জয়তু নেতাজী/গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র

গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র

( The Indian Struggle )

 সুভাষচন্দ্র ‘The Indian Struggle’ নামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ইতিহাস শিখিয়াছেন, এবং গান্ধীর চরিত্র ও তাঁহার নেতৃত্ব এই দুইয়েরই যে সমালােচনা করিয়াছেন, তাহাতে গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা সত্ত্বেও, তাঁহার নীতি ও আচরণ যে দেশের পক্ষে মঙ্গলকর হয় নাই, একথা তিনি স্পষ্টাক্ষরে ব্যক্ত করিয়াছেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি গান্ধীর উক্তি ও আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন―গান্ধীর মত মহাত্মা এমন ভুল করেন কেমন করিয়া, তাঁহার মত সাধু ও সত্যনিষ্ঠ পুরুষ এমন দ্বৈতাচারী হন কেমন করিয়া―ইহার কারণ খুঁজিয়া পান নাই। বেশ বুঝিতে পারা যায়, কারণ বুঝিতে পারিলেও তাহা বিশ্বাস করিতে বাধিয়াছে, তিনি গান্ধীর সাধুতা ও সত্যনিষ্ঠায় সন্দিহান হইতে পারেন নাই। গান্ধীর প্রতি এই যে বিশ্বাস, ইহাই তাঁহাকে ভুল ও দুরাশার বশবর্ত্তী করিয়া বহুবার ব্যর্থকাম করিয়াছে, তাঁহার অনেক প্রাণান্ত প্রয়াস এইজন্যই নিস্ফল হইয়াছে। সুভাষচন্দ্রের মত ধীমান ও মতিমান্ পুরুষের পক্ষে এমন ভুল বড়ই বিস্ময়কর। জিন্নাও যাহা এক নিমেষে বুঝিতে পারিয়া গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস হইতে শতহস্ত দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন, এবং শেষে একরূপ নিরুপায় ও প্রতিশােধ-পরায়ণ হইয়া ব্রিটিশের সহিত হাত মিলাইয়াছিলেন―তাহা সুভাষচন্দ্র বুঝিতে চাহেন নাই, জাতীয়তাবাদী মুসলমানেরাও পারেন নাই, তাঁহারা শেষে হতাশ হইয়া একুল-ওকুল দুইকুল হারাইয়া অরণ্যে দিশাহারা হইয়াছেন। অথচ সুতাষচন্দ্রের এই গ্রন্থ পাঠ করিলে গান্ধীর গূঢ় অভিপ্রায় সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকে না; সে বিষয়ে গান্ধী কখনও তাঁহার সংকল্প হইতে কিছুমাত্র বিচলিত হন নাই। সেই সংকল্পসাধনের জন্যই তিনি সেই ১৯১৯ হইতে ১৯৪৬ পর্য্যন্ত, এক এক অবস্থায় এক এক পক্ষকে পরাস্ত করিতে―কখনাে দ্ব্যর্থপূর্ণ উক্তি, কখনাে স্তোকবাক্য, কখনও ভগবদুক্তি (voice of God), কখনাে বা স্পষ্ট-বাক্য ব্যবহার করিয়াছেন; একদিকে জনগণের অন্ধভক্তি অটুট রাখিবার জন্য যত-কিছু আনুষ্ঠানিক নিত্যকর্ম্ম, অপরদিকে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদিগকে নিরস্ত ও নিষ্ফল করিবার জন্য কুটনীতির চূড়ান্ত করিয়াছিলেন। এই সকল কথাই সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থে আছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি গান্ধীজীকে অবিশ্বাস করিতে পারেন নাই। তিনি গান্ধীকে একজন সরল-বুদ্ধি, রাজনীতি-অনভিজ্ঞ, আত্মপ্রত্যয়শীল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পুরুষ বলিয়াই বুঝিয়াছিলেন, এবং গান্ধীর নিজস্ব কূটনীতির সেই অভ্রান্ত প্রয়ােগ-কৌশলকেও তাঁহার নিদারুণ বুদ্ধিভ্রম বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন। এই গ্রন্থ রচিত হয় ১৩৩৪ সালে, তখনও ত্রিপুরীকংগ্রেসের সেই কুৎসিত ষড়যন্ত্র ও উলঙ্গ তাণ্ডব অনুষ্ঠিত হয় নাই। কিন্তু তাহার পরে সুভাষচন্দ্রের হৃদয়ে যে লৌহ-শলাকা প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাতে মর্ম্মাহত হইলেও তিনি গান্ধীর সাধুতা সম্বন্ধে আস্থা হারান নাই। এই গ্রন্থে যে একটি ধারণা বারবার প্রকাশ পাইয়াছে তাহা এই যে, গান্ধীর মস্তিষ্ক-শক্তি (Intellect) নিম্নস্তরের বলিয়া তিনি ঐ সকল ভ্রান্তির বশবর্ত্তী হইয়াছিলেন; চিত্তরঞ্জন, মতিলাল বা লাজপত রায় বাঁচিয়া থাকিলে তাঁহারা তাঁহার বুদ্ধিকে ঠিক পথে পরিচালিত করিয়া ঐরূপ ভ্রান্তি হইতে রক্ষা করিতেন। সুভাষচন্দ্র যেন শেষ পর্য্যন্ত ইহাই ভারতের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য বলিয়া দারুণ দুঃখ পাইয়াছিলেন যে,―এতবড় মহাপ্রাণ, সাধু ও সত্যনিষ্ঠ পুরুষের দ্বারাও ভারতের মঙ্গল না হইয়া অমঙ্গল বৃদ্ধি পাইল! আমি এই প্রবন্ধে সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ হইতে―তাঁহার উক্তি, সমালোচনা ও মতামত হইতেই―প্রমাণ করিব, সুভাষচন্দ্র গান্ধীকে ঠিকই চিনিয়াছিলেন, কেবল অন্তরের একটু দুর্ব্বলতার জন্য তিনি গান্ধী সম্বন্ধে পূর্ণ সত্যটি স্বীকার করিতে পারেন নাই।

 এক অর্থে তাঁহার কথা সত্য। গান্ধী যে সাধু ও সত্যনিষ্ঠ―অর্থাৎ তাঁহার নিজের মনোগত অতি প্রায় ও সংকল্প হইতে তিনি কখনও বিচ্যুত হন নাই, নিজের প্রতি কখনও অবিশ্বাসী হন নাই―ইহা সত্য। সে বিষয়ে গান্ধীর মত সত্যনিষ্ঠ পুরুষ সংসারে বিরল। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এমনই একজন আত্মবিশ্বাসী ও সত্যনিষ্ঠ পুরুষের কথা আমরা জানি, তিনি ― মোগল সম্রাট ঔরংজীব। তিনিও তাঁহার ধর্ম্মবিশ্বাস এতটুকু ক্ষুন্ন করেন নাই; সেই বিশ্বাস এমন গভীর ও দৃঢ় ছিল যে, সেই ধর্ম্মকে ভারতে জয়ী করিবার জন্য তিনি আর কোন চিন্তা―কোন সমস্যাকে মনে স্থান দেন নাই; রাজ্য ধ্বংস হউক, তবু তিনি তাঁহার সেই ধর্ম্ম-প্রতিষ্ঠায় কিছুমাত্র বিচলিত হন নাই। আবার সেই সাধু ও সত্য-সংকল্পের বশে তিনি তাঁহার প্রতিবাদী বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত ব্যবহারে কোন ছল কোন চাতুরীকেই অধর্ম্মাচরণ বলিয়া মনে করেন নাই; ভারতের মুসলমান-সমাজে তজ্জন্য তাঁহার মহত্ত্ব বা সাধুত্ব কিছুমাত্র লাঘব হইয়াছে বলিয়া তিনি নিন্দিত হন নাই, আজিও ভারতের বিশাল মুসলমান-সমাজে ঔরংজীব একজন মহাধর্ম্মপালরূপে পূজিত হইয়া থাকেন। অতএব, গান্ধী যে সাধু ও মহাত্মা―ত্রিশকোটী ভারতবাসীর চক্ষে তিনি অবতার-স্বরূপ, ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কি আছে? আমি এখানে উভয়ের আত্ম-প্রত্যয় ও সংকল্প-নিষ্ঠার তুলনাই করিতেছি, ধর্ম্মমন্ত্রের কথা বলিতেছি না। উহাও একটা বড় শক্তি, এবং জনসমাজের উপরে উহার প্রভাব অত্যধিক হইবারই কথা; উহার সহিত যদি কোন ধর্ম্মমন্ত্র যুক্ত থাকে তবে তো কথাই নাই। সুভাষচন্দ্র―ভারতীয় জনগণের উপরে গান্ধীজীর ঐ প্রভাবের কারণও যেমন বুঝিয়াছিলেন, তেমনই তাহা স্বীকার করিয়াছেন, যথা―

 The asceticism of Gandhiji, his simple life, his vegetarian diet, his adherence to truth and his consequent fearlessness all combined to give him a halo of saintliness.[১] His loin-cloth was reminiscent of Christ while his sitting posture at the time of lecturing was reminiscent of Buddha. Now all this was a tremendous asset to the Mahatma in compelling the attention and obedience of his countrymen. As we have already scen a large and influential section of the intelligentsia was against him but this opposition was gradually worn down through the enthusiastic support given by the masses. Consciously or unconsciously the Mahatma fully exploited the mass psychology of the peuple (p. 162)

 ―ইহার অর্থ, মহাত্মার সেই সাধু-সন্ন্যাসীর মত মূর্ত্তি ও ধর্ম্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা জনসাধারণের চিত্তকে বশীভূত করিয়াছিল; ফলে, তিনি শিক্ষিত বুদ্ধিমানদিগকে এই জনগণ-ভক্তির সাহায্যে ক্রমেই হতবল করিয়া ফেলিয়াছিলেন―তাহাতে তাঁহার নেতৃত্বও যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিল, তেমনই, তাহাতে বুদ্ধি, বিদ্যা ও বিচারশক্তির কোন প্রতিবন্ধকতা আর রহিল না;― ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ঐ এক নেতা এবং তাঁহার অতুগত অন্ধভক্তিপরায়ণ এক বিশাল জনবাহিনীই সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া উঠিল। কিন্তু একটি বিষয়ে সুভাষচন্দ্র ভুল করিয়াছিলেন, সাধু মহাত্মারাও যে তাঁহাদের সংকল্প-সাধনের জন্য কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন, বা করিতে পারেন, তাহা তিনি ভাবিতে পারেন নাই;―তাহা যে বুদ্ধিহীনের ভ্রম নয়, পরন্তু কর্ম্মযোগীর সেই “কর্ম্মসু কৌশলম,” এই তত্ত্ব তিনি জানিতেন না। এই বিষয়ে তিনি জিন্না-সাহেবের মত সংস্কারমুক্ত হইতে পাবেন নাই, পারিলে অনেক দুঃখ, অনেক ব্যর্থ পরিশ্রম হইতে অব্যাহতি পাইতেন। ত্রিপুরীর পরেও তাঁহার সেই সংস্কার ঘুচে নাই; আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের নেতা হইয়াও তিনি সেই একটুখানি বিশ্বাস ত্যাগ করিতে পারেন নাই। কিন্তু তাঁহার মত প্রেম ও সত্যের সাধক যিনি তাঁহার এই ভুল ভাঙ্গিবেই। আজ তিনি যদি বাঁচিয়া থাকেন তবে স্পষ্টই দেখিতে পাইবেন,―গান্ধী ভুল করেন নাই, তিনি তাঁহার অভিপ্রায় সিদ্ধ করিয়াছেন; তাঁহার সেই নেতৃত্বের মূলনীতিকে তিনি আপাত-সাফল্যে মণ্ডিত করিয়াছেন―তাহারই আনন্দোৎসব করিতে করিতে নিষ্ঠুর নিয়তির হস্তে মৃত্যুলাভ ও করিয়াছেন। এই নিয়তি বড় রহস্যময়, তাহার কথা স্বতন্ত্র।

 গান্ধীর সেই অভিপ্রায়, তাঁহার সেই সংকল্প ও সেই নীতি বা কর্ম্মপদ্ধতি কিরূপ? এই গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র সর্ব্বত্রই তাহার ইঙ্গিত দিয়াছেন, কিন্তু কোথাও সেই ইঙ্গিত নিজে স্পষ্ট বুঝিবেন না―ইহাই যেন তাঁহার প্রতিজ্ঞা। আমি পরে তাহার কিছু কিছু প্রমাণ দিব। ভারত চায় স্বাধীনতা―সুভাষচন্দ্র ও তৎকালবর্ত্তী বিপ্লবীদল (পুরাতন কংগ্রেস তখন বাতিল হইয়া গিয়াছে) ভারতের ঐ স্বাধীনতাকে―পুর্ণ স্বাধীনতাকে―সর্ব্বাগ্রে অর্জ্জনীয় বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন; ব্রিটিশের শাসনপাশ হইতে মুক্ত হওয়াই ছিল তাঁহাদের একমাত্র সাধনা। সেই শাসন-পাশ হইতে সম্পূর্ণ যুক্ত হইতে না পারিলে―এতটুকুও অবশিষ্ট থাকিলে—ভারত যে বাঁচিবে না, এবং স্বাধীনতা-বস্তুটি কখনো খণ্ড আকারে বা মাত্রাহিসাবে অর্জ্জন করা যায় না, ইহাই তখন শিক্ষিত ভারতের হৃদয় ও মন উপলব্ধি করিয়াছে; আমি স্বাধীনতা-যজ্ঞের পুরোধাদের কথা বলিতেছি। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে―ঐ যুদ্ধকালে ও তাহার সদ্য-পরিণাম-অবস্থায়―পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত ভারতেও একটা শ্মশান-নৈরাশ্য ও নিশ্চেষ্টতা নামিয়াছিল, বিশ্বাস ও উৎসাহ নিবিয়া আসিয়াছিল। এই লগ্নে গান্ধী সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন ও ‘মাভৈঃ’ উচ্চারণ করিয়া বলিলেন,―ম্বাধীনতা-লাভের একটা অব্যর্থ উপায় আমি আবিষ্কার করিয়াছি, সেই সত্যকার স্বাধীনতাই তোমরা লাভ করিবে, যুদ্ধও করিবে, কিন্তু অস্ত্র পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হইয়া, পূর্ব্ব-যোদ্ধা ও নেতৃগণ―প্রথমে প্রতিবাদ করিলেও―পরে তাঁহার বশ্যতা ও নেতৃত্ব স্বীকার করিল, তিনিও তাহাদিগকে নূতন যুদ্ধবিদ্যা ও যুদ্ধ-সজ্জায় প্রস্তুত করিতে লাগিলেন। পবে সহসা একদিন ঘোষণা করিলেন―এক বৎসরের মধ্যেই তোমরা স্বাধীনতালাভ করিবে; এ যেন সেই ‘চেতাবনী’র ভবিষ্যৎ-বাণী;―এমন দুঃসাহসিক প্রতিশ্রুতি যিনি দান করিতে পারেন, তিনি হয় একজন ভাবান্ধ উন্মাদ, নয় জন-মনের মনস্তত্ব অন্তর্যামীর মত আয়ত্ত করিয়াছেন―যাদুকরের মত সেই মনকে লইয়া খেলা সুরু করিয়াছেন। পরে যখন সেই ভবিষ্যৎ-বাণী ব্যর্থ হইল―তাহাতে কোন ক্ষতিই হইল না; একবার যাদুশক্তির অধীন হইলে আর কিছুতেই সেই মোহ ভাঙ্গে না;―তখন তাহার অতি সহজ ব্যাখ্যাও হইল; মানুষ আবার স্থির হইল,―বাণী যেমনই হৌক, ব্যক্তির দিকে চাহিয়া তাহারা সাক্ষাৎ স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষা দমন করিতে শিখিল। ইহাই হইল জনমন-রূপ যন্ত্রটিকে পরীক্ষার দ্বারা সেই প্রথম কার্য্যোপযােগী করিয়া লওয়া। ক্রমে রাজনীতি বা স্বাধীনতালাভ প্রভৃতির প্রয়োজন গৌণ হইয়া ধর্ম্মনীতির কৃচ্ছ-সাধন, আত্ম-শােধন প্রভৃতিই মুখ্য হইয়া উঠিল―ভারতীয় জনগণকে তাদের চিরাভ্যস্ত সংস্কারে সচেতন করিয়া তোলাই হইল―গনচেতনার উদ্বোধন; ইহারই ইংরেজী নাম―mass-awakening! উত্তেজনার উপায়-স্বরূপ রাজনীতির একটা অছিলামাত্র বজায় রাখিয়া, গান্ধী ভারতের জনমনকে স্বকীয় উদ্দেশ্যসাধনের অনুকূল করিয়া তুলিলেন। সেই উদ্দেশ্য কি? পরে সবিস্তারে বলিব। আমি অতিশয় সংক্ষেপে গান্ধীর অতি ধীর, প্রতীক্ষাপ্রবণ অথচ গৃঢ়সন্ধানী নীতির আভাসমাত্র দিলাম। উহাতেই ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম (শষে দাঁড়াইল―ধর্ম্মজীবনের উন্নতি, ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি, সর্ব্ব দুঃখ ও দুর্গতি সহ্য করিবার সাধনা―ইংরেজীতে যাহাকে―negative বলে, সেইরূপ সিদ্ধিলাভ। এই গ্রন্থে সুভাষচন্দ্র তাহার একটি উদাহরণ দিয়াছেন। এক বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে (যশােরে) ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের দাবী অগ্রাহ্য করিয়া আধ্যাত্মিক মুক্তিলাভই কাম্য বলিয়া একটি প্রস্তাব অধিকাংশের সমর্থনে গৃহীত হইয়াছিল। ইহার পর সুভাষচন্দ্র লিখিতেছেন―

 "To make matters worse, political issues would no longer be considered in the cold light of reason, but would be unnecessarily mixed up with ethical issues. The Mahatma and his followers, for instance, would not countenance the boycott of British goods because that would engender hatred towards the British". (P. 163) এই ব্রিটিশ-প্রীতি যে কেন―অহিংসা নয়, শুধু ধর্ম্মরূপেও নয়―একটা অতি গূঢ়-গভীর উদ্দেশ্যসাধনের উপায়রূপে বড় কার্য্যকরী হইয়াছিল, সুভাষচন্দ্র তাহা বুঝিতে পারেন নাই; আজ হয়তো তাহা দিবালোকের মতই দেখিতে পাইতেন; আমরাও পরে তাহা দেখিব। অতি অল্পকালের মধ্যেই গান্ধী দেশবাসীগণের চিত্ত ভিন্নপথে আকৃষ্ট করিতে সমর্থ হইলেন। ইহা আদৌ আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, ভারতবাসী জনগণের চিত্তে ঐ ভাব সহস্ৰ বৎসরে মজ্জাগত হইয়া আছে; আজিও,―শুধু অশিক্ষিত নয়, শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে যাঁহারা ধর্ম্মপিপাসু―রাজনীতি, বা দেশ ও জাতির কল্যাণ চিন্তা যাঁহাদের সুখনিদ্রার কিছুমাত্র ব্যাঘাত করে না―সেইরূপ সুপণ্ডিত ও ধার্ম্মিক ব্যক্তিগণ গান্ধীমহাত্মাকে মহাপুরুষ বলিয়াই অসীম ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া থাকেন। হিন্দুর ধর্ম্মজীবনে এইরূপ দাস্য-ভাব লক্ষ্য করিয়াই ভারতীয় মুসলীমসম্প্রদায় হিন্দুকে কিছুতেই শ্রদ্ধা করিতে পারে না―দাস-জাতি বলিয়া অতিশয় ঘৃণা করে। ইহাতে হিন্দুর কিছুমাত্র ক্ষোভ নাই―বরং গর্ব্বই আছে; কারণ এরূপ দাস্যভাবের সাধনাকে―দুর্ব্বল, ক্ষীণপ্রাণের ঐ তামসিক মনোভাবকেই―অতি উচ্চ সাত্ত্বিকতার নাম দিয়া তাহারা বহুকাল যাবৎ পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছে। স্বামী বিবেকানন্দ ইহাই দূর করিতে চাহিয়াছিলেন।

 কিন্তু তৎসত্ত্বেও স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নানা দল গান্ধীকে মানিবে না, মাঝে মাঝে তাহাদের উপদ্রবময় অভিযান তাঁহার আশঙ্কা বৃদ্ধি করে; তখন মহাত্মা একদিকে তাঁহার মাহাত্ম্য এবং অপরদিকে তাঁহার অসাধারণ কুটবুদ্ধির স্বারা কংগ্রেসের ভিতরে ও বাহিরে সকল বিক্ষোভ শান্ত, অর্থাৎ নিষ্ফল করিয়া দিতেন। এই গ্রন্থে তাহার কয়েকটি চমৎকার দৃষ্টান্ত আছে, পরে উদ্ধৃত করিব। অনশনে প্রাণ-ত্যাগ করিবার ভয় দেখাইয়া, কংগ্রেসের নেতৃত্ব-ত্যাগের ধমক দিয়া, এবং আরও কত কৌশল করিয়া তিনি স্বাধীনতা-যুদ্ধের উদ্যম ও উৎসাহ কতবার নির্ব্বাপিত করিয়াছেন! এ সকলই তাঁহার সেই এক সংকল্প-সাধনের জন্য,―সেই গূঢ় সংকল্প তিনি কখনও প্রকাশ করিতেন না, করিলে তিনি কিছুতেই নেতৃত্ব রক্ষা করিতে পারিতেন না। আমরাও এখনই সেই সংকল্পের কথা প্রকাশ করিব না―এখনও সময় হয় নাই। যখন তিনি বুঝিতেন, কংগ্রেসের মধ্যে থাকিলে অসুবিধা হইবে তখন তিনি বাহ্যতঃ তাহার বাহিরে থাকিতেন; বাহ্যতঃ―কারণ, তিনিই সব―কংগ্রেস তাঁহার ছায়ামাত্র, জন-মনের চাবিটি যে তাঁহারই হাতে। ঐরূপ বাহিরে থাকার সুবিধা অনেক। তাঁহারই উপদেশ ও আদেশক্রমে―ঐ কংগ্রেস-নেতাগণ প্রকাশ্যে, যেন তাহাদেরই দায়িত্বে, যাহা করিবে, তাহা যদি এমন কিছু হয় যাহা গান্ধী-প্রণীত ধর্ম্মনীতির বিরোধী অতএব জনগণের মনে সংশয় জাগিতে পারে, অথচ, যাহা না করিলে একটা সংকট উপস্থিত হয়―সেইরূপ কোন কার্য্য কংগ্রেস নিজের নামেই করিবে, তিনি বাহিরে থাকিয়া তজ্জন্য দুঃখ বা অসস্তোষ প্রকাশ করিলেই যথেষ্ট; বরং তদ্বারা তাঁহার অসাধারণ বিনয় প্রকাশ পাইবে। তিনি যখন বলিবেন, কংগ্রেসের ঐ কার্য্য তাঁহার মনঃপূত নয় বটে, তিনি তজ্জন্য অসুস্থ বোধ করিতেছেন, কিন্তু যেহেতু ঐ কংগ্রেস ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি এবং তিনিও জনগণের সেবক (Servant of the People), অতএব তাহা শিরোধার্য্য করা তাঁহার কর্ত্তব্য―তখন তাঁহার মাহাত্ম্য শতগুণ বৃদ্ধি পাইবে। গান্ধী যে কত বড় কর্ম্মযোগী ছিলেন―যোগসিদ্ধ পুরুষ বলিলেও হয়, তাঁহার এইরূপ আচরণ হইতে তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যাইবে। তিনি সর্ব্বদা দুইদিক রক্ষা করিয়া চলিতেন―এমন দ্বৈত-নীতির জ্ঞান ও তাহার প্রয়োগ-নৈপুণ্য জগতের ইতিহাসে বিরল। কেবল প্রথম দিকে, একবারমাত্র তিনি সত্য-সত্যই কিছুদিনের জন্য সম্মুখ-সংগ্রাম হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, কারণ তখনও কংগ্রেসে তাঁহার পূর্ণ-কর্ত্তৃত্ব স্থাপিত হয় নাই―সেই যখন ‘স্বরাজী’রা (দেশবন্ধু, মতিলাল প্রভৃতি) কংগ্রেসে আধিপত্য বিস্তার করিতেছিল। ক্রমেই যখন কংগ্রেসের মধ্যে একটা না একটা দল প্রবল হইতে লাগিল―এবং গান্ধী কিছুতেই তাহাকে সম্পূর্ণভাবে বশীভূত করিতে পারিতেছিলেন না, তখন সেই শেষবার, তিনি যে যোগদৃষ্টির পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহাতেই অতঃপর কংগ্রেস চিরদিনের মত তাঁহাকে দাসখত লিখিয়া দিল। তখন বামপন্থীরা বড় শোরগোল আরম্ভ করিয়াছে―বলে কিনা তাহারা পূর্ণ-স্বাধীনতা চায়, অর্থাৎ ব্রিটিশের সম্পর্ক রাখিবে না! ইহার মত ভয়ানক কথা গান্ধীর পক্ষে আর কিছুই হইতে পারে না। মাদ্রাজ ও কলিকাতা-কংগ্রেসের অধিবেশনে পর-পর সেই দাবী ক্রমেই উদ্ধত হইয়া উঠিতেছিল। সেই বিষম চক্রান্তে (ব্রিটিশের সহিত সম্বন্ধ ছিন্ন করার) যে দুইজন যুবা―দুইজনেই সমান জনপ্রিয় ও ধীশক্তিমান―একত্র মিলিত হইয়াছে, সেই জবাহরলাল ও সুভাষচন্দ্রকে দেখিয়া তিনি বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন; এইবার বুঝি তাঁহার এত সাধনার, এত তপস্যার তরীখানি বানচাল হইয়া যায়! তখন তিনি তাঁহার সেই তীক্ষ্ণ যোগদৃষ্টির দ্বারা উভয়কেই উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলেন―তাহাদের অন্তরের অন্তস্থল দেখিয়া লইলেন। দুইজনকেই চিনিলেন―চিনিয়া একপক্ষে নিশ্চিন্ত হইলেন। ইংরেজরাজশক্তিও এই দুইজনকে তেমনই চিনিয়াছিল,―চিনিয়া ইংরেজও যাহা করিয়াছে, গান্ধীও তাহাই করিলেন। গান্ধীও সুভাষ সম্বন্ধে আর কোন আশাই পোষণ করেন নাই; ব্যক্তিগতভাবে সুভাষকে তিনি যে চক্ষেই দেখিয়া থাকুন, তাঁহার সেই সংকল্প-সাধনের পক্ষে সে যে কতবড় অন্তরায়, তাহা নিশ্চিতরূপে বুঝিয়া লইয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় সুভাষচন্দ্র গান্ধীকে বুঝিয়াও বুঝিতে পারেন নাই―পারিলে ইহার পরেও হরিপুরায় বর সাজিতেন না, এবং ত্রিপুরীতে আবার সেই বরবেশ পরিতে গিয়া এমন বিড়ম্বনা ভোগ করিতেন না। মহাত্মা জবাহরলালকেই মনোনীত করিলেন যথা―

 “But the Mahatma decided to back the candidature of Pandit Jawaharlal Nehru. For the Mahatma the choice was a prudent one. . ...Since 1920 Pandit Jawaharlal Nehru had been a close adherent of the policy advocated by the Mahatma, and his personal relations with the latter had been always friendly. Nevertheless, since his return from Europe in December 1927, Pandit Jawaharlal Nehru began to call himself a Socialist and gave expression to views hostile towards Mahatma Gandhi and the older leaders, and to ally himselt in his public actuvities with the Left Wing opposition within the Congress. But for his strenuous advocacy, it would not have been possible for the Independence League to attain the importance that it did. Therefore, for the Mahatma it was essential that he should win over Pandit Jawaharlal Nehru if he wanted to beat down the Left Wing opposition and regain his former undisputed supremacy over the Congress. The Left Wingers did not like the idea that one of their most outstanding spokesmen should accept the Presidentship of the Lahore Congress, because 1t was clear that the Congress would be dominated by the Mahatma. and the President would be a mere dummy (Pp 237-38)

  আজ এতদিন পরে পণ্ডিত জবাহরলালের রাজনীতি, তাঁহার প্রজাপতি-সুলভ বায়ুবিহার ও পক্ষান্দোলন সম্বন্ধে কিছুই বলিবার প্রয়োজন নাই; সম্প্রতি তিনি বিশ্বমৈত্রীর পবন-দূত ও গান্ধীবাদের সেণ্ট জন (St. John) হইয়া মার্কিনের কুবের-পুরীতে যে বিশাল বরমাল্য ও গগনভেদী জয়রবের দ্বারা অভ্যর্থিত হইতেছেন―তাহাতে মনে হয়, তিনিও সেদিন তাঁহার জীবনদেবতা বা ভাগ্যদেবতার প্ররোচনায় গান্ধীহস্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। এই আকাশবিহারী রংমশালটিকেই গান্ধীর বড় প্রয়ােজন হইয়াছিল। এতদিনে এমন একখানি অস্ত্র লাভ করিয়া অতঃপর সেই সংকটসঙ্কুল অভিযাত্রায় তিনি বিপদের পর বিপদ লঙ্ঘন করিয়া কংগ্রেসকে যেমন নিজের পাদপীঠতলে, তেমনই জনসাধারণের হৃদয়বেদিকার তুলসীমঞ্চে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিলেন। জনসাধারণকে তিনি ইহার বহুপূর্ব্বে জয় করিয়াছিলেন―রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীনতা-সংগ্রামের সেনাপতিরূপে নয়, ধর্মগুরু মহাত্মারূপে এতদিনে স্বাধীনতার নাম ও অর্থ অন্যরূপ দাঁড়াইয়াছে, এবং অহিংসা ও চরকা এই দুইয়ের বাহিরে যাহা কিছু―তাহার সকল চিন্তা মহাত্মাকে ছাড়িয়া দিয়া জনগণ নিশ্চিন্ত হইয়াছে; কেবল মাঝে মাঝে ঐ কংগ্রেসের মারফতে মহাত্মার আদেশলাভ করিয়া, এবং তাহাই অন্ধভাবে পালন করিয়া দলে দলে জেলে যাওয়া এবং পুলিশের হাতে মার খাওয়াই তাহাদের একমা কাজ হইয়াছে,―কেন, কি জন্য, সে প্রশ্ন করিবার অধিকারও তাহাদের নাই। আরও একটি কাজ―নিজেরা খাইতে পাক বা নাই পাক―একটা না একটা ফণ্ডে চাঁদা দিতে হইবে। এই চাঁদা সংগ্রহ করার যে মহৎ উদ্দেশ্য―মহাত্মার মাহাত্ম্যের তাহাও একটা বড় প্রমাণ। ইহারই নাম ব্রিটিশের সহিত যুদ্ধ, ইহাই স্বাধীনতালাভের প্রকৃষ্ট পন্থা। ইহার পর, ঐ কংগ্রেসনামক সভাকে―ব্রিটিশের সহিত কথাবার্তা (negotiatons) চালাইবার একটা বৈঠকরূপে খাড়া রাখিয়া, এবং কয়েকজন বলিষ্ঠ ভক্তের হাতে উহা ছাড়িয়া দিয়া, গান্ধী এইবার তাঁহার স্বকীয় অভিপ্রায়-সাধনে প্রায় নিষ্কণ্টক হইলেন। তখন গান্ধী-আরউইন চুক্তি, গােলটেবিল-বৈঠক, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা, ওয়াভেল-প্রস্তাব এবং শেষে ক্যাবিনেট-মিশনের রোয়দাদ―ব্রিটিশের যত কিছু অভিসন্ধিকে নানাভাবে ও নানা ভঙ্গিতে প্রশ্রয় দেওয়ার কোন বাধা আর রহিল না; শেষে ভারত-ভাগ ও পাকিস্তান পর্য্যন্ত মানিয়া লওয়া আপদ্ধর্ম-নামে কর্ত্তব্য হইয়া উঠিল―অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতাকে অতল জলে ডুবাইয়া সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামের সমাধি করা হইল। এইরূপে গান্ধী তাঁহার সেই এক অভিপ্রায় ও একনিষ্ঠ নীতিকে―তাঁহারই সংকল্পিত ভারত-ভাগ্যের একটি অপরূপ সমাধানকে জয়যুক্ত করিলেন! সে অভিপ্রায় কি, তাহা এখনও বোধ হয় পাঠকগণের ৰোধগম্য হয় নাই―না হইয়া থাকিলে আর একটু অপেক্ষা করিতে হইবে। অভিপ্রায়টি অঙ্কুরে যাহা ছিল তাহাই শেষে পূর্ণবিকাশ ও পূর্ণসিদ্ধি লাভ করিয়াছে, কেবল মধ্যে অবস্থাচক্রে একটু ভিন্নমুখী হইয়াছিল। পরে তাহা দেখাইব। গান্ধীর এই জয়লাভের প্রত্যক্ষ ফলভাগী হইয়াছেন সেই অন্তরঙ্গ কয়েকজন―যাঁহারা সেই অভিপ্রায়ের গোপন তত্ত্ব অবগত হইয়া, বাহিরের ঠাট বজায় রাখিতে প্রাণপণ করিয়াছিলেন; তাঁহারাই এখন রাজা হইয়াছেন, একজন তো মন্ত্রণাদক্ষতার পুরস্কার-স্বরূপ শালগ্রাম-শিলা হইয়া স্বর্ণ-সিংহাসনে বসিয়াছেন। আর সুভাষচন্দ্র? তিনি এই গ্রন্থে সব কথাই লিখিয়াছেন, কেবল গান্ধীর সেই মূল অভিপ্রায় বা গুঢ় উদ্দেশ্যের কথা কোথাও স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই; কিন্তু তাহা যে হৃদয়ে অনুভব করিতেছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। তাই হয়তো আজিও তিনি কোথায় কোন্ পর্ব্বতে-প্রান্তরে দিশাহীন মরু-ঝটিকার মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। ইহাকেই বলে কর্ম্মফল। এখন দেশে কাহারও অণর কোল ভাবনা নাই; গান্ধী বলিয়াছেন, ইহাই স্বাধীনতা; আরও বলিয়াছেন, ইংরেজ বড় ভালো; তাঁহার তপস্যায় তাহাদের সুবুদ্ধি হইয়াছে―মাউণ্টব্যাটন, অ্যাট্লী, এমন কি চার্চ্চিল পর্য্যস্ত বৈষ্ণব হইয়া জীবে দয়া করিয়াছে। ভারতবাসী তাহাতেই ভুলিয়াছে; তাহারা তো স্বাধীনতা কামনা করে লাই, “মহাত্মার জয় হউক” এই কামনাই করিয়াছিল; সেই মহাত্মা তুষ্ট হইয়াছেন, কাজেই ‘তস্মিন তুষ্টে জগৎ তুষ্টঃ’। এক্ষণে তাহারা তাঁহারই অংশাবতারগণের মহিমা গান করিতেছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্র সেই ১৩৩৪ সালেই যাহা বলিয়াছিলেন আজ তাহা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইয়াছে, যথা―

 “As has been already indicated, the Mahatma has endeavoured in the past to hold together all the warring elements—landlord and peasant, capitalist and labour, rich and poor. That has been the secret of his success, as surely as it will be the ultimate cause of his failure...The vested interests, the ‘haves' will in future fight shy of the ‘have-nots' in the political fight and will gradually incline towards the British Government...... Mahatma Gandhi has rendereď and will continue to render phenomenal service to the country, but India's salvation will not be achieved under his leadership. (Pp. 413-14)

 [অর্থাৎ, মহাত্মা গান্ধী দেশের সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া―যাহাতে কোন পক্ষ কিছুমাত্র বিক্ষুব্ধ বা বিরুদ্ধ না হয় সেই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, ধনী ও দরীদ্র, প্রজা ও জমিদার সকলকেই এক দলভুক্ত করিয়াছেন। ইহারই জন্য তিনি আপাত-সাফল্য লাভ করিয়াছেন, কিন্তু ঠিক এই কারণেই তাঁহার সকল সাধনা ব্যর্থ হইবে। কারণ, যাহারা কায়েমী স্বার্থের সুখ-সমৃদ্ধি ভোগ করিতেছে―সেই যাহারা ওয়ারিশ, তাহারা লা-ওয়ারিশদিগকে সুচক্ষে দেখিবে না―রাজনীতির ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বাধিবে, এবং ঐ স্বার্থরক্ষীর ক্রমে ব্রিটিশের আনুগত্য করাই শ্রেয়ঃ মনে করিবে। ... মহাত্মা দেশের প্রভূত হিতসাধন করিয়াছেন ও করিবেন বটে, কিন্তু তাঁহার দ্বারা ভারতের দাসত্ব-মোচন হইবে না।]  আসলে, মহাত্মা তাঁহার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির জন্য ঐ ধনী বণিকসম্প্রদায়ের সাহায্য অত্যাবশ্যক মনে করিয়াছিলেন, এবং তাহাদের স্বার্থ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ না হয় সেইদিকেই সর্ব্বদা দৃষ্টি রাখিয়া, গরীব প্রজাগণকে কেবল ধর্ম্মোপদেশের দ্বারা মুগ্ধ ও শান্ত করিয়াছিলেন; তাহা না করিলে, অর্থাৎ যে-দুইয়ের স্বার্থ এমন বিরোধী, তাহাদিগকেও একসঙ্গে না লইলে, সেই আপাত-সিদ্ধিলাভ অসম্ভব। ঐ দরিদ্র জনগণ অপেক্ষা ধনপতি কুবের-সম্প্রদায়ই তাঁহার কত বড় সহায়, ইহার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত সুভাষচন্দ্র অন্যত্র করিয়াছেন;―যখন বামপন্থীদের আক্রমণ নিরোধ করিয়া ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের সহিত একটা চুক্তি করিবার প্রয়োজন অত্যধিক হইয়াছে, তখন―

 “All the monied interests also desired to see the armistice followed up by a permanent peace, so that they could settle down to business peacefully. Consequently there was no dealth of funds for those who wanted to go to Karachi (করাচী কংগ্রেস)to support the Mahatma.” (P283)

 ঐ যে “business" বা ব্যবসায়, উহাই গান্ধী-নীতির মুল-মন্ত্র―তাঁহার রাজনীতিও মূলে লাভ ও ক্ষতির একটা সামঞ্জস্য-মূলক নীতি; সেই বাণিয়া-বৃত্তির পক্ষে ধর্ম্ম―অহিংসা ও তুলসীর মালা―যে কত উপযোগী, তাহা আমরা আমাদের সমাজেও বহুদিন হইতেই লক্ষ্য করিতেছি।

 সুভাষচন্দ্র বলিয়াছেন গান্ধী দেশের প্রভূত হিতসাধন করিতেছেন, এবং আরও করিবেন; কিন্তু তিনি দেশের দাসত্ব-মোচন করিতে পারিবেন না। এই উক্তিটি কি তাঁহার দিক দিয়াই স্ববিরোধী নয়? ব্রিটিশ রাজশক্তির দুর্দ্দান্ত পীড়নে দেশের জনসাধারণের হিতসাধন যে কোনদিকেই কোন প্রকারে করা সম্ভব নয়, তাহা গত ৪০|৫০ বৎসরের নিদারুণ অভিজ্ঞতায় সকল চিস্তাশীল দেশ-প্রেমিক বুঝিতে পারিয়াছিলেন। অতএব হিতসাধন আগে নয়―মুক্তিসাধনটাই আগে; সুভাষচন্দ্রও ইহাই দৃঢ় বিশ্বাস করিতেন। তাহা হইলে, গান্ধীর ঐ হিতসাধন-চেষ্টার মূল্য কি? ঐ মুক্তিসাধনের পক্ষে তিনি দুইটিমাত্র কাজ করিয়াছিলেন―এক, জনসাধারণের চিত্তে তাঁহার প্রতি অন্ধভক্তি জাগাইয়া একটা বিরাট গড্ডলিকাকে ব্রিটিশের রুদ্ধ-দুয়ারে বার বার ঘা দিবার জন্য ঠেলিয়া দেওয়া,―এবং স্বাধীনতালাভের আকাঙ্ক্ষাকে গান্ধীভক্তির দ্বারা প্রশমিত করিয়া তাহাদিগকে এমন সকল কার্য্যে প্রবৃত্ত করা―যাহার সহিত স্বাধীনতালাভের দূরতম কার্য্য-কারণ-সম্বন্ধ নাই। একটি অতি-উচ্চ বংশদণ্ডে চাউল ও জলের হাঁড়ি ঝুলাইয়া এবং নিয়ে খড়-কুটার আগুন জ্বালাইয়া ক্ষুধার্ত্তগণকে সেইরূপে অন্ন প্রস্তুত হওয়ার আশ্বাস দেওয়া যদি সত্যকার হিতসাধন হয়, তবে গান্ধীর চরকা ও অহিংসা তেমন হিতসাধন করিয়াছে―তদ্দ্বারা যেরূপ স্বাধীনতালাভ সম্ভব তাহাও হইয়াছে। ইহাই গান্ধীর “phenomenal service to the country"―সুভাষচন্দ্রও তাহা বিশ্বাস না করিয়া পারেন নাই! কিন্তু সুভাষচন্দ্র গান্ধীর অভিপ্রায় সম্বন্ধে নিজেও যে নিঃসংশয় হইতে পারেন নাই তাহা স্পষ্টই স্বীকার করিয়াছেন তাঁহার মনের সেই বৈধ কখনও ঘােচে নাই। ১৯২০ সালে তিনি যখন সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করিয়া বিলাত হইতে ফিরিয়া একেবারে সরাসরি গান্ধীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান, এবং তাঁহাকে তাঁহার অভিপ্রায় ও কর্ম্ম-পদ্ধতি সম্বন্ধে কয়েকটি বিশেষ প্রশ্ন করেন, তখন গান্ধী তাহার কোন স্পষ্ট জবাব দেন নাই, বা দিতে চাহেন নাই, যথা―  "What his real expectaton was, I was unable to understand. Either he did not want to give out all his secrets prematurely, or did not have a clear conception of the tactics whereby the hands of the Government could be forced...... My teason told me clearly, again and again, that there was a deplorable lack of clayty in the plan which the Mahatma had formulated, and that he himself did not have a clear idea of the successive stages of the campaign which would bring India to her cheusind goal of frecdom" (P 81-82)

 আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, সুভাষচন্দ্র ১৯২১ সালে যাহা মনে করিয়াছিলেন, ১৯৩৪ সালেও তাঁহার সেই ভুল বুঝিতে পারেন নাই। তিনি বুঝিতে পারেন নাই যে, ঐ “cherished goal of freedom”ই যত গােলযােগের মূল; গান্ধীর “real expectation” যাহা, তাহার জন্য নিজের ঐ কর্ম্ম-পদ্ধতি সম্বন্ধে গান্ধীর যেমন “clear conception” ছিল, তেমনই “successive stages of the campaign” সম্বন্ধে একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম্ম-পঞ্জিকাও তিনি প্রস্তুত করিয়াছিলেন। আসল কথা ঐ একটি,― “He did not want to give out all his secrets”। হায় সুভাষচন্দ্র! সেই গুপ্তমন্ত্রটি তুমি এতকালেও ধরিতে পার নাই! তখনও তোমার সেই “cherished goal of freedom”-এর জন্য গান্ধীর মুখাপেক্ষা করিতেছিলে! গান্ধীর ‘cherished goal’ যে কি ছিল, তাহা আজ আসিয়া দেখিয়া যাও―তাহাতে গান্ধী যেমন কৃতার্থ হইয়াছিলেন, ভারতবাসীও তেমনই কৃতার্থ হইয়াছে।

 গান্ধী তাঁহার সেই অন্তরের কথা আর কাহাকেও বলেন নাই―বলিলে তখন নেতৃত্ব-লাভ দূরে থাক, নিরতিশয় অবজ্ঞাত হইতেন। তিনি যেরূপ হিতসাধনকে ভারতের পরমার্থ বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন তাহা সেকালের সেই স্বাধীনতাকামী ‘সন্তানগণ’, বা রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ নেতাগণ শুনিতে পাইলে তাঁহার ভবিষ্যৎ মহাত্মা হইবার সম্ভাবনাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হইত। তাই গান্ধী কিছুমাত্র ভুল করেন নাই; সুভাষচন্দ্রই তাঁহার সেই অভিপ্রায় বুঝিয়াও বুঝিতে চাহেন নাই। সেই অতিপ্রায় কি তাহা ক্রমেই স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইয়া উঠিতেছিল। সুভাষচন্দ্র গান্ধীর নীতি ও কর্ম্ম-পদ্ধতি দেখিয়া বারবার বিস্ময় ৰোধ করিয়াছেন। গান্ধী ইংরেজের সহিত সন্মুখ-যুদ্ধের অভিনয় মাত্র করিতেন, কখনও সত্যকার যুদ্ধে নামিতেন না; জনগণকে সে বিষয়ে পূর্ণ-উদ্যত করিয়া তৎক্ষণাৎ একটি মন্ত্রের দ্বারা সেই যুদ্ধোদ্যম নিবারণ করিতেন, সব ঠাণ্ডা করিয়া দিতেন,―ইহা সুভাষচন্দ্র লক্ষ্য করিয়াছেন, কিন্তু তাহার অর্থ স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিতে পারেন নাই। বারদোলির যুদ্ধোদ্যম কেমন করিয়া ‘চৌরিচৌরা’র অজুহাতে নিবারিত হইয়াছিল তাহা ভারতবাসী বোধ হয় এখনও ভুলে নাই; “গুরুর ইচ্ছা পূর্ণ হউক” বলিয়া সকলেই নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিল। এমনই এক একটা বেতালা দুঃসাহসের ভঙ্গি করিয়া গান্ধী প্রতিবারেই কেমন তাল সামলাইতেন, সুভাষচন্দ্র তাহা অতিশয় দুঃখের সহিত উল্লেখ করিয়াছেন। এইরূপ তাল-সামলানো শেষবারে বড় বিসদৃশ হইয়া উঠিয়াছিল। দ্বিতীয় গোল-টেবিল বৈঠক হইতে যখন তিনি হতাশ্বাস, এমন কি, হত-সম্মান হইয়া ফিরিলেন, এবং লর্ড উইলিংডনের সেই অগ্নি-মূর্ত্তি দেখিলেন, তখন ব্রিটিশকে ভয় দেখাইবার, ও জনগণের নিকটে মুখ-রক্ষা করিবার জন্য তিনি যে কৌশল অৰলম্বন করিয়াছিলেন, তাহার মত হাস্যকর ও শোকোদ্দীপক কিছু পূর্ব্বে কখনো করিতে হয় নাই। তিনি পুনরায় সেই বারদোলি-অস্ত্র ত্যাগ করিলেন; কিন্তু যুদ্ধ-ঘোষণার পরে যখন দেশের সর্ব্বত্র সেই যুদ্ধ চলিতে লাগিল, এৰং একদিকে জনগণও হটিবে না, অপরদিকে গৰর্ণমেণ্টও তাহাদিগকে দমন করিতে কিছুমাত্র ক্লান্ত হইতেছিল না, তখন গান্ধী প্রমাদ গণিলেন। এবার “চৌরিচৌরা” ছিল না, কাজেই একটি অভিনব উপায়ে ঐ জনগণকে শান্ত করিতে হইল―গবর্ণমেণ্ট তাহাতে বড়ই খুসী হইল। গান্ধী তখন হরিজনদের সমস্যায় অধীর হইয়া প্রায়োপবেশন করিলেন। এই গ্রায়োপবেশন গান্ধী-লীলার একটি মহাপর্ব্ব হইয়া আছে। জনগণ তাঁহার সেই মৃত্যুপণ দেখিয়া সব ভুলিয়া গেল, আসমুদ্র হিমাচল সমুদয় ভারত নিশ্বাস রোধ করিয়া মহাত্মার প্রাণ-রক্ষা কামনা করিল। তারপর, পুণা-চুক্তি প্রভৃতি যাহা কিছু ঘটিল তাহার বিবরণ অনাবশ্যক। কিন্তু সেই হইতে ব্রিটিশের সহিত স্বাধীনতা-সংগ্রাম প্রায় সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হইল। এতদিনে গান্ধী বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার পূর্ব্বের নীতি আর চলিবে না, তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে। ঐ প্রোয়োপবেশন সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―

 “People began to ask if, after all, it was worth while for the Mahatma to have staked his life for such an issue, specially when the Communal Award was from start to finish an objectionable document.” (P. 345).

 অর্থাৎ ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’র মত একটি হাতি গিলিবার পর ঐ ছোট মাছিটায় এত আপত্তি কেন? উহার জন্য মহাত্মা তাঁহার মহামূল্য জীবন বিপন্ন করিতে গেলেন কেন? কেন, তাহা সুভাষ কি ত্রিপুরীর পরেও বুঝিতে পারেন নাই? তখনও কংগ্রেসের অত বড় সমস্যা তুচ্ছ করিয়া তিনি রাজকোটের জন্য প্রাণ-ত্যাগ করিতে গিয়াছিলেন কেন? অর্থ অতিশয় সরল―কিন্তু প্রাণ ষে বুঝিতে চায় না! হঠাৎ এই যে পন্থা-পরিবর্ত্তণ, অর্থাৎ রাজনীতি ছাড়িয়া, যুদ্ধ ত্যাগ করিয়া, হরিজন-সমস্যাকেই একমাত্র সমস্যা করিয়া তোলা―এ সম্বন্ধে তাঁহাকে প্রশ্ন করিলে―

 “He gave replies that were rather confusing or he did not reply at all, which led people to think that he preferred social work to political. This lead of the Mahatma was naturally followed more by his blind admirers and by those who were tired of repeated suffering and imprisonment and wanted a convenient excuse for giving up the political fight (P 347)

 এখানে, আমি ঐ শেষ-বাক্যটির প্রতি পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি; আজিকার দিনে উহার অর্থ আরও সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আজ মহাত্মা-শিষ্য, বড় বড় কংগ্রেসী যোদ্ধাগণ, যে চরিত্র ও মনোভাবের পরিচয় দিতেছেন, তাহা কিছুমাত্র আশ্চর্য্যজনক নয়। ইঁহারা গান্ধীর আদেশে একটা আলেয়ার পশ্চাতে ছুটিয়া বহু কষ্ট ভোগ করিয়া শেষে হতোদ্যম ও নিরাশ্বাস হইয়া পড়িয়াছিলেন। মহাত্মার নেতৃত্ব ছাড়া তখন অন্য গতি ছিল না, অথচ ব্রিটিশের সহিত যুদ্ধ চালাইবার হুকুম নাই―স্বাধীনতার সেই লক্ষ্যটা পর্য্যন্ত প্রায় দৃষ্টি-বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছে। সেই অবস্থাই স্থায়ী হইয়া উঠিয়াছিল। যুক্তি, বিচার ও বাস্তবদৃষ্টি নিষিদ্ধ হইয়াছে―কেবল একটা নিবৃত্তি-মার্গ ছাড়া আর কোন পন্থার নির্দেশ নাই। এমন অবস্থায় যাহার বাধ্য হইয়া বদ্ধ হইয়াছিল তাহাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব ও চবিত্রবল বেশিদিন জীবিত থাকিতে পারে না; আজ তাহাদিগকে গালি দিয়া কি হইবে? ইহার পর সুভাষচন্দ্র ঐ প্রায়োপবেশন সম্বন্ধে আরও লিখিয়াছেন―

 Another theory has been put forward to explain the Mahatma s conduct. It is advanced that he realised the ultimate failure of the movement and therefore wanted to create out of it another movement which would be of benefit to his countrymen ....... Whatever the real explanation may be, there is no doubt that the pact served to side-track the Civil Disobedience movement and cause a diversion of men, money and public enthusiasm to the anti-touchabilitv (or ‘Harijan’) campaign (Pp. 347-48)

 ইহার পর তিনি একটি উপমাও দিয়াছেন,—সে যেন যুদ্ধ চালাইবার কালে, যুদ্ধ বন্ধ করিয়া সৈন্যগণকে সহসা আদেশ করা হইল,―জনপদবাসীদের কষ্ট নিবারণের জন্য তাহারা অতঃপর একটা খাল কাটিতে লাগিয়া যাক্। কিন্তু কংগ্রেস তখন মহাত্মার কোন আদেশ অমান্য করিতে পারে না, ইতিপূর্ব্বে তিনি তাঁহার একচ্ছত্র আধিপত্য কেমন নির্ব্বিঘ্ন করিয়া লইয়াছিলেন তাহার প্রমাণ আছে। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―

 “When the time came for electing the Working Committee for the coming year (1930), the Mahatma came forward with a list of fifteen names from which names of Mr Srinivasa Iyengar, the writer and other Left-Wingers had been omitted... He said openly that he wanted a committee that would be completely of one mind ...,Once again it was a question of confidence in the Mahatma and as the House did not want to repudiate him it had no option but to give in to his demand .. Altogether the Lahore Congress was a great victory for him Pandit Jawaharlal Nehru was won over by him, and others (of the Left Wing) were excluded from the Working Committee The Mahatma could henceforward proceed with his own plans without fear of opposition within hıs Cubinet and whenever any opposition was raised outside his Cabinet he could always coerce the public by threatening to retire from the Congress or to fast unto death” (P. 245). পর বৎসর করাচী-কংগ্রেসেও গান্ধী ঠিক ইহাই করিয়াছিলেন (পৃ: ২৯০)। এত জানিয়াও সুভাষচন্দ্র ত্রিপুরী-যাত্রা করিয়াছিলেন, এবং তাহার পরেও সেই সাধ্য-সাধনা! প্রেম এমনই অবুঝ! মহাত্মা তখন দুইটি অস্ত্র―ব্রহ্মাস্ত্রের মত গড়িয়া লইয়াছেন; একটি, কংগ্রেসকে ত্যাগ করিবার ভয়-দেখানো; আরেকটি, প্রায়ােপবেশনে প্রাণত্যাগ। এই দ্বিতীয় অস্ত্রটি তিনি শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাইয়াছিলেন―পাকিস্তানকে সেই পঞ্চান্ন কোটি টাকা দেওয়ার জন্য প্যাটেলজীকে বাধ্য করিয়াছিলেন। তবু গান্ধী বারবার বলিতেন, তিনি কংগ্রেসের চারি-আনার সভ্যও নহেন―কংগ্রেস জনগণের প্রতিনিধি; তিনি জনগণের সেবক (Servant of the People), তাই কংগ্রেসেরও তিনি সেবকমাত্র! এমন সত্যনিষ্ঠা ৰা সত্যবাদিতা সত্যই দুর্ল্লভ! গান্ধী কংগ্রেসের দাস, কংগ্রেস গান্ধীর দাস নয়! এ সকলের একমাত্র অর্থ,―ব্রিটিশের সহিত কোন গুরুতর সংঘর্ষ না ঘটে, ইহাই ছিল গান্ধীর সবচেয়ে ভাবনার বিষয়। ইহার প্রমাণস্বরূপ আমি এই গ্রন্থ হইতে আরও কিছু উদ্ধৃতি করিব―নহিলে পরে আমার মূল প্রতিপাদ্যটি সুদৃঢ় হইবে না। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―

 “When the writer visited the Mahatma in May 1928. at his Ashram at Sabarmati, he reported to him the public enthusiasm which he met with in many provinces and begged him to come out of his retirement and give a lead to the country. At that time the reply of the Mahatma was that he did not see any light, though before his eyes the peasantry of Bardoli were demonstrating through no-tax campaign that they were ready for a struggle. (P. 208).

* * *

 The Calcutta Congress coming after the Madras Congress was in the nature of an anticlimax. There was tremendous enthusiasm all over the country at that time and every one had expected the congress to act boldly. But while the county was ready the leaders were not. The Mahatma unfortunately for his countrymen did not see light” (P 222)

 The response made by the country to the Congress appeal in 1932 and 1933 inspite of lack of preparation, in spite of the sudden arrest of the organisers and financiers of the party early in January 1932, and in spite of the diversion caused by the Mahatma's fast in Septembor, 1932 and the anti-touchability campaign thereafter―can by no means be regarded as unsatisfactory. Nevertheless, the country was startled one fine morning in May to hear that the Mahatma had suspended the Civil-Disobedience campaign. (Pp. 361-62)  হায়, জনগণ কি বুঝিবে? গান্ধীর রণ-নীতি যে ক্রমেই অধিকতর আধ্যাত্মিক হইয়া উঠিতেছিল কেন, তাহা বুঝিতে হইলে গান্ধীর সেই প্রাণের কথাটি বুঝিতে হয়,―সেই যে-কথাটি তিনি সুভাষচন্দ্রের সহিত প্রথম সাক্ষাৎকালে খুলিয়া বলিতে পারেন নাই। কিন্তু এই অদ্ভুত রণনীতিও ক্রমে এমন দুঃসহ হইয়া উঠিল যে, গান্ধী নিজের মুখরক্ষা করিবার জন্য অবশেষে আর কোন উপায় পাইলেন না; শেষে আদেশ করিলেন, ঐ যুদ্ধ ব্যক্তিগতভাবে করিতে হইবে―গণ-যুদ্ধ আর চলিবে না; অতঃপর এককভাবে ব্রিটিশের সহিত লড়িতে হইবে―উহার নাম “Individual Civil Disobedience”। ভারতের জনগন হতভম্ব হইয়া গেল, কিন্তু গান্ধী তখন ঈশ্বর-জানিত মহাপুরুষ―তাঁহার অভিপ্রায় ভেদ করিবে কে? কিন্তু ইহাতেও ফাঁড়া কাটিল না। ঐরূপ একক যুদ্ধ করিতে গিয়া মহাত্মা কারারুদ্ধ হইলেন, শাপে বর হই, মহাত্মা ছুটি পাইলেন। কিন্তু বিধি বাদী, তাই গবর্নমেণ্ট শীঘ্রই তাঁহাকে ছাড়িয়া দিল। তখন কি করিবেন? ঐ যুদ্ধ করা যেমন বৃথা, তেমনই হাস্যকর; তাই―

 On coming out from prison the Mahatma announced that since he had been sentenced to one year's imprisonment in August, 1933, and since he had been released by the Government before the expiry of his term, he would consider himself as a prisoner till August 1934, and would not offer Cıvıl-Disobedience during that period.” (P. 365).

 ―কি সুক্ষ্ম ধর্ম্ম-জ্ঞান! ব্রিটিশ তাঁহাকে ছাড়িয়া দিয়াছে―তাহারা তাহাদের সত্য-ভঙ্গ করিয়াছে; কিন্তু তিনি তাহা হইতে দিবেন না; ছাড়িয়া দিলেও তিনি সেই পূর্ব্বের দণ্ডকালএক বৎসরনিজেকে বন্দী বলিয়াই মনে করিবেন; বন্দীর কি কোন কাজ স্বাধীনভাবে করিতে আছে? অতএব তিনি ঐ যুদ্ধ তখন স্থগিত রাখিবেন। এ যেন অনেকটা রামচন্দ্রের পিতৃ-সত্য-পালনের মত! আমি এই প্রসঙ্গ আর দীর্ঘ করিব না।

 বেশ বুঝিতে পারা যায়, গান্ধী ব্রিটিশের সহিত সত্যকার বিবাদ করিতে―কোন অবস্থাতেই―রাজী ছিলেন না। অথচ জনগণ ও সংগ্রামী নেতাগণকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য ঐ যুদ্ধের একটা ঠাট বরাবর বজায় রাখিতে হইয়াছিল। লোকে মনে করিত, তিনি যাহা কিছু করিতেন তাহাতেই ব্রিটিশ-রাজশক্তিকে দমিত করিবার একটা সূক্ষ্ম কৌশল আছে―উহার দ্বারাই তাহারা পরাজয় মানিবে। ঐ প্রায়োপবেশনের দ্বারা তিনি সেই ব্রিটিশকেই বিপন্ন করেন, এইরূপ বিশ্বাসই করিত; তাহারা জানিত না, উহার দ্বারা তিনি জনগণকে অন্যমনা এবং বিপ্লবীদিগকে নিরস্ত করিতেন―ব্রিটিশকে প্রসন্ন রাখিতেই চেষ্টা করিতেন, যাহাতে তাহারা তাঁহাকে বন্ধু বলিয়াই শেষ পর্য্যন্ত বিশ্বাস করিতে পারে; এইজন্যই “according to some Britishers, Gandhi was the best policeman the Britisher had in India.”।

 আমি ঘটনাগুলির কালক্রম রক্ষা করি নাই; এইবার গান্ধীকংগ্রেসের ঐ স্বাধীনতা-সংগ্রামের শেষ পর্ব্ব এবং তাহাতে যে জয়লাভ সুরু হইল―তাহার একটু রীতিমত কাহিনী সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিব; ইহাও মনে রাখিতে বলি যে, ঐরূপ জয়লাভের জের, এবং তাহার শেষ ফল-স্বরূপ ভারত স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে। কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। আমি গান্ধী-আরউইন্‌-চুক্তি, গোল-টেৰিল বৈঠক, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা, এবং ভারত-শাসনের নূতন ব্যবস্থা ও তাহাতে গান্ধী-কংগ্রেসের সম্মতি―পর পর সেই যুদ্ধজয়ের কথাই বলিব। লর্ড আরউইন্ গান্ধীর বন্ধুতার পুরস্কার-স্বরূপ একটা চুক্তি করিতে চাহিলেন। প্রথম গােল-টেবিল বৈঠকের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য লর্ড আরউইন্ সকলকে কারামুক্ত করিয়া ঐরূপ চুক্তির সুযােগ করিয়া লইলেন। মহাত্মা বড়লাটের সহিত সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করিলেন―ওয়ার্কিং কমিটির সকলেই (গান্ধীচালিত সেই পুত্তলিকাগুলি) তাঁহার সহিত দিল্লী-যাত্রা করিল; কেবল মতিলাল নেহেরু অতিশয় পীড়িত থাকায় যাইতে পারিলেন না। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―“This was a great misfortune।” তারপর―

 “At Delhi, the Mahatma was surrounded by wealthy anistrocrats and by politicians who were dying for a settlement. Even Pandit Jawaharlal Nehru failed on this occasion.” (P. 280)

 ঐ “dying for a settlement”―কথাটি সত্য! ক্যাবিনেট মিশনের সেই রােয়দাদ―সেই স্বাধীনতার দানপত্র গ্রহণকালেও তাহারা ঠিক এইরূপ―“were dying for a settlement”। তারপর বড়লাটের সঙ্গে মহাত্মার দিনের পর দিন বােঝাপড়া চলিতে লাগিল, শেষে চুক্তিনামা প্রকাশিত হইল। তাহা পড়িয়া দেশবাসীরা হৈ হৈ করিয়া উঠিল (created an uproar in the country);―তখন― “Pandit Jawaharlal came out with the statement that he did not approve of some of the terms of the Pact, but as an obedient soldier he had to submit to the leader." তাহাতে সুভাষচন্দ্র কেবল এইটুকু মন্তব্য করিয়াছেন―"But the country had regarded him as something more than an obedient soldier." (Pp. 281)। কিন্তু পণ্ডিত জবাহরলাল তাঁহার জীবন-দেবতা বা সৌভাগ্য-দেবতার নির্দ্দেশ তখন হইতেই অকুতোভয়ে পালন করিতে সুরু করিয়াছেন। করাচী-কংগ্রেসে এই চুক্তি সারা ভারতের নামে স্বাক্ষরিত হইয়া গেল। এই কংগ্রেসের সভাপতি হইয়াছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, তিনি লাহোর-কংগ্রেসের পূর্ণস্বাধীনতা-সংকল্প উড়াইয়া দিলেন, এবং ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন-মার্কা স্বাধীনতাই যথেষ্ট বলিয়া স্থির করিলেন। তখন মতিলাল নেহেরুর মৃত্যু হইয়াছে, সুভাষচন্দ্র তাহাই স্মরণ করিয়া গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন।

 ইহার পর দ্বিতীয় গোলটেবিল-বৈঠকে কংগ্রেস গান্ধীকেই একমাত্র মুখপাত্র করিয়া পাঠাইল। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন, ইহার মত অসঙ্গত ও অশুভকর আর কিছু হইতে পারে না। মহাত্মাই ইহা চাহিয়াছিলেন নিশ্চয়,―

 “The blind followers could not be expected to criticise him and those who were not his orthodox followers had no influence on him regardless of their character, wisdom or experience.”

 ―এমনই করিয়া ভারতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। যদি কেহ বলে, ভারতবাসী গরু-ভেড়ার মতই চালিত হইয়াছে, এবং এখনও সেইরূপ শাসিত হইতেছে, তবে তাহার জন্য নরক-ব্যবস্থা হইবে। জিন্না সাহেব যখন খোলাখুলি বলিয়া দিয়াছিলেন, ভারতের জনগণ ডিমোক্রেসীর সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, তখন তাঁহাকে কংগ্রেসের যুধিষ্ঠিরগণ কি গালিই না দিয়াছিল! কিন্তু মহাত্মা ঐ চুক্তির পরে যেন হাতে স্বর্গ পাইয়াছিলেন―ব্রিটিশ জাতির প্রতি তাঁহার চিত্ত অতিশয় বিগলিত হইয়াছিল―

 “In fact before he left for London the Mahatma assured Lord Irwin that he would try his level best for a settlement there, and when he left London he assured the Premier Mr. Ramsay Macdonald that he would endeavour till the last to avoid a resumption of hostilities. (P. 295)

 বিলাতের বৈঠকে গান্ধী তাঁহার মহত্ত্ব ও উদারতা আরও করুণভাবে প্রকাশ করিয়াছিলেন, যথা―

 “I want to turn the truce that was arrived at Delhi into a permanent settlement. But for heaven's sake, give me, a frail man sixty-two years gone, a little bit of chance. Find a little corner for him and the organisation that he represents” (P. 319)

 সুভাষচন্দ্র বলিয়াছেন, অহিংসা ও প্রেমের এই আত্ম সমর্পণ বিলাতের রাজনীতি-ধুরন্ধর বলদর্পিত শাসকসম্প্রদায়কে গান্ধীকংগ্রেসের আসল অবস্থা সম্বন্ধে নিঃসংশয় করিয়া দিল। ঐ 'truce’ বা সন্ধিই কাল হইয়া দাঁড়াইল―উহার সুযোগে ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট তাহার ভবিষ্যৎ কর্ম্মনীতি উত্তমরূপে স্থির করিয়া লইল, কংগ্রেস-দমনে আট-ঘাট বাঁধিতে লাগিল। কংগ্রেস কিন্তু সুখনিশির প্রতীক্ষায় নিশ্চিন্ত হইয়া রহিল―যুদ্ধের কোন আয়োজনই করিল না। তারপর গান্ধী যুরোপ হইতে ফিরিয়া না আসিতেই, ভারত-গবর্ণমেণ্ট অগ্নি-মুর্ত্তি ধারণ করিল।

 ইহার পূর্ব্বে গান্ধী তাহাদিগকে তাঁহার দাবীর দৃঢ়তাও দেখাইয়াছিলেন; তিনি পূর্ণ স্বাধীনতাই দাবী করিয়া―

 “Then in order to soften his demand for independence he appealed in these words : “I want to become a partner with the English people. Then finding that all appeals were useless, he flared up and said “Will you not see the writing that those terrorists are writing with their blood ?” And then he said: I shall still hope against hope. I shall strain every nerve to achieve an honourable settlement for my country” (Pp. 312-13).

 গান্ধী আবেদন-নিবেদন, বন্ধুত্ব, ভয়-প্রদর্শন কিছুই করিতে বাকি রাখেন নাই। কিন্তু ভবী ভুলিল না। ঐ যে terrorist-দের ভয়―উহা ব্রিটিশকে জুজুর ভয় দেখানোর মত―গান্ধীকে তাহাও করিতে হইয়াছিল। ঐ দ্বিতীয় গোলটেবিল-বৈঠকে তিনি ব্রিটিশের সবগুলি ফাঁদে সরল বালকের মতই ধরা দিয়াছিলেন―তাহাতে কংগ্রেস নামক সৈন্যবাহিণীর নেতা এবং তাহার অবস্থা সম্বন্ধে তাহদের কোন সংশয়ই আর রহিল না―রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রেম ও ধর্ম্মের, সততা ও সত্যনিষ্ঠার প্রতি যেরূপ শ্রদ্ধা হওয়া স্বাভাবিক, তাহাই হইল। ইহার পরে, গান্ধী যুরোপ হইতে ভারতে ফিরিবার পূর্ব্বেই কংগ্রেসকে দমন করিবার সকল আয়োজন সম্পূর্ণ হইয়া গেছে। ইতিমধ্যে লর্ড উইলিংডন বড়লাট হইয়াছেন, তিনি আসিয়াই এমন মার সুরু করিলেন যে, গান্ধীকে যুদ্ধের নাম পর্য্যন্ত ভুলিতে হইল, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্নদিকে মুখ ফিরাইলেন, ইহার কিছু পরিচয় পুর্ব্বে দিয়াছি। লর্ড উইলিংডনই কংগ্রেসের শির-দাঁড়া ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলেন। সেই দুরবস্থার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিতেও বাধে। গান্ধী বড়লাটের সহিত দেখা করতে চাহিলে তাহা না-মঞ্জুর হইল। তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ভয় দেখাইতেও আর পারিলেন না―জনগণের নিকটে মুখরক্ষা করিবার জন্য―একক যুদ্ধের (individual Civil Disobedience) আদেশ জারি করিলেন। গভর্ণমেণ্টও এক একটি করিয়া সকলকে জেলে পুরিয়া বীরগণকে নিশ্চিন্ত করিয়া দিল। গান্ধীকে শীঘ্রই কারামুক্ত করিয়া দিলে তিনি যে অজুহাত দেখাইয়া পুনরায় ঐ একক-যুদ্ধ করিতে সম্মত হইলেন না, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। তারপর সেই প্রায়ােপবেশন ও পুণা-চুক্তি;―তারপর হইতে বৃটিশের সহিত সাক্ষাৎ-সংগ্রাম বন্ধ হইয়া গেল। ঐ প্রায়ােপবেশন সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র আরও যাহা বলিয়াছেন, তাহা গান্ধীর নেতৃত্ব ও ব্রিটিশের সহিত যুদ্ধে সেনাপতিত্বে তাঁহার অপূর্ব্ব বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। তিনি লিখিয়াছেন―

 “The Government had no objection to a fast of that kind, and as a matter of fact, thanks to the British News-Agencies, the fast was given wide publicity in the European Press, because it helped to advertise the internal differences of the Indian People” (P. 362)

 গোলটেবিল-বৈঠকেও গান্ধী ইংরাজের মতলব-সিদ্ধির সহায়তা করিয়াছিলেন, তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা ভাল করিয়াই স্বীকার করিয়াছিলেন। তাহাতেই―পৃথক-নির্ব্বাচন, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা, ভারতে দুইজাতির উদ্ভব, এবং শেষে ভারত-ভাগ ও পাকিস্তান। কেহ কেহ এমনও বলেন, মহাত্মাকে কারামুক্ত করিলে তিনি সত্যাগ্রহআন্দোলন বন্ধ করিবেন, ইহা গভর্ণমেণ্ট জানিত। কাজেও তাহাই হইয়াছিল, গান্ধীর কারামুক্তির পরেই কংগ্রেস ঐ আন্দোলন বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। আন্দোলন বন্ধ করিয়া গান্ধী ভারত গভর্ণমেণ্টকে অনুরোধ করিলেন―সত্যাগ্রহী বন্দীগণকে কারামুক্ত করা হউক। গবর্ণ‌মেণ্ট সে কথায় কর্ণপাত করিল না। ঐ পুণা-চুক্তি এবং গান্ধীর এইরূপ পূর্ণ পরাজয়-স্বীকারের পর, কোন কংগ্রেসী নেতা তাঁহার কার্য্যের সমালোচনা বা প্রতিবাদ করিতে ইচ্ছা বা সাহস করেন নাই, একমাত্র শ্রীবিঠলভাই প্যাটেল ভিয়েনা হইতে এক ঘোষণাপত্রে লিখিয়াছিলেন―গান্ধীর ঐরূপ নীতি-পরিবর্ত্তন (সত্যাগ্রহের পরিবর্ত্তে হরিজন-আন্দোলন)―"virtually undid the work and the sacrifice of the last thirteen years. It signified a failure of the Civil Disobedience campaign, as also of Mahatma Gandhi’s leadership.”

 কিন্তু আজ একথা কেহই স্বীকার করিবে না, কারণ সেইরূপ পরাজয়ের দ্বারাই স্বাধীনতা-লাভ হইয়াছে। বিড়াল কাঠের বিড়াল হইলেও ক্ষতি নাই―ইঁদুর ধরিতে পারিলেই হইল; খুব বড় ইঁদুরই ধরিয়াছে!

 ইহার পর ব্রিটিশের আর বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই―কংগ্রেসের দৌড় তাহারা বুঝিয়া লইয়াছিল। তাই এক নূতন ভারত-শাসনতন্ত্র, নিজেদের প্রয়োজন মত প্রস্তুত করিয়া, কংগ্রেসকে তাহা গলাধঃকরণ করাইল, ভারতে বাদ্যভাণ্ড সহকারে কংগ্রেস-রাজ প্রতিষ্ঠিত হইল। তারপর মান-অভিমানের পালা আরও কিছুদিন চলিল, এমন সময়ে সহসা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইয়া গেল। সেই যুদ্ধকালে কংগ্রেস একটা বড় চাল চালিতে গিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করিল; শেষে সেই কাঠের বিড়াল কেমন করিয়া স্বাধীনতা-ইঁদুর ধরিল―গান্ধী-কংগ্রেসের সেই শৌর্য্যবীর্য্য―সেই খদ্দর, অহিংস ও হরিজন-সেবার চাপে পড়িয়া ব্রিটিশসিংহ কিরূপ জব্দ হইয়া ভারতরাজ্য তাড়াতাড়ি ত্যাগ করিয়া গেল, তাহা আমরা সকলেই জানি―সুভাষচন্দ্র তাহা দেখিয়া যাইতে পারিলেন না। এইরূপ স্বাধীনতা-যুদ্ধ যেমন জগতের ইতিহাসে অতুলনীয়, তেমনই এমন স্বাধীনতাও পূর্ব্বে কোন জাতি লাভ করিতে পারে নাই। কিন্তু এ সকল কথা সুভাষচঞ্জের গ্রন্থে নাই―তিনি কেবল গান্ধীর রণ-কৌশল এবং গান্ধী-কংগ্রেসের অমিত পরাক্রমের কাহিনীই লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

 এইবার গান্ধীর “স্বাধীনতা” এবং তাঁহার ধর্ম্ম ও কর্ম্মনীতি বুঝাইবার সময় আসিয়াছে, সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ হইতে আমি এপর্য্যন্ত যাহা উদ্ধৃত করিয়াছি তাহা হইতেই আশা করি, তাহা কতকটা হৃদয়ঙ্গম হইবে। সুভাষচন্দ্র যাহা জানিয়াও বিশ্বাস করিতে চাহেন নাই, আমি তাহাই স্পষ্ট করিয়া তুলিতেছি। এখন সেই কথাই বলি।

 গান্ধীর আবির্ভাবের পূর্ব্বে ভারতে যে স্বাধীনতা-আন্দোলন এবং পরে যে বিপ্লববাদ দেখা দিয়াছিল, তিনি তাহার কোনটাকেই সুচক্ষে দেখেন নাই। তাঁহার অন্তরে ঐরূপ আন্দোলনের পরিবর্ত্তে অন্যরূপ একটা কর্ম্মনীতির প্রেরণা বোধ হয় অনেক পূর্ব্বেই উদয় হইয়াছিল―দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়গণের জন্য সেই কর্ম্মপদ্ধতি অবলম্বন করিয়। তিনি যেটুকু সাফল্য লাভ করিয়াছিলেন, তাহা হইতেই দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল―উহাই প্রকৃষ্ট পন্থা; শেষে তাহাই ঈশ্বরের আদেশ বা ‘Voice of God’ হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপে প্রথম হইতেই রাজনীতির সহিত ধৰ্মবিশ্বাস যুক্ত হইয়া তাঁহাকে বাস্তবের প্রতি অন্ধ করিয়া তুলিয়াছিল। যে পাশ্চাত্যের ঘোরতর রাজসিক প্রবৃত্তিকে যীশুর ধর্ম্মমন্ত্রও নিরস্ত করিতে পারে নাই এবং যে কঠিন রাষ্ট্রীয় কূটনীতিকে কুটতর করিয়া ঐ সাম্রাজ্যলোলুপ জাতি পৃথিবী গ্রাস করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছে― যাহাদের লোভের অন্ত নাই, তিনি সেই ব্রিটিশ জাতির সম্মুখে মধ্যযুগীয় ভারতের সাধু সন্তদের বেশে ন্যায়, ধর্ম্ম ও করুণার দোহাই দিয়া দাঁড়াইলেন। এইরূপ বিশ্বাসের আরও কারণ ছিল; প্রথমতঃ, তাঁহার মজ্জাগত জৈনধর্ম্মের সংস্কার দ্বিতীয়তঃ, জন্মগত বৈশ্য-ভাব। তিনি যেমন ব্রাহ্মণোচিত ব্রহ্মনিষ্ঠার বশে পূর্ণের বা পরম বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করেন নাই (এখানে ‘পূর্ণ-স্বাধীনতা’),―ব্রহ্মনিষ্ঠার পরিবর্ত্তে সুবিধাবাদ, অর্থাৎ লাভ-ক্ষতির একটা হিসাব করিয়া মিটমাটের অধিকতর পক্ষপাতী ছিলেন, তেমনই ক্ষত্রিয়োচিত বীর্য্য (শুধুই নির্ভীকতা নয়) ও যাহাকে ‘ঈশ্বর-ভাব’ বলে তাহা তাঁহার ছিল না; দান অপেক্ষা গ্রহণে তাঁহার চিত্ত উন্মুখ ছিল। এই জৈনধর্ম্ম-সংস্কার ও বৈশ্য-মনোবৃত্তির জন্য তিনি ব্রিটিশ রাজশক্তিকে মনে মনে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন; তাহাদের সেই রাজসিক বা রাজকীয় দৌরাত্ম্য তাঁহাকে বিদ্বেষভাবাপন্ন করিতে পারে নাই। রাজশক্তির সহিত বৈশ্য-বুদ্ধির একটা স্বভাব-মৈত্রী আছে―সর্ব্বদেশে ও সর্ব্বযুগে। বৈশ্য জানে, সে রাজ্য-শাসন করিতে পারিবে না; এবং ঐ রাজশক্তির বা প্রভু-ধর্ম্মের আশ্রয় ব্যতিরেকে তাহার ধর্ম্মও সে পালন করিতে পারিবে না। ইহার উপর, গান্ধী স্পষ্টই দেখিতে পাইয়াছিলেন―সে দৃষ্টি অৰ্দ্ধ সত্য হইলেও, ভারতের গত-যুগের অবস্থা ও অভিজ্ঞতার দিক দিয়া পুর্ণ সত্য―যে, ভারতবাসী জনগণ পাশ্চাত্য স্বাধীনতার মর্ম্ম বুঝে না তাহারা তাহা কামনাও করে না; তাহাদের রাজনৈতিক সংস্কার নাই বলিলেই হয়। রাজা তাহাদের চাই,― একটা প্রভুশক্তির পূজা করিতে না পাইলে তাহারা নিশ্চিন্ত হইতে পারে না; কেবল, সেই রাজাকে একটু প্রজারঞ্জক ও দয়ালু হইতে হইবে। ইহা যে কত সত্য, তাহ বর্ত্তমানে ভারতে যে প্রজাতন্ত্র ও জাতীয়ত-ধর্ম্মী শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সেই অপূর্ব্ব সাধারণ-তন্ত্রের প্রতি জনগণের―শিক্ষিতগণেরও―গভীর অনুরক্তি হইতেই প্রমাণিত হয়। এইরূপ রাজভক্তি―অর্থাৎ শক্তিমানের প্রতি অন্তরের প্রণতি-নিবেদন―ভারতবাসী জনসাধারণের মজ্জাগত। এক্ষণে ঐ মজ্জাগত সংস্কারকে নানা যুক্তি ও তত্ত্বকথায় ঢাকিয়া তথাকথিত স্বাধীনতা-ধর্ম্মী শিক্ষিত-সম্প্রদায় কোনরূপে আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছে। গান্ধী বুঝিয়াছিলেন, এই জাতির চিত্তে সেই মজ্জাগত প্রবৃত্তিকে দমন করিয়া, রাজভক্তির পরিবর্ত্তে, কেবলমাত্র ব্রিটিশ-বিদ্বেষ উদ্দীপিত করিলে তাহার সমূহ অকল্যাণ হইবে― কারণ, ব্রিটিশ-বিদ্বেষ ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা এক বস্তু নয়; বিলাতী আদর্শের স্বাধীনতা ভারতের পক্ষে ঘোরতর পরধর্ম্ম। অতএব যাহারা ব্রিটিশ-বিদ্বেষের অগ্নিতে ইন্ধন দিয়া স্বাধীনতা-সংগ্রাম করিতেছে তাহারা মুষ্টিমেয় কয়েক জন ইংরেজি-শিক্ষিত স্বপ্নবিলাসী মানুষ; তাহাদের মধ্যেও দলাদলি আছে―এবং সকলেই সাধু নয়। এই অনিষ্ট নিবারণ করিতে হইবে, ভারতের জনগণকে এই স্বাধীনতাবাদী বিপ্লবীদের হাত হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। ইহার জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তির সহিত সন্ধি-স্থাপন, বড় জোর তাহাদের নিকট হইতে শাসনকার্য্যের অংশ গ্রহণ, বা তাহাদের ঐ শাসন-পদ্ধতিটাকে একটু ধর্ম্মশুদ্ধ করিয়া লওয়াই ভারতের প্রকৃত কল্যাণ-সাধন। ইহার একমাত্র উপায়―ব্রিটিশকে সেই কথাটা ভালো করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া―উহাতে তাহাদের ক্ষতি অপেক্ষা লাভের দিকটা দেখাইয়া দেওয়া; এবং সহজে না বুঝিলে নানা সংকট ও সমস্যার সৃষ্টি করিয়া তাহাদের দুর্ব্বুদ্ধি দূর করা। ইহাই একমাত্র উপায়; ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে ধীরে ধীরে সেই পথে চালিত করাই উৎকৃষ্ট রাজনীতি। উনবিংশ শতাব্দীর সেই ভারতীয় মনোভাব গান্ধী ত্যাগ করিতে পারেন নাই―তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করিতেন, ঐ ইংরেজ যতই মন্দ হউক, আর সকল জাতির তুলনায় (ভারতবাসীর তুলনায় তো বটেই) বহু সদগুণের অধিকারী। ইহার একটা কারণ অবশ্য এই ষে, গান্ধীর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও একরূপ কর্ম্মবুদ্ধির প্রখরতা সত্ত্বেও, তাঁহার জ্ঞানবৃত্তি (Intellect) অতিশয় সাধারণ স্তরের ছিল―সুভাষচন্দ্রও তাহা বলিয়াছেন; আরও কারণ―তাঁহার সেই বৈশ্যমনোভাব; তিনি ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ছিলেন না।

 উপরে যাহা বলিয়াছি তাহা উত্তমরূপে বুঝিয়া লইলে, গান্ধীর অভিপ্রায় ও কার্য্যপ্রণালী কিছুমাত্র দুর্ব্বোধ্য হইবে না। সুভাষচন্দ্রের সহিত প্রথম সাক্ষাতে তিনি তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দেন নাই কেন, তাহাও বুঝিতে বিলম্ব হইবে না; সুভাষচন্দ্রকে তিনি সেই অপর দলের একজন ভাবোন্মত্ত যুবক বলিয়াই বুঝিয়াছিলেন―ইহাদেরই সহিত তাঁহাকে যুদ্ধ করিতে হইবে; অথচ, তখনই তাহার সেই অভিপ্রায় ব্যক্ত করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নহে,―তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সকলে তাঁহাকে তাড়াইয়া দিবে। অতএব, গান্ধীকে যে এত কূটনীতি, ছলনা, এমন কি মিথ্যাচার আশ্রয় করিতে হইয়াছিল, তাহার জন্য তিনি দায়ী নহেন―দায়ী ঐ স্বাধীনতাবাদী, ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীগণ। ব্রিটিশরাজকে বিতাড়িত করিবার প্রয়োজন নাই, বরং তাহাদের ‘হৃদয় পরিবর্ত্তণ’ করিয়া, তাহাদেরই সাহচর্য্য ও অভিভাবকতায় প্রজা-সুখ ভোগ করা―তাহাদের প্রীতি ও রাজপ্রসাদই অধিকতর কাম্য। ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারত হইতে একেবারে বিতাড়িত হইবে, ইহা ভাবিতেও তিনি ভয় পাইতেন; তাহারা চলিয়া গেলে এদেশ শাসন করিবে কে? তাঁহার অনুচর ঐ কংগ্রেসী নেতৃমণ্ডলী? তাহারা শাসন-কর্ম্মের কি জানে? ব্রিটিশের চৈতন্য-সম্পাদনের জন্য―তাহাদিগকে একটু খোঁচা বা গুঁতা দিয়া কিঞ্চিৎ প্রজাস্বত্ব আদায় করিবার জন্যই, তিনি উহাদিগকে অহিংসা ও সত্যাগ্রহে দীক্ষিত করিয়াছেন; তারপর, তাহারা প্রজার পক্ষ হইয়া ব্রিটিশরাজের সাহচর্য্য[২] করিবে মাত্র; ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের স্থান অধিকার করিবার মত যোগ্যতা তাহাদের কোথায়? অতএব, গান্ধী প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশের সহিত যুদ্ধ কখনও করেন নাই― তাহার একমাত্র কাজ ছিল জনগণকে বশীভুত করা, এবং ঐ স্বাধীনতাবাদী দলগুলাকে বলহীন করা; তাহা করিতে পারিলে ব্রিটিশের সুবুদ্ধি-সম্পাদন করা সহজ হইবে।

 গান্ধীর কার্য্যাবলীর উদ্দেশ্য যে ভারতের ‘স্বাধীনতা’-লাভ, এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশে সুভাষচন্দ্র তাঁহার ঐ গ্রন্থে গান্ধীর কর্ম্ম-পন্থার সদর্থ করিতে পারেন নাই; কখনও তাঁহাকে অতিশয় সরল, রাজনীতিঅনভিজ্ঞ, আত্মমতনিষ্ঠ ভাবিয়া দুঃখ করিয়াছেন, কখনও বা, তাঁহার স্পষ্ট দ্বৈতাচার ও সংগ্রাম-ভীরুতা দেখিয়া বিস্মিত ও মর্ম্মাহত হইয়াছেন। তিনি যদি গান্ধীর সেই নিজস্ব দৃঢ় প্রত্যয় ও তদনুযায়ী একটা গভীর গোপন নীতির প্রয়োগ-চাতুর্য্য বুঝিতে পারিতেন, তবে নিজেই ভুল করিয়া বারবার বিড়ম্বনা ভোগ করিতেন না। প্রথম দশ বৎসর অর্থাৎ ১৯২০ হইতে ১৯৩০ পর্য্যন্ত, গান্ধী তাঁহার সেই বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই―আশা ছিল যে, ইংরেজের মতি-পরিবর্ত্তন করিয়া, তিনি ভারতবাসীর জন্য এমন একটু প্রজাস্বত্ব আদায় করিতে পারিবেন, যাহা বর্ত্তমানের পক্ষে যথেষ্ট। তাই “স্বাধীনতা”, “স্বরাজ” প্রভৃতির অর্থ লইয়া কংগ্রেসে এত বাদ-বিতণ্ডা হইত; গান্ধী সে সময়ে অতিশয় সতর্ক থাকিতেন, অতিশয় সাবধানে পক্ষ-সমর্থন করিতেন। “পূর্ণ স্বরাজ” বলিতেও তিনি “Substance of Independence” এইরূপ বাক্যের আড়ালে আশ্রয় লইতেন। তিনি জানিতেন, প্রজাসাধারণ ঐরূপ স্বরাজের মর্ম্ম বুঝে না, কেবল ভাত-কাপড়ের দুঃখ ঘুচিলেই হইল। ব্রিটিশ একথা বুঝিবেই, না বুঝিলে ঐ স্বরাজের দাবী উত্তরোত্তর বাড়িতে থাকিলে তাহারেরই সমূহ বিপদ―গোলটেবিল-বৈঠকে তিনি তাহাদিগকে সেই ভয় দেখাইয়াছিলেন; তিনি যে তাহাদের কত বড় হিতৈষী বন্ধু, তাহা বারবার প্রমাণ করিতে ক্লান্তিবোধ করেন নাই। ইহার জন্য, অর্থাৎ ইংরেজ যাহাতে তাঁহাকে বিশ্বাস করে তজ্জন্য, তিনি ঐ বিপ্লবীদিগের প্রতি কিছুমাত্র পক্ষপাত বা সহানুভূতি প্রকাশ করিতে বিরত ছিলেন। বড়লাট আরউইনের সহিত সেই চুক্তি করিবার কালে তিনি তাঁহাকে অগণিত বিপ্লবী বন্দীদের কারামোচন করিবার কথা বলেন নাই, কেবল তাঁহার সত্যাগ্রহীদিগকেই মুক্তি দিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। ব্রিটিশের অসন্তোষ ও অবিশ্বাস-ভাজন হইবার ভয় তাঁহার এত অধিক ছিল―পাছে ব্রিটিশ রাজশক্তি সন্দেহ করে, তিনি ঐ বিপ্লবীদিগের প্রতি গোপনে সহানুভূতিশীল, তাই যতীন দাসের অনশনে প্রাণত্যাগ ভারতে যে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহাতে তিনি কঠিন মৌন অবলম্বন করিয়াছিলেন। অনশনে প্রাণত্যাগ তিনি কখনও করেন নাই―করিতে হয় নাই, তাই কি সেই অতুলনীয় মনোবল, আত্মার সেই অদম্য বীর্য্য দেখিয়া তিনি মনে মনে সঙ্কুচিত হইয়াছিলেন? ধর্ম্ম বা রাজনৈতিক মতভেদ যেমনই হৌক, কোন মহাত্মা ঐরূপ একটা মহা-অবদান দেখিয়া অবিচলিত থাকিতে পারে? না, যতীন দাস বাঙালী ছিল বলিয়া? বাঙালী যেমন ব্রিটিশের মহাশত্রু, তেমনই যত-কিছু বিপ্লব-বিদ্রোহের, উৎপাত-অশান্তির মূল ঐ বাঙালী। গান্ধী-নীতি ও গান্ধী-ধর্ম্মের এমন মূর্ত্তিমান্ বিঘ্ন আর কোন জাতিই নহে। তাই, গান্ধীর জন্য বাঙালী যত ত্যাগ, যত নির্য্যাতনই বরণ করুক না কেন, তিনি বাঙালীকে কখনও ৰিশ্বাস করিতেন না; তাঁহার কংগ্রেসও বাঙালীকে তাহাদের পথের একটা কণ্টক বলিয়াই মনে করে―তাহাকে লইয়া আজিও দুর্ভাবনার অন্ত নাই। গান্ধী-কংগ্রেসের এই আশঙ্কা মিথ্যা নহে, বাঙালী সুভাষচন্দ্রই তাহাদের সব চেয়ে বড় শক্র―ব্রিটিশের সহিত মৈত্রীবন্ধন এখনও নির্বিঘ্ন হয় নাই। যতীন দাসের সেই আত্মাহুতির কালে গান্ধীর আচরণ সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―

 “In this connection the attitude of the Mahatma was inexplicable. Evidently the martyrdom of Jatin Das which stirred the heart of the county did not make any impression on him, The pages of Young India had nothing to say about the incident. A follower of the Mahatma who was also a close friend of the deceased wrote to him inquiring as to why he had said nothing about the event. The Mahatma replied to the effect that he had purposely refrained from commenting, because if he had done so, he would have been forced to write something unfavourable.” (P. 228)

 ―তিনি যে ঐ ঘটনাটির সম্বন্ধে নীরব ছিলেন তাহার কারণ―“যদি তিনি কিছু লিখিতেন, তবে বাধ্য হইয়া অপ্রিয় কথাই লিখিতে হইত”! বাধ্য হওয়ার অনেক কারণই ছিল,―একটা কারণ ব্রিটিশের সন্দেহভাজন হওয়া, তাহা নিশ্চিত। পাছে ব্রিটিশ তাঁহাকে কিছুমাত্র সন্দেহ করে, তাই তিনি তাঁহার খাতা-পত্র সর্ব্বদা তাহাদের সমক্ষে খুলিয়া রাখিতেন; তাহারা যদি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে, তিনি ভিতরে ভিতরে বিপক্ষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিতেছেন, তবে তাঁহার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইবে―ব্রিটিশের বন্ধুতা ও অনুগ্রহ লাভ করিতে পারিবেন না।

 গান্ধীর অভিপ্রায় ও মূলনীতির কথা বলিয়াছি, ইহার পর সেই উদ্দেশ্য-সাধনের উপায় বা কর্ম্মপদ্ধতি সম্বন্ধে বেশী কিছু বলিতে হইবে না। পূর্ব্বে বলিয়াছি, গান্ধী জাতিতে যেমন বানিয়া, তেমনি ধর্ম্মসংস্কারে জৈনভাবাপন্ন; ইহার উপর তাঁহার দুইটী শক্তি ছিল, এক―অসাধারণ মনোবল; তিনি অতিশয় ধীরভাবে অপেক্ষা করিতে পারিতেন, এবং আপন বিশ্বাসে বজ্রবৎ দৃঢ় ছিলেন; দুই―তাঁহার একপ্রকার তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিল―তাহা intellect নয়―ঐ বানিয়া-সুষ্ঠভ বাস্তব-বুদ্ধি; অর্থাৎ অতি-নিকট বা প্রত্যক্ষ সমস্যাগুলিকে এড়াইয়া চলিবার বুদ্ধি, হিসাব করিয়া অল্পে অল্পে অগ্রসর হইবার বুদ্ধি; প্রত্যেক সঙ্কট বা পরিস্থিতি হইতে তখনকার মত উদ্ধারলাভের জন্য তাঁহার বিবেককে তিনি প্রয়োজনের অধীন করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিতেন না; ইহার বহু দৃষ্টান্ত সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থে আছে। সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ত্রিপুরীর যুদ্ধ, কিন্তু তখনও তাহা ঘটে নাই। কিন্তু প্রথম হইতেই তিনি এক দিব্যবুদ্ধি ধারণ করিয়াছিলেন, সেই বুদ্ধির বলে তিনি একই কালে ‘মহাত্মা’ এবং ‘Father of the Nation’ হইতে পারিয়াছিলেন; পূর্ব্বে সে কথা বলিয়াছি, তাহাই গান্ধীর শ্রেষ্ঠ সাধনা ও সিদ্ধিলাভ। তিনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল ভারতীয়গণকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া―সরল, অশিক্ষিত ও ভক্তিপরায়ণ হিন্দু জনসাধারণকে বশীভূত করিয়াছিলেন। গান্ধী জানিতেন, কোন্ কথায়, কেমন বেশ ও কেমন আচরণে তাহারা একদিনে সাড়া দিবে, ভক্তিভরে লুটাইয়া পড়িবে; ঐ ভক্তিই তাহাদের স্বভাব-ধর্ম্ম, স্বাধীনতার মর্ম্ম উহারা কি বুঝিবে? ইংরেজের প্রতি বিদ্বেষ ছাড়া উহারা আর কিছুই বুঝে না। অতএব, সেই ইংরেজ বিদ্বেষকেই ঘুরাইয়া আর এক পথে তাহাদের পিপাসা মিটাইয়া, একদিকে তাঁহার অভিপ্রায়সিদ্ধিও যেমন হইবে, তেমনই সেই বিপ্লবী ব্রিটিশবিরোধীদিগকে নেতৃত্বচ্যুত করা যাইবে। ইহার জন্য ঐ অহিংসা-মন্ত্রের মত সর্ব্বার্থসিদ্ধির মন্ত্র আর নাই; হিন্দুর অহিংসা নয়―জৈনপন্থীর অহিংসাই এবার বড় কাজে লাগিল। এমনই করিয়া গান্ধী শিক্ষিত ভারতবাসীর বিরুদ্ধে (ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়) যে সংগ্রাম শুরু করিলেন, তাহাতে অতি অল্পদিনেই আশ্চর্য সুফল ফলিল। শিক্ষিতগণও শেষে সেই প্রবল বন্যা রোধ করিতে না পারিয়া তাহাতেই ভাসিয়া ও ডুবিয়া ঐ গান্ধীনীতিকে জয়যুক্ত করিল। ১৯২০ হইতে ১৯৩০ পর্য্যন্ত এই দশবৎসরে গান্ধী তাঁহার আসল যুদ্ধে সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন। তখন এমন অবস্থা হইয়াছে যে, ভারতের জনগণ আর স্বাধীনতার চিন্তা করে না, সে চিন্তার ভার তাহারা গান্ধীর উপরে দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে―অন্ধভাবে তাঁহার আদেশ পালন করাই হইয়াছে তাহাদের একমাত্র কর্ত্তব্য; লক্ষ লক্ষ নর-নারী কেবল মহাত্মার দর্শন লাভ করিয়াই ধন্য হইতে লাগিল। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন―

 “During the Congress session, the Mahatma used to hold a public prayer in the morning and unprecedented crowds attended it. No propaganda could be more effective in drawing public support.” (P. 290).

 শেষে এমন হইল যে, ভারতে গান্ধীর ধর্ম্মমত বা রাজনীতির প্রতিবাদ করে এমন একজন ব্যক্তিও রহিল না―ঐ গণ-মনোভাবই বিদ্যা-বুদ্ধি ও বিচারশক্তিকে পরাভূত করিয়া গান্ধীকেই ত্রিশকোটির ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ করিয়া তুলিল। যাহারা মহাত্মার মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য দুই চক্ষু মুদ্রিত করিতে পারিল না, তাহারা জাতির জীবনরঙ্গমঞ্চ হইতে নির্ব্বাসিত হইল; যাহার কোনরূপে টিকিয়া থাকিতে চাহিল তাহারা নিজেদের বিবেক ও বিদ্যাবুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়া প্রকাশ্যে গান্ধী-মন্ত্র গ্রহণ করিল; তাহারাই গান্ধীবাদ ও গান্ধীধর্ম্মের ভাষ্যরচনায় তাহাদের সেই বিদ্যাবুদ্ধির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিল; বড় বড় বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক, এমন কি, ধর্ম্মমঠের গুরু বা অধ্যক্ষও গান্ধীর জয়গান করিতে লাগিল। এমনই করিয়া ভারত হইতে স্বাধীন চিন্তা, সত্যনিষ্ঠা, এবং জ্ঞানের আলোক নির্ব্বাপিত হইয়াছে, এবং তাহারই ফলে ভারত ‘নেশন’ হইয়া উঠিয়াছে। এমন কাজ ভারতে পুর্ব্বে কেহ করিতে পারে নাই, পৃথিবীর আর কোন অংশে এমন স্বাধীনতাধর্ম্মী ‘নেশন’ জন্মলাভ করে লাই। এই 'নেশন’কে ভারতের ভাগ্যবিধাতাও যেমন, ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টও তেমনই ভালরূপ চিনিয়াছিল―দুইয়ের কাহারও আর কোন চিন্তার কারণ রহিল না। তথাপি গান্ধী-সেনার সেই অনর্থক উপদ্রবের কারণ ঐ স্থূলবুদ্ধি ইংরাজ বুঝিতে না পারিয়া বড়ই বিরক্ত হইত,―ব্রিটিশ-সিংহ কখনও লাঙ্গুল-আন্দোলন, কখনও দংষ্ট্রাব্যাদান, কখনো বা দুই চারিটা থাবা মারিয়া সব ঠাণ্ডা করিয়া দিত। আসলে গান্ধী-সৈন্যের সত্যাগ্রহীরা ইংরেজকে কিছুমাত্র শঙ্কিত করিতে পারে নাই―উত্তেজিত করিয়াছিল মাত্র; যদি কেহ উদ্বিগ্ন করিয়া থাকে―সে ঐ বিপ্লবীগণ। এইরূপে ১৯২৯-৩০ সাল আসিয়া পড়িল।

 ইহার পর যাহা ঘটিয়াছিল, আমি পুর্ব্বে তাহা সবিস্তারে বলিয়াছি। সুভাষচন্দ্র ১৩৩৪ পর্য্যন্ত গান্ধী-কংগ্রেসের সেই নাকালের কথা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তিনি এই পরিণামকে “Defeat and Surrender” নাম দিয়া পৃথক অধ্যায়ে তাহার আলোচনা করিয়াছেন। সে যে কেমন “পরাজয় ও আত্মসমৰ্পণ” তাহার একটি নমুনা উদ্ধৃত করি―

 ‘This meeting (A. I. C. C.―Patna 1933) offered a surprise to the public in as much as Mahatma Gandhi himself sponsored the idea that Congressmen should enter the legislatures —After the meeting when the Government felt that the defeat and humiliation of the Congress was complete―they withdrow the ban on most of the Congress Organisations in the country and allowed them to function’. (P. 370).

 আমি পূর্ব্বে গান্ধীর সেই একক-যুদ্ধ-অভিনয়ের হাস্যকর সংকল্প এবং তাহার শোচনীয় পরিণাম উল্লেখ করিয়াছি। লর্ড উইলিংডনই গান্ধী-কংগ্রেসের সেই কর্ম্মভোগ, তাহার সেই গত্যন্তরহীন অবস্থা ঘুচাইয়া তাহাকে মুক্তি দিয়াছিলেন। ইহার পর ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট আপন খুসীমত তাহাকে ‘ওঠ-বোস’ করাইয়াছে। গান্ধী স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন, ব্রিটিশের সহিত তিনি রাজনীতির যুদ্ধে পারিয়া উঠিবেন না –অন্ততঃ তিনি যে উপায়ে তাহদের হিতসাধন করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহারা তাহা গ্রাহ্য করিবে না। কিন্তু তখন সেইরূপ রাজনীতির মুখোসেও আর প্রয়োজন নাই; জনগণ এখন সম্পূর্ণ বশীভূত হইয়াছে, তাই ব্রিটিশকে ছাড়িয়া তিনি এইবার তাঁহার নেতৃত্ব আর এক ক্ষেত্রে পাকা করিয়া তুলিলেন। এখন হইতে ভারতবাসী আর কিছুই করিবে না―কেবল চরকা, অহিংসা ও অস্পৃশ্যতাবৰ্জ্জনই তাহাদের স্বাধীনতা-লাভের একমাত্র সাধন হইল। পরাজয়ের লজ্জাকে মহত্ত্বের আবরণ দেওয়া, রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও অক্ষমতাকে ধর্ম্মভাবের দ্বারা শোধন করিয়া লওয়া, এবং স্বাধীনতার পরিবর্ত্তে অপর এক বস্তুকে সর্ব্বাগ্রে বাঞ্ছণীয় বলিয়া বিশ্বাস করানো,―এ সকলই গান্ধীর পক্ষে তখন অতিশয় সহজ হইয়া উঠিয়াছে। তাই কংগ্রেসকে ব্রিটিশের সহিত অপোষ-রফা করিবার অনুমতি দিয়া―কেবল একটু দরকসাকসির পর তাহারা যাহা দেয় তাহাই হাসিমুখে গ্রহণ করিবার উপদেশ দিয়া―তিনি একটু তফাতে অবস্থান করিতে লাগিলেন। নিজের পরিবর্ত্তে তিনি তাঁহার শিষ্যগণকেই সকল কার্য্যের জন্য সাক্ষাৎভাবে দায়ী রাখাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন। ইহা যে কতখানি দূরদর্শিতার পরিচায়ক তাহা আমরা ভারত-ভাগ ও পাকিস্তান স্থাপনের কালে দেখিয়াছি। কংগ্রেসের শেষ-নির্ব্বাচন উপলক্ষ্যেও দেখা গিয়াছিল —জাতীয়তাবাদী মুসলমানকে কংগ্রেস যেন আর আমোল দিতে চায় না; জিন্নার সহিত মিটমাট করিয়া তবে তো ঐ স্বাধীনতা ব্রিটিশের অনুগ্রহে লাভ করা যাইবে। সুভাষচন্দ্রও তাহা বুঝিয়াছিলেন। ইহার অর্থ, কংগ্রেস অতঃপর ব্রিটিশের নিকটে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করিল। ইহারই নাম ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাস্ত করিয়া গান্ধীবাদ ও গান্ধীধর্ম্মের জোরে স্বাধীনতা আদায়। কংগ্রেস অতঃপর সেই আশায় ছিপ ফেলিয়া বসিয়া রহিল।

 এমনই করিয়া গান্ধীর আদি অভিপ্রায় ও কর্ম্মনীতি ব্যর্থ হইল, অথবা সফল হইল বলাও যায়; কারণ, ইংরেজ যে কারণেই হোক, যখন ভারতকে স্বাধীনতা দান করিল তখন তাহা যে হৃদয় পরিবর্ত্তনের ফলে, তাহাতে সন্দেহ কি? অপর দিকে ইহাও সত্য যে, ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতকে ঐ স্বাধীনতা কখনই দিত না, যদি তাহারা না বুঝিত যে, ভারতের জনগণের সহিত উহার কোন সম্পর্ক নাই―মাত্র কয়েক জন ব্যক্তিকে উপযুক্ত মনে করিয়া তাহাদের হস্তেই তাহারা কর্তৃত্বভার অর্পণ করিতেছে। ভারতের জনশক্তি যে রাজনৈতিক অধিকার-চেতনায় কতখানি উদ্বুদ্ধ―ভারত যে কেমন একজাতিতে পরিণত হইয়াছে তাহা ব্রিটিশ শাসকবর্গের মত আর কে জানে? গান্ধী এই জনগণকে রাজনীতি হইতে সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক রাথিয়া তাহাদিগকে যে মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছেন তাহাতে ব্রিটিশের মহোপকার সাধন হইয়াছে। ঐ স্বাধীনতাদানের দ্বারা ভারতের শাসন নীতি যে কিছুমাত্র পরিবর্ত্তিত হইবে না, ইহার মত নির্ভাবনার বিষয় কি হইতে পারে? তারপর, যুদ্ধোত্তর ভারতের যে অবস্থা অনিবার্য্য, এবং সেই অবস্থায় ঐ কংগ্রেসী নেতাগণের আধিপত্য, এবং তাহার ফলে শাসন-বিভ্রাট যে কিরূপ হইবে, তাহা বুঝিয়া তাহারা আরও নিশ্চিন্ত হইল। কেবল তাহাদের শাসন-নীতিই নয়, তাহাদেরই সেই সৈন্য ও পুলিশ এবং সেই শাসনবিভাগই ভারত রাজ্যে কায়েম হইয়া থাকিবে, ইহাও তাহারা জানিত। তারপর পাকিস্তান রহিল; তারও পরে জগৎব্যাপী অব্যবস্থা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে এতবড় একটা দেশরক্ষার উপযােগী কোন শক্তিই উহার নাই,―ব্রিটিশ এ সকলই উত্তমরূপে বিবেচনা করিয়া ঐ স্বাধীনতাদানের সংকল্প করিয়াছিল। কিন্তু এসকলও বড় কথা নয়, আসল কথা, ভারতের জন-সাধারণ স্বাধীন হইবে না―গান্ধী তাহাদিগকে বশীভূত ও সম্মোহিত করিয়া কয়েকজন নেতার হস্তে সমর্পণ করিয়া রাখিয়াছেন; ঐ কংগ্রেস জনসাধারণের প্রতিনিধি নয়―গান্ধীই কংগ্রেস; অতএব বিপদের কোন আশঙ্কাই নাই। এইদিক দিয়া দেখিলে গান্ধীনীতিই জয়ী হইয়াছে―তাঁহারই বন্ধুত্বের পুরস্কার-স্বরূপ ব্রিটিশ ভারতকে ঐ স্বাধীনতা দান করিয়াছে। কিন্তু তখনও তিনি এতখানি আশা করেন নাই―তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আসন্ন হয় নাই। তাই ব্রিটিশের হস্তে নিদারুণ পরাজয় লাভ করিয়া গান্ধী কংগ্রেস-পরিচালনার ভার মুখ্যতঃ শিষ্যগণের হাতে ছাড়িয়া দিয়া অপর একটি সাধনায় মন দিলেন―তিনি পৃথিবীতে এক নবধর্ম্ম-স্থাপনে উদ্যোগী হইলেন। সুভাষচন্দ্র লিখিয়াছেন, তিনি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে গৌণ করিয়া এই অপরটির প্রতি অধিকতর মনোযোগী হইয়াছিলেন, গুরুতর সমস্ত মীমাংসার চিন্তা না করিয়া সভার বাহিরে বিরাট জনমণ্ডলীকে ধর্ম্মোপদেশ-দান সুরু করিয়াছিলেন; গোল-টেবিলে যখন তিনি ভারতভাগ্যের একটা সংকট-নিবারণে ব্যাপৃত ছিলেন, তখনও তিনি (ভারতীয় রাজনৈতিক সমস্যার আলোচনা না করিয়া) বিলাতের বন্ধুবৈঠকে তাঁহার ধর্ম্মমন্ত্র ব্যাখ্যা করিতেন―সেই ধর্ম্মপ্রচারই তাঁহার অধিকতর প্রিয় ছিল―

 “During his stay in England...... he conducted himself not as a political leader who had come to negotiate with the enemy, but as a master who had come to preach a new faith―that of non-violence and world peace” (P. 317).

 পরে ফ্রান্সে ও সুইজারল্যাণ্ডেও তিনি তাহাই করিয়াছিলেন―তিনি ভারতের স্বাধীনতা-লাভের উপায় সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন না, জগতে একটা নবধর্ম্ম প্রচার করিয়া জগদগুরু হইবার বাসনা প্রকাশ করিতেন। ইহার কারণ, ঐ কংগ্রেণী-সংগ্রামে অবসন্ন হইবার বেশ কিছুদিন আগে হইতেই গান্ধী একটি বিষয়ে নিঃসংশয় হইয়া উঠিতেছিলেন―ভারতের জনগণ তাঁহার রাজনৈতিক কার্য্যকলাপকে আর তেমন মূল্যবান মনে করে না―তাহারা তাঁহাকে ইহ-পরকালের পরিত্রাতা অবতার-কল্প ধর্ম্মগুরুরূপেই পূজা করিতেছে। দীর্ঘ দশ বৎসর তিনি যে কংগ্রেস-তরণীর পরিচালনা করিয়াছিলেন―ইহাই সেই নেতৃত্বের সর্ব্বোত্তম পুরস্কার। সমুদ্রতরণে তরণীর কর্ণধার হইয়া তিনি কিছুই করিতে পারিলেন না, শেষে সেই তরণী বানচাল হইয়া ডুবিয়া গেল। কিন্তু কর্ণধার ডুবিলেন না; পরন্তু সেই জলতল হইতে একটি মহাৰ্ঘ মুক্তা কুড়াইয়া পাইলেন―ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর সেই গুরুপদ। তখন সেই মুক্তাটি হইল তাঁহার রাজ-সম্পদ্, তাহা দিয়া তিনি আর এক রাজ্যের রাজপদ অধিকার করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন; ভারতের স্বাধীনতা, ব্রিটিশের সহিত বন্ধুত্বের দাবা-খেলা বা ভারতবাসীর আশু দুঃখ দুর্দ্দশামোচন―এসকল অপেক্ষা একটি মহত্তর সংকল্প তাঁহার চিত্ত অধিকার করিল, তিনি এক নূতন ধর্ম্ম প্রচার করিয়া জগৎগুরু হইবেন। সেইরূপ ধর্ম্মগুরু হইবার পক্ষে ঐ ভারতবাসী জনগণই তাঁহার সহায় হইবে; অহিংসা যে কতবড় ধর্ম্ম এবং তাহা মানুষের পক্ষে কিরূপ সহজসাধ্য―আত্মত্যাগের সেই মহাশক্তি ঐ ধর্ম্মে কিরূপ বিকাশ লাভ করে―তাহাই প্রমাণ করিবার জন্য তিনি তাঁহার সেই ভারতব্যাপী শিষ্যসমাজকে―সেই বিশাল গড্ডলিকাকে―দলে দলে আত্মপ্রাণ উৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিলেন। সুবিধাও হইল, ভারতের আর এক বৃহৎ সম্প্রদায় ঐ অহিংসার বিপরীত মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হইয়া দিকে দিকে রক্তস্রোত বহাইতে লাগিল―কাজেই অহিংসার নামে প্রাণদান করা সকলের পক্ষে দুঃসাধ্য হইল না। যাহারা বলির পশুর মত দলে দলে হত হইতে লাগিল, তাহার নিতান্তই দুর্ব্বল ও অসহায়; যাহারা শক্তিমান্ ও নির্ভীক তাহারা হিংসার পাপে লিপ্ত হইবার ভয়ে সেই শত শত অসহায়, প্রাণভয়ে ভীত নর-নারীকে বাঁচাইতে চাহিল না, বরং মরিতে ভয় পাওয়ার জন্য তাহাদিগকে ভীরু কাপুরুষ বলিয়া গালি দিল। তথাপি, ভারতে ঐ আর এক বিরুদ্ধবাদী সমাজ ছিল বলিয়াই গান্ধীর অহিংসাধর্ম্মের জৌলুস বৃদ্ধি পাইয়াছিল; সকল সমাজই যদি হিন্দু সমাজের মত এমন আধ্যাত্মিক, নিরীহ ও সন্ন্যাসী-ভক্ত হইত, তবে হিংসার রক্ত-সাগরে অহিংসার এমন শ্বেতপদ্ম ফুটিত না―ফুটিবার এমন সুযোগই পাইত না। অতএব, রাজনীতির ক্ষেত্রে ইংরেজের সঙ্গে সন্ধিস্থাপনের আশায় নিরাশ হইয়া গান্ধী তাঁহার সেই আদি অভিপ্রায় একরূপ বর্জ্জন করিলেন। ইহার পর জনগণের একমাত্র কাজ হইল―কোন ফল হউক বা না হউক―ঐ নবধর্ম্মকে সগর্ব্বে ঘোষণা করিবার জন্য কারাবরণ বা মৃত্যুবরণের সুযোগ অন্বেষণ করা। এমনই করিয়া গান্ধী প্রথমে ভারত-গুরু হইয়া পরে জগদগুরু হইবার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত করিলেন। ইহার জন্য তখন হইতে আজ পর্য্যন্ত জগৎময় প্রোপাগাণ্ডা চলিতেছে, এখনও―ভারতের এই অবস্থার পরেও―এই ভারতের দৃষ্টান্তেই ঐ অহিংসা যে মানবসমাজের পক্ষে কত কল্যাণকর তাহা বড় বড় কণ্ঠ ও যন্ত্রযোগে দিগৃদিগন্তে ঘোষিত হইতেছে! ঐ অহিংসার পুণ্যফলে ভারত স্বৰ্গলাভ করিয়াছে―জনসাধারণের বৈকুণ্ঠবাস হইয়াছে, তাহারা স্বাধীন হইয়াছে, ভারতে অখণ্ড শান্তি বিরাজ করিতেছে; অতএব হে জগৎবাসী, তোমরা আশ্বস্ত হও―ঐ অহিংসামন্ত্রে দীক্ষিত হইলে, গান্ধী-গুরুর শরণ লইলে, তোমরাও অচিরে বৈকুণ্ঠধামে বাস করিতে পারিবে।

 সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ হইতে আমি গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেসের এই যে পরিচয় সংকলন করিয়াছি তাহা সম্পূর্ণ নহে, কারণ, তাঁহার গ্রন্থ ইং ১৩৩৪ সালের পরে আর অগ্রসর হইতে পারে নাই। কাজেই আমিই তাহার একটা উপসংহার যোজনা করিয়াছি। কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি যে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গিকেই অনুসরণ করিয়াছে, তাহা ঐ গ্রন্থ পাঠ করিলে সকলেই স্বীকার করিবেন। এইবার আমি সেই উপসংহারটি আর একটু সবিশেষ লিপিবদ্ধ করিব। ঐ ১৩৩৪ সালের পর ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট গান্ধী কংগ্রেসের ঝুঁটি ধরিয়া তাহাকে একটার পর একটা খুঁটিতে বাঁধিয়া তাহাদেরই প্রস্তুত জাবনা খাইতে বাধ্য করিয়াছে,―তাহাদের শাসন-নীতি ও শাসন-ব্যবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন করে নাই। কংগ্রেস তাহাই হজম করিয়া―ব্রিটিশের সেই আবরণহীন ছলনাকেও তাহার সুবুদ্ধির নিদর্শন ও নিজেদের ক্রমিক জয়লাভ বলিয়া, জনগণের নিকটে ইজ্জত রক্ষা করিয়াছে; গোলটেবিল-বৈঠকের পর যে নূতন ভারত-শাসনতন্ত্র প্রবর্ত্তিত হইল, তাহাকে সাগ্রহে বরণ করিতে গান্ধী-কংগ্রেস কিছুমাত্র লজ্জিত হয় নাই। কিন্তু জনমত বলিতে তখন আর কিছুই ছিল না―ত্রিশকোটি প্রজার মত একজনের মতে লয় হইয়া গিয়াছে; সেই একজন তাঁহার কর্তৃত্ব যে কয়জন পার্ষদকে বাঁটিয়া দিয়াছেন তাহারাই জনগণের প্রতিনিধি; তাহাদের কার্য্যকলাপকে ভারতবাসীর কার্য্যকলাপ বলিয়া অভিহিত না করিলে―‘heretic’ বা বিধর্ম্মী হইতে হয়। এখনও সেই কর্তৃত্বের নাম—খাঁটি ডিমোক্রেসী! জনগণের কোন কথা কহিবার ইচ্ছা বা অধিকার ছিল না―গান্ধীর সেই অ-ব্যাবহারিক, অহিতকর নীতির ফলেই যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহাই তখন ঘটিতে লাগিল; তখন তাহার প্রতিকার প্রার্থনা করিলে, অর্থাৎ তাঁহাকে পুনরায় সংগ্রামে অবতীর্ণ হইতে বলিলে, তিনি ব্রিটিশের সেই মূর্ত্তির পানে চাহিয়া বিমূঢ় হইয়া পড়িতেন,―কিছু করিতে না পারার কৈফিয়ৎ স্বরূপ তিনি দুই তিনটি কথার সাহায্য লইতেন, যথা―কংগ্রেসে পাপ ঢুকিয়াছে (অর্থাৎ সকলে চরকা-ধর্ম্ম পালন করিতেছে না); বাতাসে হিংসার বারুদ-গন্ধ পাইতেছি; আলোক দেখিতেছি না। এই আলোক-দর্শনের কথা সুভাষচন্দ্রও কয়েকবার উল্লেখ করিয়াছেন। ঐ আলোক বা অন্ধকারদর্শন, এবং ‘Voice of God’ বা ভগবানের প্রত্যাদেশ―উহাই জনগণের সকল বুদ্ধি ও বিচারশক্তিকে অনাবশ্যক করিয়া তুলিয়াছিল, সারাভারত রাজনৈতিক চেতনা-বর্জ্জিত হইয়া অহিংসা ও চরকার মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিল। উহাতে ব্রিটিশেরই জয়লাভ হইল; কারণ জনগণের পরিবর্ত্তে তাহারা কয়েকজন ব্যক্তিকে মাত্র হাতে পাইল―গান্ধীর সেই অনুচর কয়েকটিকে ইতিমধ্যে তাহারা উত্তমরূপে বাজাইয়া লইয়াছে―উহাদের প্রার্থনা পূর্ণ করা আদৌ অসম্ভব হইবে না; উহারা ব্রিটিশের অভিভাবকতায় ডোমিনিয়ন-ধরণের রাষ্ট্রিক অধিকার চায়। সেই অধিকার জনগণের নামেই বটে; কিন্তু কার্য্যতঃ তাহারা এবং তাহাদের অনুগ্রহভাজন কয়েকজন মিলিয়া ব্রিটিশের তাঁবেদারী করিয়া কিঞ্চিং প্রভূত্ব, প্রতিপত্তি ও সুখভোগের ভিখারী। মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক, তাহাদের অন্তরের সেই কামনা ব্রিটিশ রাজনীতি-ধুরন্ধরগণের চক্ষে জলের মত স্বচ্ছ হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপ যথন অবস্থা, তখন সহসা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইয়া গেল, এবং তাহার ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যই একটা বিষম ধাক্কায় উল্টাইয়া গেল। আমরা দেখিয়াছি, কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ বা অহিংসা-যুদ্ধ তাহার বহু পূর্ব্বেই ধোঁয়া হইয়া গিয়াছে―ব্রিটিশ রাজশক্তি তাহার মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। কেবল গান্ধীর প্রতি সেই অন্ধভক্তির বন্ধন কংগ্রেস তখনও একটা ভিন্ন আকারে জীয়াইয়া রাখিয়াছে; ঐ একটা দলই জনগণের নায়কতা বা প্রতিনিধিত্ব করিতেছে―সে প্রতিনিধিত্ব যেমনই হোক। রাজনীতির ঠাটটাই বজায় ছিল, ব্রিটিশের সঙ্গে কোন রকম রফার সুযোগ ঘটিলে ঐ কংগ্রেসই তখন জনগণের নামে তাহা করিতে পারিবে। ঐ যুদ্ধের সুযোগে গান্ধী-কংগ্রেস আর একবার যে রাজনৈতিক চাল চালিবার চেষ্টা করিয়াছিল, ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট তাহা তৎক্ষণাৎ বন্ধ করিয়া দিয়াছিল,―বরং তাহাদের সেই নির্ব্বুদ্ধিতার সুযোগে ভারতবাসীর উপরে যুদ্ধের যতকিছু দুর্ভোগ চাপাইবার সুবিধা পাইয়াছিল। আমি এ প্রসঙ্গে, মুস্লিম লীগের ইতিহাস, তাহার প্রচণ্ড বিরোধিতা―ব্রিটিশের কূটনীতির সেই মহা-সাফল্যের কথা আদৌ আলোচনা করিলাম না; কেবল ইহাই বলিলে যথেষ্ট হইবে যে, ঐ হিন্দু মুসলমান-সমস্যাকে বড় করিতে গিয়া শেষে তাহারই প্যাঁচে পড়িয়া গান্ধী-কংগ্রেস নাকালের একশেষ হইয়াছিল; গান্ধী-নীতি যে কতদূর ভ্রান্ত-নীতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে গান্ধী যে কিরূপ অদূরদর্শী তাহার এমন প্রমাণ আর নাই। সেখানেও গান্ধী ব্রিটিশের কৌশলে একটা বড় ফাঁদে পা দিয়া―শেষে নিরুপায় হইয়াই পাকিস্তানের বীজটিতে স্বহস্তে জলসেচন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন; অহিংসাধর্ম্ম ও ভারতের স্বাধীনতা, এই দুয়ের এমন সুন্দর সমম্বয় আর কিছুতেই হইত না। গান্ধী যে ব্রিটিশের চাপে বাধ্য হইয়া ভারতীয় মুসলমানকে পৃথক রাজনৈতিক অধিকার দিতে বহুপূর্বেই স্বীকৃত হইয়াছিলেন―তাহার প্রমাণ সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থে আছে (পৃঃ ৩০০)। অতএব ঐ পাকিস্তান এক জিন্নাসাহেবের কীর্ত্তি নহে; অহিংসা ও সত্যাগ্রহের সাধনায় গান্ধী আর কোন সিদ্ধিলাভ করিতে না পারিলেও ঐ একটা বড় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন; ভারত-ভাগের জন্য পরে যতই মৌখিক শোক প্রকাশ করুন না কেন, উহা তাঁহারই ধর্ম্ম ও কর্ম্মনীতির অবশ্যম্ভাবী ফল―ভারতের মুসলমান সেজন্য তাঁহার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। কিন্তু সেজন্য গান্ধীর বিশেষ দুঃখ হইবার কথা নয়,―তিনি তখন অহিংসার একটা বড় সাধনায় রত ছিলেন। ভারতের মুসলমানদিগের দাবী সম্পূর্ণ মানিয়া লইলে, সেই অহিংসারই গৌরব বৃদ্ধি হয়, তাহাতে চিরদিনের সেই ভারতবর্ষ―জগদ্বন্দিত সেই পুণ্যভূমি দ্বিখণ্ডিত হইয়া দুই দেশে পরিণত হইলেও ক্ষতি কি? তিনি তো ভারতের মঙ্গলকেই একমাত্র কাম্য মনে করেন না; ঐ অহিংসা-ধর্ম্মের গৌরব বৃদ্ধি করিতে হইবে―নহিলে সারা পৃথিবীর মঙ্গল হইবে কিরূপে? তিনিই বা জগদ্গুরু হইবেন কেমন করিয়া? সুভাষচন্দ্রও গান্ধীর এই মনোগত অভিপ্রায়কে ভারতের পক্ষে মারাত্মক বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন (পৃঃ ৫০৯)।

 কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ব্রিটিশ আপনার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যরক্ষার অন্য উপায় না দেখিয়া তাহাদের অসাধারণ কূটনীতি প্রয়োগ করিল;―সেই অবস্থায় ভারত-সাম্রাজ্য যতদিন অধিকারে রাখা যায় অথচ অধিকার-ত্যাগের বাহ্যিক যতকিছু লক্ষণ তাহাও নিঃসংশয় হইয়া উঠে―এমনই একটা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করিল; ভারতকে স্বাধীনতা-দানের ছলে সম্মুখ হইতে সরিয়া পশ্চাতে আরও দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হইবার জন্য, ঐ গান্ধী-কংগ্রেসকে, অর্থাৎ গান্ধীগঠিত ক্ষুদ্র দলটিকে ডাকিয়া, তাহাদিগকে কতক গুলি মারাত্মক সর্ত্তে স্বাধীনতা-দান করিতে চাহিল। ব্রিটিশ জনিত, তাহাতেই কার্য্যসিদ্ধি হইবে―গান্ধী-কংগ্রেসকে তাহারা বহুবার বাজাইয়া দেখিয়াছে। তথন সেই কংগ্রেস-চক্রবর্ত্তীগণ গান্ধীর আশীর্ব্বাদ লইয়া ব্রিটিশের প্রায় সর্ব্বস্বার্থসংরক্ষণমূলক এক অপূর্ব্ব দানপত্রে স্বাক্ষর করিল। ঐ ষে স্বাক্ষর, তাহা ভারতবাসী জনগণের স্বাক্ষর নহে―ঐ স্বাক্ষর করিবার পূর্ব্বে, তাহারা, নিয়মরক্ষার জন্যও, কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন করিয়া জনগণের প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করে নাই; কেন করে নাই তাহা গান্ধী ও তাঁহার অনুচরগণ নিশ্চয় জানিতেন। এইরূপে তাহারা ভারতের ভাগ্য নিজেদের অভিপ্রায়-মত স্বল্পতম মুনাফায় বিক্রয় করিয়া দিল―সেই বৈশ্যনীতিই জয়ী হইল। সেই মুনাফা―ভারতীয় নেতাগণের পক্ষে―বিশেষ করিয়া ধনিক ব্যবসায়ীদের পক্ষে (Capitalists)―ইন্দ্রত্বলাভের মত। ভারত ইহার প্রতিবাদ করিতে পারিল না,―করিবে কে? হরিজন, চরকা ও প্রার্থনা-সভা―এই তিনের দ্বারা গান্ধী জনগণের সকল ভাবনা হরণ করিয়াছিলেন,―ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনা তাহারা গান্ধীর হাতে ছাড়িয়া দিয়া পরম শান্তির নিঃশ্বাস ফেলিতেছে। তাই ব্রিটিশের বড় সুবিধা হইল; জাগ্রত জনমতকেই তাহারা ভয় করে; যখন কোন এক-জাতি স্বাধীনতা-লাভের জন্য জাতিগতভাবে শক্তি ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে তখনই সমুহ বিপদ; কিন্তু এখানে জাতিগত চেষ্টা বা জনমত বলিয়া কিছুই নাই―সবই একজনের চিন্তা, বহুকে সে চিন্তা করিতেই দেয় নাই; প্রজাতন্ত্র বা ডিমোক্রেসির গন্ধমাত্র তাহাতে নাই; স্বাধীনতার প্রাণময় কামনাও নির্ব্বাপিত হইয়াছে। অতএব প্রজাশক্তিকে সম্পূর্ণ দমন করিয়া, তাহাদের রাজনৈতিক চেতনা পর্য্যন্ত লুপ্ত করিয়া যাহারা সেই প্রজাগণকে এমন বশীভুত করিয়াছে, তাহাদের স্বাধীন-শাসনতন্ত্র যে কি বস্তু, তাহার শক্তি কিরূপ শক্তি―সে রাষ্ট্র যে শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া পড়িবে, এবং ভাঙ্গিয়া পড়ার ভয়ে তাহার যে ঐ ব্রিটিশের জানুই আরও বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে বাধ্য হইবে, এবং তদ্বারা সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নীতিই জয়যুক্ত হইবে―সে বিষয়ে তাহারা নিঃসংশয় হইল। তাহাই হইয়াছে। ব্রিটিশ বোধ হয় ইহাও তখন দিব্যচক্ষে দেখিতে পাইয়াছিল যে, ঐ ভারত-বিভাগের ফলে, ভারতে যুদ্ধোত্তর অবস্থার সঙ্কট দারুণতর হইয়া উঠিবে; সেই অরাজক অবস্থায় ভারতের প্রজাগণ ঐ কংগ্রেসের প্রতিই ঘোরতর বিম্বিষ্ট হইয়া উঠিবে। কিন্তু গান্ধী ও তাঁহার কংগ্রেস ইহার জন্য কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন হয় নাই―ব্রিটিশের হাত হইতে ঐ নায়েবীটা পাইবার জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছিল। পরে যখন সেই সর্ত্তগুলি মানিয়া লইয়া কংগ্রেস স্বাধীনতা লাভ করিল, তখন গান্ধীর মুখে হাসি আর ধরে না,―তিনি ব্রিটিশকে দুইবাহু তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন, এবং ভারতবাসীকে কৃতার্থ হইয়া ভগবানের (তাঁহার সেই অহিংসার ভগবান) নিকটে কৃতাঞ্জলিপুটে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতে বলিলেন।

 ইহাই পরবর্ত্তী ইতিহাস, সুভাষচন্দ্র ইহাই আশঙ্কা করিয়াছিলেন; ক্যাবিনেট-মিশনের সেই দানপত্র তিনি দেখিয়া যান নাই―তখন ওয়াভেল-প্রস্তাব লইয়া কংগ্রেসী নেতৃবর্গ দর-কসাকসি করিতেছিল। তাহাতেই তিনি ভয়ার্ত্ত হইয়া রেডিও-যোগে ভারতবাসীকে যে কাতর আবেদন ও সাবধান-বাণী পাঠাইতেছিলেন, তাহার কিছু আমি অন্যত্র উদ্ধৃত করিয়াছি।

* * *

 সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ হইতে আমরা গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেসের এই যে পরিচয় উদ্ধার করিলাম, ইহাই বাহিরের ইতিহাস বটে, কিন্তু ভিতরে দৃষ্টিপাত করিলে একটা গভীরতর সত্যের আভাস মিলিবে। ঐ ইতিহাস একজন ব্যক্তির ইতিহাস, উহা আসলে ভারতের জনগণের বা বহুব্যক্তির মিলিত প্রচেষ্টার কাহিনী নয়। ঐ একজন ব্যক্তি তাঁহার একটি অতিশয় ব্যক্তিগত ও নিজস্ব সত্য-ধারণা বা ধর্ম্মমতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন। তজ্জন্য তিনি সেইকালের ঐ রাজনৈতিক আন্দোলন এবং কংগ্রেসনামক পুর্ব্বগঠিত প্রতিষ্ঠানটিকে আশ্রয় করিয়াছিলেন। যে সমস্যা আদৌ ভারতের সমস্যা, যে বিশেষ সংকট হইতে ভারতবাসীকে উদ্ধার করিবার চেষ্টায় নানা বিফল প্রয়াস এবং নূতনতর উপায়-চিন্তা সেইকালের দেশপ্রেমিক ও জাতির কল্যাণকামী ব্যক্তিগণকে ব্যাকুল ও বিভ্রান্ত করিয়াছিল, গান্ধী প্রথম হইতেই তাহাকে অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপ্রচারকের যে অন্ধ-প্রত্যয় ও সংকল্পের একাগ্রতা থাকে, তাহারই বশে তিনি স্বকীয় অভিপ্রায়সিদ্ধির জন্য আর কাহাকেও শক্তিসঞ্চয় বা স্বাধীন পন্থা অবলম্বন করিতে দেন নাই; এইজন্য তিনি কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা চারিত্রিক নির্ম্মলতা, ধৈর্য্য বা বুদ্ধিমত্তার আদর করেন নাই,―সেই সংকল্পসিদ্ধির জন্য, তিনি জনগণের উত্তরোত্তর দুর্দশাবৃদ্ধিও যেমন অবিচলিত চিত্তে দর্শন করিয়াছেন, তেমনই যে তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করে নাই, তাহার প্রাণ যতই উচ্চ হউক, তাহার ত্যাগ ও সত্যনিষ্ঠা যতই অপূর্ব্ব হউক―তিনি তাহাকে কিছুমাত্র স্নেহ করেন নাই; ববং যাঁহারা সেই সকলের তুলনায় সর্ব্বাংশে নিকৃষ্ট, কিন্তু তাঁহার উদ্দেশ্য-সাধনের সহায়―তিনি তাহাদিগকেই অনুগৃহীত ও সম্বর্দ্ধিত করিয়াছিলেন। ইহাই স্বাভাবিক, কারণ, তিনি যাহা চান, তাহা ভারতবাসীর পক্ষে এই যুগে এবং ঐ অবস্থায় কোন হৃদয়বান, বুদ্ধিমান ও বীর্য্যবান দেশপ্রেমিকের কাম্য হইতে পারে না। অথচ তিনি তাহাদের সকলকেই বিপথগামী ও বিধর্ম্মচারী বলিয়া মনে করিতেন; ইহার কারণ, তাঁহার সেই নব-ধর্ম্মমন্ত্র;―মানুষ যত নিঃস্বার্থ, হৃদয়বান ও মৃত্যুভয়হীন হোক না কেন, যদি তাহার আচরণে ‘হিংসা’ থাকে, তবে তাহার সকল মহত্ত্বই বৃথা। এইজন্য দেখা যায়, গান্ধীর একটা বড় সমস্যা ছিল, ঐ কংগ্রেসকে আপন ব্যক্তিত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ গ্রাস করিয়া তাহাকে নিজের সেই সংকল্পসিদ্ধির একটা যন্ত্ররূপে ব্যবহার করা; এইজন্যই, ত্রিশকোটি ভারতবাসীর মধ্যে জ্ঞানে, বিদ্যায়, চরিত্রে ও বুদ্ধিতে যে-কেহ তাঁহার প্রতিদ্বন্দী, তাহাকেই পরাস্ত করিবার জন্য, তিনি অশিক্ষিত, অজ্ঞানী, ভক্তিপ্রবণ সরল জনগণকে এক বিপুল বাহিনীতে পরিণত করিয়াছিলেন। এই কার্য্যে তিনি আশ্চর্য্যরূপ সাফল্যলাভ করিয়াছিলেন―উহাই তাঁহার কর্ম্মকুশলতা ও সাধন-বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। একদিকে তিনি জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-শক্তিকে অবজ্ঞাত করিতে পারিয়াছিলেন, অপর দিকে ঐ অন্ধভক্তিকে সংঘবদ্ধ করিয়া একটা প্রবল শক্তির অধিকারী হইয়াছিলেন। প্রথম দিকে ঐ কংগ্রেসের নানা দল লইয়া তাঁহাকে কিছু বেগ পাইতে হইয়াছিল, পরে ক্রমে ক্রমে পুরাতন নেতাগণের মৃত্যু হওয়ায়, তিনিই একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন; উদীয়মান নবীন বিদ্রোহীদিগকে তিনি অতিশয় ধীরবুদ্ধি ও বিচক্ষণতার সহিত নিরস্ত করিয়াছিলেন, সুহৃদ্-ভেদ-নীতি ও নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা―এই দুইয়ের সাহায্যে সেই সংকট উত্তীর্ণ হইতে পারিয়াছিলেন, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। গান্ধী তাঁহার সেই নবধর্ম্ম-প্রচারের ঐকাস্তিক কামনায় আর কোন মানুষের মহত্ত্ব বা মহাপ্রাণতা-দর্শনে কিছুমাত্র বিচলিত হইতেন না―তাঁহার চক্ষে ঐ এক উদ্দেশ্যসাধনের উপযোগিতা ছাড়া কাহারও কোন মূল্য ছিল না। এইজন্য তিনি যতীন দাসের সেই অপূর্ব্ব আত্মোৎসর্গকে তুচ্ছ করিয়াছিলেন; এইজন্যই সুভাষচন্দ্রের উপরে সীতারামাইয়াকে স্থান দিয়াছিলেন। এইজন্যই তিনি তাঁহার সেই ধর্ম্মস্থাপনের পক্ষে কোন বাধাই মানিতেন না―ভারতব্যাপী হাহাকার, লক্ষ জীবননাশকেও তিনি গ্রাহ্য করেন নাই; এই সকলই সেই এক কারণে―তাঁহার সেই ধর্ম্মপ্রচারের জলন্ত উৎসাহ।

 সেই ধর্ম্মস্থাপনের জন্যই তিনি রাজনীতির ভেক ধারণ করিয়াছিলেন―কংগ্রেসনামক সংঘটিকে ঐ রাজনীতির দোহাই দিয়া, তিনি প্রথমে করায়ত্ত করিয়াছিলেন, পরে তাহাকেই তাঁহার ধর্ম্মচক্রে পরিণত করিয়াছিলেন। ঐ ধর্ম্মে দেশ নাই, জাতি নাই, উহাতে কোন রাজনৈতিক জয়লাভের আবশ্যকতা নাই। তথাপি দেশে সেই রাজনৈতিক বিক্ষোভের কালে তিনি জনগণকে বাধ্য এবং তদানীন্তন নেতৃগণের বিরুদ্ধতা নিবারণ করিবার জন্য, ব্রিটিশ রাজশক্তির সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন―সেই সংগ্রাম কেমন তাহা আমরা দেখিয়াছি। তথাপি প্রথম দশবৎসর তিনি ঐরূপ সংগ্রামের সুফল প্রত্যাশা করিয়াছিলেন, এবং সেই নীতিও ত্যাগ করেন নাই। কিন্তু শেষে যখন বুঝিতে পারিলেন, ঐ সংগ্রাম বৃথা―ব্রিটিশ তাঁহার সদভিসন্ধি বুঝিল না; এবং যখন দেখিলেন, আর একদিকে তাঁহার সিদ্ধিলাভ হইয়াছে, অর্থাৎ জনগণ তাঁহাকে মহাত্মারূপে বরণ করিয়াছে―রাজনীতি অপেক্ষা ধর্ম্মনীতিই তাহদের প্রাণ-মন হরণ করিয়াছে, তখন তিনি তাঁহার হৃদিস্থিত হৃষিকেশকে, সেই Voice of God-কেই একান্ত করিয়া আশ্রয় করিলেন। ব্রিটিশের সহিত যুদ্ধ নয়, ভারতবাসী জনগণেরই উদ্ধারসাধন নয়,―পৃথিবীতে এক নবধর্ম্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাই তাঁহার ভগবৎ-নির্দিষ্ট কর্ম্ম হইয়া দাঁড়াইল। তাঁহার দৃষ্টি ভারতের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া পৃথিবীর চতুষ্প্রান্তে প্রসারিত হইল―তিনি ভারতবাসীর সেই রাজনৈতিক সংকট, দারুণ দারিদ্র্য ও দুর্গতি প্রভৃতির প্রতিকার-চিন্তাকে এমন একটি আধ্যাত্মিক উচ্চ আদর্শে মণ্ডিত করিয়া লইলেন (এই আদর্শ পূর্ব্ব হইতেই ছিল) ষে, অতঃপর যাহা কিছু করিতে লাগিলেন, তাহাতে আশু দুৰ্গতি-নিবারণের কোন সম্ভাবনাই রহিল না, বরং শেষে সেই দুৰ্গতি অতি ভীষণ আকার ধারণ করিল; কিন্তু তাহাতেই তাঁহার ধর্ম্মমন্ত্রের গৌরব বৃদ্ধি পাইল―তাহা এক সার্ব্বভৌমিক মানব-প্রেমের দাবিতে ভারতকে ছাড়াইয়া বিশ্বের শুশ্রূষা ও শ্রদ্ধার ষোগ্য হইতে চাহিল। ভারতকে ছাড়াইয়াই তাহা হইবে―কারণ, গান্ধী ইহা নিশ্চয়ই চিন্তা করিয়াছিলেন, তাঁহার ঐ ধর্ম্ম এই অধঃপতিত, দুর্ব্বল, নির্জ্জীব ভারত পালন করিতে পরিবে না; ইহা তিনি বারবার দুঃখের সহিত স্বীকার করিয়াছিলেন; অহিংসার পরিবর্তে হিংসার বাস্পে তাঁহার শ্বাসরোধ হইত, তাঁহার কংগ্রেসেও পাপ প্রবেশ করিয়াছে, তাহা তিনি স্বীকার করিয়াছিলেন, তাই তিনি প্রায় আলোকের পরিবর্ত্তে অন্ধকার দেখিতেন। ইহার কারণ কি, তাহা ভাবিবার প্রয়োজন তিনি বোধ করেন নাই; তবু তিনি যে এত শীঘ্র ভারতের জনগণের গুরু হইতে পারিয়াছিলেন কেন, তাহা হয়তো শেষে বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এক অতিশয় দুর্ব্বল, ক্ষীণপ্রাণ, অত্যাচার-অবিচারে অসাড়, ধর্ম্মনিহত জাতি পরিত্রাণের আশায় নিরাশ হইয়া তাঁহার মত ত্যাগী সন্ন্যাসীর সেই নেতৃত্বে বড়ই আশাম্বিত হইয়াছিল,―রাজনীতিকেই ধর্ম্মনীতির দ্বারা সুদৃঢ় ও শাণিত করিয়া তিনি তাহাদের বন্ধনদশার দুর্গতি ঘুচাইবেন, এই বিশ্বাসেই তাহারা তাঁহাকে উন্মাদের মত অনুসরণ করিয়াছিল; নহিলে তাঁহার ঐ নেতৃত্ব এমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠিত না। কিন্তু শীঘ্রই সেই আশা ও উৎসাহ নিবিয়া যাইতে লাগিল, এবং তাহার স্থলে তাঁহারই গূঢ়-গভীর অভিপ্রায়ের ফলে, সেই জনগণ এমন এক তন্ত্রে যেন তাহাদের অজ্ঞাতসারে ভাবান্তরিত হইল যে, সেই সাক্ষাৎ জীবনরক্ষার পিপাসা আর রহিল না। যে মৃত্যুবিযে তাহারা এতকাল জর্জ্জরিত হইয়া স্বপ্নঘোরে আচ্ছন্ন ছিল―সেই বিষই এক নবধর্ম্মের উন্মাদনরূপে পুনরায় তাহাদিগকে আক্রমণ করিল;―এজাতির পক্ষে, এই অবস্থায় এতবড় বিষ আর নাই। গান্ধীর ঐ অহিংসাধর্ম্ম হিন্দুর ধর্ম্ম―সেই সনাতন ভারতীয় ধর্ম্ম নয়; উহা জৈন-বৌদ্ধ-ধর্ম্মেরই একটা নবসংস্করণ; উহাই ভারতের হিন্দুসমাজকে অতিশয় প্রচ্ছন্নভাবে অভিভূত করিয়া এ জাতির আত্মাকে দূর্ব্বল করিয়াছিল। গান্ধীর ঐ ধর্ম্ম রোমক সাম্রাজ্যে খ্রীষ্টধর্ম্মের মত―আধুনিক যুরোপ-আমেরিকার পৈশাচিক মদমত্ততা প্রশমিত করিতে পারে, কিন্তু উহা আধুনিক ভারতের পক্ষে প্রাণঘাতী। আধুনিক ভারতের, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মবীর ও চিন্তাবীর বিবেকানন্দ―যাঁহার মত বৈদান্তিক কর্ম্মযোগী একালে ভারতে আবিভূত হয় নাই―তিনিও এই কথা বারবার দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছিলেন। কিন্তু গান্ধী তো, ভারতের জন্য নয়―জগতের জন্য ঐ ধর্ম্মপ্রচার করিবেন; অতএব, ভারত যদি ঐ ধর্ম্মের ইন্ধন হইয়া তাহার শিখাকে আকাশস্পর্শী করিতে পারে, তবে নিজে ভস্মীভূত হইয়া জগৎ আলোকিত করিবে; গান্ধী তাঁহার ধর্ম্মের পরীক্ষাগাররূপে এই ভারতকে বড় সুবিধাজনক মনে করিয়া থাকিবেন; তাই শেষ পর্য্যন্ত ভারতের চূড়ান্ত দুর্দশা দেখিয়াও তিনি কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন বা হতাশ হন নাই। তাঁহার ঐ কর্ম্মনীতি ও ঐ ধর্ম্মে ভারতের সর্ব্বপ্রকার ক্ষতি ও চরম দুৰ্গতি হউক, ঐ কংগ্রেস যতই দুর্নীতিতে ভরিয়া উঠুক, এবং শেষে স্বাধীনতার নামে যে বস্তুই লাভ হউক―সব দেখিয়াও তিনি চক্ষু মুদ্রিত করিয়াছিলেন; হিন্দুভারতের কথা ছাড়িয়াই দিলাম। অতএব, গান্ধীকে বুঝিতে হইলে, তাঁহার কার্য্যকলাপের যথার্থ সমালোচনা করিতে হইলে―আমি ঐ যে তত্ত্বটির কথা বলিয়াছি, উহা বিশেষ ভাবে অবধারণ করিতে হইবে, নতুবা গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্বন্ধে ভুল ধারণা ঘুচিবে না।

 সর্ব্বশেষে―গান্ধীও নয়, গান্ধী-কংগ্রেসও নয়―ভারতবাসীর পক্ষ হইতে কেবল তিনটি প্রশ্ন করিয়া আমি এই দীর্ঘ কাহিনী শেষ করিব। প্রথম, ঐ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী কে? দ্বিতীয়, এই যে লক্ষ লক্ষ নর-নারী নিহত হইয়াছে―গৃহ-সংসার হইতে উৎপাটিত হইয়া দিকে দিকে হন্য পশুর মত বিচরণ করিতেছে, ইহার জন্য দায়ী কে? তৃতীয়, ত্রিশকোটী ভারতবাসীর ভাগ্যবিধাতা হইয়াছে যে কয়জন ব্যক্তি,―সেই ব্রিটিশেরই পৃষ্ঠরক্ষিত হইয়া তাহারা আজ স্বৈরাচারী হইয়া উঠিয়াছে― জনগণের দুর্দ্দশার সীমা নাই, ফলে ভারত একটা বিরাট অপঘাতের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে, ইহার জন্য দায়ী কে? আমার এই কাহিনী হইতে যদি তাহার উত্তর না মেলে, তবে বুঝিব, ভারতের মোহনিদ্রা কখনও ঘুচিবে না, উহাই মহানিদ্রায় পরিণত হইবে।

 [সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ “The Indian Struggle” হইতে আমি এই যে তথ্য ও তত্ত্ব সংকলন করিলাম, ইহার অন্তরালে আমার কোন কুঅভিসন্ধি, অর্থাৎ অসত্য বা অধর্ম্মকে জয়যুক্ত করিবার অভিপ্রায় নাই। গান্ধীকে ব্যক্তিহিসাবে, অথবা গান্ধী-কংগ্রেসকে একটা রাজনৈতিক দলহিসাবে হেয় প্রতিপন্ন করিবার জন্যই, আমি এই আলোচনা করি নাই; আমি কেবল নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ধর্ম্ম ও কর্ম্মমন্ত্র উত্তমরূপে বুঝিবার ও বুঝাইবার জন্য, তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত ঐ অপর ধর্ম্ম ও কর্ম্মের একটা পরিচয় দিবার চেষ্টা করিয়াছি; তাহাতে ভক্তির অভাব থাকিতে পারে, কিন্তু অভক্তির বিদ্বেষ নাই; যতদূর সাধ্য সত্যের সন্ধানই আছে। আজ সারাভারত যাহা বিশ্বাস করিতেছে, তাহাই যদি সত্য ও শুভ হয় এবং আমার এই সন্ধান যদি মিথ্যা হয়, তবে ঐ সত্যই আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হইবে কারণ যাহা সত্য তাহার পরাজয় নাই। কিন্তু যাঁহারা গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেসের অনুরক্ত হইয়া সুভাষের বন্দনাও করেন, তাঁহারা হয় ভ্রান্ত, নয় ভণ্ড; জনসাধারণ ভ্রান্ত হইলেও, প্রধানগণ নিশ্চয়ই ভণ্ড,―কারণ, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান গান্ধীবাদীরা সুভাষচন্দ্রকে দেশের শত্রু বলিয়া মনে করিবেন, ইহাই সঙ্গত; এমন ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করা―তাঁহার কয়েকটা সদগুণের প্রশংসা করা―নিজেদেরই উদারতার পরিচায়ক, তাহাতে সুভাষচন্দ্রকে অবমাননা করাই হয়। এই মিথ্যাচার নিবারণ করাও এই আলোচনার অন্যতম অভিপ্রায়। গান্ধীবাদ ও সুভাববাদের মধ্যে কোন রফা হইতে পারে না, কেবল এই কথাটা প্রতিপন্ন করিবার জন্যও এই প্রবন্ধের প্রয়োজন ছিল। সুভাষচন্দ্রের ধর্ম্ম ও কর্ম্মমন্ত্র যদি মিথ্যাই হয়, তবে সেই মিথ্যাটাও দেশবাসীর সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করা কর্ত্তব্য, তাহাতে, আজ না হউক কাল, ইতিহাস ঐ সত্য-মিথ্যার বিচার আরও নিঃসংশয়ভাবে করিতে পারিবে। গান্ধীভক্ত ধার্ম্মিকগণ এবং কংগ্রেসী দেশপ্রেমিকগণ তাঁহাদের বিশ্বাসকে এইরূপ সমালোচনার বিরুদ্ধে যেন আরও দৃঢ় করিয়া তুলিতে পারেন, আমি উপস্থিত সেই কামনাই করি।―লেখক]

  1. ঔরংজীবেরও ঠিক এই গুণগুলি ছিল―তাঁহাকেও মুসলমানেরা ‘জিন্দা পীর’ বলিত। তাঁহারও মৃত্যুভয় ছিল না―যুদ্ধক্ষেত্রে অতিশয় সংকট সময়েও তিনি শত্রুর আক্রমণ তুচ্ছ করিয়া নমাজ করতেন।
  2. দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এই কথাই বলিয়াছিলেন―“I want to become a partner with the English people।