বাইশ

 ভারতে ফিরিয়া আসিয়া জওহরলাল নিরাশায় একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন।

 একদিকে, মোসলেম লীগের অধীনে জিন্না, ভারতের মুসলমানদের এই দেশের ভূগোলের মধ্য হইতে এক কাল্পনিক দ্বিতীয় মুসলমানী ভারতভূমি আবিষ্কার করিয়া সেই পথহীন পথে তাহাদের তাড়াইয়া লইয়া চলিতেছেন—অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস হইতে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া “ফরোয়ার্ড ব্লক” নামে এক নূতন দল গঠন করিয়া তাহার প্রচারকার্যে ভারতের একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।

 এহেন অবস্থায় জওহরলাল কংগ্রেস-রাজনীতি হইতে নিজেকে পৃথক করিয়া লইয়া জাতীয়-সংগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করিলেন—এবং তাহার জন্য একটা স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান গঠন করিলেন, এবং তাহার নাম দিলেন, ন্যাশন্যাল প্লানিং কমিটী।

 ইতিমধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ভারতবর্ষের সীমান্তে আসিয়া পৌঁছাইল—এই যুদ্ধে সর্ব্ব-মনপ্রাণ দিয়া যোগদান করিবার আগে, কংগ্রেস বৃটীশ-গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে এই যুদ্ধে তাঁহাদের লক্ষ্য কি স্পষ্ট করিয়া জানিতে চাহিলেন।

 পূর্ণ স্বাধানতার আশ্বাস ব্যতীত ভারতবর্ষ এই যুদ্ধে যোগদান করিতে পারে না—কিন্তু সে আশ্বাস যখন বৃটীশ গভর্ণমেণ্টের নিকট পাওয়া গেল না, তখন কংগ্রেস মন্ত্রীরা পদত্যাগ করিলেন।

 মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের কর্ত্তব্য-নির্দ্ধারণের জন্য ওয়ারর্কিং কমিটীর অধিবেশন আহ্বান করিলেন—এবং পুনরায় কংগ্রেসের সহিত আমলাতন্ত্রের এক বিরাট সংঘর্ষের সম্ভাবনা ঘনাইয়া আসিল।

 কিন্তু কংগ্রেস কোন আন্দোলন আরম্ভ করিবার পূর্ব্বেই মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ কংগ্রেস নেতারা পুনরায় কারারুদ্ধ হইলেন। সেই সঙ্গে জওহরলালও অনির্দিষ্ট কালের জন্য পুনরায় কারাতীর্থে প্রবেশ করিলেন—

 প্রায় তিন বৎসর কাল কারাবাসের পর ১৯৪৫ সালের জুন মাসে তিনি পুনরায় কারামুক্ত হইলেন।

 সেই সময় দেশে এক নূতন আকাশ হইতে এক নূতন গ্রহের আলো আসিয়া পড়িয়াছে। সুভাষচন্দ্রের ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্ম্মির কীর্ত্তি ও বীরত্বের কথা প্রত্যেক ভারতবাসীর চেতনায় এক নূতন আশার সম্ভাবনা জাগাইয়া তুলিয়াছে। ভারত-সরকার অবরুদ্ধ আই-এন্‌-এর সেনা-নায়কদের বিচারের জন কোর্ট মার্শাল বসাইলেন।

 দেশবাসী ও কংগ্রেসের পক্ষ হইতে জওহরলাল এই স্বদেশের মুক্তিকামী বীর পুরুষদের মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন সুরু করিলেন। এই সময় ভারতের একপ্রান্ত হইতে আর একপ্রান্ত পর্যন্ত স্তিমিত জাতীয় চেতনা এই একটী লোকের কণ্ঠে যেন নব-জীবন লাভ করিল। বিরাট ফুৎকারে উপরের পুঞ্জীভূত ভস্মস্তূপ সরাইয়া ফেলিয়া জওহরলাল ধূমায়মাণ অগ্নিকণাকে আবার অগ্নিশিখায় পরিণত করিলেন। সমগ্র জাতি একটা বৈপ্লবিক চেতনায় জাগ্রত হইয়া উঠিল।

 অপূর্ব্ব কর্ম্মতৎপরতায় জওহরলাল বন্দীবীরদের পক্ষ সমর্থনের জন্য দেশের শ্রেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্ঘবদ্ধ করিলেন এবং বহুদিন পরে তিনি পুনরায় আবার বহুদিন উপেক্ষিত ব্যারিষ্টারের পোষাক অঙ্গে ধারণ করিলেন।

 এই বিচারের ফলে দেশের মধ্যে যে গণ-চেতনা জাগিয়া উঠিল, জওহরলাল তাহার পূর্ণ সুযোগ লইয়া কংগ্রেস আন্দোলনকে চরমতার সর্ব্বোচ্চ শিখরে আনিয়া তুলিলেন। মহাত্মা গান্ধী দুইটী কথায় এই জাগ্রত চেতনাকে রূপ দিলেন ‘ভারত ছাড়।’

 এই ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ বৃটিশ গভর্ণমেণ্ট ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দিবার প্রস্তাবকে স্বীকার করিয়া লইল এবং ভারতবর্ষে মন্ত্রি মিশন প্রেরিত হইল।

 এই মিশনের সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের শাসনতন্ত্র গঠন করিবার জন্য কনষ্টিটুয়েণ্ট এসেম্বলী গঠিত হইল এবং বড়লাটের পুরাতন মন্ত্রিসভা ভাঙ্গিয়া দিয়া জনগণের প্রতিনিধিদের লইয়া নূতন মন্ত্রিসভা গঠিত হইল। এই নূতন মন্ত্রিসভায় জওহরলাল প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্বের সঙ্গে পররাষ্ট্র-সচিবের পদ গ্রহণ করিলেন।

 এক বৎসরের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিবরূপে তিনি সমগ্র বহির্জগতের সঙ্গে নব জাগ্রত ভারতবর্যের একটা রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্পর্ক গড়িয়া তুলিলেন। ঐন্দ্রজালিকের মত তৎপরতায় তিনি বাহির বিশ্বে ভারতের প্রাধান্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া ফেলিলেন এবং সেই সঙ্গে এশিয়ার আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংগঠনের দ্বারা জগতের দৃষ্টি ভারতের উপর নিবদ্ধ করাইলেন।

 জগতের সঙ্গে আত্মমর্য্যাদার যে সূত্র ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল, এক বৎসরের মধ্যে জওহরলাল সেই ছিন্ন সূত্রকে অপূর্ব্ব কৌশলে পুনরায় গাঁথিয়া তুলিয়াছিলেন।

 তাই আজ জগৎ ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতীয়রাষ্ট্রের সভাপতিরূপে তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে।

স মা প্ত