তিন

কয়েক বৎসর কাটিয়াছে।

 শ্যামা এখন তিনটি সন্তানের জননী। বড়খােকার দু'বছর বয়সের সময় তাহার একটি মেয়ে হইয়াছে, তার তিন বছর পরে আর একটি ছেলে। নামকরণ হইয়াছে তিনজনেরই—বিধানচন্দ্র, বকুলমালা ও বিমানবিহারী। এগুলি পােষাকি নাম। এ ছাড়া তিনজনের তিনটি ডাকনামও আছে, খােকা, বুকু ও মণি।

 ওদের মধ্যে বকুলের স্বাস্থ্যই আশ্চর্য রকমে ভাল। জন্মিযা অবধি একদিনের জন্য সে অসুখে ভােগে নাই। মােটা মােটা হাত পা, ফোলা ফোলা গাল,—দুরন্তের একশেষ। শ্যামা তাহার মাথার চুলগুলি বাব্‌রি করিয়া দিয়াছে। খাটো জাঙ্গিয়া-পরা মেয়েটি যখন একমুহূর্ত স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া ঝাঁকড়া চুলের ফাঁক দিয়া মিটমিট করিয়া তাকায়, দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। বুকুর রঙও হইয়াছে বেশ মাজা। রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাতে তাহার মুখখানা জ্বলজ্বল করে, ধূসব সন্ধ্যায় স্তিমিত হইয়া আসে—সারাদিনের বিনিদ্র দুবন্তপনার পর নিদ্রাতুর চোখ দুটির সঙ্গে বেশ মানায়। কিন্তু দেখিবার কেহ থাকে না। শ্যামা রান্না করে, শ্যামার কোল জুড়িয়া থাকে ছােট খােকামণি। বুকু পিছন হইতে মার পিঠে বুকের ভর দিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। মার কাঁধেr উপর দিয়া ডিবরির শিখাটির দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে তাহার চোখ বুজিয়া যায়। শ্যামা পিছনে হাত চালাইয়া তাহাকে ধরিয়া রাখিয়া ডাকে, খোকা, অ খােকা!

 বিধান আসিলে বলে, ভাইকে কোলে নিয়ে বােসো তাে বাবা, বুকুকে শুইয়ে দিয়ে আসি।

 বিধানের হাতে খড়ি হইয়া গিয়াছে, এখন সে প্রথমভাগের পাঠক। ছেলেবেলা হইতে লিভার খারাপ হইয়া শরীরটা তাহার শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, মাঝে মাঝে অসুখে ভােগে। মুখখানি অপরিপুষ্ট ফুলের মত কোমল। শরীর ভাল না হােক ছেলেটার মাথা হইয়াছে খুব সাফ। বুলি ফুটিবাব পর হইতেই প্রশ্নে প্রশ্নে সকলকে সে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে, জগতের দিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া তাহার শিশু-চিত্তে যে সহস্র প্রশ্নের সৃষ্টি হয় প্রত্যেকটির জবাব পাওযা চই। মনোজগতে সে দুর্জ্ঞেয় রহস্য থাকিতে দিবে না—তাহার জিজ্ঞাসার এই সীমা নাই। সবজান্তা হইবার জন্য তাহার এই ব্যাকুল প্রয়াসে সবজান্তারা কখনাে হাসে কখনাে বিরক্ত হয়। বিবক্ত বেশি হয় শীতল। বিধানের গােটা দশেক কেনর জবাব দিয়া পরবর্তী পুনরাবৃত্তিতে সে ধমক লাগায়। শ্যামাব ধৈর্য অনেকক্ষণ বজায় থাকে। অনেক সময় হাতের কাজ করিতে করিতে যা মনে আসে জবাব দিয়া যায়, সব সময় খেয়ালও থাকে না কি বলিতেছে। বিধানেব চিন্তাজগত মিথ্যায় ভরিয়া ওঠে মনে তাহার বহু অসত্যের ছাপ লাগে।

 দিনের মধ্যে এমন কতগুলি প্রহর আছে শ্যামাকে যখন যাচিয়া ছেলেব মুখে মুখরতা আনিতে হয়। বিধান মাঝে মাঝে গম্ভীর হইয়া থাকে। গভীব অন্যমনস্কতায় ডুবিয়া গিয়া সে স্থির হইয়া বসিয়া থাকে, চোখ দুটি উদাসীন হইয়া যায়। স্প্রিংএর মােটরটি পাশে পডিয়া থাকে, ছবির বইটির পাতা বাতাসে উল্টাইয়া যায়, সে চাহিয়া দেখে না। ছেলের মুখ দেখিয়া শ্যামার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া ওঠে। যেন ঘুমন্ত ছেলেকে ডাকিয়া তুলিতেছে এমনিভাবে সে ডাকে, খােকা, এই খােকা!

 উঁ?

 আয় তাে আমার কাছে। দ্যাখ তোর জন্যে কেমন জামা করছি।

 বিধান কাছেও আসে, জামাও দ্যাখে কিন্তু তাহার কোন রকম উৎসাহ দেখা যায় না।

 শ্যামা উদ্বিগ্ন হইয়া বলে, কি ভাবছিস রে তুই? কার কথা ভাবছিস?

 কিছু ভাবছি না তো!

 মোটরটা চালা না খোকা, মণি কেমন হাসবে দেখিস্।

 বিধান মোটরে চাবি দিয়া ছাড়িয়া দেয়। মোটরটা চক্রাকারে ঘুরিয়া ওদিকের দেয়ালে ঠোক্কর খায়। শ্যামা নিজেই উচ্ছ্বসিত হইয়া বলে, যাঃ, তোর মোটরের কলিশন হয়ে গেল! বিধান বসিয়া থাকে, খেলনাটিকে উঠাই আনিবার স্পৃহা তাহার দেখা যায় না। সেলাই বন্ধ করিয়া শ্যামা ছুঁচটি কাপড়ে বিঁধাইয়া রাখে। বিধানের হঠাৎ এমন মনমরা হইয়া যাওয়ার কোন কারণই সে খুঁজিয়া পায় না। বুড়ো মানুষের মত একি উদাস গাম্ভীর্য অতটুকু ছেলের?

 খিদে পেয়েছে তোর?

 বিধান মাথা নাড়ে।

 তবে তোর ঘুম পেয়েছে খোকা। আয় আমবা শুই।

 ঘুম পায় নি তো!

 ওবে দুর্জ্ঞেয়, তবে তোর হইয়াছে কি!

 তবে চল, ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনি।

 সিঁড়িতে ছাদে শ্যামা অনর্গল কথা বলে। বিধানের জীবনে যত কিছু কাম্য আছে, জ্ঞানপিপাসার যত কিছু বিষয়বস্তু আছে, সব সে তাহার মনে পড়াইয়া দিতে চায়। ছেলের এই সাময়িক ও মানসিক সন্ন্যাসে শচীমাতার মতই তাহার ব্যাকুলতা জাগে। কাপড় তুলিয়া কুঁচাইয়া সে বিধানের হাতে দেয়। বিধান কাপড়গুলি নিজের দুই কাঁধে জমা করে। কাপড় তোলা শেষ হইলে শামা আলিসায় ভর দিয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া বলে, কুল্পিবরফ খাবি খোকা?

 এমনি ভাবে কথা দিয়া পূজা করি, কুপিববফ ঘুষ দিয়া শ্যামা ছেলের নীরবতা ভঙ্গ করে।

 বিধান জিজ্ঞাসা করে, কুল্পিবরফ কি করে তৈরি করে মা?

 শ্যামা বলে, হাতল ঘোরায় দেখিস নি? বরফ বেটে চিনি মিশিয়ে ওর ওই যন্ত্রটার মধ্যে রেখে হাতল ঘোরায়, তাইতে কুল্পিবরফ হয়।

 চিনি তো সাদা, রঙ কি করে হয়?

 একটু রঙ মিশিয়ে দেয়।

 কি রঙ দেয় মা? আলতার রঙ?

 দূর! আলতার রঙ বুঝি খেতে আছে? অন্য রঙ দেয়।

 কি রঙ?

 গোলাপ ফুলের রঙ বার করে নেয়।

 গোলাপ ফুলের রঙ কি কবে বার করে মা?

 শিউলী বোঁটার রঙ কি করে বার করে দেখিস নি?

 সেদ্ধ করে না?

 হ্যাঁ।

 তুমি আলতা পর কেন মা?

 পরতে হয় রে, নইলে লোকে নিন্দে করে যে।

 কেন?

 এ কেনর অন্ত থাকে না।

 বিধানের প্রকৃতির আর একটা অদ্ভুত দিক আছে, পশুপাখির প্রতি তার মমতা ও নির্মমতার সমন্বয়। কুকুর বিড়াল আর পাখিব ছানা পুষিতে সে যেমন ভালবাসে, এক এক সময় পোষা জীবগুলিকে সে তেমনি অকথ্য যন্ত্রণা দেয়। একবার সন্ধ্যার সমত ঝড় উঠিলে একটি বাচ্চা শালিখ পাখি বাড়ির বারান্দায় আসিয়া পড়িয়াছিল। বিধান ছানাটিকে কুড়াইয়া আনিয়াছিল। আঁচল দিয়া পালক মুছিয়া, লণ্ঠনের তাপে সেক দিয়া তাহাকে বাঁচাইয়াছিল শ্যামা। পরদিন খাঁচা আসিল। বিধান নাওয়া খাওয়া ভুলিয়া গেল। ক্ষুদ্র বন্দী জীবটি যেন তাহারই সম্মানীয় অতিথি। হরদম ছাতু ও জল সরববাহ করা হইতেছে, বিধানের দিন কাটিতেছে খাঁচার সামনে। কি তাহার গভীর মনোযোগ, কি ভালবাসা। অথচ কয়েকদিন পবর, এক দুপুরবেলা পাখিটিকে সে ঘাড় মটকাইয়া মারিয়া রাখিল। শ্যামা আসিয়া দেখে মরা পাখির ছানাটিকে আগলাইয়া বিধান যেন পুত্রশোকেই আকুল হইয়া কাঁদিতেছে।

 ও খোকা, কি করে মরল বাবা, কে মারলে?

 বিধান কথা বলে না, শুধু কাঁদে।

 সত্যভামা আজও এ বাড়িতে কাজ করে, সে উঠানে বাসন মাজিতেছিল, বলিল, নিজে গলা টিপে মেরে ফেললে মা, এমন দুরন্ত ছেলে জন্মে দেখিনি,—সন্দোর ছ্যানাটি গাে!

 তুই মেরেছিস? কেন মেরেছিস খােকা? শ্যামা বারবার জিজ্ঞাসা করিল, বিধান কথা বলিল না। আরও বেশি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। শেষে শ্যামা রাগিয়া বলিল, কাঁদিস নে মুখপােড়া ছেলে, নিজে মেরে আবার কান্না কিসের?

 মরা পাখিটাকে সে প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া বাহিরে ফেলিয়া দিল।

 রাত্রে শ্যামা শীতলকে ব্যাপারটা বলিল। বলিল এসব দেখিয়া শুনিয়া তাহার বড ভাবনা হয়। কেমন যেন মন ছেলেটার। এত মায়া ছিল পাখির বাচ্চাটার উপর। ছেলের এই দুর্বোধ্য কীর্তি লইয়া খানিকক্ষণ আলােচনা করিয়া তাহারা দুজনেই ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বিধান তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। এরকম রহস্যময় প্রকৃতি ছেলেটা পাইল কোথা হইতে? ওর দেহ মন তাদের দুজনের দেওহা, তাদের চোখের সামনে হাসিয়া কাঁদিয়া খেলা করিযা ও বড় হইয়াছে, ওর মধ্যে এই দুর্বোধ্যতা কোথা হইতে আসিল?

 শ্যামা বলে, তােমায় এ্যাদ্দিন বলিনি মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ও কি যেন ভাবে, ডেকে সাড়া পাইনে।

 শীতল গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলে, সাধারণ ছেলের মত হয়নি।

 শ্যামা সায় দেয়। কত বাড়ির কত ছেলে তাে দেখি আপন মনে খেলাধুলাে করে, খায় দায় ঘুমােয়, এ যে কি ছেলে হয়েছে, কারো সঙ্গে মিল নেই। কী বুদ্ধি দেখেছ?

 শীতল বলে, কাল কি হয়েছে জান? জিগ্যেস করেছিলাম দশ টাকা মণ হলে আড়াই সেরে দাম কত, সঙ্গে সঙ্গে বললে দশ আনা। কতদিন আগে বলে দিয়েছিলাম যত টাকা মণ আড়াই সের তত আনা, ঠিক মনে রেখেছে।

 বাড়িতে একটা পােষা বিড়াল ছিল, রাণী। একদিন দুপুরবেলা গলায় দড়ি বাঁধিয়া জানালার শিকের সঙ্গে ঝুলাইয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বিধান তাহার মৃত্যুযন্ত্রণা দেখিতেছিল। দেখিয়া শ্যামা সেদিন ভয়ানক রাগিয়া গেল। রাণীকে ছাড়িযা দিয়া ছেলেকে সে বেদম মার মারিল। বিধানের স্বভাব কিন্তু বদলাইল না। পিঁপড়ে দেখিলে সে টিপিয়া মারে, ফড়িঙ ধরিয়া পাখা ছিঁড়িয়া দেয়, বিড়ালছানা কুকুরছানা পুষিয়া হঠাৎ একদিন যন্ত্রণা দিয়া মারিযা ফেলে। বারো তেরো বছর বয়স হওয়ার আগে তাহার এ স্বভাব শোধরায় নাই।

 এখন শীতলেব আয় কিছু বাড়িয়াছে। পিতার আমল হইতে তাহাদের নিজেদের প্রেস ছিল। প্রেসের কাজ সে ভাল বােঝে। তার তত্ত্বাবধানে কমল প্রেসের অনেক উন্নতি হইয়াছে। প্রেসের সমস্ত ভার এখন তাহার। মাহিনার উপর সে লাভের কমিশন পায়, উপরি আয়ও কিছু কিছু হয়। সেটা এই রকম। ব্যবসায়ে অনেক কিছুই চলে। অনেক কোম্পানীর যে কর্মচারীর উপর ছাপার কাজের ভার থাকে, ফর্মা পিছু আট টাকা দিয়া সে প্রেসের দশ টাকার বিল দাবী করে এরকম বিল দিতে হয়। প্রেসের মালিক কমল ঘােষ তাহা জানে। তাই খাতাপত্রে দশ টাকা পাওনা লেখা থাকিলেও আট অথবা দশ কত টাকা ঘরে আসিয়াছে, সব সময় জানিবার উপায় থাকে না। জানে শুধু সে প্রেসের ভার থাকে যাহার উপব। শীতল অনায়াসে অনেক দশ টাকা পাওনাকে আট টাকা দাঁড় করাইয়া দেয়। প্রেসের মালিক কমল ঘােষ হয়ত মাঝে মাঝে সন্দেহ করে কিন্তু প্রেসের ক্রমােন্নতি দেখিয়া কিছু বলে না।

 শীতলের খুব পরিবর্তন হইয়াছে। কমল প্রেসে চাকরী পাওযার আগে সে দেড় বছর বেকার বসিয়াছিল। যেমন হয়, এই দুঃখের সময় সুসময়ের বন্ধুদের চিনিতে তাহার বাকি থাকে নাই। এবার তাদের সে আর আমল দেয় না। সােজাসুজি ওদের ত্যাগ করিবার সাহস তাে তার নাই, এখন সে ওদের কাছে দারিদ্র‍্যের ভান করে। দেড় বছর গরীব হইয়া থাকিবার পর এটা সে সহজেই করিতে পারে। তার মধ্যে ভারি একটা অস্থিরতা আসিয়াছে। কিছুদিন খুব স্ফূর্তি করিয়া কাটানাের পর শ্রান্ত মানুষের যে রকম আসে, কিছু ভাল লাগে না, কি করিবে ঠিক পায় না। শ্যামার সঙ্গে গােড়া হইতে মনের মিল করিয়া রাখিলে এখন সে বাড়িতেই একটি সুখ দুঃখের সঙ্গী পাইত, আর তাহা হইবার উপায় নাই—সাংসারিক ব্যাপারে ও ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারে শ্যামার সঙ্গে তাহার কতগুলি মত ও অনুভূতি খাপ খায় মাত্র। শ্যামার কাছে বেশি আর কিছু আশা করা যায় না। অথচ এদিকে বাহিরে মদ খাইয়া একা একা স্ফূর্তিও জমে না, সব কি রকম নিরানন্দ অসার মনে হয়। অনেক প্রত্যাশা করিয়া হয়ত সে তাহার পরিচিত কোন মেয়ের বাড়ি যায়, কিন্তু নিজের মনে আনন্দ না থাকিলে পরে কেন আনন্দ দিতে পারিবে, তাও টাকার বিনিময়ে? আজকাল হাজার মদ গিলিয়াও নেশা পর্যন্ত যেন জমিতে চায় না, কেবল কান্না আসে। কত কি দুঃখ উথলিয়া ওঠে।

 এক একদিন সে করে কি, সকাল সকাল প্রেস হইতে বাড়ি ফেরে। শ্যামার রান্নার সময় সে ছেলেমেয়েদের সামলায়, বারান্দায় পায়চারি করিয়া ছোট খোকমণিকে ঘুম পাড়ায়, মুখের কাছে বাটি ধরিয়া বকুকে খাওয়ায় দুধ। বকুকে কোলে করিয়া ঘুম পাড়াইতে হয় না, সে বিছানায় শুইয়াই ঘুমায়, ঘুমাইয়া পড়িবার আগে একজনকে শুধু তাহার পিঠে আস্তে আস্তে চুলকাইয়া দিতে হয়। তারপর বাকি থাকে বিধান। সে খানিকক্ষণ পড়ে, তারপর তাহাকে গল্প বলিয়া রান্না শেষ হওয়া পর্যন্ত জাগাইয়া রাখিতে হয়। এসব শীতল অনেকটা নিখুঁতভাবেই করে। সকলের খাওয়া শেষ হইলে গর্বিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তামাক টানিতে টানিতে শ্যামার কি বলিবার আছে শুনিবার প্রতীক্ষা করে। শ্যামার কাছে সে কিছু প্রশংসার আশা করে বৈকি! শ্যামা কিন্তু কিছু বলে না। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হয় সে রান্না করিয়াছে, শীতল ছেলে রাখিয়াছে, কোন পক্ষেরই এতে কিছু বাহাদুরি নাই।

 শেষে শীতল বলে, কি দুষ্টুই যে ওরা হয়েছে শ্যামা, সামলাতে হয়রাণ হয়ে গেছি—ওদের নিয়ে তুমি রান্না কর কি করে?

 শ্যামা বলে, মণিকে ঘুম পাড়িয়ে নি, বুকুকে খোকা রাখে।

 এত সহজ? শীতল বড় দমিয়া যায়, সন্ধ্যা হইতে ওদের সামলাইতে সে হিমসিম খাইয়া গেল, শ্যামা এমন অবলীলাক্রমে তাহাদের ব্যবস্থা করে?

 শ্যামা হাই তুলিয়া বলে, এক একদিন কিন্তু ভারি মুস্কিলে পড়ি বাবু, মণি ঘুমােয় না, বুকুটা ঘ্যান ঘ্যান করে, সবাই মিলে আমাকে ওরা খেয়ে ফেলতে চায়,—মরেও তেমনি মার খেয়ে। তুমি বাড়ি থাকলে বাঁচি, ফিরো দিকি একটু সকাল সকাল রোজ? শ্যামা আঁচল বিছাইয়া শ্রান্ত দেহ মেঝেতে এলাইয়া দেয়, বলে, তুমি থাকলে ওদেরও ভাল লাগে, সন্ধ্যাবেলা তােমায় দেখতে না পেলে বুকু তাে আগে কেঁদেই অস্থির হত।

 শীতল আগ্রহ গােপন করিয়া জিজ্ঞাসা করে, আজকাল কাঁদে না?

 আজকাল ভুলে গেছে। হ্যাঁগাে, মুদী দোকানে টাকা দাও নি?

 দিয়েছি।

 মুদী আজ সত্যভামাকে তাগিদ দিয়েছে। তামাক পুড়ে গেছে, এবার রাখাে,—দেব আরেক ছিলিম সেজে?

 শীতল বলে, না থাক।

 আবােল তাবােল খরচ করে কেন যে টাকাগুলাে নষ্ট কর, দোতলায় একখানা ঘর তুলতে পারলে একটা কাজের মত কাজ হত। টাকা উড়িয়ে লাভ কি?

 তারপর তাহারা ঘরে যায়। মণি আর বুকুর মাঝখানে শ্যামা শুইয়া পড়ে। বিধান একটা স্বতন্ত্র ছােট চৌকীতে শোয়। শােয়ার আগে একটি বিড়ি খাইবার জন্য শীতল সে চৌকীতে বসিবামাত্র বিধান চীৎকার করুয়া জাগিয়া যায়। শীতল তাড়াতাড়ি বলে, আমি তে থােকা আমি। ভয় কি?—বিধান কিন্তু শীতলকে চায় না। সে কাঁদিতে থাকে।

 শ্যামা বলে, আয় খােকা আমার কাছে আয়।

 সে রাত্রে ব্যবস্থা উল্টাইয়া যায়। শীতলের বিছানায় শােয় বিধান। বিধানের ছােট্ট চৌকীটিতে শীতল পা মেলিতে পারে না। একটা অদ্ভুত ঈর্ষার জ্বালা বােধ করিতে করিতে সে মা ও ছেলের আলাপ শােনে।

 স্বপন দেখেছিলি না রে খােকা?

 কিসের স্বপন রে?

 ভুলে গেছি মা।

 খুকীর গায়ে তুমি যেন পা তুলে দিও না বাবা।

 কি করে দেব? পাশ বালিশ আছে যে?

 তুই যে পাশ বালিশ ডিঙ্গিয়ে আসিস। বালিশের তলে কি হাতড়াচ্ছিস?

 টর্চ্চটা একটু দাও না।

 কি করবি টর্চ্চ দিয়ে রাত দুপুরে? এমনি জ্বেলে খরচ করে ফ্যালাে, শেষে দরকারের সময় মরব এখন অন্ধকারে।

 একটু পরেই ঘরে টর্চ্চের আলাে বারকয়েক জ্বলিয়া নিভিয়া যায়। দেয়ালের গায়ে টিকটিকির ডাক শুনিয়া বিধান তাকে খুঁজিয়া বাহির করে।

 নে হয়েছে দে এবার।

 জল খাব মা।

 জল খাইয়া বিধান মত বদলায়। আমি এখানে শোব না মা, যা গন্ধ!

 শ্যামা হাসে। তাের বিছানায় বুঝি গন্ধ নেই খােকা। ভারি সাধু হয়েছিস না।


 বড়দিনের সময় রাখালের সঙ্গে মন্দা কলিকাতায় বেড়াইতে আসিল। পর পর তাহার দুটি মেয়ে হইয়াছে। মেয়ে দুটিকে সে সঙ্গে আনিল, ছেলেরা রহিল বনগাঁয়ে। মন্দার বড় মেয়েটি একটি খােঁড়া পা লইয়া জন্মিয়াছিল। এখন প্রায় চার বছর বয়স হইয়াছে। কথা বলিতে শেখে নাই, মুখ দিয়া সর না লালা পড়ে। মেয়েটাকে দেখিয়া শ্যামা বড় মমতা বোধ করিল। কত কষ্টই পাইবে জীবনে! এখন অবশ্য মমতা করিয়া সকলেই আহা বলিবে, বড় হইয়া ও যখন সকলের গলগ্রহ হইয়া উঠিবে, ফেলাও চলিবে না, রাখিতেও গা জ্বালা করিবে, লাঞ্ছনা সুরু হইবে তখন। মন্দা মেয়ের নাম রাখিয়াছে শােভা। শুনিলে মনটা কেমন করিয়া ওঠে। এমন মেয়ের ও রকম নাম রাখা কেন?

 মন্দা বলিল, ওকে ডাকি বাদু বলে।

 শ্যামা ভাবিয়াছিল সতীন আসিবার পর মন্দার জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। কিন্তু মন্দাকে এতটুকু অসুখী মনে হইল না। সে খুব মােটা হইয়াছে। স্থানে অস্থানে মাংস থলথল করে। চলাফেরা কথাবার্তায় কেমন থিয়েটারি ধরণের গিন্নি গিন্নি ভাব। স্বভাবে আর তাহার তেমন ঝাঁঝ নাই। সে বেশ অমায়িক ও মিশুক হইয়া উঠিয়াছে। আর বছর মন্দার শাশুড়ী মরিয়াছে। গৃহিণীর পদটা বােধ হয় পাইয়াছে সেই। শাশুড়ীর অভাবে ননদদের সে হয়ত আর গ্রাহ্য করে না। রাখালের উপর তাহার অসীম প্রতিপত্তি দেখা গেল। কথা তাে বলে না যেন হুকুম দেয়, আর যা সে বলে তাই রাখাল শােনে।

 সতীন—হ্যাঁ, সে এখানেই থাকে বৌ, বড্ড গরীবের মেয়ে, বাপের নেই চালচুলাে, এখানে না থেকে আর কোথায় যাবে বল, যাবার যায়গা থাকলে তাে যাবে—বাপ ব্যাটা ডেকেও জিগ্যেস করে না। চামারের হদ্দ সে মানুষটা, ওই করে তাে মেয়ে গছালে। ছল করে বাড়ি ডেকে নিয়ে যেত, আজ নেমন্তন্ন, কাল মেয়ের অসুখ—মন্দা হাসিল। পাড়ার মেয়ে ভাই ছুড়িকে এইটুকু দেখেছি, হ্যাংলার মত ঠিক খাবার সময়টিতে লােকের বাড়ি গিয়ে হাজিব হত। কে জানত বাবা ও শেষে বড় হয়ে আমারি ঘাড় ভাঙ্গবে।

 মন্দার মেয়ে দু'টিকে শ্যামা খুব আদর করিল আর শ্যামার ছেলেকে আদর করিল মন্দা। রেষারেষি করিয়া পরস্পরের সন্তানদের তাহারা আদর করিল। মন্দার মেয়েদের জন্য শ্যামা আনাইল খেলনা, শ্যামার ছেলেদের মন্দা জামা কিনিয়া দিল। একদিন তাহারা দেখিতে গেল থিয়েটার। টিকিটের দাম দিল মন্দা, গাড়ি ভাড়া ও পান লেমনেডের খরচ দিল শ্যামা। দুজনের এবার মনের মিলের অন্ত রহিল না। হাসিগল্প আমােদ আহ্লাদে দশ বারোটা দিন কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। মন্দা আসলে লোক মন্দ নয়, শাশুড়ীর অতিরিক্ত শাসনে মেজাজটা আগে কেবল তাহার বিগড়াইয়া থাকিত। শ্যামা জীবনে কারো সঙ্গে এরকম আত্মীয়তা করার সুযােগ পায় নাই। মন্দার যাওয়ার দিন সে কাঁদিয়া ফেলিল। সারাদিন বাদুকে কোল হইতে নামাইল না, বাদুর লালায় তাহার গা ভিজিয়া গেল। মন্দাও গাড়িতে উঠিল চোখ মুছিতে মুছিতে।

 শুধু রাখালকে এবাব শ্যামার ভাল লাগিল না। জেলে না গিয়াও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় মানুষের কয়েদীর মত স্বভাব হয়, সব সময় একটা গােপন করা ছােটলােকামির আভাস পাওয়া যাইতে থাকে। রাখালেরও যেন তেমনি বিকার আসিয়াছে। যে কয়দিন এখানে ছিল সে যেন কেমন ভয়ে ভয়ে থাকিত। কেমন একটা অপরাধীর ভাব, লােকে যেন তাহার সম্বন্ধে কি জানিয়া ফেলিয়া মনে মনে তাহাকে অশ্রদ্ধা করিতেছে। সে যেন তাই জ্বালা বোধ করিত, প্রতিবাদ করিতে চাহিত অথচ সব তাহার নিজেরই কল্পনা বলিয়া চোরের মত, যে চোরকে কেহ চোর বলিয়া জানে না, সব সময় অত্যন্ত হীন একটা লজ্জাবােধ করিয়া সঙ্কুচিত হইয়া থাকিত।

 পরের মাসে শীতল মাহিনা ও কমিশনের টাকা আনিয়া দিল অর্ধেক, প্রথমে সে কিছু স্বীকার করিতে চাহিল না, তারপর কারণটা খুলিয়া বলিল। কমল ঘােষের কাছে শীতল সাতশাে টাকা ধার করিয়াছে, সুদ দিতে হইবে না, কিন্তু ছ'মাসের মধ্যে টাকাটা শােধ করিতে হইবে। সাতশাে টাকা! এত টাকা শীতল ধার করিতে গেল কেন?

 রাখালকে দিয়েছি।

 ঠাকুরজামাইকে ধার করে সাতশাে টাকা দিয়েছ? তােমার মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে কিনা বুঝিনে বাবু, কেন দিলে?

 শীতল ভয়ে ভয়ে বলিল, ছ'সাত মাস রাখালের চাকরী ছিল না শ্যামা, আশ্বিন মাসে বােনের বিয়েতে বড্ড দেনায় জড়িয়ে পড়েছে, হাত ধরে এমন করে টাকাটা চাইলে—

 শ্যামার মাথা ঘুরতেছিল। সাতশাে টাকা! রাখাল যে এবার চোরের মত বাস করিয়া গিয়াছে তাহার কারণ তবে এই? সে সত্যই তাহাদের টাকা চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে? টাকা সম্বন্ধে শীতলের দুর্বলতা রাখালের অজানা নয়, এবার সে তাহা কাজে লাগাইয়াছে। মন্দাকেও শ্যামা এবার চিনিতে পারে, অত যে মেলামেশা আমােদ-আহ্লাদ সব তাহার ছল। ওদিকে রাখাল যখন শীতলকে টাকার জন্য ভজাইতেছিল, মন্দা এদিকে তাহাকে নানা কৌশলে ভুলাইয়া রাখিয়াছিল সে যাহাতে টের পাইয়া বারণ করিতে না পারে। এতাে জানা কথা যে শীতল আর সে শীতল নাই, সে বারণ করিলে টাকা শীতল কখনাে রাখালকে দিত না।

 রাগে দুঃখে সারাদিন শ্যামা ছটফট করিল, যতবার রাখাল ও মন্দার হীন ষড়যন্ত্রের কথা আর টাকার অঙ্কটা সে মনে করিল গা যেন তাহার জ্বলিয়া যাইতে লাগিল। কত কষ্টের টাকা তাহার, শীতল তাে পাগল, কবে তাহার কমল প্রেসের চাকরী ঘুচিয়া যায় ঠিক নাই, দুটো টাকা জমানাে না থাকিলে ছেলেদের লইয়া তখন সে করিবে কি? শীতলকে সে অনেক জেরা করিল,—কবে টাকা দিয়েছ? রাখাল কবে টাকা ফেরত দেবে বলেছে? টাকার পরিমাণটা সত্যই সাতশো না আরও বেশি? এমনি সব অসংখ্য প্রশ্ন। শীতলও এখন অনুতাপ করিতেছিল, প্রত্যেকবার জেরা শেষ করিয়া শ্যামা যখন তাহাকে রাগের মাথায় যা মুখে আসিল বলিয়া গেল, সে কথাটি বলিল না।

 শুধু যে কথা বলিল না তা নয়, তাহার বর্তমান বিষণ্ণ মানসিক অবস্থায় এ ব্যাপারটা এমন গুরুতর আকার ধারণ করিল যে সে আরও মনমরা হইয়া গেল এবং কয়েকদিন পরেই শ্যামাকে শোনাইয়া আবোল-তাবোল কি যে সব কৈফিয়ৎ দিতে লাগিল শ্যামা কিছুই বুঝিল না। শীতল ফাজলামি আরম্ভ করিয়াছে ভাবিয়া সে রাগিয়া গেল। শীতল অনুতপ্ত, বিষণ্ণ ও নম্র হইয়া না থাকিলে এতটা বাড়াবাড়ি করিবার সাহস হয়ত শ্যামার হইত না, এবার শীতলও রাগিয়া উঠিয়া অনেকদিন পরে শ্যামাকে একটা চড় বসাইয়া দিল, তারপর সেই যেন মার খাইয়াছে এমনি মুখ করিয়া শ্যামার আশেপাশে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করিয়া বাহির হইয়া গেল। বাড়ি ফিরিল একদিন পরে।

 এতকাল পরে আবার মার খাইয়া শ্যামাও নম্র হইয়া গিয়াছিল, শীতল বাড়ি ফিরিলে সে যেভাবে সবিনয় আনুগত্য জানাইল, প্রহৃতা স্ত্রীরাই শুধু তাহা জানে এবং পারে। তবু অশান্তির অন্ত হইল না। পরস্পরকে ভয় করিয়া চলার জন্য দারুণ অস্বস্তির মধ্যে তাহাদের দিন কাটিতে লাগিল।

 শ্যামা বলে, বেশ ভদ্রতা করিয়াই বলে, তুমি এমন মন খারাপ করে আছ কেন?

 শীতলও ভদ্রতা করিয়া বলে, টাকাটা যদ্দিন না শোধ হচ্ছে শ্যামা—

 হঠাৎ মাসিক উপার্জন একেবারে অর্ধেক হইয়া গেলে চারিদিকে তাহার যে ফলাফল ফুটিয়া ওঠে, চোখ বুজিয়া থাকিলেও খেয়াল না করিয়া চলে না। স্বামীস্ত্রীর মধ্যে যেন একটা শত্রুতার সৃষ্টি হইতে থাকে।

 শেষে শ্যামা একদিন বুক বাঁধিয়া টাকা তুলিবার ফর্মে নাম সই করিয়া তাহার সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতাখানা শীতলের হাতে দিল। খাতায় শুধু জমার অঙ্কপাত করা আছে, সত্যভামাকে দিয়া পাঁচটি সাতটি করিয়া টাকা জমা দিয়া শ্যামা শ' পাঁচেক টাকা করিয়াছে, একটি টাকা কোনদিন তোলে নাই।

টাকা তুলে কমলবাবুকে দাও গে, ধারটা শোধ হয়ে যাক, টাকা থাকতে মনের শান্তি নষ্ট করে কি হবে? আস্তে আস্তে আবার জমবে'খন।

 খাতাখানা লইয়া শীতল সেই যে গেল, সাতদিনের মধ্যে আর সে বাড়ি ফিরিল না। শ্যামা যে বুঝিতে পারিল না তা নয়, তবু একি বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় যে তার অত কষ্টের জমানো টাকাগুলি লইয়া শীতল উধাও হইয়া গিয়াছে। একদিন বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি গিয়া শ্যামা কমল প্রেসে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করিয়া আসিল। সে আসিয়া খবর দিল প্রেসে শীতল যায় নাই। শীতল গাড়ি চাপা পড়িয়াছে অথবা তাহার কোন বিপদ হইয়াছে শ্যামা একবারও তাহা ভাবে নাই, কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া শীতলকে ভালরকম চিনিত না বলিয়া হাসপাতালে, থানায় আর খবরের কাগজের আপিসে খোঁজ করাইল। গাড়িটাড়ি চাপা পড়িয়া থাকিলে শীতলের একটা সংবাদ অবশ্যই পাওয়া যাইত, শ্যামাকে এই সান্ত্বনা দিতে আসিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া অবাক হইয়া বাড়ি গেল। শ্যামা যেভাবে তার কাছে স্বামীনিন্দা করিল ছোটজাতের স্ত্রীলোকের মুখেও বিষ্ণুপ্রিয়া কোনদিন সে সব কথা শোনে নাই।

 বিধান জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায় গেছে মা?

 শ্যামা বলে, চুলোয়।

 শ্যামা রাঁধে বাড়ে, ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়, নিজেও খায় কিন্তু বাঘিনীর মত সব সময় সে যেন কাহাকে খুন করিবার জন্য উদ্যত হইয়া থাকে। জ্বালা তাহার কে বুঝিবে? তিনটি সন্তানের সে জননী, স্বামীর উপর তাহার নির্ভর অনিশ্চিত। একজন পরম বন্ধু তাহার ছিল রাখাল। সে তাহাকে ঠকাইয়া গিয়াছে, স্বামী আজ তাহার সঞ্চয় লইয়া পলাতক। বোকার মত কেন যে সে সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতাখানা শীতলকে দিতে গিয়াছিল? রাত্রে শ্যামার ঘুম হয় না। শীতের রাত্রি ঠাণ্ডা লাগিবার ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করিয়া দিতে হয়। শ্যামা একটা লণ্ঠন কমাইয়া রাখে। ঘবেব বাতাস দূষিত হইয়া ওঠে। শ্যামা বারবার মশারি ঝাড়ে, বিধানের গায়ে লেপ তুলিয়া দেয় বুকুর কাঁথা বদলায়, মণিকে তুলিয়া ঘরের জল বাহির হওয়ার নালিটার কাছে বসায়, আরও কত কি করে। চোখে তাহার জলও আসে।

 এমনি সাতটা রাত্রি কাটাইবার পর অষ্টম রাত্রে পাগলের মত চেহারা লইয়া শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে শীতল ফিরিয়া আসিল। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল, খেয়ে এসেছ?

 শীতল বলিল, না।

 সেই রাত্রে শ্যামা কাঠের উনানে ভাত চাপাইয়া দিল। রান্না শেষ হইতে রাত্রি তিনটা বাজিয়া গেল। শীতল ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিয়া তুলিয়া তাহাকে খাইতে বসাইয়া শ্যামা ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কাছে বসিয়া শীতলকে খাওয়ানাের প্রবৃত্তি হইল না বলিয়া শুধু নয়, ঘুমে তাহার শরীর অবশ হইয়া আসিতেছিল।

 পরদিন শীতল শ্যামাকে একশত টাকা ফেরত দিল।

 আর কই? বাকি টাকা কি করেছ?

 আর তুলি নি তাে?

 তোলাে নি? খাতা কই আমার?

 খাতাটা হারিয়ে গেছে শ্যামা, কোনখানে যে ফেললাম—

 শ্যামা কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল, সব টাকা নষ্ট করে এসে আবার তুমি মিছে কথা বলছ, আমি পাঁচশাে টাকা সই করে দিলাম, একশাে টাকা তুমি কি করে তুললে, মিছে কথাগুলো একটু আটকালাে না তোমার মুখে—দোতালায় ঘর তুলব বলে আমি যে টাকা জমাচ্ছিলাম গাে?

 শীতল আস্তে আস্তে সরিয়া গেল।


 এবছর প্রথম স্কুল খুলিলেই বিধানকে শ্যামা স্কুলে ভর্তি করিয়া দিবে ভাবিয়াছিল। কিন্তু এইসব টাকার গােলমালে ফাল্গুন মাস আসিয়া পড়িল, বিধানকে স্কুলে দেওয়া হইল না। শহরতলীর এখানে কাছাকাছি স্কুল নাই, আনন্দমােহিনী মেমােরিয়াল হাই স্কুল কাশীপুরে প্রায় এক মাইল তফাতে। এতখানি পথ হাঁটিয়া বিধান প্রত্যহ স্কুল করিবে, শ্যামার তাহা পছন্দ হইতেছিল না। কলিকাতার স্কুলে ভর্তি করিলে বিধানকে ট্রামে বাসে যাইতে হইবে, শ্যামার সে সাহস নাই। প্রেসে যাওয়ার সময় শীতল যে বিধানকে স্কুলে পৌঁছাইয়া দিবে তাহাও সম্ভব নয়, শীতল কোনদিন প্রেসে যায় দশটায়, কোনদিন একটায়। শ্যামা মহা সমস্যায় পড়িয়া গিয়াছিল। অথচ ছেলেকে এবার স্কুলে না দিলেই নয়, বাড়িতে ওর পড়াশােনা হইতেছে না। শীতলকে বলিয়া লাভ হয় না, কথাগুলি সে গ্রাহ্য করে না। শ্যামা শেষে একদিন পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে গেল বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি।

 বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল, এক কাজ কর না? আমাদেব শঙ্কর যেখানে পড়ে তোমার ছেলেকে সেইখানে ভর্তি করে দাও। শঙ্কর তাে গাড়িতে যায়, তােমার ছেলেও ওর সঙ্গে যাবে। তবে ওখানে মাইনে বেশি, বড়লােকের ছেলেরাই বেশির ভাগ পড়ে ওখানে। আর—ওখানে ভর্তি করলে ছেলেকে ভাল ভাল কাপড় জামা কিনে দিতে হবে—একদিন যে একটু ময়লা জামা পরিয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠাবে তো পারবে না। হেডমাষ্টার সায়েব কিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভালবাসে।

 বিষ্ণুপ্রিয়া আজও শ্যামার উপকার করিতে ভালবাসে কিন্তু আসিলে বসিতে বলে না, কথা বলে অনুগ্রহ করার সুরে। বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই মেয়েটির বয়স এখন প্রায় এগারো। বেণী দুলাইয়া সে স্কুলে যায়, দেখিয়া এখন আর বুঝিবার উপায় নাই কদর্য পাপের ছাপ লইয়া সে জন্মিয়াছিল। শুধু মনে হয়, মেয়েটা বড় রোগা। বিষ্ণুপ্রিয়ার আর একটি মেয়ে হইয়াছে, বছর তিনেক বয়স। বিষ্ণুপ্রিয়া এখন আবার সাজগোজ করে তবে আগের মত দেহের চাকচিক্য তাহার নাই, এখন চকচক করে শুধু গহনা অনেকগুলি।

 ভারি চিন্তিয়া শ্যামা বিধানকে শঙ্করের স্কুলেই ভতি করিয়া দিল। শঙ্কর বিষ্ণুপ্রিয়ার খুড়তুতাে বোনের ছেলে, এবার সেকেণ্ড ক্লাশে উঠিয়াছে। বয়সের আন্দাজে ছেলেটা বাড়ে নাই, বিধানের চেয়ে মাথায় সে সামান্য একটু উঁচু। ভারি মুখচোরা লাজুক ছেলে, গায়ের রঙটি টুকটুকে। যত ছােট দেখাক সে সেকেণ্ড ক্লাশে পড়ে, স্কুলের অভিজ্ঞতাও তাহার আছে। বিধানকে শ্যামা তাহার জিম্মা করিয়া দিল। চিবুক ধরিও চুমা খাইয়া ছেলেকে দেখাশােনা করার জন্য শ্যামা তাহাকে এমন করিয়াই বলিল যে লজ্জায় শঙ্করের মুখ রাঙা হইয়া গেল।

 সারাদিন শ্যামা অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। ভাবিবার চেষ্টা করিল বিধান স্কুলে কি করিতেছে। শ্যামার একটা ভয় ছিল স্কুলে বড়লােকের ছেলের সঙ্গে বিধান মানাইয়া চলিতে পারিবে কিনা। গরীবের ছেলে বলিয়া ওকে সকলে তুচ্ছ করিবে না তাে? একটা ভরসার কথা, শঙ্করের সঙ্গে ওর ভাব হইয়াছে, শঙ্করের বন্ধু বলিয়া সকলে ওকে সমানভাবেই হয়ত গ্রহণ করিবে, হাসি-তামাসা করিবে না। ফাল্গুনের দিন আজ শ্যামার বড় দীর্ঘ মনে হয়। একদিনের জন্য ছেলে তাহার বাড়ি ছাড়িয়া কোথাও গিয়া থাকে নাই, অপরিচিত স্থানে অচেনা ছেলেদের মধ্যে দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত সে কি করিয়া কাটাইবে কে জানে!

 বিকালে বিধান ফিরিয়া আসিলে শ্যামা তাহার মুখখানা ভারি শুকনাে দেখিল। টিফিনের সময় খাবাব কিনিয়া খাওয়ার জন্য শ্যামা তাহাকে চার আনা পয়সা দিয়াছিল, বিধান লজ্জায় কিছু খাইতে পারে নাই ভাবিয়া বলিল, ও খোকা, মুখ শুকিয়ে গেছে কেন রে? খাসনি কিছু কিনে টিফিনের সময়?

 বিধান বলিল, খেয়েছি তো, পেট ব্যথা করছে মা।

 শ্যামা বলিল, কেন খোকা, পেট ব্যথা করছে কেন বাবা? কি খেয়েছিলি কিনে?

 পেটের ব্যথায় বিধান নানারকম মুখভঙ্গি কবে। চোখে জল দেখা দেয়।

 শ্যামা ধমক দিয়া বলে, কি খেয়েছিলি বল।

 ফুলুরি।

 আর কি?

 আর ঝালবড়া।

 তাহলে হবে না তােমার পেট ব্যথা, মুখপোড়া ছেলে! রাজ্যে এত ভাল ভাল খাবার থাকতে তুমি খেতে গেলে কিনা ফুলুরি আর ঝালবড়া! কেন খেতে গেলি ওসব—?

 শঙ্কর খাওয়ালে মা। শঙ্কর বলে, বাড়িতে ওসব তাে খেতে দেয় না, শুধু দুধ আর সন্দেশ খেয়ে মর, তাই—

 শঙ্কর ছেলেটা তাে তবে কম দুষ্টু নয়? বাড়িতে যা নিষেধ করিয়া দেয় চুরি করিয়া তাই করে? ওর সঙ্গে মেলামেশা করিয়া বিধানের স্বভাব খারাপ হইয়া যাইবে না তাে! শ্যামার প্রথমে ভারি ভাবনা হয়, তারপর সে ভাবিয়া দেখে যে লুকাইয়া ফুলুরি আর ঝালবড়া খাওয়াটা খুব বেশি খারাপ অপরাধ নয়, এরকম দুষ্টামি ছেলেরা করেই। তবু মনটা শ্যামার খুঁত খুঁত করে। ছেলেকে সে নানারকম উপদেশ দেয়, অসংখ্য নিষেধ জানায়। কাজ করিতে করিতে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে কাছে ডাকিয়া বলে, এ যেন তুমি কখনাে কোরাে না বাবা, কখখনো নয়।

 কেন মা?—বিধান বলে। প্রত্যেকবার।

 একদিন মন্দার একখানা পত্র আসিল, খুব দরদ দিয়া অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়া লিখিয়াছে। চিঠি পড়িয়া শ্যামা মুখ বাঁকাইয়া হাসিল, বলিল, বসে থাক তুমি জবাবের জন্যে হা-পিত্যেশ করে, তােমার চিঠির জবাব আমি দিচ্ছিনে।—কদিন পরে শীতলের কাছে রাখালের একখানা পােস্টকার্ড আসিল, শ্যামা চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলিল, শীতলকে কিছু বলিল না। জবাব না পাইয়া একটু অপমান বােধ করুক লােকটা। ফাঁকি দিয়া টাকা বাগাইয়া লওয়ার জন্য শীতল তাহাকে এমন ঘৃণাই করিতেছে যে চিঠির উত্তরও দেয় না।

 ফাল্গুন মাস কাবার হইয়া আসিল। শীত একেবারে কমিয়া গিয়াছে। একদিন রােদ খাওয়াইয়া লেপগুলি শ্যামা তুলিয়া রাখিল। শ্যামার শরীরটা আজকাল ভাল আছে, তিন ছেলের মার আবার শরীর! তবু সানন্দে মনে আরেকটি সন্তানের সখ যেন উঁকি মারিয়া যায়, একা থাকিবার সময় অবাক হইয়া শ্যামা হাসে, কি কাণ্ড মেয়েমানুষের, মাগাে! বিধান দশটার সময় ভাত খাইয়া জুতা, মােজা, হাফপ্যাণ্ট আর সার্ট পরিয়া স্কুলে যায়, শ্যামা তাহার চুল আঁচড়াইয়া দেয়, আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া দেয়,—প্রথম প্রথম ছেলের মুখে সে একটু পাউডার মাখিয়াও দিত, বড়লােকের ছেলেদের মাঝখানে গিয়া বসিবে একটু পাউডার না মাখিলে কি চলে? স্কুলে ছেলেরা ঠাট্টা করায় বিধান এখন আর পাউডার মাখাইতে দেয় না। বলে, তুমি কিছু জানাে না মা, পাউডার দেখলে ওরা সবাই হাসে, সার শুদ্ধু। কি বলে জান?—বলে চূণ তো মেখেই এসেছিস এবার একটু কালি মাখ, বেশ মানাবে তােকে, মাইরি ভাই, মাইরি।

 মাইরি বলে? বিধানের স্কুলে বড়লােকের সােনার চাঁদ অভিজাত ছেলেদের মুখে এই কথাটির উচ্চারণ শ্যামার বড় খাপছাড়া মনে হয়। এমনি কত কথা বিধান শিখিয়া আসে, মাইরির চেয়েও ঢের বেশি খারাপ কথা। অনেক বড় বড় শব্দও সে শিখিয়া আসে, আর সঙ্কেত, শ্যামা যার মানেও বুঝিতে পারে না। তাহার অজানা এক জগতের সঙ্গে বিধান পরিচিত হইতেছে, অল্প অল্প একটু যা আভাস পায় তাতেই শ্যামা অবাক হইয়া থাকে। সে একটা বিচিত্র গর্ব ও দুঃখ বােধ করে। বাড়িতে এখন বিধানের জিজ্ঞাসা কমিয়া গিয়াছে, প্রশ্নে প্রশ্নে আর সে শ্যামাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তােলে না। ছাদে উঠিয়া, খানিকদূরে বাঁধের উপর দিয়া যে রেলগাড়ি চলিয়া যায়, ছেলেকে তাহা দেখানাের সাধ শ্যামার কিন্তু কমে নাই, জ্ঞান ও বুদ্ধিতে ছেলে তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতেছে বলিয়া গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে শ্যামার দুঃখ এইটুকু।

 বকুল আছে।

 সে কিন্তু মেয়ে। ছেলের মত শ্যামার কাছে যেন অত খাতির নাই। ছ বছরের মেয়ে, সে তাে বুড়ী। শ্যামা তাহাকে দিয়া দুটি একটি সংসারের কাজ কবায়, মণিকে খেলা দিতে বলে, সময় পাইলে প্রথম ভাগ খুলিয়া একটু একটু পড়ায়। মেয়েটা যেমন দুরন্ত হইয়াছে সেরকম মাথা নাই, কিছু শিখিতে পারে না। তাহাকে অক্ষর চিনাইতেই শ্যামার একমাস সময় লাগিয়াছে, কতদিনে কর খল শিখিবে কে জানে। মাঝে মাঝে রাগ করিয়া শ্যামা মেয়ের পিঠে একটা চড় বসাইয়া দেয়। বিধানও মারে। প্রথম ভাগের পড়া যে শিখিতে পারে না তার প্রতি বিধানের অবজ্ঞা অসীম। এক একদিন সকালবেলা হঠাৎ সে তাহার ক্লাশ-মাস্টার অমূল্যবাবুর মত গম্ভীর মুখ করিয়া হুকুম দেয়, এই বুকু, নিয়ে আয় তো বই তোর—বুকু ভয়ে ভয়ে বই লইয়া আসে, তাহার ছেঁড়া ময়লা প্রথমভাগখানি। ভয় পাইলে বােঝা যায় কি বড় বড় আশ্চর্য দুটি চোখ বকুলের। পড়া ধরিয়া বােনের অজ্ঞতায় বিধান খানিকক্ষণ শ্যামার সঙ্গে হাসাহাসি করে, তারপর কখন যে সে অমূল্যবাবুর মত ধা করিয়া চাঁটি মারিয়া বসে, আগে কারো টের পাইবার যাে থাকে না। শ্যামা শুধু বলে, আহা খোকা, মারিস নে বাবা।

  বকুল বড় অভিমানী মেয়ে, কারাে সামনে সে কখনাে কাঁদে না; ছাদে চিলে কুঠির দেয়াল আর আলিসার মাঝখানে তাহার একটি হাতখানেক ফাঁক গােসাঘর আছে, সেইখানে নিজেকে গুঁজিয়া দিয়া সে কাঁদে। তারপর গােসাঘরখানাকে পুতুলের ঘর বানাইয়া সে খেলা করে। যে পুতুলটি তাহার ছেলের বৌ তার সঙ্গে বকুলের বড় ভাব, দুজনে যেন সই। তাকে শােনাইয়া সে সব মনের কথা বলে। বলে, বাবাকে সব বলে দেব, বাবা দাদাকে মারবে, মাকেও মারবে, মারবে না ভাই বৌমা? এ্যাঁ করে জিব বের করে দাদা মরে যাবে—মা কেঁদে মরবে, হুঁ।

 শীতলের কি হইয়াছে শ্যামা বুঝিতে পারে না, লােকটা কেমন যেন ভোঁতা হইয়া গিয়াছে, স্মৃতিও নাই দুঃখও নাই। সমহমত আপিসে যায়, সময়মত ফিরিয়া আসে, কোনদিন পাড়ার অখিল দত্তের বাড়ি দাবা খেলিতে যায়, কোনদিন বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে রাগারাগিও করে না, দীনদুঃখীর মত মুখের ভাবও করিয়া রাখে না। স্ত্রী ও পুত্রকন্যার সঙ্গে তাহার কথা ও ব্যবহার সহজ ও স্বাভাবিক হয়, অথচ তার কাছে কারো যেন মূল্য নাই, কিছুই সে যেন গ্রাহ্য করে না। শ্যামার টাকা লইয়া পালানোর পর হইতে তাহার এই পাগলামি-না-করার পাগলামি আরম্ভ হইয়াছে। ধার করিয়া রাখালকে টাকা দেওয়ার অপরাধ, শ্যামার জমানাে টাকাগুলি নষ্ট করার অপরাধ, তাহার কাছে অবশ্যই পুরনাে হইয়া গিয়াছে, মনে আছে কিনা তাও সন্দেহ। মাস গেলে আগের টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকা আনিয়া সে শ্যামাকে দেয়, আগে হইলে এই লইয়া কত কাণ্ড করিত, হয় অনুতাপে সারা হইত, না হয় নিজে নিজে কলহ বাঁধাইয়া শ্যামাকে গাল দিয়া বলিত, যা সে আনিয়া দেয় তাই যেন শ্যামা সােনামুখ করিয়া গ্রহণ করব, ঘরে বসিয়া গেলা যাহার একমাত্র কর্ম অত তাহার টাকার খাঁকতি কেন?—এখন টেরও পাওয়া যায় না কম টাকা আনিয়াছে এটা সে খেয়াল করিয়াছে। শ্যামা যদি নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কি করে যে মাস চালাব,—সে অমনি অমায়িক ভাবে বলিয়া বসে, ওতেই হবে গাে, খুব চলে যাবে, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, ইয়ে করতে হয় না, কি কর অত টাকা?

 কমল ঘােষের টাকাটা মাসে মাসে কিছু কম করিয়া দিলে হয়ত চলে, শীতলকে এ কথা বলিতে শ্যামার বাধে। ঋণ যত শীঘ্র শােধ হইয়া যায় ততই ভাল। এদিকে খরচ চলিতে চাহে না। বিধানকে স্কুলে দেওয়ার পর খরচ বাড়িয়াছে, বই খাতা, স্কুলের মাহিনা, পােষাক, জলখাবারের পয়সা এ সব মিলিয়া অনেকগুলি টাকা বাহির হইয়া যায়। যেমন তেমন করিয়া ছেলেকে শ্যামা স্কুলে পাঠাইতে পারে না, ছেলের পরিচ্ছদ ও পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া যে তাহাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছিল, নিতান্ত অভাবের সময়েও শ্যামা তাহা অগ্রাহ্য করিতে পারে না। খরচ সে কমাইয়াছে অন্য দিকে। সত্যভামার এতকালের চাকুরিটি গিযাছে। নিজের জন্য সেমিজ ও কাপড় কেনা শ্যামা বন্ধ করিয়াছে, এ সব বেশি পরিমাণে তাহার কোন দিনই ছিল না, চিরকাল জোড়াতালি দিয়া কাজ চালাইয়া আসিয়াছে, এখন বড় অসুবিধা হয়। স্বামীপুত্র ছাড়া বাড়িতে কেহ থাকে না তাই রক্ষা, নতুবা লজ্জা বাঁচিত না। শীতল আব বিধান বাহিরে যায়, ওদের জামা কাপড় ছাড়া শ্যামা আর কিছু ধােপাবাড়ি পাঠায় না, বাড়িতে কাচিয়া লয়। ছেলেমেযেদের দুধ সে কমাইতে পারে নাই, কমাইয়াছে মাছের পবিমাণ। মাঝে মাঝে ফল ও মিষ্টি আনাইয়া সকলকে খাওয়ানাের সাধ সে ত্যাগ করিয়াছে। এই ত্যাগটাই সব চেয়ে কষ্টকর। শ্যামার ছেলেমেয়েবা ভাল জিনিস খাইতে বড় ভালবাসে।

 তবু এই সব অভাব অনটনেব মধ্যেও শ্যামার দিনগুলি সুখে কাটিয়া যায়। ছেলেমেয়েদের অসুখ বিসুখ নাই। শীতলের যাহাই হইয়া থাক তাহাকে সামলাইয়া চলা সহজ। নিজের শরীরটাও শ্যামার এত ভাল আছে যে একা সংসারের সমস্ত খাটুনি খাটিতে তার কিছুমাত্র কষ্ট হয় না। কাজ করিতে যেন ভালই লাগে।

 চৈত্র শেষ হইয়া আসিল। ছাদে দাঁড়াইলে বসাকদের বাড়ির পাশ দিয়া রেলের উঁচু বাঁধটার ধারে প্রকাণ্ড শিমুল গাছটা হইতে তুলা উড়িয়া যাইতে দেখা যায়। পরে খানিকটা ফাঁকা মাঠের পরে টিনের বেড়ার ওপাশে ধানকলের প্রকাণ্ড পাকা অঙ্গন। কুলি মেয়েরা প্রত্যহ ধান মেলিয়া শুকাইতে দেয়, ধান খাইতে ঝাঁক বাঁধিয়া পায়রা নামিয়া আসে। পায়রার ঝাঁকের ওড়া দেখিতে শ্যামা বড় ভালবাসে, অতগুলি পাখি আকাশে বারবার দিক পরিবর্তন করে এক সঙ্গে, সকাল ও বিকাল হইলে উড়িবার সময় একসঙ্গে সবগুলি পায়রার পাখার নিচে রােদ লাগিয়া ঝকঝক করিয়া ওঠে, শ্যামা অবাক হইয়া ভাবে, কখন কোন দিকে বাঁকিতে হইবে সবগুলি পাখি একসঙ্গে টের পায় কি কবিয়া? ধানকলের এক কোণায় ছােট একটি পুকুর। ইঞ্জিন ঘরের ওদিকে আরও একটা বড় পুকুর আছে। বয়লারের ছাই ফেলিয়া ছােট পুকুরটির একটি তীরকে ওরা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঠেলিয়া আনিয়াছে, পুকুরটা বুজাইয়া ফেলিবে বােধ হয়। ছাই ফেলিবার সময় বাতাসে রাশি রাশি ছাই সাদা মেঘের মত টিনের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া রেলের বাঁধ পার হইয়া কোথায় চলিয়া যায়। আজকাল এসব শ্যামা যেমন ভাবে, চাহিয়া দেখে, কতকাল তেমনি ভাবে সে তা দেখে নাই। বিকালে ছাদে গিয়া সে মণিকে ছাড়িয়া দেয়। মণি বকুলের সঙ্গে ছাদময় ছুটাছুটি করে। আলিসায় ভর দিয়া শ্যামা কাছে ও দূরে যেখানে যা কিছু দেখিবার আছে দেখিতে থাকে। বােধ করে কেমন একটা উদাস উদাস ভাব, একটা অজানা ঔৎসুক্য। পর পর অনেকগুলি গাড়ি রেললাইন দিয়া দুদিকে ছুটিয়া যায়, তিনটা সিগনেলের পাখা বারবার ওঠে নামে। ধানকলের অঙ্গনে কুলি মেয়েরা ছড়ানো ধান জড়ো করিয়া নৈবিদ্যের মত অনেকগুলি স্তূপ করে তারপর হোগলার টুপি দিয়া ঢাকিয়া ফেলে। ছোট পুকুরটিতে ধানকলের বাবু জাল ফেলান, মাছ বেশি পড়ে না—এতটুকু পুকুরে মাছ কোথায়? জাল ফেলাই সার। শ্যামার হাসি পায়। তাহার মামাবাড়ির পুকুরে ও জাল ফেলিলে আর দেখিতে হইতে না, মাছের লেজের ঝাপটায় জাল খান খান হইয়া যাইত। পারিপাৰ্শ্বিক জগতের দশা ও ঘটনা শ্যামা এমনিভাবে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উপভােগ করে। বাড়িঘর, ধানকল, রেললাইন, রাস্তার মানুষ এসব আর কবে তাহার এত ভাল লাগিয়াছিল? অথচ মনে মনে অকারণ উদ্বেগ, দেহে যেন একটা শিথিল ভয়বোধ, হাইতােলা আলস্য। বিধান আজকাল বিকালের দিকে শঙ্করের বাড়ি খেলিতে যায়, ছেলেকে না দেখিয়া তার কি ভাবনা হইয়াছে?

 শীতল বলে, বুড়ো বয়সে তোমার যে চেহারার খােলতাই হচ্ছে গো, বয়েস কমছে নাকি দিনকে দিন?

 শ্যামা বলে, দূর দূর! কি সব বলে ছেলের সামনে!

 শীতলের নজর পড়িয়াছে, শ্যামার ছেঁড়া কাপড় দেখিয়া তাহার চোখ টাটায়। শ্যামার জন্য সে রঙীন কাপড় কিনিয়া আনে। শ্যামা প্রথমে জিজ্ঞাসা করে, ক’টাকা নিলে? টাকা পেলে কোথা?

 হুঁ, কটা টাকা আর পাইনে আমি,—উপরি পেয়েছি কাল। একটি পয়সা তে দেও না আমায়, খরচ চলে কিসে উপরি না পেলে?

 খরচ চলে? শীতল তাহা হইলে আবও উপরি টাকা পায়, খুসিমত খরচ করে। তাহাকে যে টাকা আনিয়া দেয় তাই সব নয়? শ্যামা রাগিগা বলে, কি রকম উপরি পাও শুনি?

 দশ বিশ টাকা, আর কত?

 নিশ্চয় আরও বেশি, মিথ্যে বলছ বাবু তুমি। নিজে নিজে খরচ কর তো সব? আমার এদিকে খরচ চলে না, ছেঁড়া কাপড় পরে আমি দিন কাটাই।

 আরে মুস্কিল, তাই তো কাপড় কিনে আনলাম। আচ্ছা তো নেমকহারাম তুমি।

 শ্যামা রঙীন কাপড়খানা নাড়াচাড়া করে মিষ্টি করিয়া বলে, কি টানাটানি চলছে বোঝ না তো কিছু। কি কষ্টে যে মাস চালাই, ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না। দুচারটে টাকা যদি পাও কেন নষ্ট কর? এনে দিলে সুসার হয়। তোমার খরচ কি? বাজে খরচ কবে নষ্ট কর বৈত নয়। যা স্বভাব তোমার, জানি তো। হাতে টাকা এলে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। এবার থেকে আমায় এনে দিও, তোমার যা দরকার হবে চেয়ে নিও—আর কটা মাস মোটে, ধারটা শোধ হয়ে গেলে তখন কি আর টানাটানি থাকবে? না তুমি দশ বিশ টাকা বাজে খরচ করলে এসে যাবে?

 শ্যামা বলে, শীতল শোনে। শ্যামাকে বোধ হয় সে আরর একজনের সঙ্গে মিলাইয়া দেখে, যে এমনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলিয়া বুঝাইয়া টাকা আদায় করিত। বলিত, আমায় দু’খানা গয়না গড়িয়ে দে, টাকাটা তাহলে আটকা থাকবে। নইলে তুই তো সব খরচ কবে ফেলবি! দরকারের সময় তুই তোর গয়না বেচে নিস, আমি যদি একটি কথা কই—

 সে এসব বলিত মদেব মুখে। শ্যামা কিন্তু—

 তারপর শ্যামা বলে, এ কাপড় তো পরতে পারব না আমি ছেলের সামনে। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, আমার লজ্জা কববে বাবু। না পরতে পার, ওই নর্দমা রয়েছে ওখানে ফেলে দাও।—শীতল বলে।

 রাত্রে ছেলেমেয়েরা সব ঘুমাইয়া পড়িলে শ্যামা আস্তে আস্তে শীতলকে ডাকে। বলে, হ্যাঁগা, ঘুমুলে নাকি? ফুটফুটে জ্যোছনা উঠেছে দিব্যি, ছাতে যাবে একবারটি?

 শীতল বলে, আবার ছাতে কি জন্যে?—কিন্তু সে বিছানা ছাড়িয়া ওঠে।

 শ্যামা বলে, গিয়ে একটা বিড়ি ধরাও, আমি আসছি।

 রঙীন কাপড়খানা পরিয়া শ্যমা ছাদে যায়। বড় লজ্জা কবে শ্যামার—শীতলকে নয়, বিধানকে। ঘুম ভাঙ্গিয়া রাত দুপুরে তার পরণে রঙীন কাপড় দেখিলে, ও যা ছেলে—ওর কি আর বুঝিতে বাকি থাকিবে শীতলের মন ভুলানাের জন্যে সে সাজগােজ করিয়াছে? অথচ শীতল সখ করিয়া কাপড়খানা আনিয়া দিয়াছে, একবার না পরিলেই বা চলিবে কেন?

 শামা মাদুর লইয়া যায়। মাদুর পাতিয়া দুজনে বসে: চাঁদের আলােয় বসিয়া দুজনে দুটো একটা সাংসারিক কথা বলে, বেশি সময় থাকে চুপ করিয়া। বলার কি আর কথা আছে ছাই এ বয়সে! হ্যাঁ, শীতল শ্যামাকে একটু আদর করে। শীতলের স্পর্শ আর তেমন মোলায়েম নয়। কখনো যেন স্ত্রীলোকের সঙ্গ পায় নাই এমনি আনাড়ির মত আদর করে। শ্যামা দোষ দিবে কাকে, সেও তাে কম মােটা হয় নাই!

 তারপর একদিন শ্যামা সলজ্জ ভাবে বলে, কি কাণ্ড হয়েছে জান?

 শীতল শুনিয়া বলে, বটে নাকি!

 শ্যামা বলে, হ্যাঁ গাে, চোখ নেই তোমার? কি হবে বলত এবার, ছেলে না মেয়ে?

 মেয়ে।

 উঁহুঁ ছেলে।—বুকু বেঁচে থাক আমার, আর মেয়েতে কাজ নেই বাবু।

 বলিয়া শ্যামা হাসে। মশুর পরিপূর্ণ হাসি দেখিয়া কে বলিবে, শীতলের মত অপদার্থ মানুষ তাহার মুখে এ হাসি যােগাইয়াছে।