নেতাজী

নাম-স্মরণ

 এই প্রবন্ধ যখন লিখিতেছি তখন বাংলার মহানগরী, বাঙালীর শতবর্ষব্যাপী সাধনার সাধন-পীঠ, তাহার নবজীবনযজ্ঞের পুরাতন যজ্ঞশালা এবং অধুনাতন মহাপাপের প্রেতভূমি—কলিকাতা ধ্বংস হইতেছে; কার্থেজ নয়, ট্রয় নয়—শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা বিধ্বস্ত, লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হইতেছে। ১৭৫৭ সালে বাঙালী যে পাপ করিয়াছিল, ১৮৫৭ সালে সে যে-পাপকে আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছিল, এবং গত ২৫ বৎসর ধরিয়া যে পাপকে ঢাকিবার চেষ্টায় সে নিজের চরিত্র ও বুদ্ধি দুইয়েরই হত্যাসাধন করিয়াছে, আজ সেই পাপ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া তাহাকে গ্রাস করিতেছে। বহু সাধক, বহু মহাত্মা বহু বীর সেই পাপের সহিত যুদ্ধ করিয়া প্রায়শ্চিত্তও করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না, আজ তাহার চরমকাল উপস্থিত। বাঁচাইবার কেহ নাই, একটি পুরুষও নাই যাহার মুখের দিকে সে চাহিবে, ক্লীব ও কাপুরুষ, ভণ্ড ও স্বার্থপর প্রবঞ্চকের দল নেতার ভূমিকা অভিনয় করিতেছে, ধর্ম্মের ধ্বজা উড়াইয়া—তাহার যেটুকু ধর্ম্মবোধ ছিল তাহাও হবণ করিয়াছে। এমন দিন বাংলায় আর কখনও আসে নাই। এই নীরন্ধ্র অন্ধকারে, মহামৃত্যুর ঘনায়মান ছায়ায় কেবল একজনকেই স্মরণ হয়, তাহারই কীর্ত্তি ও তাহার চরিত এই ঘাের নৈরাশ্যকেও কথঞ্চিৎ লঘু করে, মানসনেত্রে সেই মূর্ত্তি দর্শন করিয়া আত্মা যেন একটু আশ্বস্ত হয়—বলিয়া উঠে, “Sweet Benediction in the eternal Curse!... Thou living form among the Dead!” নীরন্ধ্র অন্ধকার ভেদ করিয়া সেই আলােকরশ্মি নির্গত হইতেছে, বিরাট হত্যাশালার আর্ত্ত কোলাহল ক্ষণে ক্ষণে স্তব্ধ করিয়া একটি দূর কণ্ঠের মাভৈঃ-রব শােনা যাইতেছে। সেই এক। আর কেহ নাই —কিছু নাই।

 বাঙালী, আজ সেই সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ কর। পুরাণে আছে, এই দেশেরই শতবেণী-সঙ্গমে পবিত্র জাহ্নবীধারাকে দূর গঙ্গোত্তরী হইতে টানিয়া আনিয়া সগররাজবংশের ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়াছিল—সেই নির্ব্বংশের একমাত্র বংশধর। পুরাণ ইতিহাস নহে, অর্থাৎ সে কোন বিশেষ কালের বিশেষ ঘটনার কাহিনী নয়, তাহার কাহিনী নিত্যকালের, তাই সেই ঘটনা আজিও ঘটিতেছে। বাঙালীর সগরবংশ ঋষির অভিশাপে ভস্ম হইয়াছে; আজিকার সাগরসঙ্গমে তাহার যে ভস্মরাশি পড়িয়া আছে তাহাকে সঞ্জীবিত করিতে পারে ও করিবে— তাহারই ঐ একমাত্র জীবিত বংশধর, সারা ভারতে সে যে পুণ্যপ্রবাহ বহাইয়াছে তাহারই স্পর্শে ঐ ভন্মরাশি সঞ্জীবিত হইবে—ঋষির অভিশাপ হইতে সে মুক্ত হইবে।

 সেই মুক্তি হইবে কেমন করিয়া? সে মুক্তিসাধনের মন্ত্র কি? একজন বাঙালী-সন্তান জননী-জঠরে বাসকালেই সেই মন্ত্র লাভ করিয়াছিল, তার পর ভূমিষ্ঠ হইয়া, জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সেই মন্ত্রসাধনের উপায় বা পন্থা খুঁজিয়াছে, স্বপ্নে জাগরণে এক মুহূর্ত্ত স্থির থাকিতে পারে নাই; নিমজ্জমান ব্যক্তি যেমন আকুলভাবে জলের উপরকার বায়ুমণ্ডলে নিঃশ্বাস লইবার চেষ্টা করে, সে তেমনই করিয়া মুক্তিলাভের চেষ্টা করিয়াছে। সে নিজের মধ্যে যে মুক্তিকে অপরোক্ষ করিয়াছে, বাহিরেও সেই মুক্তিকে সত্য করিয়া তুলিতে না পারলে সে বাঁচিবে কেমন করিয়া? তাহার মূর্ত্তিও যেমন, তাহার সেই বাণীও তেমনই উর্জ্জস্বল। তাই এই বৃহৎ কারাগারে বন্ধনই যাহাদের জন্মগত সংস্কার, তাহারা মুক্তিদূতেব সেই অদ্ভুত বাণী ও অদ্ভুত আচরণে বিস্ময-বোধ করিল, কিন্তু শ্রদ্ধা করিল না; যাহারা সেই বন্ধন দশায় কোলাহল শুরু করিয়াছে তাহারা মুগ্ধ হইল, কিন্তু বিশ্বাস করিল না, এবং যাহারা মুক্তিকে বিশ্বাস করে না, যাহাদের মুক্তির ধারণাই অন্যরূপ—অতিশয় ভিন্নপথে মানুষগুলাকে চালনা করিতে পারিয়া যাহারা দলপতিত্বের অভিমানে অন্ধ হইয়াছিল, বণিকের মত অতি-সাবধানী হিসাব-বুদ্ধিই যাহাদের কর্ম্মবুদ্ধি, এবং ভিক্ষাই যাহাদেব ধর্ম্ম—তাহারা এই নব গাণ্ডীবীর গাণ্ডীবে মুক্তি-মন্ত্রের টঙ্কার শুনিয়া প্রমাদ গণিল, নিজেদের নেতৃত্বনাশ-ভয়ে ভীত হইয়া তাহারা ঐ মুক্তিদূতকে ছলে বলে কৌশলে দেশ হইতে বিতাড়িত করিবার কত চেষ্টাই না করিল! কিন্তু পারিল না। ক্ষুদ্র যেমন মহৎকে পারে না, মিথ্যা যেমন সত্যকে পারে না, মেঘ যেমন সূর্য্যকে পারে না, তেমনই পারিল না। বরং শেষে তাহারই আশ্রয়ে, তাহারই আবরণে, আপনাদের মহাপরাজয় ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছে; নিজেদের মুখরক্ষা, মানরক্ষার জন্য তাহারই কীর্ত্তি-গৌরবের ছায়ায় আসিয়া সমবেত হইয়াছে। আজ তাহাদের সকল বুদ্ধি সকল কৌশল যখন ব্যর্থ হইতে চলিয়াছে-দীনতা ও হীনতা, আত্মপ্রবঞ্চনা ও পর-প্রবঞ্চনা যতই বীভৎস হইয়া উঠিতেছে, ততই জনগণকে দণ্ড কৌপীনের মাহাত্ম্য বুঝাইতেছে; মানুষ যখন আসন্ন সর্ব্বনাশের ভয়ে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে তখন তাহাদিগকে পরম-বৈরাগ্যের উপদেশ দিতেছে! কিন্তু আর কেহ তাহাতে ভুলিবে না, বণিকবৃত্তির দ্বারা সওদা-করা, নির্দ্দিষ্ট ওজনের মুক্তি তাহা চায় না—জানে, তাহা মুক্তি নয়, বন্ধনেরই একটা নূতন ফাঁদ। ইহাও জানে যে, দেশকে যে ভালবাসে দেশ তাহারই; সেই অধিকার সুভাষচন্দ্রের মত আর কাহারও নাই, অতএব দেশ সুভাষের। সেই দেশের সম্বন্ধে অপর পক্ষের সহিত কোনরূপ বোঝাপড়া করিবার অধিকার আর কাহারও নাই। সুভাষ মরে নাই, তাহার জীবনে কোটি জীবন জাগিয়াছে। ধৃতরাষ্ট্রের সভায় শকুনির সহিত পাশাখেলার যে ফলাফল তাহাই ভারতের ভাগ্য মীমাংসা নয়। তাই আজ যখন গান্ধীধর্ম্মী কংগ্রেস একটা মহামিথ্যাকে স্বাধীনতা-নাম দিয়া, সেই স্বাধীনতা সে লাভ করিয়াছে বলিয়া, ধমক ও চীৎকারের দ্বারা সকলকে নিরস্ত করিবার আশা করিতেছে, এবং যখন সেই স্বাধীনতার সম্ভাবনা মাত্রে চতুর্দ্দিকে শিবা ও সারমেয়গণের চীৎকার, কবন্ধের নৃত্য প্রভৃতি অশিব ও দুর্ন্নিমিত্ত দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে, তখন সারাভারতকাহারপুনরাবির্ভাব-প্রত্যাশায় অধীর হইয়া উঠিয়াছে? মন্দিরে মন্দিরে কাহার মৃত্যু-জয় কামনা করিতেছে? যে কালরাত্রি এই বাংলাদেশে ঘনাইয়া উঠিয়াছে, এ দেশ একটা মহাশ্মশান বা হত্যাশালায় পরিণত হইয়াছে—আজ, শুধু আজ নয়—কালই বা তাহাকে কে বাঁচাইবে? গান্ধী-কংগ্রেস? সে ত’ জীবন-ধর্ম্মকে মানে না; সে বাঁচাইতে পারে না—মরিবার উপদেশ দেয়! তাই বাংলাদেশ আজ কাহাকে স্মরণ করিবে? মশানের শূলাসনে বসিয়াও সে কাহার মুখ মনে করিয়া মুহূর্ত্তের জন্যও যাতনা ভুলিবে? তাই আজ সে শুধুই সেই এক নাম জপ করিতেছে—নেতাজী, নেতাজী, নেতাজী।

‘নেতা’ ও ‘নেতাজী’

 সুভাষচন্দ্রকে এ নাম কে দিল? কোথায় দিয়াছে? কাহারা দিয়াছে? এ নাম কি কেহ দেয়? একি একটা পদবী—একটা খেতাব? ভারতে আজ ৪০।৫০ বৎসর ধরিয়া ‘নেতা’-নামের কি মাহাত্ম্যই রটিয়াছে। কিন্তু এ ত ‘নেতা’ নয়—‘নেতাজী’; অর্থাৎ এক অদ্বিতীয়, অবিকল্প, অন্বর্থনামা নেতা। এ নাম কেহই তাহাকে দেয় নাই, ঐ নাম লইয়া সে জন্মিয়াছে—বিধাতার স্বহস্ত-অঙ্কিত ঐ নামের তিলক-রেখা সে ললাটে ধারণ করিয়া এই জাতির মধ্যে অবতীর্ণ হইয়াছে। সে কি নেতা হইবার জন্য—নেতৃত্ব-গৌরব লাভ করিবার জন্য কখনও অধীর হইয়াছিল?—সেই চিন্তা কি সে কখনও করিয়াছে? আজ এই যে সারাদেশ তাহাকে ‘নেতাজী’ নামে ডাকিয়া নিজেরই প্রাণের আকাঙ্ক্ষা মিটাইতেছে—ইহাও কি তাহাকে চরিতার্থ করিয়াছে? উহাতেই কি সে পরমপুরুষার্থ লাভ করিয়াছে? যদি ‘নেতাজী’ নামে তাহাকে ডাকিবার অধিকার আমাদের হইয়া থাকে, তবে এমন চিন্তা যেন আমাদের মনের কোণেও স্থান না পায়—নেতাজী-চরিত্রের সেইটুকুও বুঝিবার বুদ্ধিযােগ যেন আমরা লাভ করি।

 ভারতবর্ষে কি আজ নেতার অভাব আছে? সুভাষচন্দ্র ‘নেতাজী’ হইতে পারেন, কিন্তু তিনি ত ‘নেতা’ নহেন। তৈয়ারী হয় ঐ একটি কারখানায়—সেখানকার ছাপ না থাকিলে, কেহই নেতা হইতে পারিবে না।[১]

 সুভাষচন্দ্রকে নেতাজী নামে ডাকিলে—ঘােরতর সিডিসন হয়—গান্ধীজীর অবমাননা হয়, তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়—ইহা সত্য। বাহিরের ভাবভঙ্গি দেখিয়া ভুলিলে চলিবে না, ভিতরে চাহিয়া দেখ। কংগ্রেসী নেতৃমণ্ডল সুভাষচন্দ্রকে কোন্ চক্ষে দেখে? ‘নেতাজী’ নাম তাহাদের গলায় বাধে না? ‘জয় হিন্দ্’ বলিতে তারা কি সত্যই খুশী? সত্যকে চাপা দিয়া, মিথ্যা ভাব-সুখে ভাের হইয়া থাকিলে ধর্ম্মহানি হইবে; একই মুখে ‘গান্ধীজী’ ও ‘নেতাজী’ বলা চলিবে না। হয় ‘নেতাজী’ বল, নয় ‘গান্ধীজী’ বল,—তাহাতে ত’ কোন অপরাধ হয় না; কিন্তু নেতার সহিত ‘নেতাজী’কে এক করিও না; তাহাতে একূল-ওকূল দুই কূলই হারাইবে। মিথ্যার শতরূপ আছে—সত্যের রূপ একটাই; যাহারা সেই বহুকে সেই বিপরীতকেও এক করিয়া লইতে চায়, এবং তাহাকেই মনের প্রসার ও উদারতা নাম দিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করে, তাহাদের মত মিথ্যাচারী আর কেহ নয়,—তাহাদের আত্মা অলস, সত্যকে তাহারা সহজ করিয়া লইয়াছে, তাহারা ফাঁকি দিয়া বড় হইতে চায়।

 আমি বলিয়াছি, আজিকার দিনে আমরা এই যে ‘নেতাজী’র নামে এত উল্লাস প্রকাশ করি,—ইহা শুধুই মােহ নয়, স্পষ্ট দ্বৈতাচার। গান্ধীজীর কোন দোষ নাই—তিনি একদিন স্পষ্ট ভাষায় এবং অতিশয় কঠিন ও নির্ম্মম উপায়ে সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কার করিয়া দিয়াছিলেন; সুভাষ এখনও গান্ধী-ধর্ম্মে সমান পতিত হইয়া আছেন। সেদিন সুভাষচন্দ্র যাহা নিবারণের জন্য আকুল হইয়া নিম্নের দেহটাকে পর্য্যন্ত গান্ধীজীর রােষহুতাশনে সমর্পণ করিতেকুণ্ঠিত হন নাই,[২] আজ তাহাই অপ্রতিহত প্রতাপে সমাধা হইতে চলিয়াছে। ত্রিপুরী ও রাজকোটে, দল ও দলপতি মিলিয়া, সেদিন যাহা রক্ষা করিবার জন্য সকল ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়াছিল, আজ দিল্লীতে সগৌরবে তাহারই প্রতিষ্ঠা হইতেছে। তাহা হইলে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতাজী কোথায়? ভারতের একরাষ্ট্র, জাতীয় আত্মমর্য্যাদা ও স্বাধীনতার যে অতিশয় মিথ্যা ও বিকৃত তত্ত্ব এবং ততোধিক মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাকে যাহারা আশ্রয় করিয়াছে, তাহাদের এই অপ্রতিহত প্রভাবের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের ‘নেতাজী’-নামের সার্থকতা কি? কথাটা বুঝিতে হইলে সেই ত্রিপুরীর ইতিহাস আবার ভাল করিয়া স্মরণ ও মনন করা প্রয়োজন, কারণ সেই ত্রিপুরী এখন সমগ্র ভারতে তাহার ক্ষেত্র বিস্তার করিয়াছে; যতদিন না ভারত স্বাধীন হয় ততদিন ঐ ত্রিপুরী-যুদ্ধের বিরাম নাই। যুদ্ধের রূপ ও তাহার পূর্ব্বাপর কারণ পরম্পরা এই প্রসঙ্গে একটু সবিস্তারে বিবৃত করা একান্ত কর্ত্তব্য।

পূর্ব্ব-কথা

 ১৯১৯ সালে গান্ধীজীর উদয় হয়—এক দণ্ড-কৌপীনধারী সন্ন্যাসী ভারতের মুক্তিসংগ্রামকে অভিনব পথে প্রবর্ত্তিত করিয়া ভারতের আত্মাকেই যেন আশ্বস্ত করিলেন; পথভ্রষ্ট, আত্মভ্রষ্ট ভারতবাসী এক নূতন যুদ্ধাস্ত্র লাভ করিল, দেশের কারাবরণ, মৃত্যুবরণ-ত্যাগ ও বীর্য্যের চূড়ান্ত উৎসাহ, সংগ্রামে সর্ব্বশক্তি নিয়োগের আকুল আকাঙ্ক্ষা, কিছুই বাধা পাইল না; কেবল সেই সংগ্রামের নীতি অতিশয় উচ্চ আধ্যাত্মিক নীতির আকার ধারণ করিল। ১৯২০২১ সালে গান্ধীজীর সেই নীতি ও নেতৃত্ব সারা ভারতকে এক নবজীবনের আবেগে স্পন্দিত করিতে লাগিল। গান্ধীজী তখন ধর্ম্মগুরু নহেন, বিশাল সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি—অচির-বিজয়লাভের আশ্বাসদাতা, পাঞ্চজন্যধারী জনার্দ্দন। সেই কালে, ভারতের সেই অভিনব জাগরণ-ক্ষণে, একজনের আত্মা যেমন জাগিয়াছিল, তেমন আর কাহারও জাগে নাই। তরুণ সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতালাভকে অন্তরের সহিত বিশ্বাস করিলেন, সে আর স্বপ্ন নহে— অতিশয় বাস্তব সত্য বলিয়া বিশ্বাস করলেন। তিনি গান্ধীজীর নীতিতে পূর্ণ আস্থাবান না হইলেও, তাঁহার নেতৃত্বে আশ্বস্ত হইলেন এবং বিরাট জন-জাগরণের—তথা জাতির চৈতন্যসম্পাদনের গুরুরূপে তাঁহাকে বরণ করিলেন, গান্ধী-ধর্ম্ম নয়, গান্ধী-নীতিও নয়,—তিনি গান্ধীজীকে অকপটে বিশ্বাস করিলেন। সুভাষচন্দ্র চান স্বাধীনতা; গান্ধীজী সেই স্বাধীনতালাভের জন্য যুদ্ধ করিবেন, কোনরূপ আপোষ বা রফা তিনি করিবেন না। এই আশা ও বিশ্বাসে সুভাষচন্দ্র বিরজা-হোম করিয়া সেই হোমাগ্নিতে সর্ব্বস্বার্থ আহুতি দিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ছিলেন—আজিও তিনি গৃহে ফিরেন নাই

 কিন্তু ক্রমেই তাঁহার সেই বিশ্বাস আঘাতের পর আঘাতে জর্জ্জরিত হইয়া উঠিল। গান্ধী-মন্ত্র যে একটি অব্যভিচারী সত্য মন্ত্র নয়, তাহাতেও সুবিধাবাদ ও কূটকৌশলের স্থান আছে, ইহা ক্রমেই অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল। সুভাষচন্দ্রের ভক্তি লঘুচিত্তের ভক্তি নয়, সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর পরবর্ত্তী কীর্ত্তিকলাপে ক্রমিক দুর্ব্বলতা, নিরুপায়ের উপায়উদ্ভাবন, দ্বৈধ ও সংশয় এবং নৈষ্কর্ম্য বা সংগ্রাম-বিমুখতা লক্ষ্য করিয়াও গান্ধীজীর সততা বা সত্যনিষ্ঠায় আস্থাহীন হন নাই; এমন কি, ত্রিপুরীতে গান্ধী-সৈন্যের ধর্ম্ম ও কর্ম্মের সেই স্বরূপ প্রকাশিত হইবার পরেও তিনি গান্ধীজীর প্রতি তাঁহার সেই বিশ্বাস ত্যাগ করিতে পারেন নাই; যাহারা নিজে মহৎ তাহারা মহতের অধঃপতনকেও সাময়িক ভ্রান্তি বা পদস্খলন বলিয়াই মনে করে।

 ১০।১২ বৎসরের মধ্যেই গান্ধী-নাতির আমূল পরিবর্ত্তন হইল। খেলাফতের দারুণ নির্ব্বুদ্ধিতা ও তাহার অন্তর্নিহিত অসত্যই সর্ব্বপ্রথম তাঁহার শক্তি ও নীতির শুচিতা নষ্ট করিয়াছিল। ক্রমে খাদি ও চরকাই হইল একমাত্র সংগ্রাম-কর্ম্ম এবং অহিংসা বা প্রেমের আধ্যাত্মিক তপস্যাই হইল অক্ষমতা ও আত্মসংকোচের একটি প্রকৃষ্ট আবরণ। যুদ্ধ ত্যাগ করিয়া গান্ধীজী নেতার পরিবর্ত্তে ধর্ম্মগুরুরূপে দেখা দিলেন; কিন্তু তখনও সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামের সৈন্য-সজ্জা তেমনই রহিল; পূর্ব্বে সংগ্রাম ছিল, সৈন্যও ছিল, কেবল সংগ্রামের নীতিটাই ছিল ভিন্ন—তাহা ছিল একরূপ ধর্ম্মযুদ্ধ; এখন যুদ্ধ রহিল না, তাহার সেই ধর্ম্মটাই আরও বড়, আরও গভীর হইয়া উঠিল। যে জাগরণ হইয়াছিল সংগ্রামের জন্য—তখন সেই জাগরণকে একটা অতিশয় আধ্যাত্মিক ধর্ম্মসাধনায় নিয়োজিত করিয়া জনগণকে নিশ্চিন্ত করা হইল। স্বাধীনতার কোন চিন্তা বা ভাবনা তাহারা করিবে না, তাহারা কেবল ধর্ম্মগুরুর আদেশ পালন করিবে। স্বাধীনতারূপ যে লক্ষ্য তাহার প্রতি দৃষ্টি রক্ষা করারও আবশ্যকতা নাই—সে ভার গুরুর; পাছে সংগ্রামের চিন্তা থাকে, তাই মনকে দমন করিবার জন্য, তাহারা অহিংসার মন্ত্র জপ করিবে এবং হাত-পাগুলাকে শান্ত ও সংযত রাখিবার জন্য স্থির হইয়া চরকা ঘুরাইবে। তাহা হইলেই স্বাধীনতা আপনা-আপনি আসিয়া পড়িবে। কেবল গুরুর আজ্ঞা পালন করিলেই এমন একটি অবস্থার উদ্ভব হইবে যে, ইংরেজ ভারত-রাজ্য ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইবে।[৩] উপায় ও লক্ষ্যের মধ্যে বাস্তব-সম্পর্ক কি, তাহা সাধারণ বুদ্ধির অগোচর বলিয়াই, গুরুবাক্যে অচল বিশ্বাস রাখা চাই। গান্ধীজী এখন আর নেতা নহেন, তিনি ধর্ম্মগুরু হইয়া জাগ্রত জনগণের সেই স্বাধীনতা-পিপাসাকে, তাহাদের হৃদয়-মনের সেই উৎসাহকে,—দেশপ্রেমের সেই অপূর্ব্ব উন্মাদনাকে, সাহস-শৌর্য্য পুরুষোচিত কর্ম্ম-স্পৃহাকে নির্ব্বাপিত করিয়া দিলেন। কারণ, তাঁহার ঐ ধর্ম্মোপদেশের মূল মন্ত্রই হইল-আত্ম-সংবরণ, আত্মসংকোচ বা আত্ম-সম্মোহন। ইহাতে পূর্ব্বের সেই ভাবস্রোত প্রথমে উজানে বহিল; কিন্তু ক্রমেই ধর্ম্মে ও কর্ম্মে, লক্ষ্যে ও উপায়-নির্দ্দেশে যে একটি দুর্ব্বোধ্য ব্যবধানকে মানিয়াও অস্বীকার করিতে হয়, তাহাতেই সেই বিরাট বাহিনী ভিতরে ভিতরে বিমূঢ় হইয়া উঠিল; উপরের ঠাট বজায় রহিল, কিন্তু তাহার মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরিল; সেই গান্ধীধর্ম্মের বুলি ও বেশ আত্মভ্রষ্টগণের লজ্জা নিবাবণ করিল; কংগ্রেসের তক্‌মা পরিধান করিয়া শঠতা, কাপুরুষতা, স্বার্থপরতা ও ক্ষমতা-প্রিয়তা প্রভৃতি যাবতীয় পাপ দেশময় সগর্ব্বে বিচরণ করিতে লাগিল। বলাবাহুল্য, ক্রমেই স্বাধীনতা গৌণ হইয়া উঠিল, উপলক্ষ্যই লক্ষ্যের স্থান অধিকার করিল।

 গান্ধীজীর এই নীতি-পবিবর্ত্তনের আরও কারণ আছে, ভারতের মুক্তি-সংগ্রামকেও গৌণ করিয়া, একটি নবধর্ম্ম-প্রচার এবং এই নবধর্ম্মে জগতের পাপমোচন করিবার, তথা জগতগুরু হইবার একটা আকাঙ্ক্ষা বোধ হয় ইতিমধ্যে কোন শুভ বা অশুভ লগ্নে তাঁহার অন্তরে উঁকি দিয়াছিল —তিনি বুদ্ধ ও খ্রীষ্টকেও অতিক্রম করিয়া এই মহামম্বন্তরে মানবজাতির উদ্ধারকর্ত্তা হইবেন, তাঁহার ভিতর হইতে কে যেন তাহাই বলিতেছে! তাই তিনি ভারতের মুক্তি-সংগ্রামকে অহিংসা-যুক্ত করিয়া-তাহাতেই যাহা লাভ হয় তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিয়া, সকল পার্থিব লাভালাভের উপরে ঐ অহিংসার এক মহোচ্চ বাণীকে জগত-জনের চিত্তে দৃঢ়-মুদ্রিত করাকেই, তাঁহার প্রধান ব্রত বলিয়া স্থির করিলেন। অতঃপর, ভারতবাসীর স্বাধীনতা বা রাষ্ট্রিক পুরুষার্থলাভ যে নিতান্তই ক্ষুদ্র বস্তু, ভারতবাসীকে ঐ অহিংসা-বেদীতলে যুপবদ্ধ পশুর মত কাতারে কাতারে বলি দেওয়া এবং তদ্বারা জগতের হিতার্থে ভারতবাসীর এই আত্মবলিই যে তাহার পরমপুরুষার্থ—তাহাই নানা ছন্দে নানা ভঙ্গিতে প্রচার করিতে লাগিলেন। এইজন্যই তিনি সত্যাগহ-সংগ্রামও ত্যাগ করিলেন; কারণ তাহাতে ‘চৌরিচৌরার’ ভয় আছে। অর্থাৎ তিনি জনগণকে বিশ্বাস করেন না, তাহারও অর্থ—ঐ অহিংসা-ধর্ম্ম যে মনুষ্যসাধারণের স্বভাব-বিরুদ্ধ তাহা তিনি জানেন, অথচ, ভারতবর্ষের ত্রিশকোটিকে সেই মন্ত্রে দীক্ষিত করিতে না পারিলে ঐ ধর্ম্মের গুরু হওয়া অসম্ভব। যদি সম্ভবও হয়, তজ্জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করিতে হইবে। কিন্তু উপস্থিত তাহাদিগকে কোন উপায়ে বাধিয়া রাখিতে না পারিলে তাঁহার নেতৃত্ব রক্ষা করা দুষ্কর; ঐ নেতৃত্বগৌরব না থাকিলে—ভারতের জনগণের উপরে একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত করিতে না পারিলে, জগতের অন্যান্য জাতিগণ তাঁহাকে জগৎগুরু বলিয়া মানিবে কেন? তাই ভারতবাসীর স্বাধীনতা-সংগ্রামে তাহাদের নেতৃত্ব করিয়া তিনি এককালে এ জাতির যে অতুলনীয় আনুগত্য লাভ করিয়াছিলেন তাহা এখনও রক্ষা করিবার জন্য ঐ স্বাধীনতার নামটা ত্যাগ করিলেন না, গান্ধী-কংগ্রেস সেই নামটাকে কখনও ছাড়িবে না। যদিও স্বাধীনতা-লাভের জন্য ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন আর নাই, তথাপি চরকাকে সেই যুদ্ধেরই অস্ত্র বলিয়া বারবার ঘোষণা করিতে হইবে, এবং “He (Gandhi) alone can lead us to victory”—এই কল্‌মা সকলকে পাঠ করিতে হইবে, অথাৎ, চক্ষু কর্ণ বুজিয়া গান্ধীজীর আদেশ পালন না করিলে জয়লাভ হইবে না। যে-যুদ্ধ আর নাই—সেই যুদ্ধের নামেই জনগণকে সৈন্যবৎ একতাবদ্ধভাবে গান্ধীজীর আদেশ পালন করিতে হইবে! ঐ গান্ধী-ভক্তির নামই ‘unity and discipline’; কিন্তু তাহা যুদ্ধজয়ের জন্য নহে, যুদ্ধে বিরতি এবং ইংরেজের সঙ্গে চিরসন্ধি-স্থাপনের জন্য। সেই সন্ধিস্থাপনে যে বাধা দিবে, সে যত বড় দেশপ্রেমিক, যতবড় ত্যাগী এবং যতবড় জ্ঞানী হউক, তাহাকে ছলে বলে কৌশলে অপসারিত করিতে হইবে, কারণ চরকার দ্বারা যে যুদ্ধ তাহাই প্রকৃত যুদ্ধ, এবং “He (Gandhi) alone can lead us to victory”। এই ধর্ম্ম ও কার্য্যনীতির যাহারাই বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে, তাহারাই তদ্দণ্ডে গান্ধী-কংগ্রেসের হাতে রাজনৈতিক মৃত্যুলাভ করিয়াছে।[৪]

ত্রিপুরী-তত্ত্ব

 সুভাষচন্দ্রের নিকটে ধরা পড়িয়া, ও তাঁহার মত শক্তিমান পুরুষের বিবোধিতায়, গান্ধী-কংগ্রেস ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু সুভাষচন্দ্র অটল, শুধুই অটল নয়—সততায়, সত্যনিষ্ঠায়, সৌজন্যে ও সহিষ্ণুতায়, আদর্শ-বীরের মত তিনি তাহাদের সম্মুখ দণ্ডায়মান হইলেন। পূর্ব্ব-বৎসর হরিপুরা-কংগ্রেসে তিনি রাষ্ট্রপতি হইয়াছিলেন, সেই পদ লাভ করিয়াও তিনি (জবাহরলাল প্রভৃতি সুবোধ বালকের মত) কর্ত্তৃমণ্ডলীর বশ্যতা স্বীকার করিলেন না, বরং তাহার পর এক বৎসর ধরিয়া, কংগ্রেসের ভিতরকার সংকল্প সম্বন্ধে দেশবাসীকে উচ্চকণ্ঠে সাবধান করিতে লাগিলেন—ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের সঙ্গে রফা করার বিরুদ্ধে উদ্যোগ আয়োজন করিতে লাগিলেন। ঐ হরিপুরা-কংগ্রেসে তাঁহার প্রণীত, ইংরেজ সরকারের সহিত সংগ্রাম-মূলক একটি প্রস্তাব তিনি পাস করাইয়া লইয়াছিলেন—গান্ধী-চক্র সেজন্য বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। এক্ষণে সুভাষচন্দ্র পরবর্ত্তী অধিবেশনে ঐ ‘ফেডারেশনে’র বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে বাঁধিয়া ফেলিবার জন্য সর্ব্বত্র যে প্রচার-কর্ম্ম করিতেছিলেন তাহাতে সেই গান্ধী-অধিষ্ঠিত নেতা-কোম্পানী অতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠিল জনার্দ্দন তাহাদের পক্ষে—পক্ষেই বা কেন, জনার্দ্দনই ত সব করিবেন ও করাইতেছেন; সেই জনার্দ্দনের নামে ধার্ম্মিকও ধর্ম্মত্যাগ করিবে, সত্যবাদীরা নীরব থাকিবে, এমন কি বামপন্থীরাও প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণ করিতে সাহস পাইবে না। এদিকে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হইবার জন্য দেশবাসীর সম্মতি চাহিয়াছেন, হইলে রক্ষা নাই—ফেডারেশনের গয়া প্রাপ্তি হইবে। গান্ধীজী ভিতরে ভিতরে এমন একটি ব্যক্তিকে মনোনীত করিয়াছেন যাহার মত বীর-ভক্ত আর নাই,—সেই সীতারামায়াকেই রাষ্ট্রপতিরূপে খাড়া করিয়া তাহাদ্বারা অনায়াসে কার্য্যসিদ্ধ হইবে। সুভাষচন্দ্রের নিজে রাষ্ট্রপতি হইবার কোন আকাঙ্ক্ষাই ছিল না; তিনি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে সেই গুরুতর লগ্নে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন আসন্ন) বিপথে নষ্ট হইতে দিবেন না; শীঘ্রই যে সমস্যা এবং যে সুযোগ উপস্থিত হইবে তাহার পক্ষে ঐ গান্ধী-নীতি যে কিরূপ ভয়াবহ তাহাই চিন্তা করিয়া তিনি অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলেন। গান্ধী-পাদুকাধারী কোনও পুত্তলিকার পরিবর্ত্তে যদি সর্ব্বদলের আস্থাভাজন ও উপযুক্ত কাহাকেও রাষ্ট্রপতি-পদে ববণ করা হয়, তবে তিনি সানন্দে ঐ পদ-গৌরব ত্যাগ করিবেন, ইহাও মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন। কিন্তু শোনে কে?—শুনিবেই বা কেন? ব্রিটিশ সরকারের সহিত রফা করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়, সদ্ভাবও ক্রমে বেশ জমিয়া উঠিতেছে, তরী প্রায় কূলে ভিড়িয়াছে—এমন সময়ে সেই মন্ত্রীত্ব-প্রভৃতির ‘বাড়া-ভাতে ছাই ফেলিতে’ এ কোন মহাশত্রুর আবির্ভাব! এইবার সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা হইল তাহাতে ধর্ম্মযুদ্ধের যোদ্ধাগণ অতঃপর যে নির্ল্লজ্জ হিংস্রতা ও মোরিয়া-মনোভাবের তাণ্ডব জুড়িয়া দিল, গান্ধী কংগ্রেসের ইতিহাসকে তাহা চিরদিন কলঙ্কিত করিয়া রাখিবে, ভারত-মহাসাগরের সমুদয় জলরাশি সে কলঙ্ক ক্ষালন করিতে পারিবে না। একদিন এই জাতি যখন মোহমুক্ত হইবে, তখন ঐ একটি ঘটনার বিদ্যুতালোকেই তাহারা গান্ধী-কংগ্রেসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করিয়া দারুণ লজ্জা ও দুঃখ অনুভব করিবে।

 ত্রিপুরীতে গান্ধী-সৈন্য সুভাষচন্দ্রকে অপদস্থ ও পরাস্ত করিবার জন্য কি করিয়াছিল, সুভাষচন্দ্রই বা কি অবস্থায়, কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হইয়াও সেই রণাঙ্গন ত্যাগ করেন নাই—সে কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করিব না। আমি কেবল, সেই সুভাষ-নিধন-যজ্ঞের যিনি যজ্ঞেশ্বর তিনি তখন কি করিতেছিলেন, তাহাই একটু স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করিব। সুভাষচন্দ্র যখন দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্ব্বাচিত হন, তখন মহাত্মা গান্ধী ভগ্নহৃদয়ের গভীর আক্ষেপ সহকারে বলিয়াছিলেন—“সুভাষচন্দ্রের জয়ে আমারই পরাজয় হইয়াছে”। এই উক্তি-প্রচারের অন্তরালে একটি অতিশয় ন্যায়-বিগর্হিত অভিপ্রায় ছিল; উহার দ্বারা তিনি সকল গান্ধী-ভক্ত ভারতবাসীকে জানাইতে চাহিয়াছিলেন যে, তিনি এই ব্যাপারে নির্লিপ্ত বা নির্ব্বিকার আছেন মনে করিয়া তাহারা যেন অতঃপর সুভাষের আনুকুল্য না করে। তাহার অর্থ—যদিও সুভাষের জয়লাভে ইহাই প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, অধিকাংশ দেশপ্রেমিক কংগ্রেসকর্ম্মীও দেশের সেই সঙ্কটকালে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব কামনা করে, তথাপি গান্ধীজী তাহা সহ্য করিবেন না; জনগণের বুদ্ধি ও বিশ্বাসকে তিনি কিছুমাত্র শ্রদ্ধা করেন না—তিনি তাহাদের গান্ধী-ভক্তিকেই দেশভক্তির উপরে উঠাইতে আদেশ দিলেন। গান্ধীজী তখন সতাই বড় বিচলিত হইয়াছিলেন, ভারতবাসীর মহা-মুক্তির পথে এই বিঘ্ন দূর করিবার চিন্তায় তাঁহার ধর্ম্মবুদ্ধিও বিপন্ন হইয়াছিল। ইহার পর যখন তাঁহার সেই সেনাপতিগণ ত্রিপুরীযাত্রা করিল, তখন ঠিক তাহার পূর্ব্বাহ্নে তিনি তাঁহার ধর্ম্মবুদ্ধিকে অক্ষত রাখিবার জন্য এমন একটি কার্য্য করিলেন যাহার মত বিস্ময়কর আর কিছু হইতে পারে না,— জনগণের চিত্তে এইরূপ বিস্ময় উৎপাদন করিবার শক্তিই তাঁহাকে সর্ব্বজন-বরেণ্য করিয়াছে। তিনি ঠিক সেই সময়ে রাজকোটে প্রস্থান করিয়া তথায় তনুত্যাগের জন্য যোগাসনে বসিলেন। মহাপুরুষগণের লীলা বড়ই রহস্যময়, তাহার মর্ম্ম যেমন সরল, তেমনই গভীর। এই যে ত্রিপুরীতে চন্দ্রগ্রহণ হইবার ঠিক প্রাক্‌কালে তিনি প্রায়োপবেশনে বসিলেন, ইহা কি তিনি নিজেই স্থির করিয়াছিলেন? তিনি নিজে কিছুই করেন না, ভিতর হইতে আদেশ আসে; সে যে কখন কিভাবে আসে তাহা মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর বলিয়াই ভক্তগণ যেমন বিস্মিত হয়, তেমনই ভক্তির ভাবে অবসন্ন হইয়া পড়ে। দেশটা যে হিন্দুর দেশ! একটি অতিক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্যের প্রজাগণের জন্য এই যে জীবন পর্য্যন্ত ত্যাগ করা, ইহার মহিমা তাহারা শীঘ্রই বুঝিতে পারিল। গান্ধীজী কংগ্রেসের কর্ত্তৃত্ব অনেক পূর্ব্বেই ত্যাগ করিয়াছেন, তাহা ত’ সকলেই জানে; কংগ্রেসের জন্য তিনি কিছুমাত্র চিন্তিত নহেন—সে সময়ে রাজকোটকে না বাঁচাইলে ভারতবর্ষই যে বাঁচে না!

 এ দিকে তাঁহার সেই কংগ্রেসী অনুচর—বীরভক্তগণ ত্রিপুরীতে আসিয়া যুদ্ধের পূর্ব্বরাত্রে শপথ-বাক্যে প্রচার করিতে লাগিল যে, পরদিন সভার মধ্যে তাহারা যাহা করিবে তাহাতে গান্ধীজীর সম্পূর্ণ অনুমোন আছে,—এমন কি, তাহারা টেলিফোন-যোগে তাহাঁকে সর্ব্বদা ওয়াকিবহাল রাখিয়াছে। এইরূপ বাক্যের দ্বারা তাহারা সারারাত্রি তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরিয়া সুভাষচন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিনিধিগণের ধর্ম্মবুদ্ধি জাগ্রত করিতে লাগিল; সুভাষচন্দ্রের সেই কঠিন রোগও যে একটা ভান মাত্র—সুভাষচন্দ্রকে এইরূপ কপটাচারী বলিয়া তাঁহার প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি নাশ করিবার এমন হীন চেষ্টাতেও তাহারা বিরত হয় নাই।

 ত্রিপুরীর অধিবেশনে যাহা হইয়াছিল তাহা এখনও অনেকের স্মরণ আছে, সেই দলবদ্ধ ক্রূরতা, হিংসা ও মিথ্যাচরণের বিস্তৃত বিবরণে উপস্থিত আমার প্রয়োজন নাই। আমি কেবল দুইটি বিষয়ের উল্লেখ করিব। সেই কুখ্যাত পন্থ-প্রস্তাবটির সম্বন্ধে গান্ধীজী যে কিছুই জানিতেন না—ঘটনার অনেক পরে তিনি তাহার অনুলিপি দেখিয়াছিলেন, একথা তিনি অসঙ্কোচে বলিয়াছিলেন। অর্থাৎ ত্রিপুরীতে সুভাষ-বধের জন্য তাঁহার প্রাণ-প্রিয় অনুচরগণ যাহা করিয়াছিল, তাহার বিন্দুবিসর্গ তাহারা তাঁহাকে জানিতে দেয় নাই, পাছে জানাইতে পারে সেই ভয়ে তিনি রাজকোটে গিয়া তপস্যায় মগ্ন হইয়াছিলেন। এত বড় একটা সঙ্কটকালে তাহারা গুরুর নিকটে পূর্ব্বে কোন উপদেশ বা মন্ত্রণা গ্রহণ করে নাই! অথচ, “সুভাষের জয়লাভে আমারই পরাজয়” এই উক্তির কারণ এবং পরে ঐ কার্য্য, এই দুইয়ের মধ্যে কোথায় কিরূপ যোগ আছে তাহা ভক্তিমানেরা বুঝিতে চাহিবে না, কিন্তু বুদ্ধিমানেরা না বুঝিয়া ছাড়িবে না। আর একটি কথা এই যে, ঐ ঘটনার পরে সুভাষচন্দ্র যখন গান্ধীজীর সহিত পত্রবিনিময়কালে, তাঁহার ঐ না-জানার কথায় বিস্মিত হইয়া তাঁহার অনুচরগণের সেই আচরণ সম্বন্ধে অভিযোগ করিয়াছিলেন, তখনও গান্ধীজী তাহাতে নীরব বা বধির হইয়াছিলেন। এত বড় একটা অভিযোগের তদন্তও তিনি করিলেন না, সেই অসত্যবাদী অসাধু অনুচর লইয়াই তিনি ধর্ম্মযুদ্ধ চালাইতে লাগিলেন। সত্য ও অহিংসার এত বড় ঋষি যিনি, তিনি এখনও ইহাদিগকেই বাহন করিয়া, বুকে জড়াইয়া, আশীর্ব্বাদ করিয়া, তাঁহার ধর্ম্মব্রত উদ্‌যাপন করিয়াছেন! ত্রিপুরীর পরেও, স্নেহ, দয়া ও উপদেশ-প্রার্থী, রোগশয্যাশায়ী সুভাষের প্রতি তাঁহার ব্যবহার, এবং তাহাকে সম্পূর্ণ একক ও সহায়হীন করিবার জন্য তাঁহার সেই কঠিন ও কঠোর সংঙ্কল্প হইতেই বুঝিতে পারা যায়, তিনি ত্রিপুরীর ব্যাপারে কিরূপ নির্লিপ্ত ছিলেন। তবুও গান্ধীজী মহাত্মা, এবং—“These are thy gods, O Israel!”

 উপরে ত্রিপুরীর প্রসঙ্গে যাহা বলিয়াছি তাহাতে সুভাষচন্দ্রের পক্ষে ওকালতি করা বা তাঁহার পরাজয়ের দুঃখ প্রকাশ করা আমার অভিপ্রায় নয়; সুভাষচন্দ্র যাহা করিয়াছিলেন তাহার ফলাফল বহন করিতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন।[৫] পাঠকপাঠিকাগণকে আমি কেবল ইহাই ভাবিয়া দেখিতে বলি যে, গান্ধীজীর এই যে একচ্ছত্র নেতৃত্বের অধিকার—তাহার প্রধান কারণ কি এই নয় যে, সমগ্র গান্ধী-আন্দোলনের মূলে একটা কঠোর ও বিশুদ্ধ ধর্ম্মনীতি আছে? গান্ধীজী তাঁহার সংগ্রাম হইতে রাজনীতির কূট-কৌশল, অসাধুতা ও শঠতা সম্পূর্ণ বর্জ্জন করিয়া কেবল সত্য ও সততাকেই একমাত্র অস্ত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া, দেশের রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তিগণ তাঁহার অসংখ্য ভ্রম-প্রমাদ ও যুক্তিহীন কর্ম্মপদ্ধতিকে—এমন কি, যাহাতে পরাজয় বা সর্ব্বনাশ অনিবার্য্য তাহাকেও—মানিয়া লইয়াছেন; রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে তাঁহার পারমার্থিক কার্য্য-নীতিও যদি সফল হয়, এই আশায় তাঁহার হাতে ভারতের ভাগ্য ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু যখন দেখা গেল, সেই সত্য ও সাধুতা তাহাতে নাই, মহাত্মাও লুকাচুরী খেলিতে আরম্ভ করিয়াছেন—কংগ্রেসের সম্মুখভাগে না থাকিয়া তাহার পশ্চাতে আত্মগোপন করিয়া কল-কাঠি নাড়িতে লাগিলেন; সকল দলের ঊর্দ্ধে থাকিয়া, সম্পূর্ণ অপক্ষপাত রক্ষা করিয়া, ভারতীয় জন-মনের ঐক্যবিধায়ক মহাগুরুর ভূমিকা গ্রহণ না করিয়া, তিনি ভিতরে ভিতরে একটি দল গঠন করিয়া লইলেন; মতিলাল, লাজপৎ রায়, চিত্তরঞ্জন প্রভৃতির লোকান্তর-গমনে তিনি নিঃসপত্ন হইলেন, এবং শেষে একমাত্র উদীয়মান শত্রুকে দমন করিবার জন্য নিজের সেই দলটিকে আরও দৃঢ়তর করিয়া যখন তিনি প্রকাশ্যে সেই দলীয় মনোভাব ঘােষণা করিলেন—তখন হইতে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে গান্ধীজীর ঐ পরমার্থ-নীতির মূল্য আর কি রহিল? তখন হইতে রীতিমত রাজনৈতিক কূটবুদ্ধিই কি কংগ্রেসের একমাত্র নীতি হইয়া উঠে নাই? মিথ্যাই কি সর্ব্বাঙ্গের ভূষণ হয় নাই? সেই মিথ্যাকে ঢাকিবার জন্যই কি সে আরও উচ্চৈঃস্বরে ধর্ম্মপ্রচার করিতেছে না? কাপুরুষতাকে সে বীর-ধর্ম্ম বলে, বশ্যতামূলক তােষণ-কর্ম্মকে সে সংগ্রামশীলতা বা রেভােল্যুশনারী (revolutionary) আখ্যা দান করিয়া থাকে, এবং তাহার ঐ নির্ল্লজ্জ ও উৎকট এক-প্রভুত্বকেও ডিমােক্রেসী বলিয়া জনসাধারণকে বিশ্বাস করিতে বলে। তাহার পরেও উপবাস, মৌনব্রত, এবং রাম-ভজন প্রভৃতির কোন মূল্য আছে? হইতে প্রকৃষ্ট রাজনীতির দিক দিয়াই গান্ধী-কংগ্রেসের কার্য্যাবলী বিচার করিতে হইবে না? চরকা বা অহিংসার সঙ্গে এ ভিতরকার কর্ম্মনীতি ও অভিপ্রায়-সিদ্ধির যে সম্পর্ক তাহা কি প্রবঞ্চনামূলক নয়?

 ঐ ত্রিপুরীতেই গান্ধী কংগ্রেস তাহার মুখােস খুলিয়া ফেলিল।[৬] সুভাষকে ভারতের রাজনৈতিক রণাঙ্গন হইতে একেবারে বহিষ্কার করিবার জন্য অতঃপর তাহারা যে হিংস্র প্রতিশোধপরায়ণতার পরিচয় দিল তাহাতে সুভাষচন্দ্র মর্ম্মাহত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতেও তিনি দেশ-সেবা মুহূর্ত্তের জন্যও ত্যাগ করেন নাই। বরং এই ভাবিয়া আরও অস্থির হইয়াছিলেন যে, ইতিহাসের এক অতিশয় সুমহৎ সন্ধিক্ষণে, স্বাধীনতা-লাভের একটি অপূর্ব্ব সুযোগ ঐ কংগ্রেসের ক্ষুদ্র ও হীন-নীতির ফলে ভারত বহুকালের জন্য হারাইবে; বীর্য্য ও বিশ্বাসের অভাবে সে সুনিশ্চিতকেও লাভ করিতে পারিবে না, এবং শেষে অনিবার্য্য ভাবে অধিকতর শোচনীয় অবস্থায় পতিত হইবে। ইহা তিনি —একমাত্র তিনিই—সেইকালে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিলেন। সেই অপরাধে গান্ধী-কংগ্রেস তাঁহাকে এমনই বিষ-দৃষ্টিতে দেখিল যে, কিছুকালের জন্য ব্রিটিশ প্রতিপক্ষকেও ভুলিয়া গেল—সুভাষচন্দ্রকে নিঃশেষে বিনাশ করিয়া তাঁহার ভস্মরাশি উড়াইয়া দেওয়াই তাহার একমাত্র চিন্তা হইয়া উঠিল। সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন করার জন্য বাংলার কংগ্রেসও তাহার বিষদৃষ্টিতে পড়িল —রামগড় কংগ্রেসে বাংলা হইতে প্রতিনিধি-নির্ব্বাচনে এমন নিয়ম করা হইল, যাহাতে বাংলার ভোট সেখানে কোন বাধা সৃষ্টি করিতে না পারে। ইহাও কংগ্রেসের সনাতন-রীতি—প্রতিনিধি-নির্ব্বাচনের যে কঠিন নিয়মাবলী আছে তাহাও গান্ধী-কংগ্রেসের ডিমোক্রেসীকে অতিশয় বিশুদ্ধ বা পবিত্র করিয়া তুলিয়াছে। তথাপি সুভাষচন্দ্র দমিলেন না, তিনি একাই পথে পথে সকলকে ডাকিয়া ফিরিতে লাগিলেন; ক্রমে সে পথ ‘একলা-চলা’র পথ হইয়া উঠিল,[৭] তখন তিনি বোধ হয় তাঁহার বুকের মধ্যে কেবলই শুনিতেছিলেন—

‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চল রে!
একলা চল, একলা চল,
একলা চল রে!
যদি সবাই ফিরে যায়
(ও রে, ও অভাগা!)

যদি গহন পথে যাবার কালে
কেউ না ফিরে চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে
একলা দল রে!

যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে
দুয়ার দেয় ঘরে,

তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে
একলা চল রে!

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চল রে!’

ত্রিপুরীর পরে ও আজ পর্য্যন্ত

 বেশ বুঝিতে পারা যায়, সুভাষচন্দ্র ক্রমেই হস্তপদবদ্ধ হইয়া পড়িতেছিলেন; পথ রুদ্ধ হইয়া আসিল, বড় দুয়ারগুলি সব বন্ধ হইয়া গেল।[৮] কিন্তু তবু সুভাষচন্দ্র স্থির থাকিতে পারেন না। শেষে আর কোন কাজ না পাইয়া, হলওয়েল মনুমেণ্ট-সংক্রান্ত একটা আন্দোলন সৃষ্টি করিয়া তিনি তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, এবং কারারুদ্ধ হইয়া এমন এক মানসিক অবস্থায় উপনীত হইলেন, যেমন অবস্থা পূর্ব্বে কখনও হয় নাই। তখন তিনি প্রায়োপবেশনের দ্বারা আত্মহত্যা করিতে মনস্থ করিলেন। বাংলা গভর্ণমেণ্টকে এই সংকল্প জানাইয়া তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়, তিনি ঐ কালে দেশের বর্ত্তমান সম্বন্ধে হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন, দেশের জন্য কোন সত্যকার কাজ করা অসম্ভব মনে করিয়াছিলেন। কংগ্রেসের ঐ বিরুদ্ধতাই যে তাহার কারণ সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। জীবনে তিনি যাহাকে সফল করিতে পারিলেন না, মৃত্যুর দ্বারা সেই আদর্শে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য তিনি ঐরূপ সংকল্প করিলেন। তিনি, লিখিয়াছিলেন—

 “Liſe under existing conditions is intolerable for me.···In this mortal world everything perishes and will perish—but ideas, ideals and dreams do not. One individual may die for an idea, but that idea will, after his death, incarnate itself in a thousand lives”.

 [বর্ত্তমান অবস্থায় জীবন-ধারণ আমার পক্ষে অসহ হইয়া উঠিয়াছে।···এ জগতে সকলই বিনাশশীল; কেবল উৎকৃষ্ট ভাব, উচ্চ আদর্শ ও মহতী কামনা—এ সকলের বিনাশ নাই। এইরূপ একটি তত্ত্ব-বিশ্বাসের বশে যদি একজন ব্যক্তিও জীবন বিসর্জ্জন করে, তবে তাহার মৃত্যুতে সহস্র জীবন সেই এক বিশ্বাসে উজ্জীবিত হইয়া উঠিবে]।

 উপরের ঐ কথাগুলি আজ আর কাহাকেও বিশ্বাস করাইতে হইবে না। কিন্তু, “বর্ত্তমান অবস্থায় জীবন-ধারণ আমার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে”—এই “বর্ত্তমান অবস্থা” যে কিরূপ তাহাও আমরা অনুমান করিতে পারি। একদিকে গভর্ণমেণ্ট, অপর দিকে ততোধিক প্রতিহিংসাপরায়ণ পরমাত্মীয়গণ। ইহার পর, সুভাষচন্দ্র যখন তাঁহার সেই সংঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিলেন, তখন সেই সংবাদে গান্ধী-কংগ্রেসের কিরূপ ভাবোদয় হইয়াছিল? কল্পনা করা কি দুরূহ? সেই পরমাত্মীয়গণ কি দিনের পর দিন টেলিগ্রামের আশায় উদগ্রীব হইয়াছিল না, কখন সেই মহাশত্রুনিপাতের—চির-নির্ভয়ের—বার্ত্তা সত্য হইয়া উঠে। সুভাষচন্দ্র কম দুঃখে, কম ধিক্কারে প্রাণত্যাগের সংকল্প করেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেন—“ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট ও উহাদের মিত্র, তাহার তুলনায় আমিই ঘোরতর শত্রু।” তাঁহার প্রতি গান্ধী-কংগ্রেসের এই আচরণকে তিনি Vendetta-আখ্যা দিয়াছিলেন, এবং তাহা যে “determined, ruthless and vindictive” ইহাও তিনি বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু গান্ধী-চক্রের মনস্কামনা পূর্ণ হইল না, বাংলা-গভর্ণমেণ্ট তাহাদের অপেক্ষা দয়াধর্ম্ম ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিল, তাহারা তাঁহার ঐ প্রায়োপবেশন নিবারণ করিবার জন্য তাঁহাকে কারামুক্ত করিল। ইহার পরে সুভাষচন্দ্র দেশত্যাগ করিলেন, নির্ব্বান্ধব ফকিরের বেশে তিনি তাঁহার প্রাণাপেক্ষা প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করিয়া গেলেন, আর ফিরলেন না। ফিরিলেন না বটে, কিন্তু উপরি-উদ্ধৃত তাঁহার অমর বাণী মিথ্যা হয় নাই; ভারতের বাহিরেও তিনি তাঁহার সেই Idea বা Ideal-এব জন্য মহাত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাই আজ লক্ষ নর-নারীর হৃদয়ে দিব্য দীপশিখার ন্যায় জ্বলিতেছে।

 আর কংগ্রেস কি করিতেছে? তেমনই করিয়া সে বুকে হাঁটিয়া তাহার সরীসৃপ-জীবন সার্থক করিতেছে। প্রাণ নাই, প্রেম নাই, উচ্চ আদর্শ নাই, মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগাইয়া তুলিবার বীর্য্য মন্ত্র নাই,—আছে কেবল ভিক্ষাভাণ্ড, এবং তাহারই গৌরব-বৃদ্ধির জন্য নিরন্তর ধর্ম্মোপদেশের নামে কাপুরুষতার জয়কীর্ত্তন—যাহাদের সংখ্যা এদেশে অত্যধিক, সেই ক্লীব ও নির্জ্জীব মানুষগুলাকে তাহাদের ক্লীবত্বে উৎসাহ-দান। তাহাতে যাহা লাভ হইয়াছে, এবং হইবে সে বিষয়ে সুভাষচন্দ্র সেইকালেই অব্যর্থ ভবিষ্যৎ-বাণী করিয়াছিলেন। কংগ্রেস এখনও সেই হীন নীতির কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন করে নাই; সুভাষচন্দ্র এখনও তাহার শত্রু, গান্ধী-কংগ্রেস তাঁহাকে সেই যে বর্জ্জন করিয়াছিল এখনও তেমনই করিতেছে; বরং এখন আরও নির্ল্লজ্জ ও নির্ভীকভাবে সমগ্র জাতিকে তেমনই প্রবঞ্চনা করিতেছে; সুভাষচন্দ্র যদি আজ উপস্থিত থাকিতেন, তবে গান্ধী-কংগ্রেসের প্রতি তাঁহার যেটুকু শ্রদ্ধা ও অবশিষ্ট ছিল তাহাও লুপ্ত হইত।

 এ প্রসঙ্গ প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। আমি বলিতেছিলাম―সুভাষচন্দ্রকে ‘নেতাজী’ নামে আমরা যে এমন আকুল হইয়া সম্বোধন করি, তাহা কি আমাদের পক্ষেও একটা আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? সেই গান্ধী ও গান্ধী-চক্র এখনও পূর্ণবিক্রমে তাহাদের সেই নেতৃত্বকে —সেই ত্রিপুরী-অভিযানকে জয়যুক্ত করিতেছে। তাহাতে সুভাষচন্ত্রের নামে গৌরব করিবার কি আছে? সেই প্রেম, সেই ত্যাগ, সেই দিব্যদৃষ্টি ও সেই সত্যনিষ্ঠা যদি এমনই ভাবে ব্যর্থ হয়, তবে সুভাষচন্দ্রের অমর আত্মার যাতনাও কি অমর হইয়া থাকিবে না? সেই অবস্থাতেও যদি আমরা তাঁহাকে ‘নেতাজী’ বলিয়া সম্বোধন করি, তবে তাহা কি সেই পুরুষের পক্ষে একটা মর্ম্মান্তিক পরিহাস নহে? দেশের অধীনতামোচন যে-মহাজীবনের একমাত্র সাধনা—যে নেতা না হইয়া ক্ষুদ্রতম সেবক ভৃত্য হইতেও অসম্মত নয়, যদি দেশ তাহার সেই সেবার দ্বারা স্বাধীন হয়,—তাহাকে এই পরাধীন জাতির ‘নেতাজী’ বলিয়া যতই আমরা সম্মান করি না কেন, তাহাতে সে কি চরিতার্থ হইবে? তাহার তো নেতা হইয়া দেশবাসীর উপর প্রভুত্ব করিবার—ইংরেজ-সরকারের নিকটে কিঞ্চিৎ ক্ষমতা লাভ করিয়া, এবং তাহারই দোসর হইয়া,[৯] এই দুঃখী মানুষগুলাকে দমন শাসন করিবার প্রবৃত্তি কখন ছিল না। যাহারা দেশকে স্বাধীন করিবার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করিবে—সত্য সতাই সর্বস্বপণ করিয়া মৃত্যুবরণ করিবে, মান গৌরব প্রতিপত্তি কিছুরই আশা বা কামনা করিবে না—সে তাহাদেরই ‘নেতাজী’ অর্থাৎ—‘অগ্রণী’। ইহাই যদি আমরা না বুঝিলাম, তবে তাঁহাকে ঐ নামে ডাকিয়া তাঁহার অসম্মান করি কেন?

 গান্ধী-কংগ্রেস ইতিমধ্যেই সুভাষচন্দ্রের স্মৃতির প্রতিও তাহাদের সেই পুরাতন বৈর-মনোভাব আর ঢাকিয়া রাখিতে পারতেছে না। আজাদ-হিন্দ্-ফৌজ ও নেতাজীর প্রতি ভারতবাসীর সেই উদ্বেল ভক্তিকে কংগ্রেস একটা দুঃসময়ে বড় কাজে লাগাইয়াছিল, এখন সে প্রয়োজন আর নাই। সে এমন আশাও করিয়াছিল যে, ভারতবাসীর সেই সুভাষ-প্রীতি কংগ্রেস-ভক্তিতেই পরিণত হইবে—গান্ধীর পদতলে উপবিষ্ট ভক্তশিষ্যের মূর্ত্তিতেই সুভাষচন্দ্র পূজা পাইবেন; তাহার জন্য দুই একটা বুদ্ধির কাজও সে করিয়াছিল। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হইবে না দেখিয়া গান্ধী-কংগ্রেস পূর্ব্বের মতই সুভাষের নামে শঙ্কিত এবং কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। দিল্লীর মসনদে চড়িয়া যে মহাবীর আবুহোসেনের অভিনয় করিতেছেন, তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না—সুভাষচন্দ্র যে মরিয়া ভূত হইয়া গিয়াছেন, এই অতিশয় সত্য ও শুভ বাণী তিনি কম্বুকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন। ইহার কি প্রয়োজন ছিল? সুভাষচন্দ্র না বাঁচিয়াও বাঁচিয়া আছেন—সে বাঁচিয়া-থাকা কি তুমি রোধ করিতে পারিবে? তুমি কি ইহাই বুঝিয়া ভয় পাইয়াছ যে, যতদিন ভারতবাসী জনগণ সুভাষের আশায় পথ চাহিয়া থাকিবে, ততদিন তোমাদেরই বিপদ? কিন্তু তাহারা ঐ মিথ্যা আশা ত্যাগ করে না কেন, তাহা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ? তোমার ঐ কংগ্রেসকে মুখে, এমন কি মনেও যতই তাহারা বিশাস করুক, অন্তরে তাহার উপরে কোন ভরসাই নাই। তোমার কংগ্রেস তাহা বুঝিবে না। জনগণকে ধমক দিয়া, অথবা ধর্ম্মোপদেশের ভাঁওতা দিয়া, এতদিন তাহাদের ইহকাল পরকাল সে নষ্ট করিয়াছে; সে কখনও তাহাদের হৃদয়কে, প্রাণকে গ্রাহ্য করে নাই, বরং তাহাদের সেই হৃদয়কে-মনুষ্যসুলভ আশা-বিশ্বাস ব্যথা-বেদনাকে—দমন বা উচ্ছেদ করিয়া সে তাহার নেতৃত্বের ধর্ম্ম-ধ্বজা উড়াইয়াছে। সে তাহাকে কি দিয়াছে? দুঃখ দূর করা পরের কথা, সে তাহাকে অসীম দুঃখ ভোগ করাইয়াছে, অসংখ্য কঙ্কালরাশির উপরে তাহার গণপতিত্বের আসন উচ্চ হইতে উচ্চে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। মুখের বুলি দিয়া তুমি ত’ তাহার বুকের সেই হাহাকার রুদ্ধ করিতে পারিবে না। তাহারা ঐ মিথ্যা আশা ত্যাগ করিতে পারে না কেন? এক্ষণে ভাবতবাসীর মনের অবস্থা—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষে’র সেই কুন্দনন্দিনীর মত যে—পিতা ছাড়া তাহার আর কেহ নাই,সেই পিতার মৃত্যু-শিয়রে সে বসিয়া আছে; গভীর রাত্রে ও জনহীন কক্ষে পিতার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল; তখনও সেই ক্ষীণ দীপালােকে সে তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া আছে—পিতার মৃত্যু হইয়াছে এ বিশ্বাস সে কিছুতে করিবে না, কারণ তাহার যে আর কেহ নাই। এমন সর্ব্বনাশ কি হইতে পারে। তাই কুন্দনন্দিনী তাহার মৃত পিতাকেও, যতক্ষণ পারে জীবিত মনে করিয়া সেই মহাভয় দূর করিতে চায়। সুভাষচন্দ্র জীবিত কি মৃত—সে বিশ্বাস ভারতবাসীর পক্ষেও তেমনই; তাহার যে আর কেহ নাই! তুমি হুঙ্কার করিলে কি হইবে?

 শুধু তাহাই নয়, আজাদ-হিন্দ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান-উৎসব প্রভৃতি কংগ্রেসের চক্ষুঃশূল হইয়াছে, পাছে মিত্র-পক্ষ অসন্তুষ্ট হন, তাই যাহারা বিদ্রোহী সুভাষের পক্ষ তাহাদের কার্য্যকলাপ বে-আইনী হইয়া থাকিবে। ত্রিপুরীর পরে সুভাষচন্দ্রের সকল কার্য্যে উহারা এইরূপ হুকুম জারী করিত। তবু এখনও মুখােস সম্পূর্ণ ত্যাগ করে নাই, এখনও ‘জয় হিন্দ্’ বলিতে বাধ্য হয়, এখনও ‘নেতাজী’কে প্রকাশ্যে অস্বীকার করিতে সাহস পায় না।

কংগ্রেসের নীতি ও নেতৃত্ব

 নেতাজীর নেতৃত্ব কংগ্রেস কখনও মানে নাই, মানিবে না, মানিতে দিবে না। তাহারা বলে, নেতাজীর পন্থা শুধুই ভুল নয় —উহা ধর্ম্মবিরুদ্ধ। ভুল কি ঠিক, তাহাও বড় কথা নয়, আসলে উহা হিংসাকলুষিত; অতএব ঐ পথে ভারতের স্বাধীনতালাভ হইলেও তাহা গ্রাহ্য নহে, কারণ সেই স্বাধীনতা-রক্ষাও সংগ্রাম-সাপেক্ষ, অর্থাৎ হিংসামূলক। তাহাতে জগতের উপকার হইবে না, ইতিহাসের ধারা পরিবর্ত্তিত হইবে না—মানব-সমাজে সংগ্রামের অবসান হইবে না, জগতে চিরশান্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে না। এই অতি উচ্চ ধর্ম্মধ্বজিতার জবাব দিবার অবকাশ এখানে নাই; পৃথিবীর ইতিহাস যাহারা কিছুমাত্র অবগত আছে—সৃষ্টির নিয়ম, মানুষের জীবন, তথা পার্থিব কল্যাণ-অকল্যাণ ও তদ্‌ঘটিত শাশ্বত বিধান যাহারা চিন্তা করিতে পারে, তাহারাই জানে যে, ঐ গান্ধী-ধর্ম্ম-নামক তত্ত্ববাদ যেমন নূতন নহে, তেমনই উহার অন্তর্গত প্রেরণা ও যুক্তি দুই ই একরূপ দুরারোগ্য ব্যাধির লক্ষণ। এ ব্যাধি ভারতবর্ষে আরও পুরাতন, এবং উহারই বিস্তার ও প্রচ্ছন্ন প্রকোপে ভারতের আজ এই মুমূর্ষু অবস্থা। সে আলোচনা এখানে অবান্তর। আমি কেবল ইহাই বলিতেছি যে, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম যদি মুখ্যত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হয়, অর্থাৎ বিরুদ্ধ রাজশক্তির হস্ত হইতে স্বাধীনতা-উদ্ধারের চেষ্টা হয়, তবে সেই সংগ্রামে কংগ্রেস যে পন্থা অবলম্বন করিয়াছে তাহাতে সত্যকার নেতৃত্ব গুণের কোন্ পরিচয় আছে? জনগণকে ভক্তিবিমূঢ় করিয়া একরূপ একতাবদ্ধ করা—তাহাদিগকে অবোধ অজ্ঞ শিশুর মত করিয়া রাখা, এবং জন-মনের উপরে সেই প্রভাবটাকেই প্রতি পক্ষের আশঙ্কাজনক করিয়া তোলা—ইহার বেশি কিছু সে করিয়াছে? সেই আশঙ্কাবৃদ্ধি ছাড়া সে আর কিছুই করে নাই, করিবার সামর্থ্যও তাহার নাই। প্রতিপক্ষও তাহা জানে, এবং তাহার সেই নিস্ক্রিয়তার সুযোগে সে সর্ব্ববিধ সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছে,—এমন করিয়া আট-ঘাট বাঁধিয়া লইয়াছে যে, সেই আশঙ্কাও সে আর করে না, অতিশয় বর্ত্তমানে সেই সত্য আরও প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। আজ গান্ধী-কংগ্রেস যে জয়লাভের গর্ব্ব করিতেছে তাহার মত মিথ্যা, শোকাবহ ও লজ্জাকর কিছু আছে? নেতৃত্বের প্রমাণ কেবল ক্রমাগত কতকগুলা পরীক্ষামূলক কর্ম্মপদ্ধতি-প্রণয়ন করাতেও নয়, অথবা সর্ব্বপ্রকার সংঘর্ষ এড়াইয়া, গা বাঁচাইয়া, কেবল আপোষ-নিষ্পত্তির আশায় বসিয়া থাকা, কিম্বা অভিমান বা বীরত্ব করিয়া জেলে যাওয়াতেও নয়। এ যেন নিথর নিষ্কম্প জলে টোপের পর টোপ ফেলিয়া ছিপ হাতে বসিয়া থাকা; শেষ পর্যন্ত একটি পুঁটিমাছ ধরিতে পারিলেও তাহাতেই ধন্য বোধ করা। পাছে সেইরূপ বসিয়া-থাকাকে এবং ঐরূপ পুঁটিমৎস্যকে কেহ শ্রদ্ধার চক্ষে না দেখে, সেজন্য ক্রমাগত শ্রীমদ্‌ভাগবত-পাঠ এবং নানাবিধ ধর্ম্মোপদেশ ও ভজনগানের দ্বারা জনগণকে সম্মোহিত করাই নেতৃত্বের অপর একটি গুরুতর কর্ম্ম, স্বাধীনতার নামে একটি মাকাল-ফল মূল্যবান্ হইয়া উঠিয়াছে, তাহাই লাভ করিয়া কৃতার্থ হইতে হইবে। ঐরূপ স্বাধীনতা লাভে দেহ ও আত্মাকে প্রস্তুত করিবার যে সকল নির্দ্দেশ দেওয়া হইতেছে তাহা শুনিলে প্রকৃতিস্থ মানুষও অপ্রকৃতিস্থ হইয়া পড়ে। কিন্তু যেহেতু গান্ধীজী এ-জাতির নাড়ী বহু পূর্ব্বেই ঠাণ্ডা করিয়া ফেলিয়াছেন, তাই কেহ আর চমকিত বা স্তম্ভিত হয় না। ইহার পরে স্বাধীনতার কথাও কেহ মনে আনিবে না,—বড় বড় পণ্ডিতেরা ইতিমধ্যেই গান্ধী-প্রণীত অপূর্ব্ব ‘পরিকল্পনা’র ভাষ্য-রচনায় লাগিয়া গিয়াছেন; কারণ, তাহার প্রকৃত অর্থবোধের উপরেই নাকি ভারতের চরম সৌভাগ্য নির্ভর করিতেছে; স্বাধীনতা-লাভ না হইলেও, উহার দ্বারাই চতুর্ব্বর্গ-লাভ হইবে। দেশের অবস্থা এখনই এমন হইয়া উঠিল কেন?—ঔ পরিকল্পনায় ইহার প্রতিষেধ-চিন্তা আছে কি? বাংলাদেশের যে অবস্থা হইয়াছে, সারা ভারতের আসন্ন অবস্থা তাহা হইতেই অনুমেয় “ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে”, কিন্তু গান্ধীজীর মোহিনীশক্তি এমনই যে, ঘুঁটেও হাসিতেছে।

 কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। গান্ধী-কংগ্রেসের নীতি ও নেতৃত্ব সেই রামগড়-কংগ্রেসেই—তাহার সেই সুভাষ-বিজয় অধিবেশনে—পরম গৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল, দুইট প্রস্তাবেই তাহার জৌলুসের অবধি রহিল না। প্রথম প্রস্তাবটি এইরূপ—

 The Working Committee will continue to explore all means of arriving at an honourable settlement, even though the British Government has banged the door in the face of the Congress.

 [ভাবার্থ—দুরন্ত ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট আমাদিগের সহিত যতই অসম্মানসূচক ব্যবহার করুক না কেন (মুখের উপর সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেও) আমরা তাহাদের নিকট হইতে সম্মান আদায় করিবার জন্য শান্তভাবে সর্ব্ববিধ উপায় অম্বেষণ করিব।]

 সুভাষচন্দ্র ইহার অর্থ করিয়াছিলেন—we shall lick the feet of the British Government even though we have been kicked by them”।— সুভাষচন্দ্রের কি নিষ্ঠুর অভদ্রতা!

 দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আরও আধ্যাত্মিক, আরও সাত্ত্বিকভাবাপন্ন—

 The Working Committee desire to make it clear that the true test of preparedness for Civil Disobedience lies in Congressmen themselves spinning and promoting the cause of Khadi...and individual Congressmen seeking an occasion for fraternising with Harijans as often as possible, and deeming it their duty to establish harmony between the communities.

 [ইংরেজী ভাষার আব্রু খুলিয়া লইলে ইহার রূপটি বড়ই মনোহর হইয়া উঠে, যথা—“সত্যাগ্রহ বড়ই ভীষণ যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে হইলে কংগ্রেসের দৃঢ় আদেশ এই যে, কংগ্রেস-সেনাবৃন্দ অনবরত চরকায় সূতা কাটিবে, এবং সর্ব্বত্র খাদির জয় (জাতীয় সঙ্গীত) গাহিবে; আরও, প্রত্যেক কংগ্রেস-মনুষ্য, দিনের মধ্যে যতবার সম্ভব, হরিজনদের পাড়ায় গিয়া তাহাদের সহিত প্রেমপূর্ণ কোলাকুলি করিবে, পথেঘাটেও ঐরূপ করিবার সুযোগ সন্ধান করিবে। এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সহিত ‘হার-মানা’-(harmony)-সম্বন্ধ স্থাপন করাকে একটি আবশ্যিক কার্য্য বলিয়া গণ্য করিবে।]

 সুভাষচন্দ্র মন্তব্য করিয়াছিলেন—“A wonderful plea for preparing the Country for direct action..... There is no appeal to one's higher self which can send a thrill through his nerves and steel him for suffering and persecution” অর্থাৎ, “প্রত্যক্ষ সংগ্রামে প্রবৃত্ত করিবার কি চমৎকার আবেদন।.....এ সকলের মধ্যে মানুষের মহত্তর প্রাণকে উদ্বুদ্ধ করিবার কিছুই নাই, যাহাতে তাহার স্নায়ুশিরায় বিদ্যুৎ-চেতনা সঞ্চারিত হয়—চরম নিগ্রহ ও দুঃখকষ্টকে বরণ করিবার জন্য সে লোহার মত কঠিন হইতে পারে, এমন প্রেরণা নাই।[১০]

 ইহা অতিশয় সত্য। মানুষকে জাগাইবার মন্ত্র উহা নয়— উহা ঘুম পাড়াইবার মন্ত্র। ঐ কর্ম্মও মানুষকে যন্ত্রের মত প্রাণহীন করিয়া তোলে, ঐ প্রেমচর্চ্চাও একটা ভণ্ডামী হইয়া উঠে। শুধু তাহাই নয়, ঐ চরকায়-সূতা-কাটার মত পুরুষের পুরুষত্ব-নাশক মহৌষধ আর নাই, মানুষকে অলস করিবার—এবং সেই হেতু তাহার চিত্তে নানা কুবুদ্ধি উদ্রেক করিবার, এমন উপায় আর নাই। সর্ব্বদা বিপদের মুখে ছুটিয়া যাওয়া, আগুনে ঝাঁপাইয়া পড়া, অত্যাচার নিবারণে অস্থির হইয়া উঠা, পরের প্রাণবক্ষার জন্য নিজ-প্রাণ বিপন্ন করিয়া শত্রুর উপরে পতিত হওয়া—এক কথায় দেহ-মন-প্রাণকে সর্ব্বদা একটা উচ্চ ভাব ও উচ্চ লক্ষ্যে নিযুক্ত বাখিলেই মানুষের মনুষ্যত্ব জাগিয়া উঠে, তাহার বক্ষে-বাহুতে সেই বীর্য্য সঞ্চারিত ও সঞ্চিত হয় যাহা বৃহত্তর যুদ্ধে তাহাকে জয়ী করিতে পারে। কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে সে যদি কেবল চরকায় সূতা কাটে, তবে তাহার মনও ভিতরে ভিতরে যতপ্রকার দুষ্টচিন্তার সূতা কাটিতে থাকিবে, সৎ প্রবৃত্তির পরিবর্ত্তে অসৎ প্রবৃত্তিই জাগিবে (আমি সাধারণ মানুষের কথাই বলিতেছি); সে তখন গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেসের ভক্ত হইয়া সেই ভক্তির বশে, হয় ‘নেতা’, নয় ‘সম্পাদক’, নয় ‘রিলিফ কমিটি’র অধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে, অথবা নানাবিধ ব্যবসায়ে লায়েক হইয়া উঠিবে; ভক্তি যদি আরও গভীর ও নির্জ্জলা হয় তাহা হইলে গো-পালন ও খাদি-বয়নের দ্বারা দেশোদ্ধারের চুড়ান্ত করিয়া ছাড়িবে। গান্ধী-ধর্ম্মের দোহাই দিয়া অতি চতুর সুবিধাবাদীর দল আজ কি না করিতেছে! আর ঐ হরিজন-সেবা এবং সাম্প্রদায়িক প্রেম-সাধনা—তাহার দাপটে প্রাণরক্ষা করাই দায় হইয়া উঠিয়াছে।

 তথাপি সুভাষচন্দ্র ঐ কংগ্রেসকে কি চক্ষে দেখিতেন, গান্ধীজীকেও তিনি শেষ পর্য্যন্ত কিরূপ শ্রদ্ধা করিতেন, তাহার প্রমাণ, কংগ্রেসের সহিত বিরোধ সত্ত্বেও, প্রতি কথায় ও কাজে দিয়াছেন। কুরুক্ষেত্রে অর্জ্জুন যেমন ভীষ্মের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন গান্ধীজীর সহিত সুভাষচন্দ্রের ব্যবহারও তেমনই; এবং কংগ্রেসকে তিনি কোন একটি চক্রের নিজস্ব সম্পত্তি বলিয়া মনে করিতেন না বলিয়া, কখনও তাহাকে ত্যাগ করেন নাই। ঐ কংগ্রেস সারা ভারতের সকল স্বাধীনতাকামী জাগ্রত জনগণের প্রতিনিধি, দেশসেবায় যাহার অধিকার আছে কংগ্রেস তাহারই; ঐ কংগ্রেসই নেতৃত্ব করিবে—জনগণের স্বাধীনতাপিপাসাকে কর্ম্মের ভিতর দিয়া রূপ দিবে; সকল মতবিরোধ সহ্য করিয়া বিরোধের সমন্বয় করিবে; যাহা ন্যায়ধর্ম্ম ও বুদ্ধিসম্মত—অধিকাংশের স্বাধীন সম্মতিক্রমে (ছলে বলে কৌশলে একটা মেজরিটি খাড়া করিয়া নয়) অতিশয় অপক্ষপাতে তাহাই আচরণ করিবে; এবং সেই সকলের মূলে থাকিবে এক অবিচলিত ও একাগ্র উদ্দেশ্য—পূর্ণ-স্বাধীনতালাভ। এই নেতৃত্ব কংগ্রেসই করিবে। তিনি ত্রিপুরীর পরেও গান্ধীজীর পায়ে ধরিয়া কংগ্রেসের এই ধর্ম্ম বজায় রাখিতে বলিয়াছিলেন, সেই সময়ে গান্ধীজীকে লিখিত তাঁহার পত্রাবলীতেও তাঁহার প্রাণের সেই আকুল কামনা ব্যক্ত হইয়াছে। কংগ্রেসের সহিত যুদ্ধ করিবার কারণ তিনি নিজেই অন্যত্র এইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন—

 “The Congress is essentially and fundamentally au organisation which stands for complete independence, and the method it has adopted is that of non-cooperation and Satyagraha. If a Congressman abandons these essentials and fundamentals he automatically ceases to be a Congressman. And if the Congress tomorrow gives up its fundamental objective and method it will cease to be the Indian National Congress with which we have been familiar since 1920. With the voluntary withdrawal or expulsion from the Congress of the compromise-wallahs the Congress will be restored to its former status, and become once again the revolutionary organisation that it always should be.”

 [ভাবার্থ:—অসহযােগ ও সত্যাগ্রহই কংগ্রেসের মূল কর্ম্মনীতি, এবং পূর্ণ-স্বাধীনতা লাভই তাহার লক্ষ্য। এই নীতি লঙ্ঘন করিয়া যাহারা আপােষ-রফার দ্বারা সেই লক্ষ্যকে অক্ষুন্ন রাখিতে চায় তাহদিগকে কংগ্রেস হইতে বহিষ্কার করিয়া দিলেই কংগ্রেস তাহার পূর্ব্ব মর্য্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইবে— সে আবার পূর্ব্বের মতই একটি সংগ্রামশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হইতে পারিবে।]

‘নেতাজী’-নামের সার্থকতা

 সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব কামনা কিরূপ এবং কি হেতু, তাহা উপরিউদ্ধৃত বাক্যগুলি হইতেই বুঝিতে পারা যাইবে। ইহা নেতৃত্ব-লালসা নয়—নেতৃত্বের সংশােধন-কামনা। ইহার পর দেশের বাহিরে গিয়া তিনি যে নেতৃ-গুণের পরিচয় দিয়াছিলেন সে ইতিহাস লিখিবার সময় এখনও হয় নাই—বিক্ষিপ্ত উপাদান এখনও সম্পূর্ণ সংগৃহীত হয় নাই। তথাপি একটি ঘটনায় তাঁহার নেতৃত্বপ্রতিভার যে পরিচয় নিঃসংশয় হইয়া উঠিয়াছে, এখানে কেবল তাহারই উল্লেখ করিব। গান্ধী-কংগ্রেসের নীতিকে তিনি যে শ্রদ্ধা করিতে পারেন নাই তাহার কারণ, ঐ নীতি যে অতিশয় ভ্রান্ত সে সম্বন্ধে ক্রমেই তিনি নিঃসংশয় হইয়াছিলেন। গান্ধীজী প্রথম হইতেই ভারতের হিন্দু-মুসলমান-সমস্যাকে সেই গুরুত্ব দিয়াছিলেন যাহা ব্রিটিশ-সরকারের পক্ষেই অতিশয় সুবিধাজনক; গান্ধী-কংগ্রেস সেই সমস্যাকে ভয় করিয়াই তাহাব শক্তি ও দুর্লঙ্ঘ্যতা এমনই বৃদ্ধি করিল যে, অবশেষে তাহাই টর্পেডো-রূপ ধারণ করিয়া কংগ্রেসের সুবৃহৎ রণতরীকে জলমগ্ন করিয়াছে। সুভাষচন্দ্র তাহার ঐ নীতিতে যেমন বিরক্ত তেমনই অধীর হইয়া উঠিয়াছিলেন। কংগ্রেস সেই সমস্যার সমাধান করিবে আপোস করিয়া,—অথচ একটি দুর্দ্ধর্ষ তৃতীয় পক্ষ তাহাই হইতে দিবে না। আপোস না করিয়াই বা কি করবে? তাহার যে সেই প্রাণশক্তি নাই, সেই প্রেম—প্রমের সেই দূর্ব্বার একীকরণ-শক্তি নাই, যাহার বলে এই বিরাট ও বহু-বিভক্ত জাতিকে এক মহাজাতিতে পরিণত করা যায়। নাই বলিয়াই সে সর্ব্বদা ভয়ে অস্থির; সে ইংরেজকে ভয় করে, মুসলিম-লীগকে ভয় করে, সুভাষকে ও হিন্দু-মহাসভাকে ভয় করে; সে জনগণকেও অবিশ্বাস করে। তবু নেতৃত্ব চাই, কাজেই আপোস ভিন্ন উপায় কি? আজ সেই অপোস-নীতির পরিণাম প্রকট হইয়া উঠিয়াছে—এখন তাহার অবস্থা হইয়াছে— ‘সাপের ছুঁচো-গেলা’র মত। পাকিস্থান সে কার্য্যতঃ পুরাপুরি মানিয়া লইয়াছে, এবং হিন্দুস্থানেও সে কর্ত্তাদের বাহন হইয়া লাগাম ও চাবুকের আঘাত যতদূর সম্ভব গা-সহা করিয়া লইবার চেষ্টা করিতেছে;[১১] যদি তাহাও না পারে, তবে এবার সে একূল-ওকূল দুই কূলই হারাইবে। সেই খেলাফৎ-আন্দোলনের সময়েই গান্ধীজী যে দ্বিধা ও দুর্ব্বলতা, এমন কি রাজনৈতিক বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়াছিনে তাহাতে সেকালের প্রবীণ রাজনীতি-বিদ্, পূর্ব্বতন নেতাগণ, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া নিরতিশয় শঙ্কিত হইযাছিলেন, কিন্তু অসহযোগ ও সত্যাগ্রহের নূতন মন্ত্র এবং তাহার ফলে সেই অভূতপূর্ব্ব জন-জাগরণ তাঁহাদিগকে স্তব্ধ করিয়া দিল—সমস্যা-সমাধান বা আশু পরিত্রাণের কোন উপায় ত’ তাঁহারাও নির্দ্দেশ করিতে পারেন নাই, জনগণকে চালনা কবার শক্তিও অর্জ্জন করেন নাই। অতএব সেই নীতির উপরেই নির্ভর করিয়া গান্ধীজী অপ্রতিহত প্রভাবে নেতৃত্ব করিতে লাগিলেন, অর্থাৎ ভারতের ভাগ্যতরণীকে সুনিশ্চিত বিনাশের দিকে চালনা করিতে লাগিলেন। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে মুসলিম-লীগ যে একটা ভয়ানক বাধা, উহাদের সাহায্য না পাইলে ভারতের ত্রিশ কোটি হিন্দু যে নিতান্তই অসহায়; হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যস্থাপন আগে, পরে স্বাধীনতা-সংগ্রাম—ইহাই হইল তাঁহার একমাত্র বুলি। বিলাতের গোল-টেবিল বৈঠকে ইহাই স্বীকার করিয়া তিনি জগতের সমক্ষে ইংরেজের কথারই সমর্থন করিলেন—ঐ বিরোধটাই যে ভারতকে স্বাধীনতা-দানের ঘোরতর অন্তরায়, এতবড় সত্যসন্ধ ধার্ম্মিক নেতার মুখে তাহা ব্যক্ত হওয়ায়, ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের মতলব-সাধন অতিশয় সহজ, এমন কি সততাযুক্ত হইয়া উঠিল। পরে গান্ধীজী ক্রমান্বয়ে এমন সকল কার্য্য করিতে লাগিলেন যে ঐ বাধা উত্তরোত্তর দুর্ল্লঙ্ঘ্য হইয়া উঠিল, এবং উহারই কারণে, শেষে ব্রিটিশ সরকারের হস্তে বিষম পরাজয় স্বীকার করিয়া গান্ধী-কংগ্রেস আজ মরাণাপন্ন। গান্ধীজীর নেতৃত্ব ওই একটি বাধাকে জয় করিতে না পারিয়া ক্রমশ অন্তঃশক্তিহীন, অসরল ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়াছে। ঐ আপোস-নীতিই তাহার সর্ব্বনাশের কারণ। যে এক চোখ সর্ব্বদা ইংরেজশাসক-সম্প্রদায়ের দিকে পাতিয়া রাখিয়াছে, যে সত্যই পূর্ণ-স্বাধীনতা কামনা করে না, এবং সেই সর্ব্বস্বপণ করিয়া সংগ্রামে অবর্তীণ হইবে না, যে কেবল একটা দলগত নেতৃত্ব-রক্ষার জন্যই অধীর— জন-জাগরণের পরিবর্ত্তে জন-সম্মোহনই যাহার কাম্য, যে একটা অতিশয় বিশিষ্ট ধর্ম্মমতকেও আপামর সাধারণের উপরে চাপাইয়া, রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতার নামে আধ্যাত্মিক পরাধীনতা—একটা অভিনব ধর্ম্মের শাসন—বিস্তার করিতে চায়, তাহাকে অপর কোন সম্প্রদায় বিশ্বাস করিবে কেন? ইহাও একরূপ exploitaion বা পরের দ্বারা নিজের স্বার্থসাধন, এমন করিয়া মানুষকে জাগানো যায় না—মানুষে মানুষে বিরোধ দূর করিয়া এক বিশাল মুক্ত-স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থাপনাও সম্ভব নয়। তাহা কেমন করিয়া সম্ভব? নেতাজী সুভাষচন্দ্রই তাহা প্রথম হইতে বুঝিয়াছিলেন, কিন্তু ঐ কংগ্রেসকে কিছুতেই বুঝাইতে পারেন নাই—সেই দিব্যদৃষ্টির জন্য যে মহাপ্রাণতার প্রয়োজন তাহা একমাত্র ঐ একটি পুরুষেরই ছিল। তিনি ঐ সমস্যার জন্য কিছুমাত্র উদ্বিগ্ন হন নাই; তিনি জানিতেন যে, ভারতবাসীকে সর্ব্বস্বপণের জন্য আহ্বান করিয়া সংগ্রামে নিযুক্ত করিলেই সকল বিবোধ সকল ভেদ আপনিই মিলাইয়া যাইবে; বদ্ধজলেই রোগ-বীজাণু বৃদ্ধি পায়, প্রবল স্রোত বহাইতে পারিলে সে সকল আপনিই নষ্ট হয়। তিনি বিশ্বাস করিতেন—

 “When the bugle is sounded, all those who hunger for freedom will naturally fall in line and resume freedom's march, regardless of their religious faith and denomination....When people become “comrades-in arms” in the struggle for liberty, a new espirit d' corps will develop— and along with it a new outlook, a new perspective, a new vision.... It will then be easy for them to solve many of the questions which today appear difficult to solve.”

 [ভাবার্থ:—যাহারা স্বাধীনতা লাভের জন্য আকুল হইয়াছে, যুদ্ধের ডাক শুনিলেই তাহারা জাতি-ধর্ম্ম-ভেদ ভুলিয়া পরস্পরের পাশে আসিয়া দাঁড়াইবে; যুদ্ধযাত্রাকালে সেনাবাহিনীর মধ্যে সকল ব্যবধান লোপ পায়। ....কারণ যাহারা স্বাধীনতা-সংগ্রামে যুদ্ধ-সাথী হয় তাহাদের মধ্যে একটা নূতন ধরণের এক-দেহ-বােধ বা সম প্রাণতার জন্ম হয়; তাহাদের সকল ধারণা, সকল সংস্কার, সকল আকাঙ্ক্ষার আমূল পরিবর্ত্তন হয়। তখন, যে সকল সমস্যা, আজ এত দুরূহ মনে হইতেছে, সে সকলের সমাধান অতি সহজেই হইয়া যাইবে।]

 গান্ধী-কংগ্রেস এই স্বাধীনতার কামনা বা স্বাধীনতা-সংগ্রামকে গৌণ করিয়া চরকা, খাদি ও হরিজন সেবাকেই মুখ্য করিয়াছে; সে প্রাণশক্তির পরিবর্ত্তে ‘ধর্ম্মবুদ্ধি’কে আশ্রয় করিয়াছে।

 তারপর সুভাষচন্দ্র বলিতেছেন, স্বাধীনতালাভের আকাঙক্ষাই জাতীয়তা-বােধ সৃষ্টি করে, তখন হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রীষ্টান প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আর থাকে না—“He undoubtedly has a genuine nationalist mentality who wages a war for national freedom.”

 অতএব—

 “Let us not sit with folded hands waiting for the day when the High Command of the Congress and of the Muslim League will bring about a solution of the communal problem.... Those who love freedom and will die for it can solve the Communal problem more easily than anybody else.”

 [কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা কবে এই সমস্যার মীমাংসা করিবেন সেই আশায় আমরা যেন হাতযোড় করিয়া বসিয়া না থাকি।.... যাহারা দেশের জন্য প্রাণ দিবে তাহারাই এ সমস্যার সমাধান করিবে, আর কাহারও সে ক্ষমতা নাই।]

 কংগ্রেস ইহা স্বীকার করে নাই—কিন্তু ইহাই যে সত্য, সুভাষচন্দ্র নেতাজী-রূপে তাহা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপন্ন করিয়াছেন। ইহাতেই প্রমাণ হয়, সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব-প্রতিভা কত বড়, সে প্রতিভা দৈবী-প্রতিভা, সেই দৃষ্টিও দিব্যদৃষ্টি। কংগ্রেসের সেই নীতি ও তাহার কার্য্যপদ্ধতির পরিণামদৃষ্টে কি ইহাই মনে হয় না যে, সেইকালে যদি সে সুভাষচন্দ্রের হাতে নেতৃত্ব ছাড়িয়া দিত, তবে আজ ভারতের ভাগ্য অন্যরূপ হইত? আসল কথা, কংগ্রেস জনগণকে বিশ্বাস করে নাই, কেবল শাসন করিয়াছে, হুকুম পালন করাইয়াছে; স্বাধীনতালাভ অপেক্ষা নেতৃত্বের নেশাই তাহাকে পাইয়া বসিয়াছে। এই প্রসঙ্গে এক আশ্রম-গুরু সন্ন্যাসীর একটি উক্তি মনে পড়ল, এখানে তাহা উদ্ধৃত করিতেছি—ঐরূপ নেতাদের সম্বন্ধে তিনিও বলিতেছেন—

 “নেতারা জনসাধারণকে আটকাইয়া রাখে, নিজেদের “মানদণ্ড” বজায় রাখিবার জন্য, অবশ্য মুখে তাহাদের বড় বড় আদর্শের কথা বলিতে হয়; নচেৎ লুঠটা নিরাপদ হইবে কেন? জনসাধারণ প্রাণপ্রধান, তাই চালাকি অনেক সময়ে তাহাদের চোখে ধরাই পড়ে না। তবে প্রাণধর্ম্মী মুক্ত পুরুষ যদি জনসাধারণের মধ্যে প্রাণ লইয়া; ঝাঁপাইয়া পড়েন, তবে প্রাণোপাসক জনসাধারণ তাঁহার সঙ্গে প্রাণসাধনায় যুক্ত হইবে, চালক নেতৃবৃন্দ তখন ফাঁপরে পড়িয়া জনসাধারণের চরণতলে আসিতে বাধ্য হইবেন। যীশু, মহম্মদ, বুদ্ধ, গৌর সকলেই প্রাণপ্রধান জনগণের সঙ্গে পরিচিত হইয়াছিলেন” (‘স্বরাজের পূর্ণরূপ’—শ্রীমৎ স্বামী পুরুষোত্তমানন্দ অবধূত, পৃঃ ৩১)।

 ১৩৪৪ সালে অর্থাৎ প্রায় নয় বৎসর পূর্ব্বে ঐ কথাগুলি মুদ্রিত হয়, অতএব উহাতে লেখক যে সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করেন নাই তাহা নিশ্চিত; আবার ঐ পুস্তকে তিনি কংগ্রেসের সমালোচনাও করেন নাই, কতকগুলি সাধারণ তত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন। কিন্তু কথাগুলি কি সত্য! ঐ ‘প্রাণধর্ম্মী মুক্ত পুরুষে’র কথাই ত’ আমরাও বলিতেছি। প্রাণ-প্রধান জনগণের ‘নেতা’ নয়—‘নেতাজী’ হইতে আর কে পারিয়াছে? কংগ্রেস জনগণের সহিত পরিচিত হইয়াছে বটে, কিন্তু সে প্রাণধর্ম্মী নয় বলিয়া সেই পরিচয় ব্যর্থ হইয়াছে।[১২] সুভাষচন্দ্র যেন ইহাই আশঙ্কা করিয়া, আদর্শ-নেতার কি কি গুণ থাকা আবশ্যক, সে সম্বন্ধে একদা একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। আমি এই পুস্তকের পরিশিষ্টে তাহার একটি অনুবাদ সন্নিবিষ্ট করিয়াছি। তাহাতে দেখা যাইবে, সুভাষচন্দ্রও কেবল বুদ্ধিকে একমাত্র শক্তি বলিয়া স্বীকার করেন নাই—জনচিত্তের সহিত গভীরতর যোগ-রক্ষার কথা তিনিও বলিয়াছেন, ইহার জন্য যে instinct বা inuition আবশ্যক, তাহা প্রাণধর্ম্মেরই একটি প্রকৃষ্ট বৃত্তি, একরূপ আধ্যাত্মিক শক্তিও বলা যাইতে পারে। এই শক্তি যে মানুষের নাই সে জনগণের নেতৃত্ব করিতে পারে না—তাহার সেই নেতৃত্ব সভ্য ও কল্যাণকর হয় না। এই প্রবন্ধ অন্য কারণেও মূল্যবান, ইহাতে সুভাষচন্দ্র যেন দর্পণে আপনাকেই দেখিতেছেন, তাই ইহার নাম দিয়াছেন ‘Heart-searching’ বা ‘আত্ম-পরীক্ষা’। অতএব এই প্রবন্ধে তাঁহার আত্ম-পরিচয় আছে। তিনি যে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ হইবার যােগ্যতা লাভ করিয়াছেন, সেই বিশ্বাস তাঁহার হইয়াছে—তাহা যে কত সত্য, আজাদ-হিন্দ ফৌজ তাহা প্রমাণ করিয়াছে।

 শুধু এই উৎকৃষ্ট ‘জনগণমনঅধিনায়কতা’র নেতৃপ্রতিভাই নয়—সুভাষচন্দ্রের রাজনীতি-জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি কিরূপ অসামান্য ছিল, তাহার কিঞ্চিৎ নিদর্শন দিব।

 কংগ্রেস অধুনা যে Constituent Assembly বা গণপরিষদের নামে মাতিয়া উঠিয়াছে, এবং তাহাই পরমপুরুষার্থ বলিয়া ঘােষণাদ্বারা সর্ব্বভারতকে মেঘাচ্ছন্ন করিয়াছে, সেই গণপরিষদের ফন্দিটি তাহার নূতন আবিষ্কার নয়। গান্ধীজী যেদিন হইতে ব্রিটিশ সরকারের সহিত সংগ্রাম পরিহার করিলেন সেইদিন হইতেই আসল বস্তুর নামে ঐ নকল বস্তুর দ্বারা ভারতের পূর্ণস্বাধীনতা বা স্বরাজকে চাপা দিলেন—ভারতের বুদ্ধিমান শিক্ষিত জনগণকেও ঠকাইবার এতবড় কৌশল ইতিপূর্ব্বে কেহ আবিষ্কার করিতে পারে নাই। আজ সেই গণপরিষদই সরকারের সহিত চিরসন্ধি-স্থাপনের প্রধান উপায় হইয়াছে।[১৩] সত্যকার গণ-পরিষদ যে কি বস্তু, তাহা কখন ও কি অবস্থায় সম্ভব, সে সকল কথা বুঝাইয়া পরে সুভাষচন্দ্র বলিতেছেন—

 “But what will happen if the demand is fulfilled by the British Government now? It will be elected on the basis of separate electorate. The Congress has gone so far as to accept the existing franchise for Legislative Assembly as the basis for electing the Constituent Assembly of their dreams. It will meet under the aegis of the present Imperialist Government. ... It will be a glorified Debating Society. The floor of the Assembly will become, moreover, the battleground for all the Communal forces of the country. The present Government standing in the background will be in a position to do all the wirepulling that they consider necessary. Unless a miracle happens the squabble within the Assembly will end in a deadlock and the Assembly will prove to be abortive. No this move is a most dangerous one...the Congress will land itself in disaster”.

 [ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্ট যদি কংগ্রেসের ঐ দাবী পূরণ করে, তবে সম্প্রদায় হিসাবে পৃথক ভােটের দ্বারা ঐ গণ-পরিষৎ গঠিত হইবে; সেই ভােটাধিকারও অতিশয় নির্দ্দিষ্ট— কংগ্রেস তাহাও মানিয়া লইয়াছে। ঐ গণ-পরিষৎ ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের ছত্রচ্ছায়ায় মিলিত হইবে। সকল কারণে উহা একটি আড়ম্বরপূর্ণ বিতর্কসভা ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারিবে না। সেখানে দেশের যাবতীয় বিরুদ্ধ দল পরস্পর বিবাদ করিতে থাকিবে, এবং বর্ত্তমান গভর্ণমেণ্ট অন্তরালে থাকিয়া আবশ্যকমত তাহাতে সাহায্য করিবে। যদি ইতিমধ্যে কোন অনৈসর্গিক ঘটনা না ঘটে, তবে ভিতরকার ঐ দ্বন্দ্ব-কলহ হইতেই গণ-পরিষদের পঞ্চপ্রাপ্তি অনিবার্য্য।···ঐরূপ গণ-পরিষৎ ভারতবর্ষের পক্ষে বড়ই বিপজ্জনক···কংগ্রেসের সর্ব্বনাশ হইবে।]

 আজ কি হইতেছে? সুভাষচন্দ্রের ভবিষ্যৎ-বাণী কি সত্য হইয়া উঠে নাই? “The Congress will land itself in disaster”—তাহার কি বাকি আছে? অদ্য তারিখে (২১।১১।৪৬) যে সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে দেখা যাইতেছে, পণ্ডিতজীও আর পারিতেছেন না, যদিও গণ-পরিষৎ গঠন করা অসম্ভব হইয়াছে, তথাপি তিন একরূপ মোরিয়া হইয়া উঠিয়াছেন। এদিকে গান্ধীজী তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃতির চূড়ান্ত পরিচয় দিতেছেন—নোয়াখালির সেই শ্বাপদ-সঙ্কুল গহন অরণ্যে তিনি একাই অহিংসাব স্বর্গীয় শক্তি পরীক্ষা করিতে প্রবেশ করিয়াছেন।[১৪] এবার অবস্থা সাংঘাতিক, তিনিও হয়ত’ তাহা বুঝিয়াছেন, এখন ঐ ভাবে একটা কিছু করা ছাড়া আর কোন উপায় যে নাই! তিনি এখনও, একাই পৃথিবীতে সত্যযুগ আনিবার সংকল্প ত্যাগ করেন নাই—মানুষ যে তাঁহার ঐ ধর্ম্মমন্ত্রের প্রভাবে দেবতা হইয়া উঠিবে না, ইহা তিনি কিছুতেই স্বীকার করিবেন না। না করুন, তাঁহার ঐ ধর্ম্মোন্মাদ প্রসূত মস্তিষ্কবিকৃতির জন্য একটা জাতির কি দুর্গতিই না হইল। আজ তিনি যদি তাঁহার সেই অদ্ভুত খেয়ালকে সত্যে পরিণত করিতে না পারিয়া তেমনই অন্ধ বিশ্বাসের বশে একটা কিছু করিয়া বসেন, তাহাতেই বা দেশের কি উপকার হইবে? কংগ্রেস এতকাল ধরিয়া, আত্মবুদ্ধির অতিরিক্ত অভিমানে ও নেতৃত্বের নেশায়, জাতির যে সর্ব্বনাশ করিয়াছে, তাহার কোন প্রতিকার আছে? সুভাষচন্দ্র ইহাই নিবারণ করিতে চাহিয়াছিলেন—ঐ গান্ধীচক্রের নেতৃত্ব যে কিরূপ বিপদ-জনক, তাহা বুঝিতে পারিয়া তিনি দেশের ঠিক এই ভবিষ্যৎকেই প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন; তাই স্থির থাকিতে পারেন নাই। কিন্তু কংগ্রেস অতিশয় সহজ ও পন্থায় ভারত-উদ্ধার করিবে বলিয়া তাঁহার সেই পরামর্শ গ্রহণ করে নাই উপরন্তু বিদ্রোহী বলিয়া তাঁহাকে গুরুতর শাস্তিদান করিয়াছিল।

 ইহার পরেও কি সুভাষচন্দ্রকে অবিশ্বাসী, উন্মাদ, দেশদ্রোহী বলিয়া অভিহিত করিতে হইবে? সুভাষচন্দ্র যে স্বমত-অন্ধ, নেতৃত্বলোভী একজন সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র ছিলেন নাই, পরন্তু তাঁহার মত চিন্তাশীল, তীক্ষ্ণধী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জননায়ক আধুনিক ভারতে আর দেখা যায় না, তাহার অসংখ্য প্রমাণ তাঁহার চরিত্রে, চিন্তায় ও কার্য্যাবলীতে পাওয়া যাইবে আমি এই পুস্তকে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের যেটুকু পরিচয় দিতে পারিয়াছি তাহাতে আশা করি, ইহাই প্রতিপন্ন হইবে যে, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ইদানীন্তন কালে যদি কোন প্রকৃত নেতৃগুণসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হইয়া থাকে, তবে সে পুরুষ সুভাষচন্দ্র। শুধু তাহাই নয়, এই স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাস যখন লিখিত হইবে, তখন সেই ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিক নিশ্চয় ইহা লক্ষ্য করিবেন যে, সেই যুদ্ধে জয়লাভের যে একটি মহাসুযােগ আসিয়াছিল তাহা অতিশয় শোচনীয়রূপে ব্যর্থ করিয়া ছিল তাহারাই—যাহারা সেই লগ্নে সুভাষকে দেশত্যাগী করিয়াছিল। সেই সংগ্রামের একটা দীর্ঘ অধ্যায় প্রায় শেষ হইয়াছে, কংগ্রেস—গান্ধী-কংগ্রেস—এক্ষণে প্রায় পরাজিত বা পতনােন্মুখ, দেশব্যাপী হিংসা-হানাহানি ও পৈশাচিক তাণ্ডবের মধ্যে তাহার সেই অহিংসা ও আপোষ-নীতির সমাধি হইতেছে।[১৫] ইহার পর জনসমুদ্রে ব্যর্থশ্বাসের যে তুমুল ঝড় উঠিবে, তাহাকে নিয়ন্ত্রিত করিবে কে? নেতাজীর মত পুরুষ একই যুগে একই জাতির মধ্যে কয়বার আবির্ভুত হয়? “তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে”।

নেতাজী-চরিত -উপসংহার

 এইবার আমি, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মধ্যে মানবাত্মার যে অপূর্ব্ব প্রকাশ দেখিয়াছি, তাহারই আরতি ও অর্চ্চনা করিয়া এই প্রবন্ধের, তথা গ্রন্থের উপসংহার করিব। এই গ্রন্থে, আমি যেখানে যত অপ্রিয় সত্যভাষণের পাপ করিয়াছি―লোক?জা ব্যক্তি ও জন-বরেণ্য নেতার বিরুদ্ধ-সমালােচনা করিয়াছি, এবং সেই সমালোচনাতেও―মানুষ আমি―যে সকল তথ্য বা তত্ত্বের ভ্রম করিয়াছি, সেই সকল পাপই, এক্ষণে নেতাজী-চরিতের পাবনী-ধারায় স্নান করিয়া ক্ষালন করিতে পারিব। এখন আর কংগ্রেস নয়, জাতীয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম নয়, এমন কি, আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের অলৌকিক কীর্ত্তি-কাহিনীও নয়, এখন কেবল সেই পুরুষের প্রতি চাহিব, তাঁহার মহনীয় চরিত্র ও মহত্তর আত্মার অমর মহিমা হৃদয়ঙ্গম করিব। পৃথিবীর ইতিহাসে কত বড় বড় পুরুষের আবির্ভাব হইয়াছে―মানবাত্মার কত বিভূতিই প্রকাশ পাইয়াছে। কেহ ধর্ম্মে, কেহ রাষ্ট্রে, কেহ শিল্পে, কেহ সাহিত্যে, কেহ রণাঙ্গনে, কেহ মানুষের চিন্তারাজ্যে―মানবীয় প্রতিভার, মানব-মহত্ত্বের বিজয়-কেতন উড্ডীন করিয়া এখনও ইতিহাসের ধারায় বিদ্যমান বহিয়াছেন। এই সকলের মধ্যে এক-একটি শক্তির বিকাশ আমরা দেখিয়াছি,―সকলের মধ্যে সকল শক্তির বিকাশ দেখি নাই। এইজন্যই, ভারতবর্ষে যাঁহাদিগকে অবতার-কল্প পুরুষ বলা হয়―সেইরূপ পুরুষের মধ্যেও, মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র একমাত্র শ্রীকৃষ্ণকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন, তাঁহার ‘কৃষ্ণচরিত্রে’ তিনি সে-পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি ও চিন্তার সমাবেশ করিয়াছেন। আমি অবশ্য সুভাষচন্দ্রের জন্য সেইরূপ গৌরব দাবী করিতেছি না; অবতার বা মানব-ধর্ম্ম-প্রতিষ্ঠাতা যে সকল মহাপুরুষ পৃথিবীতে চিরপূজ্য হইয়া আছেন, তাঁহাদের মহিমা যেমনই হৌক, তাঁহারা সাধারণ মানবচরিত্র নহেন―একটু উর্দ্ধস্তরের আত্মা। সুভাষচন্দ্রের চরিত্র সাধারণ না হইলেও, তাহার মহত্ত্ব―মানবতায়। ভারতইতিহাসের এক অতিশয় সঙ্কট-লগ্নে তিনি যেন বিধাতাকর্ত্তৃক একটি কঠিন ব্রত উদ্‌যাপন করিতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, আমরাও প্রধানতঃ সেই কর্ম্মের ভিতর দিয়াই তাঁহার পরিচয় পাই। কিন্তু মানুষ-সুভাষচন্দ্র যে সেই নেতাজী-নামধারী সুভাষচন্দ্র হইতে কত বড়, ইহাই যদি আমরা বুঝিতে না পারিলাম, তবে মানবাত্মার একটা বড় প্রকাশকেই আমরা দেখিলাম না। তাই ক্ষণেকের জন্য তাঁহার সেই বাহিরের বেশ, যত কিছু বাহিরের সম্পর্ক―গান্ধী, কংগ্রেস, ব্রিটিশ-গভর্ণমেণ্ট ও আজাদ-হিন্দ্―সব দূরে সরাইয়া, আমরা সুভাষ-নামধারী সেই মহাত্যাগী ও মহাপ্রেমিক, আত্মশক্তিমান্ ও মহাবীর্য্যবান্ পুরুষশ্রেষ্ঠকেই চিনিয়া লইব। চিনিবার উপায়ও আছে।

 মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় প্রেমে―এই প্রেম যত বড়, মানুষও তত বড়। সুভাষচন্দ্রের দেশ-প্রেম―তাহার কি তুলনা আছে? তেমন প্রেম পৃথিবীর ইতিহাসে আর কাহারও মধ্যে ঠিক সেই মাত্রায় ও সেই রূপে প্রকাশ পাইয়াছে? এ প্রেম―আত্মার আত্মোৎসর্গের যে আনন্দ, সেই আনন্দ-পিপাসা। স্বামী বিবেকানন্দ ইহাকে জ্ঞানে পাইয়া কর্ম্মে রূপ দিতে চাহিয়া ছিলেন; সুভাষচন্দ্র ইহাকে জ্ঞানে নয়, ধ্যানেও নয়―তাঁহার নিঃশাসবায়ুরূপে পাইয়াছিলেন। এই প্রেম ভাব-সাধনার প্রেম নয়―ইহা বৈষ্ণবের বৃন্দাবন-বিলাস নয়, নিজ-মানসের নিভৃত নিকুঞ্জে ভাব-সম্মিলনের গোপন প্রীতিরস-ভুঞ্জন নয়। এ প্রেম শক্তিমান্ শাক্তের প্রেম, ইহার প্রীতি-মন্দাকিনী নিষ্কলুষ কর্ম্মধারায় অহরহ বেগবান্; ইহা আপনার মধ্যে আপন আত্মমুগ্ধ হইয়া থাকিতে পারে না—শক্তির জগতে নিজেকে প্রসারিত করিয়া, জীবনের অগ্নিক্ষেত্রে পুরুষ-যজ্ঞের বলিরূপে আপনাকে আহুতি দিয়া ধন্য ও কৃতার্থ হইতে চায়। সুভাষচন্দ্র যে-দেশে যে-যুগে, যে-জাতির মধ্যে জন্মিয়াছিলেন, তাহাতে সেই অগ্নিক্ষেত্র ও যজ্ঞবেদিকা পূর্ব্ব হইতেই প্রস্তুত ছিল। তিনি ছিলেন শাক্ত―বাঙালীর সন্তান, তাই সেই আত্মবলির জন্য একটি দেবীর প্রয়োজন ছিল;[১৬] ধ্যান-কল্পনা বা কবিত্বের দেবী নয়―একেবারে সাক্ষাৎ মৃন্ময়ী মূর্ত্তি। সেই মূর্ত্তিও গড়িয়া লইতে হয় নাই, পূর্ব্বগামী সাধকগণ তাঁহার জন্য গড়িয়া রাখিয়াছিলেন। সেই মূর্ত্তি―দেশমাতৃকার সেই ভূলুণ্ঠিত রাজরাজেশ্বরী-মূর্ত্তি তাঁহাকে পাগল করিয়াছিল। তাহারই প্রেমে তিনি সর্ব্বত্যাগী সন্ন্যাসী হইলেন―জীবন ও যৌবন তাহাকেই সমর্পণ করিলেন; এমন সর্ব্বত্যাগ আর কেহ করে নাই। এমন একনিষ্ঠ প্রেম, এমন অনন্যময়তা বােধহয় আর কোন দেশোদ্ধারব্রতী ইতিহাসপ্রসিদ্ধ পুরুষের জীবনে লক্ষিত হইবে না। প্রায়ই দেখা যায়, দেশকে ভালবাসিয়া, দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করিয়া যাঁহারা অমর কীর্ত্তি অর্জ্জন, করিয়াছেন তাঁহাদের প্রায় সকলেরই অপর কোন প্রেম-পাত্র বা পাত্রী ছিল; সুভাষচন্দ্রের প্রেমে পাত্রভাগ ছিল না, ঐ এক প্রেম ও এক পাত্র ভিন্ন তাঁহার জীবনে আর কিছুই ছিল না।[১৭]

 কিন্তু ঐ প্রেমও মূলে মানবাত্মারই এক গভীর চেতনা ও বেদনা-প্রসূত। মানুষ-সুভাষচন্দ্রকে না দেখিলে এই প্রেমের সেই মূলটিকে দেখিতে পাওয়া যাইবে না। একদিকে যেমন আত্মার আত্মসম্মানবােধ, অপরদিকে তেমনই সর্ব্ব-অভিমান ত্যাগ করিয়া অতি দীন-হীন দুঃখী-জনকে বক্ষে আলিঙ্গন করিবার―সেবা করিবার সে কি আকিঞ্চন! শােনা যায়, পথের ধূলা হইতে রােগকাতর কাঙাল বালককে কুড়াইয়া বক্ষে বহিয়া গৃহে আনিতে তাঁহার বাধিত না; এ কাহিনী সুভাষচন্দ্রের পক্ষে আদৌ অসম্ভব নহে। সুভাষচন্দ্র যখন অতিশয় স্বাস্থ্যভগ্ন অবস্থায় মাদ্রাজের জেলে কিছুদিন আবদ্ধ ছিলেন, সেই সময়ে অপর একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বন্দী তথায় ভিন্ন কক্ষে বাস করিতেন। এই বন্দী লিখিয়াছেন, তখন সুভাষচন্দ্র পাকস্থলীর কঠিন ব্যাধিতে মরণাপন্ন, আহার্য্য পথ্য প্রায় কিছুই ছিল না, যাহা ছিল তাহাও তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিতেন না। কিন্তু সেই অবস্থাতেও তিনি প্রত্যহ নিজহস্তে কিছু-না-কিছু খাদ্য পাক করিয়া, জেলের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদিগকে আহ্বান করিয়া খাওয়াইতেন, এবং সেই অবকাশে তাহাদিগকে মিষ্টবাক্যে সদুপদেশ দিতেন―নিজে প্রায় অভুক্ত বলিলেও হয়! স্বহস্তে পাক করিতে তিনি ভালবাসিতেন, এবং তাহা অভ্যাস করিয়াছিলেন; তাঁহার মধ্যে যেন একটি মাতৃ-হৃদয় ছিল, এইরূপ পাক করিয়া পরকে খাওয়াইবার আগ্রহ―সেইরূপ স্নেহেরই অভিব্যক্তি।[১৮] লেখক বলিতেছেন, এই মহা প্রাণ পুরুষকে তিনি পূর্ব্ব হইতেই পূজা করিতেন, এক্ষণে তাঁহার শারীরিক অবস্থা, এবং সেই অবস্থায় নিজের ঔষধ-পথ্য সম্বন্ধে ঔদাসীন্য, এবং তদুপরি এইরূপ সেবাকর্ম্মের পরিশ্রম দেখিয়া তিনি অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিতেন না―নির্জ্জনে কাঁদিতেন; কিন্তু কিছুতেই সুভাষচন্দ্রকে আত্মরক্ষা বা আত্মকল্যাণচিন্তায় অবহিত করিতে পারিতেন না।

 উপরে যে দুইটি কাহিনীর উল্লেখ করিয়াছি, উহার মধ্যেই সুভাষ-চরিত্রের আদি-রূপ দেখিয়া লইতে হইবে। সুভাষের দেশ-প্রেম একটা বড় সেণ্টিমেণ্ট বা প্রবল হৃদয়াবেগ মাত্র ছিল না, তাহার মূলে ছিল অপার করুণা; করুণা বলিতে দয়া নয়, ইহা সেই অনুকম্পা―যাহাতে দাতাও দানকালে ভিখারীর সমান হয়, সেও যেন যাচনা করে, যেন গ্রহণ করিলে সে কৃতার্থ হয়। এই সুভাষচন্দ্র যুদ্ধ করিয়াছিলেন! এত বড় প্রেম যাহার তাহার সেই যােদ্ধৃবেশের অন্তরালে কোন্ হৃদয় স্পন্দিত হইতেছিল? সাক্ষাৎ আততায়ী তাঁহাকে বধ করিতে আসিয়া ধৃত হইয়াছে―তেমন ব্যক্তিকেও তিনি আলিঙ্গন করিয়া মুক্তি দিয়াছেন। কতবার যে সামরিক আইন অগ্রাহ করিয়া বিশ্বাসঘাতক সেনানীকে ক্ষমা করিয়াছেন, তাহা উল্লেখ করিয়া আজাদ-হিন্দ ফৌজের এক উচ্চ কর্ম্মচারী পরে দুঃখ করিয়াছেন; তাহাতে অনেক ক্ষতি হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র যখন যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করিতে যাইতেন তখন সেনানিবাসে পৌঁছিয়া তিনি সর্ব্বাগ্রে নিম্নতম সৈনিকের ভােজনশালায় প্রবেশ করিতেন, এবং নিজে তাহাদের খাদ্য আস্বাদন করিয়া দেখিতেন, তাহা খাদ্য কি অখাদ্য। যুদ্ধশেষে রেঙ্গুন হইতে প্রত্যাবর্ত্তন-কালের একটি ঘটনাও উল্লেখযােগ্য; তিনি নিজে ‘ঝান্সীর-রাণী’―নারীসেনার কয়েকজনকে নিরাপদ স্থানে পৌছাইয়া দিবার ভার গ্রহণ করিলেন। তাঁহার গভর্ণমেণ্ট তখন ব্যাঙ্কক শহরে স্থানান্তরিত হইয়াছে, রক্ষীবেষ্টিত সামরিক যানে তথায় তাঁহার গমন করিবার কথা; তিনিই সর্ব্বাধিনায়ক, আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের সর্ব্বস্বধন, তাঁহার প্রাণরক্ষার জন্য সকলেই উৎকণ্ঠিত। কিন্তু তিনি সে সকল কথা গ্রাহ্য করিলেন না; কতিপয় নারী-সৈন্যকে নিরাপদ স্থানে পৌছাইয়া দিবার জন্য নিজেই, মাথার উপরে শত্রুপক্ষের বিমান হইতে গােলাবর্ষণ, পথে সাঁতার দিয়া নদীপার, মাঝে মাঝে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ প্রভৃতি সর্ব্বপ্রকার সঙ্কট ও দৈহিক কষ্ট তুচ্ছ করিয়া, তাহাদিগকে বিপদ-মুক্ত অবস্থায় রাখিয়া আসিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন।[১৯]

 গীতা বলিয়াছেন―“অন্বেষ্টা সর্ব্বভূতানাং মৈত্র করুণ এব চ”; পাঠ করিবার সময়ে মনে হয়, ইহাই আদর্শ-চরিত্র বটে, এবং যাহারা সৰ্বত্যাগী সন্ন্যাসী, যাহারা সমাজে থাকিয়াও কর্ম্মত্যাগের সাধনা করে, তাহাদের পক্ষেই এইরূপ আদর্শ-চরিত্র হওয়া সম্ভব। কিন্তু যাহাদিগকে কোন একটি বৃহৎ ব্রতউদযাপনের জন্য সমাজের সর্ব্বস্তরের সকল পক্ষ ও দলের সহিত ক্রমাগত সন্ধি-বিগ্রহ করিয়া চলিতে হয়, তাহাদের মত ব্যক্তির পক্ষে―‘অদ্বেষ্টা সর্ব্বভূতানাম্’―অর্থাৎ সকল প্রাণীর প্রতি বিদ্বেষহীন হওয়া প্রায় অসম্ভব বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু গীতার এই পংক্তিটিই সুভাষচন্দ্রের চরিত্রকে দৃষ্টান্ত করিয়া তুলিয়াছে। গান্ধী-কংগেসের সহিত তাঁহার প্রায় চির-বিরোধ, এবং ত্রিপুরীতে ও তাহার পরে, তাঁহার সহিত সেই দলের ঘােরতর শক্রতাচরণের কথা আমি সবিস্তারে বলিয়াছি, কিন্তু একটি কথা বলি নাই। আমি সেই ঘটনার আদ্যন্ত অতিশয় সাবধানে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু মনের অণুবীক্ষণ-সাহায্যেও আমি সে সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের অন্তরে অণুমাত্র বিদ্বেষ আবিষ্কার করিতে পারি নাই। ইহা বিশ্বাসযােগ্য নয় বলিয়াই আমিও পরমাশ্চর্য্য বােধ করিয়াছি। পরে বুঝিয়াছি, এই অবিদ্বেষের কারণ কি। যাহার হৃদয় এত বড় প্রেমে বলীয়ান, যাহার দৃষ্টি এত উর্দ্ধে নিবদ্ধ, যে আত্মশক্তিতে এমন আস্থাবান, সে ঐরূপ শত্রুতায় দুঃখ পায় মাত্র―বিচলিত হইবে কেন? সে তাহাকে একটা বাধামাত্র মনে করে, কিন্তু সকল বাধা লঙ্ঘন করাতেই যাহার পৌরুষ―সে তাহাতে ক্ষুন্ন বা ক্ষুব্ধ হইবে কেন?[২০] আমরা এমন প্রেম ও পৌরুষ দেখি নাই বলিয়াই মনে ঐরূপ সংশয় জাগে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলিয়া রাখি―না। বলিলে একটা ভুল ধারণা বড়ই প্রশ্রয় পাইবে। আজাদ-হিন্দ্ ফৌজ ও গভর্ণমেণ্টের নেতাজী হইয়াও সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়াছিলেন, অতএব শেষ পর্য্যন্ত তিনি গান্ধীকংগ্রেসের আনুগত্য করিয়াছিলেন, এইরূপ যুক্তি দ্বারা সুভাষচন্দ্রের পৃথক নেতৃত্ব অস্বীকার করার বড় সুবিধা হইয়াছে। গান্ধীজীর প্রতি সুভাষচন্দ্রের শ্রদ্ধা যে কখনও লুপ্ত হয় নাই ইহা সত্য, কিন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁহার সেই সমরাভিযানকালে গান্ধীজীর প্রতি যে এমন ভক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহার অন্যতর এবং বিশিষ্ট কারণ ছিল। তৎপূর্ব্বে গান্ধীকংগ্রেস ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ উচ্চারণ করিয়া ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে সম্মুখ-যুদ্ধ ঘােষণা করিয়াছে―নেতাগণ কারারুদ্ধ হইয়াছেন এবং ভারতে একটা বিপ্লবের ঝড় বহিয়া গিয়াছে; অতএব এই গান্ধী পূর্ব্বের গান্ধী নহেন, সুভাষচন্দ্রের চক্ষে তিনিও তখন বিদ্রোহী ও যুদ্ধার্থী―তাই গান্ধীজীর যুদ্ধঘােষণার মর্ম্ম এবং কংগ্রেসের প্রকৃত অভিপ্রায় পুরাপুরি না জানিয়াই তিনি, এতদিনে তাঁহার নীতিই জয়ী হইয়াছে এই বিশ্বাসে, গান্ধীজী ও তাঁহার কংগ্রেসকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছিলেন। পরে কারামুক্ত হইয়া গান্ধীজী সেই বিদ্রোহ সম্বন্ধে তাঁহার যে মনােভাব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা সুভাষচন্দ্র যে জানিতে পারেন নাই, ইহাই তাঁহার সৌভাগ্য; সেই ‘কুইট ইণ্ডিয়া’র যুদ্ধঘােষণা রব আজ কোন্ সুরে নামিয়া আসিয়াছে!

 সুভাষ-চরিত্রের আর একটি বড় লক্ষণ অনেকেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, কিন্তু হয় ত তেমন মনােযােগ আকর্ষণ করে নাই। সুভাষচন্দ্র যে শাক্ত―শক্তির উপাসক, এ কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; কিন্তু সুভাষচন্দ্রের শক্তি-উপাসনা―তাঁহার সেই নারী-পূজাও কম লক্ষণীয় নয়। নারীজাতির প্রতি এমন কামগন্ধহীন শ্রদ্ধা একটি বিশিষ্ট সাধনা-সাপেক্ষ।[২১] মনে রাখিতে হইবে, সুভাষচন্দ্র আকুমার ব্রহ্মচারী, তিনি কোন নারীকে―বিবাহ-মন্ত্রে শোধন করিয়াও―কাম-সঙ্গিনী করেন নাই; তাঁহার সে শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ যৌন-সংস্কার-মুক্ত। এই ব্যবহারে একাধারে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে যুক্ত হইতে দেখি, একজনের নারী সম্বন্ধে শিশু বা সন্তানবৎ ব্যবহার―বিবাহিত স্ত্রীকেও অন্যভাবে গ্রহণ, আর একজনেব নারীকে পুরুষের সমকক্ষরূপে, সহযােগিনীরূপে, সমান মর্য্যাদা-দান, ইহাও সুভাষ-চরিত্রের একটা বড় লক্ষণ―খাঁটি পৌরুষের লক্ষণ। নারীকে এইরূপ শ্রদ্ধা করিতে পুরুষেই পারে―কাপুরুষে পারে না। তথাপি, আমাদের দেশে পুরুষের এই পৌরুষ-লক্ষণ বহুকাল লুপ্ত হইয়াছিল। সুভাষচন্দ্র যে কত বড় পুরুষ―তাঁহার নারী-পূজাই তাহার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

 আমি সুভাষ-চরিত্রের যে লক্ষণগুলির উল্লেখ করিয়াছি―তাহা তাঁহার ব্যক্তিগত পুরুষ-চরিত্রের লক্ষণ, অর্থাৎ মানুষসুভাষের পরিচয় তাহাতে আছে। তাঁহার প্রতিভা ও মনীষা, অপূর্ব্ব দক্ষতা বা উপায়-কুশলতা, রাজনীতি ও রণনীতি জ্ঞান, কর্ম্মে ক্লান্তিহীনতা, বাস্তব-বুদ্ধি ও কল্পনা-শক্তি, এবং সর্ব্বোপরি অজেয় আত্মবিশ্বাস ও অকুতােভয়তা―এ সকল গুণের উল্লেখ নিষ্প্রয়ােজন। সমগ্র গুণাবলী একত্র করিয়া সুভাষচন্দ্রের দিকে চাহিলে মনে হয় না কি যে, মানব-চরিত্রের উহা একটি অভিনব পূর্ণ-প্রকাশ বটে? সকল কীর্ত্তিকে, সকল জয়-পরাজয়কে, মানব-ভাগ্যের সকল ঘটন-অঘটনকে অতিক্রম করিয়া, উহা যেন স্ব-মহিমায় বিরাজ করিতেছে! কুরুক্ষেত্রের পার্থ ও পার্থসারথি, বুদ্ধ ও চৈতন্য সকলেই যেন উহার মধ্যে লুকাচুরী খেলিতেছে―পূর্ণতঃ কোন একজন নয়, সকলেরই কিছু-কিছু যেন একটি সূত্রে ‘মণিগণা ইব’ পাশাপাশি মিশিয়া দীপ্তি পাইতেছে! কিন্তু সেই সূত্র কি? এই সকল গুণ কোন এক গুণকে আশ্রয় করিয়া আছে? সে তাঁহার সেই অতুলনীয়, অপরিমেয় দেশ-প্রেম।

 কারণ, আমি সুভাষচন্দ্রের সেই এক রূপ, সেই এক মূর্ত্তি অহৰহ আমার মানস-চক্ষে দেখিতেছি। আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের সর্ব্বাধিনায়ক, যােদ্ধৃবেশপরিহিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরের বিশাল প্রাঙ্গণে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ও সমবেত জনসমুদ্রের সম্মুখে মঞ্চোপরি দণ্ডায়মান। সে রূপ দেব-সেনানী তারকারি স্কন্দের রূপই বটে! হ্যানিবল, সীজার, আলেকজাণ্ডার নেপােলিয়নকে কি ঐরূপ উপলক্ষ্যে ঐ বেশে এমনই দেখাইত! নেতাজী তাঁহার মাতৃভূমিকে উদ্ধার করার জন্য সর্ব্বস্বপণের সেই শপথ-পত্র পাঠ করিতেছেন; সেনাগণ তাহাদের অভ্যস্ত সামরিক আচার রক্ষা করিবার জন্য আবেগ রুদ্ধ করিয়া স্থির হইয়া আছে, কিন্তু উদ্বেল জনসমুদ্র স্থির থাকিতে পারিতেছে না―উন্মাদনার ঝটিকাবেগে আন্দোলিত হইতেছে। এমন সময়ে মঞ্চের উপরে নেতাজীর এ কোন্ মূর্ত্তি! শপথ-বাণীর এক স্থানে আসিয়া তাহা পাঠকালে হঠাৎ তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল, তারপর দেহে আর স্পন্দ নাই, চক্ষুতারকা অপলক, সর্ব্বশরীর পাথরের মত কঠিন হইয়া গেছে! একেবারে সমাধিস্থ! সীজার হ্যানিবলের কি এমন সমাধি হইত? এ কি রণােন্মাদের সমাধি? যােদ্ধৃবেশপরিহিত মূর্ত্তি, সম্মুখে বিরাট সৈন্য-প্রদর্শনী,―তাহার মধ্যে এ কি ভাবাবস্থা! দেশের চল্লিশকোটি নর-নারীর দাসত্বমােচন, তাহাদের সেই দুর্ব্বিষহ দারিদ্র ও অসীম দুর্গতি স্মরণমাত্রে সারাপ্রাণে বেদনার বিদ্যুৎ-স্ফুরণ হইল, সেই চল্লিশকোটির বেদনা একটি মানুষের দেহে নিমেষে পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিল―সেই পুঞ্জীভূত বেদনার বিরাট স্পন্দনে সারাদেহ নিস্পন্দ হইয়া গেল। কিন্তু এমন সমাধি ত আর কাহারও হইতে শুনি নাই। প্রায় বিশমিনিট বা অর্দ্ধঘণ্টা ব্যাপিয়া তেমনই অবস্থা―দেহ নিস্পন্দ, চক্ষু পলকহীন; শেষে সেই দেহ স্পর্শ করিলে পর সম্বিৎ ফিরিয়া আসিল। আমি সেই মহাপ্রেমের সেই সমাধি―নেতাজীর সেই মূর্ত্তি আমার মানসনেত্রে অহরহ দেখিতেছি।

 এ মানুষ কি শুধু ‘নেতাজী’? এ যে মানবাত্মার এক নবতম পরিচয়। ভারতভূমি ভিন্ন আর কোন দেশে এহেন রূপ কখনও সম্ভব হইত না। আজাদ-হিন্দ্-সেনার প্রত্যেক নর-নারী এই রূপ দেখিয়াছে, দেখিয়া―‘মুক্ত’ হইয়া গিয়াছে। নহিলে, তাহারা অসম্ভবকে সম্ভব করিতে পারিত না, নিশ্চিত পরাজয়কে জয়ে পরিণত করিবার এমন বিশ্বাস হৃদয়মধ্যে লাভ করিত না; এবং অতিশয় দুরধিগম্য স্থানে প্রবেশ করিয়া, যুবা ও বালক-নির্ব্বিশেষে, তাহাদের পীড়িত উপবাসক্লিষ্ট দেশের শেষ রক্তবিন্দু ও শেষ নিঃশ্বাস, কেবল ‘নেতাজী’-নাম উচ্চারণ করিয়া, এমন হাসিমুখে উৎসর্গ করিতে―এবং তাহাতেই চরম ও পরম শান্তিলাভ করিতে পারিত না। যে-পুরুষকে তাহারা ‘নেতাজী-নাম দিয়াছিল, সে-পুরুষ সকল নামের অতীত; সে-প্রেমকে কেবল হৃদয়ে অনুভব করা যায়, মুখে উচ্চারণ করা যায় না। তথাপি ঐ নামই তাহার নির্দ্দেশক হইয়াছে, ঐ নামের গুণেই শুষ্কতরু মুঞ্জরিত হইতেছে―ঐ নামই এক মহাশক্তি-মন্ত্রের সমান হইয়া উঠিয়াছে। তৎসত্ত্বেও একথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই যে, ঐ নাম ভারতের মুক্তিদাতা এক মহাশক্তি-সাধকের নাম, প্রেমের এক অপূর্ব্ব শক্তি ঐ পুরুষের রূপে মুর্ত্তি-ধারণ করিয়াছিল। সেই শক্তি অমর, তাহার মৃত্যু নাই―তাই পরাজয়ও নাই,[২২] তাই কোনকালে কোন অবস্থায় ‘জয়তু নেতাজী’ বলিতে কোন ভারত-সন্তানের কিছুমাত্র বাধিবে না।

জয় হিন্দ্

  1. আবার স্বাধীন রাষ্ট্রের উচ্চতম পদগুলিও ঐ নেতারাই অধিকার করিবেন, ভারতে আর মানুষ নাই; রাজাগােপালাচারীর পর রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভারতরাষ্ট্রের অধিপতি হইয়েন—মহাত্মার ___ কিনা!
  2. “He knew that to challenge the Mahatma's authority was playing with fire, and yet knowing this he did not hesitate to throw out a challenge, because he thought he was right.” [Testament of Subhash Bose Preface]
  3. পরিশিষ্টে “গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র” দ্রষ্টব্য।
  4. নরিম্যান, আয়েঙ্গার—পরে সুভাষচন্দ্র। Robespiere Danton-র দল ‘গিলোটিন’ আবিষ্কার করিয়াছিল, গান্ধী-কংগ্রেসের এই অহিংস শিরশ্ছেদের যন্ত্র তদপেক্ষা নিপুন।
  5. যদিও এই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বন্ধু শ্রীযুক্ত দিলীপকুমার রায় যাহা বলিয়াছেন তাহাও উল্লেখযোগ্য—
     “But this was not his only tragedy. His life was becoming a frustration at every turn—so much so, that even his brave lion-heart of a born optimist was on the verge of heart-break, as for example, when he instead of roaring actually bleated in his piteous appeal at Tripuri, to Mahatmaji” (The Subhas I knew P, 45)
     ঠিক এই কারণে বর্ত্তমান লেখক (সুভাষচন্দ্রকে তখনও চিনিতাম না) তাঁহার এক সাময়িক প্রবন্ধে সুভাষচন্দ্রের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়াছিলেন।
  6. বর্ত্তমানে সেই মুখােস সে একেবারেই খুলিয়াছে—আর তাহাতে প্রয়োজন নাই বরং ইহার পর এতকালের ছদ্মবেশ ত্যাগ করাই আবশ্যক।
  7. “I feel so forlorn sometime”—This was one of his constantly recurring dirges in his later years of growing disillusionment"—The Subhas I Knew. P 44.
     এবং— “Subhas felt his deepenrag loneliness in his later life as keenly as he did because he was persuaded, he had few to count upon among his compatriots.” (Ibid. P. 111)
  8. পূর্ব্বে উদ্ধৃত দিলীপকুমারের উক্তি স্মরণীয়।
  9. পরিশিষ্টে “গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র” দ্রস্টব্য।
  10. রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই কথা বলিয়াছিলেন—“The spinning wheel might indeed create yearns, but how on earth 1s it going to create Swaraj? For, it cannot possibly call to the soul, as a message has to—for instance, whether you agree with Vivekananda or not, his was a message—a drum-boat inviting to sacrifice, to stake your all. Those who think that the spinning wheel can spur you on similarly do not understand the rudiments of human psychology”. (দিলীপকুমার রায়ের সাক্ষ্য—The Subhas I knew, P. 32)
  11. বিভক্ত খণ্ড ছিন্ন ভারত ইংলণ্ডের রাজাকে জানু পাতিয়া আনুগত্য নিবেদন করিয়াছে। সে সর্ব্বতোভাবে ব্রিটিশ প্রভুদের মন রক্ষা করিয়া তাহাদেরই উপদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, তাহাদেরই প্রতিষ্ঠিত শাসন-যন্ত্র পরিচালনা করিতেছে, এবং সেই বণিকতন্ত্র ও সেই সাম্রাজ্যবাদকে ভিতরে ভিতরে বরণ করিয়া লইয়াছে।
  12. এই ব্যর্থতা এখন নানা উপায়ে, এমন কি, আইনের দ্বারাও চাপিয়া রাখা হইতেছে। জনগণ এখনও তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। কেবল ক্রমেই হতবুদ্ধি হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু ব্যর্থতা যে কত সত্য তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িতে বিলম্ব নাই।
  13. এই গণ-হীন গণ পরিষদই ভারতের গণ-তন্ত্র প্রণয়ন করিতেছে—তাহা ‘ভারতীয় নহে’, হুবহু বিলাতী।
  14. নোয়াখালির কলঙ্ক বাঙালী হাসিমুখে ললাটে তিলকের মত ধারণ করিয়াছে— গান্ধীর দেবলীলা ও অহিংসার মাহাত্ম্য-কীর্ত্তন করিয়া সে তাহার অ-পৌরুষের সকল কালিমা মুছিয়া ফেলিয়াছে—সেখানকার নারী-শিশুকে সে ভালরূপেই উদ্ধার করিয়াছে।
  15. একথা আরও সত্য; যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহা ঘটিতে একটু বিলম্ব হইয়াছে মাত্র। ক্ষীর খাইয়া স্বাধীনতা লাভ করা যায় না, গেলেও ভিক্ষালব্ধ চাউলের মত— ভিক্ষালব্ধ রাজপাটে সুখভোগ হইতে পারে না। প্রভুত্ব বজায় রাখিবার জন্য ন্যায় ও সত্যকে জলাঞ্জলি দিতে হয়— শক্তের তোষামোদ ও দুর্ব্বলের নিপীড়ন আবশ্যক হইয়া পড়ে। এইজন্য ঘোরতর অরাজক ও বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী।
  16. তাঁহার বন্ধু দিলীপকুমার এই কথাই আর এক ভাষায় বলিয়াছেন:―
     “He could only thrill to India when the peninsula ceased to be a thing of clay and became invested with Divinity” (The Subhas I Knew P 79)
    এবং―
     “He died dreaming not of his family or defeats, nor even of the clouds that had so aften blurred his Vision―but of the sun he had dreamed from his boyhood, of faith and courage, that would free his great Goddoss, his Motherland”. (Ibid. P 75)
  17. বিলাত প্রবাসকালে ছাত্রাবস্থায় তরুণ সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে দিলীপকুমার এইরূপ লিখিয়াছেন:―
     "But all the mystic ardour of Subhas had been diverted and canalised to this end. It is not everybody who could subordinate his whole life to one consuming ideal. (Ibid. P. 67)
  18. দিলীপকুমারও সুভাষ-চরিত্রের এই লক্ষণটির উল্লেখবিশেষভাবে করিয়াছেন, যথা―
    “This element of mothorliness in him had always been a salient feature of his charactor. He had been born with a strong streak of tenderness in his composition.” (The Subhas I Knew, P. 34)
  19. অহিংসা-ধর্ম্মে এইরূপ পৌরুষের প্রয়োজন হয় না, নারী-সৈন্য তো পরের কথা, কুলকামিনীদিগকেও রক্ষা করিতে হয় না―তাহারা নিজেরাই আত্মহত্যা করিয়া (বিষপান) নিজেদের সতীত্ব রক্ষা করিবে; পুরুষে তাহার সতীত্ব রক্ষা করিবে কেন? তাহাতে হিংসার প্রয়ােজন হইতে পারে।
  20. দিলীপকুমারও লিখিয়াছেন –“It almost seemed that he not only loved to conquer opposition, but almost courted as it were―probably to enjoy more vividly the joy of courage and price of indomitable initiative” (The Subhas I Knew P. 50)}}
  21. ইহা যেন তাঁহাকে একরূপ সাধনার দ্বারাই লাভ করিতে হইয়াছিল, কারণ, তিনি প্রথম যৌবনে নারীজাতির প্রতি বিমুখ ছিলেন। শ্রীযুক্ত দিলীপকুমারের গ্রন্থে তাহার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।
  22. ভারতের মুক্তি এখনও ঘটে নাই―সেই মুক্তিদান না করিয়া সুভাষচন্দ্রেরও মুক্তি নাই। তাই সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু অসম্ভব।