জওহরলাল/সতের
সতের
বহুদিনের বহু পরিশ্রমের ফলে জওহরলালের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িল। ডাক্তারেরা বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন— কারাগারে গিয়া বিশ্রাম নয়-কারাগারের বাহিরে বিশ্রাম— ভারতের বাহিরে এবং ভারতের নিকটেই সিংহলেই বিশ্রামের জন্য যাওয়ার ব্যবস্থা হইল। প্রিয় কন্যা ইন্দিরাকে সঙ্গে লইয়া সস্ত্রীক তিনি সিংহলে যাত্রা করিলেন। সিংহল হইতে ফিরিবার পথে ট্রাভানকোর, কোচিন, মহীশূর, মালাবার, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি নেটিভ ষ্টেট পরিভ্রমণ করিয়া তিনি আবার এলাহাবাদে ফিরিয়া আসিলেন।
এলাহাবাদে ফিরিয়া আসিয়া জওহরলাল যুক্তপ্রদেশের কৃষাণদের ব্যাপার লইয়া কাজে নামিলেন। রাজনৈতিক দিক হইতে তখন কংগ্রেসের পক্ষ হইতে প্রায় সব আন্দোলনই বন্ধ রাখা হইয়াছিল, কারণ বিলাতে তখন রাউণ্ড টেবিল কনফারেন্সের অধিবেশন চলিতেছিল। কংগ্রেসের প্রতিনিধিরূপে গান্ধীজি উক্ত কন্ফারেন্স যোগদান করেন। সুতরাং গান্ধীজির ফিরিয়া আসা পর্যন্ত কংগ্রেসের আন্দোলন এক রকম বন্ধই ছিল। দিল্লীতে লর্ড আরউঈনের সহিত গান্ধীজির সেই মর্ম্মে,চুক্তি হইয়াছিল।
বহুদিন হইতে দুইটী দেশ বিশেষভাবে জওহরলালকে আকর্ষণ করিতেছিল, একটী হইল, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, তার একটী হইল বাংলা দেশ। ১৯৩১ সালের শেষের দিকে জওহরলাল বাংলা দেশে আসেন। কিন্তু বাংলা দেশের রাজনীতি তখন দুই পরস্পর বিরোধী দলের পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন কুৎসিৎ হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহার মধ্যে কাহারও কিছু করা সম্ভব নয়। জওহরলাল দেখিলেন তাঁহ'র মধ্যস্থতায় কোন উপকার হইবে না, তাই বাংলা দেশে আসিয়া সভা সমিতি করিয়া, লোকজনের সঙ্গে দেখা করিয়া তিনি ফিরিয়া গেলেন।
তখন যুক্ত প্রদেশের কৃষাণ আন্দোলনকে দমন করিবার জন্য সরকার রুদ্রনীতি অবলম্বন করিল। রাউণ্ড টেবিলের কাজ সারিয়া গান্ধীজি তখন দেশে ফিরিতেছিলেন, সেইজন্য বোম্বাই-শহরে তখন কংগ্রেসনেতারা সমবেত হইতেছিলেন। জওহরলালও বোম্বাইতে উপস্থিত হইলেন—কিন্তু যুক্ত-প্রদেশের আন্দোলন তখন এমন তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল যে, তিনি বোম্বাইতে আর থাকিতে পারিলেন না। কমলা তখন অত্যন্ত অসুস্থ। সেই অবস্থায় তাঁহাকে বোম্বাইতে রাখিয়া জওহরলাল যুক্ত-প্রদেশে ফিরিয়া আসিলেন এবং কৃষাণ-আন্দোলন যাহাতে স্বতন্ত্রভাবে একটা সার্থকতা লাভ করে, তাহার আয়োজন করিতে লাগিলেন।
কিন্তু যুক্ত-প্রদেশে প্রবেশ করিয়া তিনি পদে পদে গভর্ণমেণ্টের অর্ডিনান্স দ্বারা ব্যাহত হইতে লাগিলেন। এলাহাবাদে ফিরিয়া আসিলে, স্থানীয় ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁহাকে জানাইলেন যে, তিনি কোন সভায় যোগদান করিতে পারিবেন না- প্রকাশ্যভাবে কিছু বলিতে বা লিখিতে পারিবেন না—এমন কি খবরের কাগজেও কোন বিবৃতি দিতে পারিবেন না। এই আদেশ পাইয়া জওহরলাল তৎক্ষণাৎ ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবকে লিখিয়া জানাইলেন যে, তিনি কি করিবেন বা না করিবেন, সে সম্বন্ধে মতামত তাঁহার নিকট হইতে লইবার কোন প্রয়োজন তাঁহার নাই। আপাতত মহাত্মা গান্ধী বোম্বাইতে আসিতেছেন—তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করার তাঁহার প্রয়োজন আছে-এবং তিনি তাহা করিবেন। ম্যাজিষ্ট্রেটকে এইভাবে উত্তর দিয়া জওহরলাল মিঃ শের্ওয়ানীকে লইয়া গান্ধীজির সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য বোম্বাই যাত্রা করিলেন। রেলষ্টেশনে তাঁহাকে কেহই আটকাইল না। ইরাদগঞ্জ ষ্টেশনে বম্বাই মেল থামিয়া গেল। জওহরলাল যে কামরায় ছিলেন, সে কামরায় একজন পুলিশ কর্ম্মচারী উঠিয়া আসিলেন এবং ওয়ারেণ্ট দেখাইয়া তাঁহাদের দুইজনকে গ্রেফতার করিলেন। রেল লাইনের পাশে একখানি বৃহৎ মোটর গাড়ী অপেক্ষা করিতেছিল। সেই মোটরে করিয়া তাঁহারা আবার ফিরিয়া আসিলেন, সেই নয়নী-জেলে।
কারাগারে থাকিয়া জওহরলাল শুনিলেন যে, গান্ধীজির দেশে ফিরিয়া আসিবার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস আন্দোলন আবার পূর্ব্বেকার রূপ গ্রহণ করে এবং তাহার ফলে নূতন বড়লাট নূতন পব অর্ডিনান্স জারী করিয়াছেন এবং গান্ধীজি ও সর্দার বল্লভভাই পুনরায় কারারুদ্ধ হইয়াছেন—সারা দেশের মধ্যে অর্ডিনান্সের বেড়াজাল পড়িয়া গিয়াছে—এবং কংগ্রেসকে বে-আইনী সঙ্ঘ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে—আবার দলে দলে কংগ্রেস নেতারা কারাগারে আসিয়া ভর্ত্তি হইতে লাগিলেন। বিচারে শেরওয়াণীর ছয়মাস কারাদণ্ড হইল কিন্তু সেই একই অপরাধে জওহর লালের পুনরায় দুই বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হইল। কমলা তখন বম্বাইতে রোগ-শয্যায় শায়িত। জওহরলালের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অধিকাংশই একে একে জেলে চলিয়া আসিতে লাগিলেন, ভাই, ভগ্নিপতি, বোন—জওহরলালের বৃদ্ধা জননী রাস্তায় পুলিশ কর্তৃক প্রহৃত হইলেন—তাহার মাথা ফাটিয়া রক্ত বাহির হইয়া তিনি জ্ঞানশূন্য হইয়া রাস্তায় পড়িয়া রহিলেন। বহুক্ষণ সেইভাবে সংজ্ঞাহীন হইয়া থাকার পর এক পুলিশ কর্ম্মচারী তাঁহাকে তুলিয়া আনন্দভবনে রাখিয়া যায় ।
জেলের ভিতর যখন জওহরলাল তাহার সম্বন্ধে এই সংবাদ গাইলেন, তখন এক নিদারুণ বেদনায় তাঁহার মন ভরিয়া উঠিল, এই সম্পর্কে তাঁহার আত্মচরিতে তিনি লিখিতেছেন—“ঘটনার কয়েকদিন পরে জেলের ভিতর যখন সংবাদ পাইলাম যে, আমার বৃদ্ধা তনুদেহ জননী পুলিশের প্রহারে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় রাস্তার ধারে পড়িয়াছিলেন, তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, যদি আমি তখন সেখানে উপস্থিত থাকিতান, জানি না কি ভাবে তাহা গ্রহণ করিতাম, জানি না, অহিংস-নীতি তখন কতদূর আমাকে আটকাইয়া রাখিতে পারিত, হয়ত বারো বৎসর ধরিয়া যাহা বহু বেদনায় শিক্ষা করিয়াছিলাম, একমুহূর্ত্তে তাহা ভুলিয়া যাইতাম, ভুলিয়া যাইতাম, তাহার জন্য আমার বা আমার জাতির কি ক্ষতি বা লাভ হইত—”
একমাস পরে মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় জওহরলালের জননী কারাগারে পুত্রের সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। মাথায় সেই ব্যাণ্ডেজ, গর্ব্বের চিহ্নের মত বীর-জননী পুত্রকে দেখাইলেন। তাঁহার পরম গর্বের বিষয় যে, তাঁহার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তিনি আঘাত বণ্টন করিয়া লইতে পারিয়াছেন!
বীর জননীর গর্ব্বে পুত্র কি সেদিনের লাঞ্ছনার জ্বালা ভুলিয়া গিয়াছিলেন?