আদর্শ-নেতা

( সুভাষচন্দ্রের ইংরাজী রচনার অনুবাদ )

 প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন একটা সঙ্কট-কাল আসে, যখন তাহাকে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ সংকল্প গ্রহণ করিতে হয়। কখনও দুই চারিজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাহা স্থির করেন, কখনও বা উহার ভার একজনের উপরেই পড়ে। যে বা যাহারা সমগ্রজাতির ভবিষ্যৎ সুখশান্তি এইরূপ হাতের মুঠায় লইয়া দাঁড়ায়, তাহারা সেই ভীষণ দায়িত্ব কি উপায়ে পালন করিতে পারে? অতি ধীরে ও গভীর চিন্তাসহকারে, অগ্র-পশ্চাৎ ভাবিয়া, উপায়ান্তরের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, অতিশয় সাবধানে ভাল-মন্দ ফলাফল বিচার করিয়া―তবে একটা কর্মপদ্ধতি স্থির করিতে হয়। কিন্তু এত ভাবনা ও চিন্তা সত্ত্বেও কাজটি দুরূহ হইয়া থাকে। তেমন সংশয়-সঙ্কটে নেতামাত্রেই বুদ্ধির স্থিরতা ও সাহসের দৃঢ়তাসহকারে কর্ত্তব্য-নির্ণয় করিতে পারেন না। যতই বিজ্ঞ বা বুদ্ধিমান হউন না কেন, উপযুক্ত পরিমাণ জ্ঞানের অভাব হইতে পারে; যত দিক দেখা দরকার এবং যত বিষয় জানা থাকা আবশ্যক, তাহাও সকলের পক্ষে সকল ক্ষেত্রে সম্ভব না হইতে পারে।

 আমরা মাঝে মাঝে একটা কথা শুনি এই যে, বুদ্ধি যেখানে হার মানে সেখানে অপর এক বৃত্তি কার্য্যকরী হইয়া থকেে, ইহার নাম― অন্তর্দৃষ্টি, অপরোক্ষ-জ্ঞান (Instinct বা Intuition)। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ পুরুষ-বীরগণ ইহারই বলে ঘোর অন্ধকারে পথ নির্ণয় করিয়াছেন, এবং পরে সেইরূপ কার্য্যের ফলাফল দৃষ্টে প্রমাণ হইয়াছে যে, সেই দৃষ্টি মিথ্যা বা ভ্রান্ত নহে। ইহা অনেক পরিমাণে সত্য। আমাদেরই সংকীর্ণ অভিজ্ঞতায় আমরা দেশ-বিশেষের নেতাকে ঐরূপ রাজনৈতিক বােধ-শক্তির পরিচয় দিতে দেখিয়াছি; তাঁহারা অতিশয় সঙ্কট-মুহূর্ত্তে যেন ঐরূপ একটা উদ্দীপ্ত চেতনার বশে এমন কাজ করিয়াছেন যাহা সে সময়ে অতিশয় দুঃসাহসিক বলিয়া মনে হইয়াছিল, কিন্তু পরবর্তী ঘটনা-প্রমাণে তাহাই অতিশয় সমীচীন বিবেচিত হইয়াছে। এই যে অপরা-বুদ্ধি, ইহা কিরূপ? একহিসাবে উহা একটি জন্মগত শক্তি। অপর সকল প্রতিভার মত, রাজনৈতিক প্রতিভাতেও একটি সহজাত বোধশক্তি গােড়া হইতে থাকা একান্ত আবশ্যক।

 কিন্তু ঐ জন্মগত সংস্কারকেও শিক্ষা ও সাধনার দ্বারা উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে হয়, তাহার জন্য নিরন্তর অনুশীলন চাই। ঐ বেশ শক্তি প্রায়শঃ কার্য্যকরী হইলেও প্রতিবারেই হইবে, এমন নিশ্চয়তা নাই। এখন, কোন নেতার পক্ষে সেই সহজাত রাজনৈতিক বোধশক্তিকে স্বচ্ছ ও সুপ্রবুদ্ধ রাখিবার জন্য কি করা উচিত?

 প্রথমতঃ তাঁহাকে সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য হইতে হইবে; সজ্ঞানেই হোক, আর অজ্ঞানেই হোক, কোনরূপ স্বার্থচিন্তাযুক্ত হইলে ওই দৃষ্টি আর স্বচ্ছ থাকিবে না, তখন তাহা নেতাকে পথের পরিবর্ত্তে বিপথে চালিত করিবে। ঐ বােধশক্তির উপরে যখন অহং বুদ্ধি জয়ী হয় তখন বিনাশেরও আর বিলম্ব নাই। অতএব একটা জাতির ভাগ্য লইয়া খেলা করিবার সময়ে―মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব―স্বার্থশূন্য হইতে হইবে।

 দ্বিতীয়তঃ নেতামাত্রকেই নিজ ব্যক্তি-চেতনাকে গণ-চেতনার সহিত এক করিয়া ফেলিতে হইবে, তাহা না হইলে, গণ-চিত্তের বিরাট সংবেদন নেতার সেই বোধশক্তিকে আশ্রয় করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে পারিবে না। সাধারণ মানুষের পক্ষে ইহা সহজ নয়। সৌভাগ্যক্রমে এমন দুই একজন মানুষ থাকেই যাহারা জনগণের ঐ চেতনার সহিত নিজেদের ব্যক্তি-চেতনা সহজেই মিলাইয়া লইতে পারে, এবং সেই হেতু তাহারা জনমনের গতি ও প্রকৃতি ঠিকমত উপলব্ধি করিতে পারে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতেই জানি যে, যে-নেতা এই জন-চিত্তকে যত অধিক বুঝিতে সক্ষম হইযাছেন তিনি তত অধিক শক্তি ও সাফল্যের অধিকারী হইয়াছেন। জন-চিত্তের সহিত এইরূপ যােগ-স্থাপন কেবল বুদ্ধির আয়ও নহে, ইহার জন্য সেই অন্তঃশীলা বোধ-বৃত্তি চাই।

 নেতার সেই মনকে এমন শুদ্ধ ও সংযত করা সম্ভব, যাহাতে গণ-চিত্তের সঙ্গে উহা একসুরে বাঁধা হইয়া যায়। কিন্তু ইহার জন্য অবিরাম সাধনা ও সতর্কতা চাই। মনে কর, পর্ব্বত-বন্ধ পথে একটা জলস্রোত প্রবলবেগে নির্গত হইতেছে, উহার অন্তর্গত প্রত্যেকটি জলকণা কি ঐ প্রপাতের সঙ্গে একই বেগে একই ছন্দে বহিতেছে না? বের্গসঁ-র (Bergson) সেই ‘জীবনাত্মিকা অনাদ্যন্ত গতিধারা’র (Elan Vital) কথা চিন্তা কর, মানুষের চিৎ-সত্তা কি সেই বিশুদ্ধ ‘সৎ'―(সই গতি-সত্তার মধ্যে অবতরণ করিয়া তাহাকে আত্মসাৎ করিতে পারে না? হেগেলের (Hegel) সেই অদ্বিতীয় ‘মহা-তত্ত্ব’ (Absolute Idea) যাহা সৃষ্টির পর্ব্বে পর্ব্বে অভিব্যক্ত হইতেছে―মানুষের ব্যক্তি-চেতনা কি সই তত্ত্বে নিমজ্জিত হইয়া তাহার সহিত এক হইয়া যাইতে পারে না? অথবা, আমাদের তন্ত্রের সেই এক ‘পরমা শক্তি’―যাহার নিত্য-নব রূপান্তর এই জগৎ, ―মানুষের আত্মা কি ভাব-যােগে সেই শক্তিকে হৃদগত করিতে পারে না?

 সেইরূপ, গণ-চিত্তের সহিত ব্যক্তি-মানসের যােগসাধনও সম্ভব; কিন্তু ঐ যে-বৃত্তির দ্বারা তাহা হইয়া থাকে তাহাকে ঠিক পথে চালনা না করিলে, এবং শাসনে না রাখিলে,―বাস্তব-বিরােধী তত্ত্ববাদ (mysticism) তাহাকে গ্রাস করিয়া ফেলিতে পারে; এজন্য জগৎসংসার ও মনুষ্য-জীবনসংক্রান্ত যে বাস্তব নিয়তি-নিয়ম, তাহার জ্ঞানকে যুক্তিধর্ম্মী মনের দ্বারা সর্ব্বদা জাগ্রত রাখিতে হইবে। অতএব, তৃতীয়তঃ, ঐরূপ নেতার কর্ত্তব্য হইবে―যুক্তি-বিচার ও বিশ্লেষণপূর্ব্বক অতিশয় বিস্তারিতভাবে ইতিহাস-পাঠ। মানুষের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও যেখানে বন্ধ্যা সেখানে ঐ বােধ-শক্তি (Intuition) যেমন আমাদের সহায় হইয়া থাকে, তেমনই ঐ অন্তর্দৃষ্টি যখন অবাস্তব-তত্ত্ববাদের কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হয়, তখন যুক্তিধর্ম্মী জ্ঞানই তাহাকে উদ্ধার করিতে পারে।

 চতুর্থতঃ, দেশের রাষ্ট্রীয় ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করিবেন সেই নেতা, পৃথিবীর অপর সকল রাষ্ট্রে সেইকালে কি ঘটিতেছে সেদিকে লক্ষ্য রাখিবেন ও তাহার অর্থ উত্তমরূপে বুঝিবার চেষ্টা করিবেন। কারণ, এ যুগে সারাপৃথিবী একই ভাগ্য-রজ্জুতে বাঁধা, একের চাপ বা আকর্ষণে অন্যের অবস্থান্তর ঘটিবেই। অতএব নেতার যদি অপর সকল গুণও থাকে, তথাপি এই আন্তর্জ্জাতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে পরিচয় যদি সম্পূর্ণ ও যথার্থ না হয়, তবে তাঁহার নেতৃত্ব নিষ্ফল হইবে।