে বনলতা পুষ্পিত হইয়া উঠিতেছে, ইহাকে সস্নেহ কোমলতায় ফুঠিয়া উঠিতে আমাকেই যে সাহায্য করিতে হইবে, সে-ধারণা তখন আমার আদৌ ছিল না। মনে পড়ে, স্বভাবতই আমরা উভয়ে উভয়কে আকর্ষণ করিয়াছিলাম, কিন্তু ক্রমশঃ বুঝিতে লাগিলাম যে, আমাদের দুজনার মানসিক জগৎ এত বিভিন্ন যে, আমাকে সর্ব্বদাই তাহার সহিত আপোষ করিয়া চলিতে হইবে। কাজে কাজেই নানা বিষয়ে আপোষ করিতে হইত এবং সব সময়ে তাহাতে সুফল ফলিত না।
“ফলে, সামান্য ব্যাপার লইয়া ঝগড়া হইত, তবে ছেলেমানুষের ঝগড়ার মত, তাহা বেশীক্ষণ স্থায়ী হইত না। আবার মিটমাট হইয়া যাইত। ঝগড়া বাঁধিবার প্রধান কারণ ছিল, আমরা দু'জনেই ছিলাম, যাকে বলে রগচটা অর্থাৎ একটুতেই তীব্র রাগিয়া উঠিতাম —দুজনেই ছিলাম সমান অভিমানী এবং আত্মমর্য্যাদাজ্ঞান-সম্বন্ধে দুজনেই ছিলান সমান ছেলেমানুষ। তবু তাহারই মধ্য হইতে আমাদের ভালবাসা নিবিড়তম হইয়া উঠিতেছিল।
“আমার যখন বিবাহ হয়, ঠিক সেই সময়ই আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থাও তীব্রতর হইয়া উঠিতে থাকে—সারা দেশময় তখন যে আন্দোলন জাগিল, তাহার আকর্ষণে আমি কমলাকে প্রায় ভুলিয়া গেলাম—ঠিক যে-সময় সে আমাকে তাহার পাশে একান্তভাবে চাহিতেছিল, সেই সময় আমি তাহাকে একাকী রাখিয়া বাহিরের কাজে ডুবিয়া গেলাম—এই ব্যবহারিক ত্রুটির দরুণ, কমলার প্রতি আমার অনুরাগ আরও নিবিড় হইয়া উঠিল—যখনই ভাবিতাম, সকল কর্ম্ম-অন্তে সে আমার জন্য তাহার সুস্নিগ্ধ সেবা লইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে, এক পরম সুন্দর অনুভূতিতে আবার মন আচ্ছন্ন হইয়া যাইত। এমনিভাবে দূর হইতে সে আমাকে শক্তি জোগাইত—কিন্তু আজ জানি, তাহার জন্য নীরবে সে নিজেকে কতখানি রিক্ত করিয়াছিল। আজ বুঝি, আমার সেই উদাসিনতার পরিবর্ত্তে যদি নিষ্ঠুরভাবে তাহাকে আঘাতও করিতাম, তাহা হইলে তাহার মনের দিক দিয়া হয়ত অধিকতর সান্ত্বনা সে পাইত।
“এ হেন অবস্থায় আসিল, তাহার ব্যাধি এবং আমার কারাগারে যাওয়া আর আসা। আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হইত, জেলের মধ্যে— ক্ষণিকের-সে তাই তখন নিজেকে চেষ্টা করিয়া আমার কাছে আসিতে লাগিল—দেশের সেবায় সে আত্মসমর্পণ করিল—আমারই মতন কারাজীবন যাপন করিবার জন্য, ব্যাধিগ্রস্থ দেহকে সে তুচ্ছ করিয়া সে অসহযোগ আন্দোলনে, নারী-আন্দোলনে যোগদান করিল—এইভাবে আমরা দুজনে দুজনার কাছে ক্রমশঃ আগাইয়া আসিতে লাগিলাম - আমাদের দুজনার দুই আলাদা জগৎ ক্রমশঃ এক হইয়া আসিতে লাগিল—
“আমাদের পরস্পরের দেখা হইত, বহু মাস পরে এক-আধবার—বড় দুর্লভ মিলন—সকল কাজের মধ্যে দুজনেই উৎসুক আনন্দে অপেক্ষায় থাকিতাম, কবে আবার দেখা হইবে! দুজনে দুজনার কাছে নিত্যই যেন নূতন অদর্শন - আমাদের অনু-রাগকে নব-রসে সঞ্জীবিত করিয়া রাখিত—দুজনে দুজনার মধ্যে নিত্য-নূতন আনন্দের বস্তু আবিষ্কার করিতে লাগিলাম!”
কারাগার হইতে কয়েকদিনের মুক্তি লাভ করিয়া তিনি তখন স্ত্রীর বিদায়োম্মুখ পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া নিজেকে অপরাধী বোধ করিলেন। মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে এক প্রশ্ন জাগে, কমলা যদি আর সারিয়া না উঠে?
এগারো দিনের দিন, পুলিশের গাড়ী আবার দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। ছুটির মেয়াদ ফুরাইয়া গিয়াছে-বন্দীকে আবার ফিরিতে হইবে বন্দিশালায়! যাবার সময় কমলা ইঙ্গিত করিয়া তাঁহাকে কাছে ডাকিলেন। জওহরলাল মাথা নীচু করিলে কমলা কাণে কাণে বলিলেন, শুনছি তুমি নাকি আমার অসুখের জন্যে সরকারের সঙ্গে আপোষ করবে? কখুনো না!”
বীর নারীর এই বিদায়বাণী লইয়া জওহরলাল কারাগারে ফিরিলেন।
কিছুকাল ডেরাডুন কারাগারে থাকার পর জওহরলাল আলমোড়ার কারাগারে স্থানান্তরিত হইলেন। সেখানে শুনিলেন কমলার অসুখ বাড়িয়াছে, চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ভাওয়ালিতে আনা হইয়াছে। কিন্তু সেখানেও বিশেষ কোন সুফল না পাওয়ায়, কমলা স্বামীকে কারাগারে রাখিয়া য়ুরোপে চিকিৎসার জন্য যাইতে বাধ্য হইলেন। কমলা যখন ভাওয়ালিতে ছিলেন, তখন আলমোড়া হইতে জওহরলাল মাঝে মাঝে তাঁহাকে দেখিতে যাইতেন। তাহাও বন্ধ হইয়া গেল।
হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে (১৯৩৫) জওহরলাল কারামুক্ত হইলেন—কমলা নাকি মৃত্যুশয্যায়! আকাশপথে জওহরলাল জার্ম্মানী যাত্রা করিলেন, কারণ কমলা তখন জার্ম্মানী ব্যাডেনউইলার নামক নগরে ছিলেন।