জন্ম ও মৃত্যু/জন্ম ও মৃত্যু

জন্ম ও মৃত্যু

 জীবনের মাঝে মাঝে বেশ চমৎকার ব্যাপার ঘটে। ভেবে দেখবার ও উপভোগ করবার জিনিস হিসেবে সেগুলোর মূল্য বড় কম নয়। সম্প্রতি আমার অভিজ্ঞতার গণ্ডীর মধ্যে এমনই একটা ঘটনা এসে পড়েছিল—ঠিক একটা ঘটনা না ব’লে বরং তাকে দুটো ঘটনার সমষ্টিই বলা যেতে পারে।

 মধুপুরে একটা বাড়ি ভাড়া করবার দরকার ছিল—এক জায়গায় সন্ধান পেলাম— ভবানীপুরের এক ভদ্রলোকের বাড়ি আছে মধুপুরে এবং তিনি সেটা ভাড়া দেবেন। সকাল বেলা তাঁর ওখানে গেলাম, বেলা তখন দশটা। ভবানীপুরে ভদ্রলোক যে বাড়িতে থাকেন তা বেশ বড় বাড়ি। বাইরে সুসজ্জিত বৈঠক খানা, কিন্তু তিনি তখন বৈঠকখানার পাশে একটা ছোট ঘরের তক্তাপোশের উপর ব’সে গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়ে তামাক খাচ্ছিলেন।

 ভদ্রলোক বৃদ্ধ, বয়সে পঁয়ষট্টির কাছাকাছি মনে হ’ল। কিন্তু তিনি নিজেই তাঁর বয়সের সম্বন্ধে আমার মনে কোন কল্পনার স্থান রাখলেন না। বললেন—আসুন, আসুন, বড় ভালো দিনে এসেছেন। আজ আমার জন্মতিথি কি-না, তাই বাড়িতে একটু উৎসব গোছের আছে। তা বেশ, এসেছেন যখন আপনাকেও ছাড়ছিনে—ইত্যাদি।

 কারুর জন্মতিথি উৎসবে যে ভাবে তাকে মিষ্ট কথা বলবার কথা আছে—ভদ্রলোককে আমি তা বললাম। কাজের কথাটা এই উৎসবের দিনে কি ভাবে পাড়া যায়? বা কতক্ষণ ধ’রে জন্মতিথিতে মঙ্গলেচ্ছা প্রকাশ সংক্রান্ত কথাবার্তা বলবার পরই বা কাজের কথা পাড়া সুষ্ঠু হবে—কিংবা আজকার দিনে বাড়ি ভাড়ার দরদস্তুররূপ ইতরজনোচিত কথাবার্তা বলা আদৌ শোফন হবে কি-না—ইত্যাদি মনে মনে তোলা-পাড়া করছি এমন সময়ে একটি সুন্দরী তরুণী হাসি মুখে বড় একটা ফুলের তোড়া হাতে ঘরে ঢুকলেন, পেছনে একটি যুবক। গৃহকর্তা ব’লে উঠলেন—এই যে অরুণা এসেছিস্ দিদি—ওঃ, পেছনে যে নির্মলকে গাঁটছড়া বেঁধে এনে হাজির করেছিস্—ছেড়ে আসা যায় না বুঝি? বেশ বেশ, আমরা হয়ে গিয়েছি এখন বুড়োসুড়ো—

 তরুণী ফুলের তোড়াটি বৃদ্ধের হাতে দিয়ে প্রণাম ক’রে এবং হাসি মুখে বৃদ্ধের গালে দুটি ঠোনা মেরে ঘর থেকে বার হ’য়ে গেল, যুবকটিও গেল পেছনে পেছনে। বললেন—আমার নাতনী—আমার বড় ছেলের মেয়ে। আই, এ পাস—ও বছর বিয়ে হয়েছে—স্বামী ইঞ্জিনিয়ার, বিলেত ফেরত, কর্পোরেশনে ভালো চাকরি পেয়েছে।

 কথা তখনও ভালো ক’রে শেষ হয়নি, আর দুটি তরুণী ঘরে ঢুকল—এদের ঘাড়ের উপর এলোখোপা এলিয়ে পড়েছে—পরনে জামিয়ারের মতো ছোট কল্কার কাজ করা নীল শাড়ি ও ব্লাউজ, গলায় সরু মফ্‌চেন, পায়ে সোনালী জরীর কাজ করা নাগরা। দুইটিই অবিবাহিতা—একটি গৌরী, অপরটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। এরাও ফুলের তোড়া দিলে—গৌরী মেয়েটি ঝিনুকের কাজ করা একটি নস্যদানী বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বললে—বাবা পাঠিয়েছেন কুন্নুর থেকে—মা আসতে পারলেন না এখন—রাত্রে আবার থিয়েটারে যাবেন।

 বৃদ্ধ বললেন——আজ দু’জনে বুঝি স্কুল কলেজ কামাই ক’রে ব’সে আছ? যা, ও ঘরে যা—হরিদাসকে বলে রাখ্ গাড়ির কথা। আমার এর পরে মনে থাকবে না।

 তরুণী দুটি চলে যেতেই বৃদ্ধ বললেন—আমার মেজ মেয়ের মেয়ে—বাগবাজারে আমার মেজ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। গোরাচাঁদ মল্লিকের নাম শুনেচেন তো? ওই তাদেরই বাড়ি। বনেদী বংশ—গোরাচাঁদ মল্লিক ছিলেন আমার মেয়ের শ্বশুরের···এই যে ভূধর! এসো, এসো বাবা—ব’সো।

 এবার আরও গুরুতর ব্যাপার। যাঁকে সম্বোধন করা হ’ল এবং যাঁর নাম ভূধর তাঁর বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন। তিনি স্থূলকায় হ’লেও সঙ্গের মহিলাটির তুলনার তিনি নিতান্ত কৃশ। এঁদের স্বামী-স্ত্রীর পেছনে চার পাশ ঘিরে ছ’ সাতটি ছেলেমেয়ে। এদের বয়েস দশ থেকে ঊনিশের মধ্যে—আর একটি কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে একটু পিছিয়ে ছিল—তার কোলে একটি শিশু কিন্তু এ পর্যন্ত যে কয়টি মেয়ে এখানে দেখলুম, তার মধ্যে এই মেয়েটিই সর্বাপেক্ষা সুন্দরী।

 বৃদ্ধ তার দিকে চেয়ে বললেন— এই যে মৃণাল, পিছিয়ে কেন—আয় আয়, খোকাকে দেখি, দে একবার ভাই আমার কোলে। নিশীথ এল না?

 আমার অবস্থা শোচনীয় হ’য়ে উঠেছে। ছোট ঘরে যে ফাঁকা জায়গাটুকু ছিল স্বামী-স্ত্রী তার অনেকটা অংশ জুড়ে দাঁড়িয়েছেন। বাকিটা জুড়েছে ছেলেমেয়ের দল—পেছনের মেয়েটির জন্যে তেমন জায়গা নেই, আমি সঙ্কুচিত অবস্থায় চেয়ার যতদূর সম্ভব পিছিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি। জড় পদার্থকে আর সঙ্কুচিত করা সম্ভব নয়। অথচ এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঠেলে যে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে এদের স্থানের সঙ্কুলান করবো তাও অসম্ভব। এরা আমাকে সঙ্কোচের হাত থেকে শীঘ্রই অব্যাহতি দিলেন—এই জন্যে যে পেছনে আর একদল এসে ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে, এরা না বেরুলে তারা ঢুকতে পারে না। এরা তো প্রত্যেকে এক-একটা তোড়া দিয়ে গেল—দুটি মেয়ে আবার দুটি বেলের গোড়ে বৃদ্ধের গলায় নিজেরা পরিয়ে দিলে—বৃদ্ধ কি একটা ঠাট্টাও করলেন। আমার তখন শোনবার মতো অবস্থা ছিল না। তারা ঘর থেকে বা’র হয়ে গেলে বৃদ্ধ বললেন—এই আমার বড় ছেলে তারক, আলিপুরে প্রাক্‌টিস্ করে, বালিগঞ্জে বাড়ি করেছে, সেখানেই থাকে। পিছনের দলটির মধ্যে মহিলা নেই—তিনটি ছোকরা, বয়সে ষোল থেকে একুশ, এরা এসে কিছু দিলে না, একজন অটোগ্রাফের খাতা বার করে বললে—জেঠামশায়, আমার খাতায় আজকের দিনে কিছু লিখে দিন। অটোগ্রাফের খাতা ফেরত দিতে না দিতে আর দুটি ছেলে, তাদের সঙ্গে বারো তেরো বছরের একটি বেণী দোলানো মেয়ে।

 তারপরে ব্যাপারটা গণনার বাইরে চলে গেল।

 কত ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া যে ঘরটায় ঢুকতে বেরুতে লাগল, আমার আর তাদের হিসেব রাখা সম্ভব হ’ল না। ফুলে ফুলে তক্তাপোশটা ছেয়ে গেল, ফুলের তোড়। ক্রমশ উঁচু হ’য়ে উঠতে লাগল—আর সেখানে জায়গা দেওয়া যায় না। আর এরা সবাই আত্মীয়-আত্মীয়া, বাইরের লোক কেউ নেই। সব আপনা-আপনির মধ্যে, পুত্র-কন্যা, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, জামাই, ভ্রাতৃবধূ, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্রী—ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রলোক ভাগ্যবান, এঁদের মতো লোকের সাহায্য না পেলে প্রজাপতির সৃষ্টি রক্ষা অসম্ভব হ’য়ে উঠ্‌ত। ক্রমশ ভিড় বাড়চে দেখে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লুম, আমি তখন হাঁপিয়ে উঠেছি। ভদ্রলোকও গোলমালের মধ্যে আমাকে তখন ভুলে গিয়েছেন। আমি তখন বাড়ির বাইরে এসে হাঁপ্ ছেড়ে বাঁচি। বাড়ির সামনের গলিতে সারবন্দী মোটর দাঁড়ানো—সেখানে ধরেনি, গলি ছাপিয়ে মোটরের সারি বড় রাস্তায় এসে পৌঁছেচে, বিয়ে বাড়িতেও এত মোটর জমে কি-না সন্দেহ। গলি পার হ’য়েই বড় রাস্তার মোড়ে নিবারণ মিত্রের সঙ্গে দেখা—সে আমার পরিচিত বন্ধু, সেজেগুজে সিল্কের পাঞ্জাবি শুঁড়ওয়ালা নাগরা পরে তাকে ব্যস্তসমস্ত ভাবে গলিতে ঢুকতে উদ্যত দেখে বললুম, ওহে, তুমিও কি বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি যাচ্ছে। না কি?

 —হাঁ। কেন বলত? তুমি বিশ্বনাথবাবুকে চিনলে কি করে?

 —এতক্ষণ সেখানে বসেছিলুম ভাই, দেখে শুনে মাথা ঘুরে উঠল। শহরের এক-তৃতীয়াংশ লোক দেখলুম বিশ্বনাথবাবুর আত্মীয়-আত্মীয়া, আর তাঁরা সবাই এসেছেন ওই সাতাত্তর বছরের বুড়োর জন্মদিনে ফুলের তোড়া উপহার দিতে। তোমার তোড়া কই?

 বন্ধু হেসে বললে—খুব আশ্চর্য লাগছে? বিশ্বনাথবাবুর সাত ছেলে, চার মেয়ে। এদের সকলেরই আবার ছেলেমেয়ে এবং অনেকেরই নাতি নাতনী, নাতজামাই ইত্যাদি হ’য়ে গিয়েছে। বিশ্বনাথবাবুরা তিন ভাই। তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনী আছে। হিসেব ক’রে দ্যাখো কত হয়—এবং আসল কথা কি জানো, বুড়োর হাতে হাজার পঞ্চাশ ষাট টাকা আছে, সকলেরই চোখ সেদিকে একথা যদি বলি, তবে সেটা খুব খারাপ শোনাবে হয়তো। কিন্তু কথাটা মনে না উঠে কি পারে? তুমিই বলো। আচ্ছা, আসি ভাই, দেরি হ’য়ে যাচ্ছে।

 বিশ্বনাথবাবুর জন্মদিনের সপ্তাহ দুই পরেই আমি স্বগ্রামে গেলুম। বলা আবশ্যক যে, আমার গ্রামের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব বেশি নয়, সেখানে বছরে একবার যাওয়াও ঘটে কি-না সন্দেহ।

 বাড়ি গিয়ে শুনলুম গ্রামের বৃদ্ধা শশী-ঠাকরুণ মারা গিয়েছেন। শশী-ঠাকরুণের বয়স যে কত হ’য়েছিল, তা বলা শক্ত। কেউ বলে নব্বুই, কেউ বলে একশো’র কাছাকাছি হবে। আমরা মোটের উপর তাঁকে আমাদের বাল্যকাল থেকেই অতি বৃদ্ধাই দেখে আসছি। বয়সের যে গণ্ডী পার হ’য়ে গেলে মানুষের আকৃতির পরিবর্তন আর চেনবার উপায় থাকে না, শশী-ঠাকরুণ আমাদের বাল্যেই সে গণ্ডী পার হয়েছিলেন। শশী-ঠাকরুণের চার ছেলে, তিন মেয়ে। বড় ছেলেটি ছাড়া আর সকলেই বিদেশে চাকরি করে—বড় ছেলে তেমন লেখাপড়া না জানার দরুণ দেশে থেকে সামান্য কি কাজকর্ম করে, তার অবস্থাও ভালো নয়, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্ট পায়। ভায়েরা পৃথক, কেউ কাকে সাহায্য করে না। কর্মস্থান থেকে দেশেও কেউ আসে না।

 শশী-ঠাকরুণের কষ্টের অবধি ছিল না। একটা চালা ঘরে ইদানীং তিনি পড়ে থাকতেন—বড় ছেলেই তাঁর ভরণ-পোষণ করতো বটে, কিন্তু তেমন আগ্রহ ক’রে করতো না। অর্থাৎ তার মনের মধ্যে এ ভাবটা জেগে রইতো যে, মা তো আমার একার নয়—সকলেরই তো কিছু কিছু সাহায্য করা উচিত মাকে—তারা যদি না করে আমিই বা কেন এত দায় ঘাড়ে করতে যাই?

 শশী-ঠাকরুণের অন্য ছেলেরা কখনো সন্ধান নিত না—বুড়ী বাঁচল, কি মোলো। অথচ তাদের সকলেরই অবস্থা ভালো—মাইনে কেউই মন্দ পায় না, শহরে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকে। বড় ভাইয়ের পত্রের জবাব দিত—তাদের নিজেদেরই অচল হ’য়েছে, শহরের খরচ থেকে বাঁচিয়ে বাড়িতে কি ক’রে পাঠায়। বাড়িতে বিষয়-সম্পত্তি তো রয়েছে—তার আয় থেকে তো মায়ের চলা উচিত—ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়-সম্পত্তি এমন কিছুই না যার আয় থেকে বেকার বড় ছেলের একপাল পোষ্য ও শশী-ঠাকরুণের ভরণ-পোষণ ভালো ভাবে চলে।

 বুড়ী খেতেই পেত না। ইদানীং আবার তার ছেলেমানুষের মতো লোভ দেখা দিয়েছিল—বিশেষ ক’রে মিষ্টি জিনিস খাবার! আমি সেবার যখন দেশে যাই, বুড়ী দেখি একটা কঞ্চির লাঠি হাতে মুখুয্যে পাড়ার মোড়ে বেলতলায় বসে। আমায় দেখে বললে, কুঞ্জ এলি নাকি?

 —হাঁ, ঠাক্‌মা। এখানে ব’সে কেন?

 —এই বাদা বোষ্টম খাবার বেচতে যাবে, তাই ব’সে আছি তার জন্যে। বাতাসা কিনব —ভিজিয়ে খাই।

 তা বেশ, বসো। ভালো আছ তো?

 —আমাদের আবার ভালো থাকা থাকি, তুমিও যেমন দাদা। খেতেই পাইনে। বাদার কাছে চারটে পয়সা ধার হ’য়েছে, আর সে ধার দিতে চায় না। সিধুর কাছে আর কত চাইব? সে নিজের ছেলেপিলে নিয়ে আথান্তরে পড়ে আছে। আহা, বাছার আমার মুখ দেখলে বুক ফেটে যায়। আমি তার কাছে কিছু নিই নে।—তা তুই আমাকে আনা চারেক পয়সা দিয়ে যাবি?

 বুড়ীর অবস্থা দেখে বড় কষ্ট হ’ল। পকেট থেকে একটা টাকা বার করে তার হাতে দিয়ে বললাম—এখন রাখুন ঠাক্‌মা, যখন যা দরকার হয়—আমি যতদিন বাড়ি থাকি, দিয়ে যাব আপনাকে।

 বুড়ী অবাক্ হ’য়ে গেল—আনন্দে বিস্ময়ে সে যেন প্রথমটা বুঝতেই পারলে না—আমি কি তাকে সত্যি একটা গোটা টাকা দিলুম।

 পরের বছর—পুজোর কিছু আগে দেশে গিয়েছি—বুড়ী দেখি আমাদের বাড়ির সামনের বাতাবি লেবুর তলার পথটা দিয়ে যাচ্ছে—হাতে একটা কাঁসার জামবাটি। আমায় দেখে বললে—কখন বাড়ি এলি?

 বললুম—কাল এসেচি ঠাক্‌মা। বাটি হাতে কোথায় গিয়েছিলেন?

 —আর বলিস্‌নে, দাদা! বাটিটা নাপিতবাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম যদি ওরা কেনে। আমার দিন তো আর চলে না, হাতে মোটে পয়সা নেই। সিধু খুলনে গিয়েছে—আজ চার-পাঁচদিন। বাড়ি একেবারে অচল। ছেলেপিলেগুলো খেতে পায় না এমন অবস্থা।

 —তা বাটিটা বিক্রি করে আর ক’দিন যাবে ঠাকুমা?

 —তবু যে ক’দিন যায়। তাও ওরা নিলে না—বলে এখন নগদ দিতে পারব না। ধারে বাটি দিলে আমার কি করে চলে ভাই বলো তো? একটু গুড় খেতে পাচ্ছিনে, বাটিটা বেচে ভেবেছিলাম আজ হাটে আধসের ভালো আকের গুড় আনতে দেব—আর আজকের হাটটাও হবে এখন। ছেলেপিলে শুধু ঝিঙে ভাজা আর ভাত খেয়ে মারা গেল। তা নিবি দাদা বাটিটা!—ফুল কাঁসা, এ ওদের বাটি না। আমার নিজের বাটি——বিয়ের দানে আমার বাবা দিয়েছিলেন, দ্যাখ্ না?

 শহরে থাকি,—অনেক সময় কাঁচা পয়সা রোজগার করি। পাড়াগাঁয়ে যে এত পয়সার কষ্ট তা ভেবে দেখি নে। আমায় অন্যমনস্ক দেখে বুড়ী ভাবলে বোধ হয় বাটি কিনবার ইচ্ছে নেই আমার। অনেকটা মিনতির সুরে বললে—না কিনিস, ওটা বাঁধা রেখে আমায় বরং আট আনা পয়সা দে।

 এ রকম অবস্থায় বুড়ীকে আমি আরও কয়েকবার দেখেছি।

 শুনলাম—বুড়ীর মরণকালে ছেলেরা কেউ আসেনি—বড় ছেলে খুব সেবা-যত্ন করেছিল। বুড়ীর গায়ে একটা লেপ ছিল, মরণের ঘণ্টা দুই আগে বুড়ী পুত্রবধূকে বলেছিল—বৌমা, লেপটা সরিয়ে নাও, চার-পাঁচ টাকা দামের লেপটা—আমি বাঁচব না, তখন ওটা আমার সঙ্গে ফেলে দিতে হবে। ও গেলে আর হবে না বৌমা। আহা, কোথায় পাবে সিধু যে, আবার চারপাঁচ টাকা খরচ ক’রে লেপ বানাবে? শীতকালে বাছারা আমার আদুড় গায়ে কাটাবে তা হ’লে।

 আরও খানিক পরে বুড়ী ছেলেকে ডেকে বললে—দ্যাখ্ সিধু, একটা কথা বলি, শোন্। আমার শ্রাদ্ধে বেশি কিছু খরচপত্র করতে যাসনে যেন। বিধু, মণি, শরৎ ওরা কেউ কিছু হয়তো দেবে না—তুই একা পাবি কোথায় যে খরচ করবি? নমো নমো করে অমনি পাঁচটি ব্রাহ্মণ খাইয়ে দিবি। আর যদি ওরা কেউ কিছু পাঠায়, তাও সব টাকা খরচ করিস্ নে। হাতে কিছু রাখবি,—এর পরে তোর ছেলে-পিলেরা খেয়ে বাঁচবে।

 শুনলাম শশী-ঠাকরুণের ছেলেরা সবাই বাড়ি এসেছে ও খুব ঘটা করে মায়ের শ্রাদ্ধ করছে।

 বেড়াতে বেড়াতে ওদের বাড়ির দিকে গেলাম। সামনের উঠানে নারিকেলের ডাল পুঁতে বৃষোৎসর্গ শ্রদ্ধের মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে—মণ্ডপের সামনে সামিয়ানা টাঙানো। গ্রামের অনেকেই সেখানে উপস্থিত, সেজ ছেলে গোপেশ্বর কাছা গলায় গ্রামের বৃদ্ধ চৌধুরী মহাশয়ের সঙ্গে আফিসে নূতন লোক ঢোকানো আজকাল যে কত অসম্ভব হ’য়েছে—সে সম্বন্ধে কি বলচে। গোপেশ্বরের বয়েস পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে, রেলের অডিট আফিসে বড় চাকুরি করে—চৌধুরী মহাশয় বোধ হয় তাকে কারো চাকুরির জন্যে ব’লে থাকবেন, কথার ভাবে তাই মনে হ’ল।

 —আগে অনেক ঢুকিয়েছি কাকাবাবু, সিমসন গিয়ে পর্যন্ত আর সেই সুবিধে নেই। সিমসন সাহেব, আমি যা বলেছি তাই করেছে। এখন পোস্ট খালি হ’লে সব তলায় তলায় ঠিক হ’য়ে যায়—আপিসের আর সেই দিন নেই। শুনলাম গোপেশ্বর রিটায়ার করবার পরে প্রভিডেণ্ট ফণ্ডের দরুণ প্রায় আঠার ঊনিশ হাজার টাকা পাবে, হাওড়ায় না বরানগরে জমি কিনেছে, সেই খানেই বাড়ি করবে। আজ দশ-এগারো বছরের পরে সে দেশে এসেছে, মায়ের মৃত্যু না ঘটলে, আরও কতদিন আসতো না তাই বা কে জানে?

 ওদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমি অবাক্ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদের বাড়িতে যে এত ছেলে-মেয়ে, বৌ, ঝি-চাকর আছে—তা চোখে না দেখ্‌লে বিশ্বাস করবার জো ছিল না। মেজ, সেজ ও ছোট ছেলের বৌয়েরা এসেছে, তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি, নাতনীতে বাড়ি ভর্তি। খুব ছোট বেলায় যে মেয়েদের দেখেছিলাম, হয়তো অনেকের সঙ্গে খেলাও করেছি—তাদের বিয়ে হ’য়ে ছেলেপিলে হয়ে গিয়েছে—অনেকের স্বামীরাও এসেছে। তবু তো বুড়ীর বড় মেয়ে অনেক দূর থাকে ব’লে আসতে পারেনি—অপর দুই মেয়ে ও তাদের ছেলেমেয়েরা এসেছে। সবাই ব্যস্তসমস্ত, এখানে তরকারি কোটা হ’চ্চে, ওখানে জিনিসের ফর্দ হ’চ্ছে, বাড়িময় ছেলেমেয়েদের চিৎকার, হাসি, ছোটাছুটি—মেয়েরা এ ওকে ডাকছে, মায়েরা ছেলেপিলেদের বকছে, কুয়োতলায় বড় বড় পেতলের গামলা মাজার শব্দ, বাড়িসুদ্ধ সবাই শশব্যস্ত, কারো হাতে একদণ্ড সময় নেই।

 —ওরে ও ঝি, রেণুর গায়ের জামাটা ছাড়িয়ে নিয়ে কেচে দেনা বাপু, কতক্ষণ থেকে বলছি, আমার কি সব সময় সব কথা মনে থাকে?

 —ও কমলা, হেলে দুলে বেড়ােচ্ছ মা, ততক্ষণ পানগুলো তুমি আর বীণা নিয়ে ধুয়ে ফেল না—এরপর আর সময় পাবে?···কি—কি—আবার মরছে ডেকে ছোট বৌ―মাগো, হাড় জ্বালালে—বসতে দেয় না একরত্তি—এই তো আসছি ভাঁড়ার ঘর থেকে—

 একটি সতরো-আঠারো বছরের সুন্দরী মেয়ে দালানে ঢুকবার দরজায় এক পাশে একটা স্টোভ ধরাবার চেষ্টা করছে—আমি পাশ কাটিয়ে দালানের মধ্যে ঢুকে দেখি—মেজ ছেলে বীরেশ্বর ও তার বৌয়ে ঝগড়া হ’চ্ছে। মেজ ছেলে কোন জমিদারী ষ্টেটের ম্যানেজার, বয়েস পঞ্চাশের ওপর—তার স্ত্রীকে আগে কৃশাঙ্গী দেখেছি, আজ আট ন’ বছর দেখিনি—এত মোটা হয়েছেন যে এরি মধ্যে প্রথমটা যেন চিনতেই পারি না। হাতে মোটা সোনার বালা ও অনন্ত, গলায় ছিকলি হার। তিনি স্বামীকে বলছেন—ও ঘরে আমি থাকতে পারব না, এই ভিড়, তাতে ও ঘরে খিল নেই। আমার মেয়ের গায়ে এক গা গয়না, কাজের বাড়ি, লোকের ভিড়—বিশ্বাস আছে কাউকে—তাতে এই পাড়াগাঁ জায়গা। বাবা, ভালোয় ভালোয় কাজ মিটিয়ে এখন এখান থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি। কাল সারারাত মশায় খেয়েছে।

 বীরেশ্বর বলচে, তা তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে না হয় পশ্চিমের কোঠায় শুয়ো—মাথা গরম কোরোনা, দোহাই তোমার——তোমার মাথা গরম আমার বরদাস্ত হয় না বাপু—

 আমি ঢুকে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে বললুম—চিনতে পারেন কাকীমা?

 তিনি কথার উত্তর দেবার পূর্বেই এগারো বারো বছরের একটি মেয়ে কোথা থেকে ছুটে এসে বললে—নাথ্‌নি এখনও পিণ্টুকে দুধ খাওয়ায়নি মা—সকাল থেকে তাকে নিয়ে বাইরের উঠোনে বসে আছে—বললেও শুনচে না—

 বীরেশ্বর বললে—যা এখন যা, বলগে যা নাথ্‌নিকে—আমি ডাকছি। এসো কুঞ্জ বসো। ওগো তুমি কুঞ্জকে চিনতে পারলে না?

 রেশ্বরের স্ত্রী মৃদু হাস্যে বললে—দেখেছি বোধ হয় ওকে ছেলেবেলায়, যাতায়াত নেই—দেখাশুনো তো হয় না, না চিনবার আর দোষ কি বল? শাশুড়ী মারা না গেলে কি এখন আসা হ’ত? চিঠি পেয়ে আমি বলি—না যেতে হবে বই কি, দেশে একটা মানখাতির আছে। শাশুড়ীর কাজটা ভালো করে না করলে লোকে ওঁদেরই দুষবে। বট্‌ঠাকুরের পয়সা নেই সবাই জানে। ওঁদের গাঁয়ে ঘরে নাম রয়েছে, দেশে-দেশে সবাই মানে, চেনে, বলবে——অমুক বাবুর মায়ের শ্রাদ্ধে কিছুই করেনি, বলত বাবা, কথাটা কি শুনতে ভালো?······তাই তো এলুম নইলে এসব জায়গায় কি মানুষ আসে? কি মশা! কাল রাত্তিরে একদণ্ড চক্ষের পাতা বুজতে দেয়নি।

 রোয়াকের ধারে বসে মেজ ভাইয়ের ছেলে বিকাশ তাদের স্কুল কি ভাবে একটা ফুটবল ম্যাচ্ জিতেছে, মহাউৎসাহে সে গল্প করছে সেজ ভাইয়ের ছেলে বিনুর কাছে। বড় ভাইয়ের ছেলে ভোলা অবাক্ দৃষ্টিতে ওদের মুখের দিকে চেয়ে এক মনে গল্প শুনছে। তার বয়েস ওদের চেয়ে যদিও বেশি, কিন্তু জীবনে কখনো সে গাঁয়ের আপার প্রাইমারী পাঠশালা ছাড়া অন্য স্কুলের মুখ দেখেনি। এদের কাছে সে সর্বদা কুণ্ঠিত হ’য়ে আছে। শুধু ভোলা নয়—ভোলার মাকেও লক্ষ্য করলুম,—জায়েদের বড়মানুষি চালচলন ও কথাবার্তার মধ্যে নিতান্ত সঙ্কুচিত হ’য়ে আছে। জায়েরা বড়মানুষি দেখাবার জন্যে প্রত্যেকে ঝি, চাকর এনেছে, তাদের কাছেও যেন ও-বেচারী কুণ্ঠিত ও সঙ্কুচিত।

 হঠাৎ কোথা থেকে বিকাশের ছোট দিদি আরতি ঝড়ের মত এসে বললে—এই যে এখানে বসে গল্প হচ্ছে ছেলের। ওদিকে কাকীমা, দিদি—সব ডেকে ডেকে হয়রান, চা হ’য়ে গেছে, খেয়ে এসে সবারই মাথা কেনো, যাও—

 ওকে দেখেই আমার একটা ছবি মনে এসে গেল। বৃদ্ধা, মাজা বাঁকা, গাল তোবড়ানো শশী-ঠাকরুণ কাঁসার বাটি বিক্রয় করতে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরছে নাপিত-বাড়ি থেকে। এই হাসিমুখ বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, তরুণী—এদের সৌন্দর্য, সজীবতা, আনন্দ, যৌবন—এদের সৃষ্টি করেছে সেই দরিদ্রা বৃদ্ধা শশী-ঠাকরুণ—এরা তারই বংশধর—তারই পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, আজ তার মৃত্যু-বাসরে এই যে চাঁদের হাট বসেছে—এতদিন এরা ছিল কোথায়? এরা থাকতে বুড়ী কেন খেতে পেত না, কেন চোখের জলে তার বুক ভেসেছে—তার কোন উত্তর নাই।

 সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সেই বাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ভদ্রলােকের বাড়ির উৎসবের কথাও মনে পড়ে গেল। এইরকমই অগণিত পুত্র, কন্যা, পৌত্র, দৌহিত্রীর, দৌহিত্র ভিড় দেখেছি সেখানেও। সবই সেইরকম—কেবল সেটা ছিল জন্মতিথি উৎসব—জন্মতিথি যার, তার বয়েস শশী-ঠাকরুণের মতােই প্রায়।