জয়তু নেতাজী/দ্বিতীয় সংস্কবণের ভূমিকা

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

 ‘জয়তু নেতাজী’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। এই পুস্তক যে সময়ে প্রকাশিত হইয়াছিল, তখনও ভারতের ‘স্বাধীনতা’-লাভ হয় নাই, স্বাধীনতার সিংহদ্বারে তখন সে ঘা দিতে শুরু করিয়াছে। সেই সময়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে নেতাজীর আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের কীর্ত্তিকাহিনী ও ব্রিটিশ প্রভুদের হস্তে তাহার কয়েকজন যোদ্ধার বিচারনির্যাতন সারা ভারতে বিপুল উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়াছিল। তখন ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই প্রাণান্তক জয়লাভে অবসন্ন; তার উপর, আজাদ-হিন্দ-ফৌজের সেই গগনস্পর্শী বীরত্ব-মহিমায় হতচকিত হইয়া তাহারা তাহাদের জাতিসুলভ অসামান্য কূটবুদ্ধি সহকারে ভারত-সাম্রাজ্যের কাঠামো এবং তাহার মূল স্বার্থ নির্ব্বিঘ্ন রাখিয়া, উপরকার দায়িত্বটাই ভারতবাসীকে ছাড়িয়া দিতে চাহিল। নিতান্ত নিরুপায় হইয়াই তাহারা ঐ নীতি অবলম্বন করিল, কারণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে তাহারা চোখে যেমন অন্ধকার দেখিতেছিল, তেমনই আজাদ-হিন্দ্-সেনার রাজদ্রোহীদিগকে দণ্ডিত করিতে গিয়া বুঝিতে পারিল, তাহাদের ভারতরক্ষী ভারতীয় সেনাও বিদ্রোহী হইয়া উঠতেছে; এমন কি, অহিংসাধর্ম্মী কংগ্রেসী নেতাগণও অহিংসাধর্ম্ম ভুলিয়া আজাদ-হিন্দ্-সেনা ও তাহাদের নেতাজীর জয়ধ্বজা তুলিয়া ব্রিটিশকে ভয় দেখাইতেছে। দ্বিতীয়তঃ, ঐ আজাদ-হিন্দ্-সেনার প্রায় চৌদ্দ আনা সেনানীই মুসলমান, এবং তাহারাও একজন হিন্দুর নেতৃত্বে এমন শৌর্য্য-বীর্য্য ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়াছে! ভারত শাসন-নীতির পক্ষে এতবড় বিপদ আর নাই। তৃতীয়তঃ, সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তাহাদের নিজের ঘরে যে ভীষণ দুরবস্থা আরম্ভ হইবে তাহা হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ব্রিটিশজাতির সকল বুদ্ধি ও সকল সামর্থ্য তাহাতেই নিয়োজিত করিতে হইবে; সে অবস্থায় ভারতের মত এমন একটা বিশাল দেশের সেই যুদ্ধোত্তর সঙ্কটগুলির কথা চিন্তা করিয়া ভয় পাইবারই কথা, কারণ, জমিদারী তখন আর লাভের জমিদারী নয়―বিপুল লোকসানের দায় হইয়া উঠিয়াছে। তাই জমিদারী-শাসনের নায়েবীটা―যাহার মত দুর্ভোগ আর নাই, ভারতীয় নেতৃবর্গের উপরে চাপাইয়া সে আপাততঃ একটু সুস্থ হইতে চাহিল, তারপর ‘ক্ষেত্রে কর্ম্ম বিধীয়তে”―ইহাই হইল ব্রিটিশের চিরাচরিত রাজনীতি। এইরূপে যখন তাহারা এক ঢিলে দুই পাখী মারিবার ফন্দী করিতেছিল, এবং গান্ধীজী সেই ফন্দীকেই তাঁহার অহিংসা ও সত্যাগ্রহের একটি সুফল মনে করিয়া ব্রিটিশকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করিতে উদ্যত হইয়াছেন―তাহারা কত মহৎ, এতদিনে তাহারা সত্যই “হৃদয় পরিবর্ত্তন” করিয়াছে বলিয়া, ভারতবাসীকে আশ্বস্ত ও আনন্দিত হইতে আদেশ করিতেছিলেন―ঠিক সেই সময়ে আমার এই “জয়তু নেতাজী” রচিত ও প্রকাশিত হয়। আজ প্রায় তিন বৎসর পরে ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ মুদ্রিত হইতেছে; এই স্বল্প কালের মধ্যে ভারতে যে ঘটনাগুলি ঘটিয়াছে, এবং এক্ষণে যে-ভাবে যে গতিতে, ও যে-মুখে ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহার পটভূমিকায় এই পুস্তক যিনি পাঠ করিবেন তিনি বুঝিতে পারিবেন, আমি সে-দিন ঐ কংগ্রেসী সংগ্রামের অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ ফলাফলের যে বিচার করিয়াছিলাম তাহার কোনটাই মিথ্যা হয় নাই। কয়েকটি সমসাময়িক ঘটনার ব্যাখ্যা, এবং তৎকালীন পরিস্থিতি হইতে যে দুই চারিটা অনুমান, তাহা ছাড়া ইহার কোন কথাই প্রত্যাহার করিবার প্রয়োজন নাই। তাই আমি এই পুস্তকের কোন অংশ পরিবর্ত্তন করি নাই, কেবল মাঝে মাঝে পাদটীকায় কিছু মন্তব্য আছে। কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে একটা কাজ করিয়াছি। এবার নেতাজীর মন্ত্র ও তাঁহার কর্ম্মনীতি উত্তমরূপে বুঝিয়া লইবার জন্য আমি এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে কয়েকটি বিষয়ের পৃথক আলোচনা সন্নিবিষ্ট করিয়াছি। পাঠকগণকে এই আলোচনা গুলি ধীর ভাবে পাঠ করিতে বলি, কারণ, নেতাজীর নীতি যে ভ্রান্তনীতি নয়, এবং গান্ধী-নীতির সহিত তিনি যে কোন আপোষ করিতে পারেন নাই, তাহা এই আলোচনাগুলি হইতে তাঁহারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন। এজন্য, ঐ পরিশিষ্ট-ভাগে, সুভাষচন্দ্রের গ্রন্থ “The Indian Struggle” হইতে যে সারোদ্ধার ও সমালোচনা করিয়াছি তাহা এই সংস্করণের একটি মূল্যবান অধ্যায় হইয়াছে।

 পুস্তকের মূল অংশে হস্তক্ষেপ করি নাই আরও একটি কারণে। যাঁহারা ইতিপূর্ব্বে এই পুস্তক পড়িয়াছেন তাঁহারা সম্ভবতঃ লক্ষ্য করিয়াছেন, ইহার রচনাভঙ্গিতে একটা প্রবল ভাব-প্রেরণা আছে। আমি জানি, এই কারণেই এই ক্ষুদ্র পুস্তক অনেককে আশাতিরিক্ত মুগ্ধ করিয়াছে―আমি তাহার বহু প্রমাণ পাইয়াছি, নিজেও আশ্চর্য্য হইয়াছি। তথাপি এই পুস্তক-প্রকাশের কালে আমার আশা ছিল, পাঠক-পাঠিকাভেদে যাঁহার ধর্ম্মমত যেমনই হোক―আমার সেই প্রাণের দীপ্তি সকলকেই স্পর্শ করিবে, কারণ, ইহাতে মতামত ও যুক্তিতর্ক ছাড়াও এমন কিছু আছে যাহা অতিশয় বিরুদ্ধবাদী, এমন কি, অসত্যজীবীকেও চমকিত করিবে। কিন্তু পুস্তকখানি সুপ্রচারিত হইবার পূর্ব্বেই সারা ভারতে স্বাধীনতার জয়ভেরী বাজিয়া উঠিল; গান্ধী ও কংগ্রেসের অলৌকিক সংগ্রাম-নীতিই জয়যুক্ত হইয়াছে বলিয়া নেতাজীর ধর্ম্ম ও কর্ম্মমন্ত্রের গৌরব আর রহিল না। সে উন্মাদনা বাঙালীকেও এমনই পাইয়া বসিল ষে, স্বাধীনতার সর্ত্ত রক্ষা করিতে গিয়া তাহার নিজের দেশ ও জাতি যে উৎসন্ন হইয়া গেল, সে দিকে একবারও সে চাহিয়া দেখিল না। ইহার অল্প কিছু আগে এই বাঙালীই নেতাজী ও তাঁহার আজাদী সেনার গৌরব-কীর্ত্তনে আত্মহারা হইয়াছিল। তাহার পর যখন সেই আজাদী ফৌজকে ও তাহার মহাপ্রাণ, মহাতেজা বীর সেনানীদিগকে ব্রিটিশের সেই ভারতীয় সেনাদল হইতে বহিষ্কৃত করিয়া, এবং ব্রিটিশ-ভৃত্য, দেশদ্রোহী সেনানীদিগকেই উচ্চতর পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া, শেষে নেতাজীর নাম পর্য্যন্ত তথা হইতে মুছিয়া ফেলা হইল, তখনও তাহারা নীরবে তাহা সহ্য করিল, কারণ, তাহারা যে সত্যই স্বাধীন হইয়াছে। নেতাজী ও তাঁহার আজাদী সেনাকে তো কোন প্রয়োজনই হয় নাই―অহিংসার অলৌকিক শক্তিই তাহাদিগকে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা-স্বর্গে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছে। কংগ্রেসের ঐ নীতি যে নেতাজীর নীতি নয়, ঐ স্বাধীনতা যে প্রকৃত স্বাধীনতা নয়―উহা যে নেতাজীর আজীবন তপস্যা ও অমানুষিক সাধনার ধন নয়, এবং উহা যে কত দুঃখ ও দুর্দ্দশার মূল হইয়া উঠিবে, সে কথা তখন শোনে কে? এখনও সেই মোহ ঘোচে নাই; যাহাতে না ঘোচে তজ্জন্য কত উপায়, কত রকমের প্রচার ও অনুষ্ঠান নিত্য উদ্ভাবিত হইতেছে। তাই আমার এই নেতাজী-কথা এখনও সকলের হৃদয়ে পৌছিবার পথ পায় নাই।

 তথাপি, এতবড় বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও ইহার প্রথম সংস্করণ, প্রায় হাজার কপি যে নিঃশেষিত হইয়াছে, এবং এক্ষণে কিছুকাল দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় ইহার অভাব যে অনুভূত হইতেছে, ইহাও আশ্চর্য্যের বিষয়। এইজন্য আমি এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করিতে আর বিলম্ব করিলাম না। আরও কারণ, আমার মনে হইতেছে, এতদিনে নেতাজীকে জানিবার ও বুঝিবার মত মনের অবস্থা ফিরিয়া আসিয়াছে।

 নেতাজীর সেই পরিচয় আমার এই গ্রন্থে তাঁহারা যে ছন্দে, এবং যে ছায়ালোকসম্পাতে নূতন করিয়া পাইবেন, ঠিক তেমনটি আর কোথাও পাইবেন না, ইহা নিশ্চিত। আরও কত ধরণের কত পরিচয় কত ভাষায় রচিত হইয়াছে, সে সকল গ্রন্থের মূল্য আমার এই ক্ষুদ্র পুস্তক অপেক্ষা অধিক হইবারই কথা; তথাপি, আমি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অন্তর-পুরুষকে যে ভাবে দেখিয়াছিলাম, আর কেহ যে তেমন করিয়া দেখেন নাই, ইহা আমি সত্য বলিয়া জানি, এইজন্য সেই ভাবাবেশের অবস্থায় আমার লেখনীমুখে যাহা বাহির হইয়াছিল তাহার কিছুই পরিবর্ত্তন বা পরিবর্জ্জন করি নাই। সে দেখা এমনই যে, কেবল এই রচনাটীই নয়―আমি তাহার পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গান্ধী কংগ্রেসের ব্যর্থতা, এবং তাহা হইতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সম্বন্ধে এমনই একটি নিসংশয়তা লাভ করিয়াছি যে, তাহার পর যাহা কিছু ঘটিয়াছে ও ঘটিতেছে তাহার কার্য্য-কারণ ও ফলাফল জলের মত পরিষ্কার বোধ হইয়াছে। আমি কখনও রাজনীতি চর্চ্চা করি নাই। এই গ্রন্থেও যে সকল কথা আছে তাহা রাজনীতিশাস্ত্রের কথা নয়; তথাপি অনেক রাজনৈতিক, গান্ধীবাদী, কংগ্রেসী যোদ্ধা (এবং সাহিত্যিক)―আমি অনধিকারী বলিয়া―এই পুস্তকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়াছেন। কিন্তু আমি জানি, আমার দৃষ্টি রাজনীতির দৃষ্টি নয়―তাহা এমন এক নীতি যাহা সকল নীতির উপরে; উহাই মানব-ধর্ম্মনীতি ও শাশ্বত সত্য-নীতি, এবং সে প্রেরণা আমি লাভ করিয়াছি―সেই এক পুরুষের অন্তর মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়া। প্রেম ও সত্যের, বীর্য্য ও ত্যাগের সেই জ্বলন্ত, জীবন্ত বিগ্রহকে আমি এক পুণ্যক্ষণে আমার অন্তরের আলোকে দেখিয়াছিলাম, দেশ ও জাতির নিপীড়িত আত্মার যতকিছু আর্ত্তি―তাহার মৃত্যুর কারণ ও পুনর্জ্জীবনের আশা―আমি সেই পুরুষের আত্মাহুতির যজ্ঞানলশিখায় পাঠ করিয়াছিলাম; তজ্জন্য রাজনীতি শিখিতে হয় নাই―কোনও বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত করিতে হয় নাই। সেই মহা-জীবনের সেই একটি মন্ত্রে সকল দুয়ার খুলিয়া গিয়াছে―যে দিকে চাই, সেই জীবনের সত্য আমাকে সকল মিথ্যা হইতে রক্ষা করিয়াছে। আজাদ-হিন্দ সেনা ও তাহার নেতাজী-রূপে সুভাষচন্দ্রের সেই আবির্ভাবই আর সকলের মত আমাকেও চমকিত ও অণুপ্রাণিত করিয়াছিল বটে কিন্তু পরে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরী যুদ্ধের সেই পরাজয় ভারত ভাগ্যের যে কত বড় অভিশাপ―তাহা যতই চিন্তা করিয়াছি, ততই সুভাষচন্দ্রের ঐ নেতাজী-মূর্ত্তির অন্তরালে এক সম্যক প্রবুদ্ধ, জ্ঞান-প্রেম ও কার্ম্মের দিব্য প্রেরণাময়―দেশাত্মবোধের সেই অবতারপুরুষকে দেখিতে পাইয়াছি। ঐ ত্রিপুরী-তত্ত্ব যাহারা জানে না, বা জানিয়াও তাহা চাপিয়া রাখিতে চায় তাহারা কখনও সুভাষচন্দ্রকে বুঝিবে না―তাহারাই ভারতের সর্ব্বনাশকে সর্ব্বপ্রাপ্তি বলিয়া বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইবে, কাহারা কি জন্য হইবে তাহাও আজ আর কাহারও বুঝিতে বাকি নাই। ঐ ত্রিপুরী-যুদ্ধে মহাত্মার অন্তরালে অবস্থান, তাহার পূর্ব্বে ও পরে তাঁহার আচরণ, এবং শেষে ব্রিটিশের দানস্বরূপ ঐ স্বাধীনতালাভের জয়গান―যাহারা ধীরচিত্তে, সত্যনিষ্ঠা সহকারে বিচার করিয়া দেখিবে, তাহারা আজ একজন অতি-দম্ভী প্রভূত্বপরায়ণ মানুষের দ্বারা সমগ্র ভারতের এই দাসত্ব-বন্ধনের জন্য উহাদিগকেই দায়ী করিবে না, গান্ধীজীকেই করিবে। ব্রিটিশের সহিত রফা তিনিই করিয়াছিলেন―বৈবাহিক রাজাগোপালাচারীর মন্ত্রণাকেই তিনি শিরোধার্য্য করিয়াছিলেন। তাঁহারই একান্ত কামনায় ভারতের ত্রিশকোটি প্রজার জীবন-মরণের ভার ঐ কয়েকজনের হস্তে ন্যস্ত হইয়াছে। ভারত-বিভাগও তাঁহারই অনুমতিক্রমে হইয়াছে―বাহিরে তজ্জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করিলেও, ভিতরে তিনিই যে একরূপ জোর করিয়া সকলকে সম্মত করিয়ছিলেন, ইহা গোপন করা সম্ভব হয় নাই। লক্ষ লক্ষ নর-নারীর প্রাণহরণ, ও বাস্তুহরণ যে নীতিঅনুসরণের ফলে ঘটিয়াছে―হিন্দু ও মুসলমানে চির-বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে, সকলই সেই এক নীতি; সেই নীতিকে জয়ী করিবার জন্যই ত্রিপুরীতে সুভাষচন্দ্রকে পরাস্ত করিতে হইয়াছিল।

 আমি সুভাষচন্দ্রকে দেখিয়াছি সেই ত্রিপুরীতে; সেইখানে তাঁহার দেহ ক্রুশবিদ্ধ হইয়াছিল, পরে তাহার সমাধির ব্যবস্থাও হইয়াছিল। তারপর সেই Resurrection―সেই পুনরুত্থান!―আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর নেতাজীরূপে তাঁহার সেই আবির্ভাব! সেই আবির্ভাব কি মিথ্যা? তাহা কি ব্যর্থ হইয়াছে? যথন এই পুস্তক লিখিয়াছি তখন যে ধরণের আশা ছিল তাহাই ইহাতে ব্যক্ত করিয়াছি; আজ সেই ত্রিপুরী-যুদ্ধের ফল ভারত-ভাগ্যে যেরূপ প্রকট হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে মনে হয়, নেতাজীরূপে সুভাষচন্দ্রের সেই যে পুনরাবির্ভাব, তাহা শুধু অলৌকিক নহে―যদি সত্যও হয়, তবে সেইখানেই তাহা শেষ হয় নাই; কারণ, যাহা সত্য তাহা কখনও অসম্পূর্ণ বা নিষ্ফল হইতে পারে না; যদি নিস্ফল হয়, তবে ভারতের আর কোন আশা নাই। মহাত্মাজীর চরকা, অহিংসা ও হিন্দু মুসলমানের মিলন (ঐ শেষেরটির জন্য হিন্দুর হিন্দুনাম-ত্যাগ) এই তিনের যে মহিমা আজ সারা ভারতকে জর্জ্জরিত করিয়াছে, এবং প্রাদেশিকতা-দমনের জন্য ‘নেশন’-নামক যে দৈত্য তাহার রক্ত-চক্ষু উন্মীলন করিয়াছে, তাহাতে হিন্দুনামও যেমন, ভারত-নামও তেমনই অচিরে লোপ পাইবে।

 প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় যাহা বলিয়াছিলাম তাহার পরে এই যে আরও কিছু বলিলাম, ইহাতে নূতন কিছু নাই, কেবল, এই অল্পকালের মধ্যে স্বাধীনতা-নামক যে ‘দিল্লী কা লাড্ডু’ (অতি পুরাতন নাম আজিও ৰদলায় নাই।) পাইয়া ভারতবাসী―বিশেষ করিয়া বাঙালী―চক্ষে সরিষার ফুল দেখিতেছে, তাহারই অবকাশে আমার এককালের সেই অতিশয় অপ্রিয় কথাগুলা আর একটু প্রমাণ সহকারে বলিয়াছি। আমি নেতাজীর জবাণীতে, তাঁহারই সেই প্রাণবহ্নির আলোকে, ঐ তথ্য ও তত্ত্বগুলিকে পাঠ করিয়াছিলাম, তাই আজিও তাহা বর্ণে ৰণে সত্য। ইহাও জানি যে, এই পুস্তকে আমি মহাত্মা গান্ধীর নীতি ও তাঁহার আচরণ সম্বন্ধে যে সকল মন্তব্য করিয়াছি,―তাহার যে ভক্তিহীন সমালোচনা কবিয়াছি, তাহাতে―নেতাজীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও, আমার এই নেতাজী-বন্দনা অনেকের পক্ষে কটু ও বিরক্তিকর বোধ হইবে; ইহা যে কত বড় দুঃখের বিষয় তাহা স্বীকার করি। কিন্তু আমি নেতাজী-সত্যকে যেরূপ বুঝি তাহা গান্ধী-সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত, এবং সেই দুই সত্য দুই ব্যক্তির সহিত অবিচ্ছেদ্য হইয়া আছে। গান্ধীজী মহাত্মা হউন, তিনি সারা পৃথিবীর ধর্ম্মগুরু হউন তাহাতে কাহারও আপত্তি নাই, কিন্তু ধর্ম্মপ্রচার ও দেশোদ্ধার-কার্য্য যে এক নহে, ইহা স্বীকার করিতেই হইবে; এক যে নহে তাহার প্রমাণ দিন দিন প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিতেছে,―মহাত্মার সেই ধর্ম্মমন্ত্র রাজনীতির সঙ্গে রফা করিতে গিয়া যেমন বিকার প্রাপ্ত হইয়াছে, তেমনই ভারতের সর্বনাশ করিয়াছে,―ইংরেজ তাহার বুকে ঐ যে পাকিস্তানের শক্তিশেল বসাইয়া দিয়াছে, উহার অবস্থানেও যেমন, উৎপাটনেওতেমনই, ভারতের প্রাণ-সংশয় ঘটিবে। এ কথা আজ যাহারা এখনও বুঝে নাই, কাল তাহাদিগকে বুঝিতেই হইবে। আমি দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করার কথাই বলিতেছি, তৎপূর্ব্বে তাহার ধর্ম্মজীবন উন্নত করা, আধ্যাত্মিক ঔষধের দ্বারা আত্মার আধি নিবারণ করা,এবং তাহা হইতেই জাতির ত্রিতাপ-হরণের কথা বলিতেছি না, সাক্ষাৎ মৃত্যু হইতে জাতিকে রক্ষা করার কথাই বলিতেছি। ধর্ম্মের কথা আমি বলিব না, কারণ, সে বিষয়ে―শুধু আমারই নয়―ভারতবাসী হিন্দুমাত্রেরই―গান্ধীর সহিত মতভেদ ঘটিতে পারে। ধর্ম্ম-বিশ্বাস সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত তো বটেই, তা ছাড়া, মহামানব-ধর্ম্ম বা বিশ্বপ্রেম-বাদের মর্ম্ম আমি হিন্দু বলিয়া হিন্দুর মতই বুঝি; দুঃখের বিষয়, আমি হরিজনও নই, আবার মহাত্মা-শিষ্য নেহেরুর মত সর্ব্বসংস্কারমুক্ত ব্যোমবিহারী জ্ঞানী পুরুষও নই,―তাই মহাত্মাকে আমার গুরু করিতে পারি নাই। কিন্তু সেজন্য কাহারও অসন্তুষ্ট ইষ্ট হইবার কারণ নাই―যেহেতু, এখানে যে-ধর্ম্মের আলোচনা করিয়াছি, তাহাতে হিংসা-অহিংসার তর্ক উঠিতে পারে না, কারণ সে-ধর্ম্মের নাম স্বদেশ ও স্বজাতি-প্রেম; তাহার একমাত্র নঃশ্রেয়স―এই জাতি ও দেশের মুক্তিসাধন; মানব জাতির চিন্তা আগে নয়, স্বজাতির চিন্তাই আগে। সেই ধর্ম্মেরই মূর্ত্ত প্রতীকরূপে আমি নেতাজীকে বরণ করিয়াছি। তাহার সহিত আমার ব্যক্তিগত ধর্ম্ম বা আধ্যাত্মিক সাধন-মন্ত্রের কোন সম্বন্ধ নাই; গান্ধীজীকেও যেমন―নেতাজীকেও তেমনই, আমি আমার ধর্ম্মগুরুরূপ বরণ করি নাই। অতএব, মহাত্মাকে যাঁহারা ঈশ্বরের অবতার অথবা ধর্ম্মগুরু বলিয়া ভক্তি করেন তাঁহাদের সহিত আমার কোন বিবাদই থাকিতে পারে না―এই পুস্তকপাঠ-কালে সেই কথাটি স্বরণ রাখিলে আমাকে সকলেই ক্ষমা করিতে পারিবেন।

 আর একটি কথা আমাকে দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে। এই পুস্তক যখন লিখি তখন সুভাষচন্দ্রের জীবনবৃত্ত বা অন্যবিধ পরিচয়-কাহিনীর অনেকগুলিই প্রকাশিত হয় নাই; যাহা হইয়াছিল তাহার দুই চারিথানি মাত্র (অধিকাংশ ইংরাজী) পড়িবার সুযোগ পাইয়া বিশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছিলাম। কিন্তু পরে একখানি পুস্তক পড়িয়া বড়ই বিস্মিত ও মর্ম্মাহত হইয়াছি। বইখানি সুভাষচন্দ্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায়ের “The Subhas I Knew”। এই পুস্তকে দিলীপকুমার তাঁহার বন্ধুর সম্বন্ধে শেষ পর্য্যন্ত যে ধারণা ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহার মত অমূলক ও অবিচারী আর কিছু হইতে পারে না। তিনি তাঁহার নিজের সাধন-জীবনের উচ্চভূমি হইতে সুভাষ-চরিত্র বিচার করিয়াছেন, তাঁহার সেই দৃষ্টিতে বন্ধুর অধঃপতন দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন; কারণ, সুভাষচন্দ্রের প্রথম-জীবনের যে পরিচয়ে তিনি তাঁহার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, শেষে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কার্য্য-কলাপে তাঁহার সেই আধ্যাত্মিক শুচিতার নাকি হানি হইয়াছে। শেষে আজাদ-হিন্দ্ সেনার নেতাজী-রূপে সুভাষচন্দ্র যেরূপ আত্ম-গৌরব প্রচার করিতেন তাহাতে তাঁহার আত্মার মলিনতাই প্রমাণিত হয়। সুভাষচন্দ্র তাঁহার সৈন্যদল সমক্ষে এমন কথাও নাকি বলিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে মারিবে এমন বোমা ইংরেজ কখন তৈয়ারী করিতে পারিবে না। এমন আত্মশ্লাঘা কোন সাধু ও সত্যনিষ্ঠ পুরুষ করিতে পারে? মানুষ হইয়া―ভগবানের দাস হইয়া―এমন দম্ভ! আমি এই পুস্তকের উল্লেখ করিতাম না, কিন্তু অন্তরঙ্গ বন্ধু বলিয়া সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে দিলীপকুমারের সাক্ষ্য ও উক্তিসকলের কিছু মূল্য আছে। ঐ পুস্তকে তেমন অনেক কথা আছে, আমি এই দ্বিতীয় সংস্করণের পাদটীকায় তাহার কয়েকটি উদ্ধৃত করিয়াছি। দিলীপকুমারের বাচালতাই তাঁহার একরূপ প্রতিভা বলিলেও হয়; নানা বিষয়ে তাঁহার যে মতামত ও ভাবোচ্ছাস বাংলা ও ইংরেজীর মারফতে চতুর্দ্দিকে উড়িয়া ছড়াইয়া পড়ে তাহা যেমন বিচিত্র, তেমনই কৌতুককর। দিলীপকুমার অতিশয় সরল-হৃদয় ব্যক্তি, তাঁহার এই সরলতাই আমাকে মুগ্ধ করে; তাঁহার প্রাণমনের যত কিছু ভাবনা-কামনা তিনি অকপটে ব্যক্ত করিয়া থাকেন― একটুও আব্রু রক্ষা করিতে পারেন না। এই পুস্তকেই তিনি সেই ‘enfant terrible’ হইয়া নিজের সম্বন্ধেই একটা সত্যকথা কবুল করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি পণ্ডিত জবাহরলালের অনুরাগী―তার কারণ, জবাহরলাল সুভাষ অপেক্ষা সঙ্গীতপ্রিয়, তিনি সঙ্গীতকলার মর্য্যাদা বুঝেন। একদা দিলীপকুমারের গান তিনি শ্রদ্ধা ও মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিয়াছিলেন—এজন্য দিলীপকুমার পণ্ডিতজীর প্রতি বড় কৃতজ্ঞ ও তাঁহার গুণানুরাগী―ইহা তিনি স্পষ্টতঃ স্বীকার করিয়াছেন। এমন আত্মপ্রীতি যাঁহার―সুভাষচন্দ্রকে সে-ও আত্মম্ভরী বলিয়া নির্দ্দেশ করে! যে হাস্যরসিক বিধাতার খেয়ালে সুভাষচন্দ্রের মত পুরুষের সহিত এই রস-সাধক আত্মবিগলিত পুরুষটির ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল, সেই বিধাতার পরিহাস তিনি বুঝিতে পারেন নাই; কারণ, ঐ বন্ধু আর তিনি এই দু’য়ের মধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ্য সাগরের ব্যবধান আছে,―তাঁহার গুরু শ্রীঅরবিন্দের আসন যতই উচ্চ হউক। শিষ্য তাঁহারই জবানীতে সুভাষচন্দ্রের চরিত্র-বিচার করিতে পারেন না, কারণ সে-দৃষ্টি তাঁহার এখনও লাভ হয় নাই। দিলীপকুমারের ঐ পুস্তক পাঠ করিয়া মনে হয়, সুভাষচন্দ্রের প্রতি তাঁহার এই অনুকম্পা ও অসস্তোষের কারণ―সুভাষচন্দ্র পণ্ডিচেরীর আশ্রমে যোগাভ্যাস করিতে রাজী হন নাই, তিনি আধ্যাত্মিক রস-সাধনার মূল্য বুঝিতে চাহেন নাই। কিন্তু একথা তিনি কেন ভুলিয়া যান যে, শ্রীঅরবিন্দই ভগবানের একমাত্র বিভূতি নহেন, আরও অনেক বিভূতি বা প্রকাশ তাঁহার আছে; এবং শ্রীঅরবিন্দ বড় কি, সুভাষচন্দ্র বড়, সে প্রশ্ন অতিশয় অপ্রাসঙ্গিক হইলেও, ভারতের এই যুগের যুগ-প্রয়োজনে (বিশ্বমানবের শাশ্বত প্রয়ােজনে নয়) কাহার সাধনা অধিকতর মূল্যবান, ইতিহাস তাহা পরে নির্ণয় করিবে, এখন সে বিষয়ে কিছু বলা অনাবশ্যক ও অসম্ভব। না, আমি শাশ্বত-সত্য বা মানবের শাশ্বত কল্যাণে অবিশ্বাস করি না; কিন্তু ইহাও বিশ্বাস করি যে, ‘supra-mental plane’, বিশ্বমানব ও ব্রহ্মাণ্ড, Divine Life প্রভৃতির গভীর তত্ত্ব উপস্থিত কিছুকাল মুলতুবি রাখিলে কিছুমাত্র ক্ষতি নাই, কারণ, একটা ‘far-off divine event’-এর জন্য বসিয়া থাকিবার সময় আছে, কাল যে অনন্ত। শ্রীঅরবিন্দের সাধনাও তাহাই প্রমাণ করে। কিন্তু ভগবানের আরও একটা কাজ আছে―সেই মহাকালের যুগ-চক্রটাকে কোন একটা মহাসঙ্কটসন্ধি হইতে উদ্ধার করিয়া সচল করিয়া দেওয়া; সেটা ঐরূপ অনন্তকালের নয়―অতিশয় ক্ষুদ্র কালে, একট সুনির্দ্দিষ্ট লগ্নে সম্পন্ন না করিলে, Divine Life-ও নিতান্তই Divine হইয়া পড়ে। সুভাষচন্দ্র যােগী নহেন―যোদ্ধা; বৃন্দাবনবিহারীর লীলাসহচরও নহেন—সেই বৃন্দাবন-বিহারীকেই সারথি করিয়া তিনি কুরুক্ষেত্রে গাণ্ডীব ধারণ করিয়াছেন। তাই সুভাষচন্দ্র যদি ঐরূপ আত্মশ্লাঘা করিয়া থাকেন, তবে কিছুমাত্র ধর্ম্মভ্রষ্ট হন নাই। মহাশক্তির বরপুত্র যে, তাহাকেই ঐরূপ মহা-নির্ভরের উক্তি সাজে, সে কেন বলিবে না―“আমি সেই মহিষমর্দ্দিনী, দানবদলনী মহাশক্তির পুত্র, আমাকে মারিবে এমন দৈত্য, দানব, অসুর কোথায় আছে?” শক্তিসাধনায় যে, সিদ্ধ হইয়াছে সে-ই এমন কথা বলিতে পারে, নতুবা চতুর্দ্দিকে শেল্-(shell)-বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়াইয়া এমন কথা কেউ বলিতে পারিত? পণ্ডিচেরীর যোগাশ্রমে বসিয়া বলিলে অবশ্যই তাহা আধ্যাত্মিক হইত না। সুভাষচন্দ্রের আত্মশ্লাঘা! ঐ আত্মার ঐ শ্লাঘা যদি দোষাবহ হয়, তবে বিবেকানন্দও গোল্লায় গিয়াছেন! একথা সত্য যে, এখনও এই আধ্যাত্মিক জাতির মধ্যে দিলীপকুমারের মত সাধকপুরুষের সংখ্যাই বেশী, অগণিত বলিলেও হয়―শ্রীঅরবিন্দের শিষ্যসংখ্যাই তাহার প্রমাণ। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মত পুরুষ-বীর হাজার বৎসরেও একটা জন্মে কিনা সন্দেহ। ম: রোমা রলাঁ (M. Romain Rolland) সুভাষচন্দ্রকে যাহা লিখিয়াছিলেনা তাহাই উদ্ধৃত করিয়া এই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ শেষ করি―

 We the men of thought must each of us fight against the temptation that befalls us in moments of fatigue and un-settlednessof repairing to a world beyond the battle called either God or art or independence of spirit or those distant regions of the mystic soul. But fight we must our duty lies on this side of the occan on the battle-ground ot men

 স্বামী বিবেকানন সম্বন্ধেও তিনি ঠিক এই কথাই বলিয়ছিলেন, যথা―

 Those who have followed me up to this point know enough ot Vivekananda's nature with its tragic compassion binding him to all the suffering of the universe and the tury of action wherewith he flung himself to the rescue to be certain that he would never permit himself or tolerate in others any assumption of the right to lose themselves in an ecstasy of art or contemplation.

—সুভাষচন্দ্রের সম্বন্ধেও ইহা কি অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয়? কিন্তু ইঁহাদের কেহই দিলীপকুমারের মত গুরু-লাভ করেন নাই, তাই “ecstasy of art, or contemplation”-ই কেহ কেহ পরমপুরুষার্থ করিতে পারেন নাই।

 আর কয়েকখানি পুস্তক পরে পড়িবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে তাহার মধ্যে জেনারেল শাহনওয়াজ-লিখিত ‘I. N. A and its Netaji’ নামক গ্রন্থখানি পাঠ করিয়া ধন্য হইয়াছি। এই পুস্তকখানিকে “নেতাজী-চরিত-মানস” বলা যাইতে পারে; সেই ‘চরিত’ লিখিবার যােগ্যতা ও অধিকার তাঁহার যেমন আছে তাহা সকলের নাই। এই গ্রন্থ পাঠ করিয়া আমার কেবল ইহাই মনে হইয়াছে যে, হােমারের ‘ইলিয়াড’, বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ ও ব্যাসের ‘জয়’-মহাকাব্য পাঠ করার পব যদি আর একখানি মহাকাব্য তেমনই পাঠ্য হইতে পারে, তবে তাহা এই ‘নেতাজী-চরিত’―এই মহাবস্তদান-গাথা। অথচ ইহা কাব্য নহে―ইতিহাস! আমার বিশ্বাস, জগৎ-সাহিত্যে এমন মহাকাব্য আর মিলিবে না। ভারত যদি আবার বাঁচিয়া উঠে, তবে রামায়ণ মহাভারতের মতই এই মহা-কাহিনী, যুগ-যুগান্তর ধরিয়া, কৃষকের পর্ণকুটীর হইতে ধনীর প্রাসাদ পর্য্যন্ত সর্ব্বত্র ঘরে ঘরে পঠিত হইবে; কত গান, কত গাধা, কত কাব্য, কত নাটক এবং কত রকমের শিল্পকলায় এই অমৃত-নিস্যন্দী বসুধারা প্রবাহিত হইতে থাকিবে।

জয় হিন্দ্ !

 বৈশাখ, ১৩৫৭
―গ্রন্থকার