কুড়ি

 য়ুরোপে আসিয়া রুগ্ন স্ত্রীর সেবার অবসরে জওহরলাল সাক্ষাৎভাবে সেই মহাদেশের ভিতর ও বাহির করিয়া দেখিয়া লইলেন। জগতের সমস্যার সহিত আলাদা করিয়া ভারতবর্ষকে দেখা, জওহরলালের কাছে অসার রাজনীতি। তিনি বরাবরই ভারতবর্ষকে জগৎ-সমস্যার একটা প্রধান অঙ্গরূপ দেখিয়া আসিয়াছেন এবং কংগ্রেস নীতিতে এই বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গী হইল তাঁহারই দান। তাই সেদিন য়ুরোপে বসিয়া য়ুরোপের সেই ভয়াবহ ক্ষুধিত মূর্ত্তি দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন।

 আবিসিনিয়ার উপর ইতালীর অত্যাচার, স্পেনে ইতালী এবং জার্ম্মানীর গোপন সাহায্যে, ফ্রাঙ্কোর অভ্যুত্থান—এই সমস্ত ব্যাপারের মধ্যে তিনি স্পষ্ট দেখিলেন, গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করিবার জন্য এক মহাসমরের দাবানল জ্বলিয়া উঠিয়াছে—সমগ্র য়ুরোপ এক বৃহৎ আগ্নেয়গিরির মুখের উপর বসিয়া আছে—এখনি অগ্ন্যুদ্‌গার হইবে এবং তাহার লাভাস্রোত ভারতের গায়েও আসিয়া লাগিবে—ভারতবর্ষকে সেই বিরাট সমস্যা সম্বন্ধে আগে হইতে সচেতন করিয়া তুলিবার জন্য, তাহাকে সেই বৃহৎ বিপদের যোগ্য করিয়া তুলিবার জন্য এক নূতন কর্ম্মপ্রেরণা তাঁহাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল—কিন্তু সেই সঙ্গে জীবনসঙ্গিনী কমলার কালব্যাধি তাঁহাকে আরও বিপন্ন করিয়া তুলিল—

 ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস—তখন তিনি কমলাকে লইয়া লুজান শহরে ভারতবর্ষ হইতে সংবাদ আসিল, জাতীয় কংগ্রেস তাঁহাকে পুনরায় সভাপতি নির্ব্বাচিত করিয়াছেন—

 তাঁহার দেশ তাঁহার স্বামীকে ডাকিতেছে অথচ তিনি তাঁহাকে তাঁহার রোগ-শয্যার পাশে ধরিয়া রাখিয়াছেন—মহীয়সী নারী যেন তাহা বুঝিতে পারিয়া তাঁহার স্বামীকে মুক্তি দিলেন ২৮শে ফেব্রুয়ারী বিদেশে ভারতমাতার প্রিয়-কন্যা দেহত্যাগ করিলেন!

 মৃতা-পত্নীর শবদেহ অন্তরে বহন করিয়া জওহরলাল ভারতের দিকে ফিরিলেন রাজনৈতিক কোলাহলের আড়ালে ব্যক্তিগত জীবনের সেই মহা-হাহাকার কোথায় তলাইয়া রহিল, কেহ দেখিল না!

 ফিরিবার পথে রোম পড়িল। লুজান ত্যাগ করিবার সময় বিশেষ রাজদূত মারফৎ জওহরলাল সংবাদ পাইলেন, মুসোলিনী তাঁহাকে রোমে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইয়াছেন। আবিসিনিয়ার অত্যাচার স্মরণ করিয়া জওহরলাল সে নিমন্ত্রণ ফিরাইয়া দিলেন।

 যে বিমান-পোতে তিনি ফিরিয়া আসিতেছিলেন, তাহা নিয়ম-অনুসারে রোমে থামিল। পোত হইতে নামিতেই জওহরলাল দেখিলেন, ইতালীর সর্ব্বময় কর্ত্তার প্রতিনিধি তাঁহার জন্য দাঁড়াইয়া। মুসোলিনী তাঁহার সহিত দেখা করিতে চান, তাই তাঁহাকে লইয়া যাইবার জন্য তিনি আসিয়াছেন। গণতন্ত্রের চিরউপাসক বীর যোদ্ধা সেই নিমন্ত্রণের গৌরব প্রত্যাখান করিলেন। কিন্তু রাজদূত কিছুতেই তাহা মানিবেন না। একঘণ্টা ধরিয়া তাঁহার সহিত বাদানুবাদ হইল। কিন্তু জওহরলাল মুসোলিনীর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করিয়াই চলিয়া আসিলেন। সেদিনকার সেই আমিই-জগতের-সব সেই মুসোলিনী হয়ত বুঝিয়াছিলেন, পরাধীন দেশেও স্বাধীন মানুষ জন্মায়!

 ভারতে ফিরিয়া আসিয়া জওহরলাল পূর্ণ উদ্যমে কংগ্রেসের কাজে আত্মনিয়োগ করিলেন, কিন্তু কয়েক মাস যাইতে না যাইতে তিনি দেখিলেন, তাঁহার সহিত তাঁহার সহকর্ম্মীদের কোথায় যেন মানসিক বিচ্ছেদ ঘটিয়া গিয়াছে ওয়ারকিং কমিটির সদস্যদের সহিত সাক্ষাৎ ভাবে তাঁহার মতবিরোধ ঘটিতে লাগিল।

 জাতীয় কাজের যে অংশ তিনি অধুনাকর্ত্তব্য বলিয়া জোর দিতে চান, তাহার সহকর্ম্মীদের মতে সে সব কাজ তত প্রয়োজনীয় বোধ হইল না। এই লইয়া তাঁহার সহিত তাঁহার সহকর্ম্মীদের একটা মানসিক বিরোধ ক্রমশঃ পাকিয়া উঠিল! তিনি স্থির করিলেন যে, কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করিবেন। কিন্তু পরে ভাবিয়া দেখিলেন যে, যদি তিনি এই সময় সভাপতিত্ব ত্যাগ করেন, তাহা হইলে সেই ব্যাপার লইয়া শত্রুপক্ষ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য্যের সুযোগ পাইবে। অগত্যা তিনি এক বৎসর কাল সেই দায়িত্ব বহন করিলেন!

 সেই সময় সহসা ভারতবর্ষে নূতন স্বায়ত্ত-শাসনবিধানের ফলে কিঞ্চিৎ প্রাণসঞ্চার হইল। কংগ্রেস নূতন শাসন-তন্ত্রে যোগদান করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিল। ব্যক্তিগতভাবে জওহরলাল কংগ্রেসের এই নূতন ব্যবস্থার মধ্যে স্বাধীনতা- লাভের কোন সুযোগই দেখিতে পাইলেন না, তবুও তিনি, যখন সাধারণ নির্ব্বাচনের সময় আসিল, তখন পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। তাহার কারণ তিনি লিখিয়াছেন, “ভোট সংগ্রহের ব্যাপারে দেশের জনসাধারণের সঙ্গে যে সাক্ষাৎ পরিচয় হইবে, আমার জীবনে আমি তাহাকে খুব মূল্যবান বলিয়া মনে করিলাম।”

 এই নির্ব্বাচন উপলক্ষে জওহরলাল ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত যে রকম বিরামবিশ্রামহীন ভাবে পর্য্যটন করিয়া বেড়ান, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই! এই বিরাট কাজের তিনি একটা আঙ্কিক চিত্র দিয়াছেন, চার মাসের মধ্যে তিনি চল্লিশ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করিয়াছিলেন, এবং এমন যান নাই, যাহা ব্যবহার করেন নাই—এরোপ্লেন, রেল, মোটর, লরী, ঘোড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, সাইকেল, বোট, ঘোড়ার পিঠে, হাতীর পিঠে, উটের পিঠে এবং পায়ে হেঁটে - প্রতিদিন কমপক্ষে অন্ততঃ বারোটী করিয়া সভায় বক্তৃতা দিতে হইয়াছে—এবং এই সমস্ত সভায় কম পক্ষে অন্তত এক কোটী লোক সমবেত হইয়াছে এবং সমগ্র পরিভ্রমণের মধ্যে সাক্ষাৎ ভাবে অন্তত কয়েক লক্ষ লোকের সহিত পরিচিত হইয়াছেন—