দুই

 বালক জওহরলালের শিক্ষার জন্য মতিলাল মেম সাহেব নিযুক্ত করিলেন। ইংরেজ গভর্নেসের কাছে বালক প্রথম শিক্ষা গ্রহণ করেন। পিতার ইংরেজ বন্ধুদের তিনি দু'বেলাই দেখিতেন।

 জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইংরেজদের দেখিয়াছেন, তাহাদের সহিত উঠিয়াছেন, বসিয়াছেন— স্বভাবতই বালকের মনে তাই ইংরেজ-প্রীতি ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে বাড়ীর সকলের অগোচরে, বালকের বন্ধু—মহলে এমন একটা বিষয় লইয়া তাহারা সেই শিশুকালেই আলোচনা করিত, যাহার সহিত ইংরেজ প্রীতির কোন যোগ ছিল না।

 জওহরলাল যদিও পিতার একমাত্র পুত্র, তবুও তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, এক সুবৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে। সে পরিবারে তাঁহার সমবয়সী বা দু'এক বৎসরের বড়, অনেক খুড়তুতো জাঠতুতো ভাই ছিল। তাহাদের সকলকে লইয়া ছিল বালকের বন্ধুমহল।

 সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করিবার জন্য তিনি অনেক সুখ পাইয়াছিলেন, যাহা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা পায় না—কিন্তু তেমনি বালককালের একটা সুখ হইতে তিনি বঞ্চিত হইয়াছিলেন—সেটা হইল, বাড়ীর বাহিরে বিপুল পৃথিবীর ছেলেমেয়েদের সহিত খেলা করা, তাহাদের সহিত মিলিয়া মিশিয়া হল্লা করা, গাছে চড়া—বালককালের হাজার রকমের দুষ্টামি!

 সেইজন্য ছেলেবেলা হইতেই তিনি ছিলেন ভাবুক —তাহার দলবল লইয়া নানারকমের গুরুগম্ভীর বিষয় আলোচনা করিতেন—একটা বিষয় বিশেষ করিয়া সদাসর্ব্বদাই তাহার মনে খেলা করিত, তাহা হইল ইংরেজদের সহিত আমাদের অর্থাৎ ভারতবর্ষীয় লোকদের সম্পর্ক।

 বাড়ীর ভিতর বালক দেখিতেন, বড় বড় সব ইংরেজ তাঁহার বাবা বা কাকা বা জ্যাঠার সহিত সমান ভাবে উঠিতেছে, বসিতেছে, বন্ধুর মত ব্যবহার করিতেছে, নিজের ইংরেজ গভর্নেস হাত পাতিয়া তাঁহার পিতার নিকট হইতে মাহিনা লইতেছে, কিন্তু বাহির হইতে যে সব গল্প সেই বালক-মহলে উড়িয়া আসিত, তাহাতে বালকের মনে ইংরেজ জাতির প্রতি এক তীব্র ঘৃণা জাগিয়া উঠিত।

 সে-সময় পার্কে ইংরেজদের বসিবার জন্য বেঞ্চ আলাদা করা থাকিত, ‘নেটিভ’ লোকেরা সেখানে বসিতে পারিত না। বড় বড় পার্কে এমন সব জায়গা থাকিত, যেখানে নেটিভ লোকেরা ঢুকিতে পর্য্যন্ত পাইত না।

 রেলে ইংরেজদের জন্যে আলাদা কামড়া! ভিড়ের দরুণ কোন নেটিভ যদি সেখানে ঢুকিতে যাইত, তাহা হইলে তাঁহাকে অপমান করিয়া বাহির করিয়া দেওয়া হইত। এমন কি রাস্তায় প্রস্রাব কবিবার জায়গাতেও য়ুরোপীয়দের আলাদা বন্দোবস্ত!

 এই সব ব্যাপারে প্রতিপদে আমাদের বুঝাইয়া দেওয়া হইত যে, আমরা পরাধীন, ইংরেজদের দাস—ইংরেজরা আমাদের মনিব, রাজার জাতি, উচ্চস্তরের লোক।

 বালক যখন এই সব ব্যাপার শুনিতেন, তখন এত যে ইংরেজ-প্রীতি, তাহা সত্ত্বেও, তাঁহার মনের ভিতর কি একটা নিদারুণ রাগ গর্জিয়া গর্জিয়া উঠিতমনে হইত, তাঁহার দলবল লইয়া গিয়া তখনি এই নিদারুণ অপমানের প্রতিশোধ তিনি গ্রহণ করেন— মাঝে মাঝে যখন তিনি সংবাদ পাইতেন যে, অমুক ভারতবর্ষীয় রেলে দু'জন ইংরেজ সৈনিকের বেয়াদপীর যোগ্য-প্রত্যুত্তর দিয়াছে, তখন গর্ব্বে বালকের মন ফুলিয়া উঠিত, মনে হইত, এখনি ছুটিয়া গিয়া সেই লোককে তাহার অন্তরের শ্রদ্ধা জানান!

 সন্ধ্যাবেলায় বাড়ীতে মজলিস বসিত। বাহির হইতে মতিলালের বন্ধুগণ সেই আড্ডায় যোগদান করিতেন। বাড়ীর ছেলেদের স্বভাবতই সেখানে থাকিবার উপায় ছিল না। কিন্তু জওহরলালের মনে নিদারুণ কৌতূহল জাগিয়া উঠিত, এই সব বড় বড় লোকেরা কি লইয়া আলোচনা করিতেছে —

 কৌতূহল নিবারণ করিতে না পারিয়া অনেক সময় বালক দরজায় কাণ পাতিয়া তাহাদের কথাবার্ত্তা শুনিতে চেষ্টা করিতেন—সেই অবস্থায় অনেকবার ধরাও পড়িয়া গিয়াছেন—এবং চুরি করিয়া অপরের কথা শোনার দরুন তাঁহাকে শাস্তিও ভোগ করিতে হইয়াছে।

 এই সম্পর্কে একবার এক মজার ব্যাপার ঘটে আগেই বলিয়াছি, পণ্ডিত মতিলাল পূরাপূরি বিলাতী জীবন-ধারণের আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাই সান্ধ্য-ভোজে বাড়ীতেই বন্ধু-বান্ধবদের সহিত বিলাতী রীতি অনুযায়ী তিনি সুরা গ্রহণ করিতেন। ক্লারেট নামে এক রকম মিষ্ট সুরা আছে। তাহার রঙ রক্তের মত গাঢ় লাল।

 একদিন বালক জওহরলাল লুকাইয়া বড়দের আসরের কথাবার্তা শুনিতেছেন, এমন সময় হঠাৎ তাঁহার নজর পড়িল যে, তাঁহার পিতার গ্লাসে রক্তের মত লাল কি রহিয়াছে। গ্লাসে এত রক্ত কোথা হইতে আসিল? বালক ভাবিয়াই আকুল। এমন সময় বালক জওহরলাল দেখিলেন যে, তাঁহার পিতা সেই রক্তের গ্লাস মুখে তুলিয়া হাসিতে হাসিতে খাইয়া ফেলিলেন। ভয়ে, বিস্ময়ে বালক আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না। তাড়াতাড়ি ছুটিয়া একেবারে অন্দরমহলে জননীর কাছে গিয়া বালক ভীত-উৎকণ্ঠিত-কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, মা, মা, বাবা রক্ত খাচ্ছেন?

 জওহরলালের তখন সাত-আট বৎসর বয়স হইবে। ব্যায়ামের জন্য পণ্ডিত মতিলাল পুত্রের ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। একজন অবসর প্রাপ্ত সৈনিককে সেইজন্য মাহিনা দিয়া রাখিয়াছিলেন। তাহার কাজ ছিল, প্রত্যহ সকালে এবং বিকালে বালক জওহরলালকে ঘোড়ায় চড়াইয়া বেড়াইয়া আনা। বালক ঘোড়ায় চড়িয়া যাইতেন আর সেই সৈনিকটী তাহার পাশে পাশে যাইত। এই ব্যবস্থা বালকের আদৌ পছন্দ ছিল না। তিনি নিজের ইচ্ছামত ঘোড়া চালাইবেন, ঘোড়া টগ্‌বগ্‌ করিয়া ছুটিবে—তবে তো আনন্দ! কিন্তু সে আনন্দ উপভোগ করিবার কোন উপায়ই ছিল না। সৈনিকটী শত মিনতি সত্ত্বেও এক মুহূর্ত্তের জন্য পাশছাড়া হইত না।

 একদিন বিকেলবেলায় পণ্ডিত মতিলাল বাড়ীর সংলগ্ন টেনিস-কোর্টে বন্ধু-বান্ধবদের লইয়া খেলায় মত্ত। সেই অবসরে আস্তাবলে গিয়া বালক দেখিল, পিতার আরব-ঘোড়াটী লাগামশুদ্ধ সুসজ্জিত রহিয়াছে এবং নিকটে কেউ কোথাও নাই ।

 এদিক ওদিক চাহিয়া বালক যখন বুঝিলেন যে, তাঁহাকে কেহই লক্ষ্য করিতেছে না, তখন তিনি আস্তে আস্তে আস্তাবল হইতে ঘোড়াটীকে বাহির করিলেন এবং তাহার পিঠে চড়িয়া বাড়ী হইর্তে বাহির হইয়া পড়িলেন। কেহই তাঁহাকে লক্ষ্য করিল না। রাস্তায় আসিয়া বালক মনের সাধে ঘোড়া ছুটাইলেন। কিন্তু বেয়াদপ ঘোড়াটী কিছুদূর ছুটিয়াই বালক আরোহীকে পিঠ হইতে ফেলিয়া দিল।

 এধারে বাড়ীতে হঠাৎ সকলের নজরে পড়িল যে, জওহরলাল বাড়ীতে নাই এবং সেই সঙ্গে আস্তাবলে ঘোড়াটাও নাই। তখন চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, সর্ব্বাঙ্গে ধূলা মাখিয়া বালক ফটক দিয়া প্রবেশ করিতেছেন, তাঁহার ভঙ্গী দেখিয়া অবশ্য কেহই অনুমান করিতে পারিত না যে, কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে, বরঞ্চ বালকের ভঙ্গী দেখিয়া মনে হইল যে, তিনি এইমাত্র ওয়াটার্‌লুর যুদ্ধ জয় করিয়া যেন ফিরিতেছেন!