জ্ঞাতি-শত্রু/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 এই সকল কার্য্য শেষ করিয়া আমি যুবকের সহিত তাঁহার বাড়ী যাইতে প্রস্তুত হইলাম; এবং তাঁহার সহিত সেই ভাড়াটিয়া গাড়ীতে আরোহণ করিলাম। কোচমান শকট চালনা করিল।

 কিছুদুর গমন করিলে পর আমি শক্তিসাধন বাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার জ্যেষ্ঠের বয়স কত?”

 শক্তিসাধন অতি নম্রস্বরে উত্তর করিলেন, “দাদা আমাঅপেক্ষা দশ বৎসরের বড়। দাদার পর আমার আরও দুইটা ভ্রাতা ছিলেন, তাঁহারা উভয়েই অকালে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন।”

 আ। আপনার দাদা কর্ম্ম করিতেন?

 শ। আপাতত কোন কর্ম্মই করিতেন না। নিজের যৎসামান্য সম্পত্তি আছে তাহাই দেখিতেন।

 আ। পৈতৃক সম্পত্তি?

 শ। আজ্ঞে না—দাদার উপার্জ্জিত সম্পত্তি। জ্ঞাতিগণ মোকদ্দমা করিয়া আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। আমি কিম্বা আমার জ্যেষ্ঠ আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির এক কপর্দ্দকও পাই নাই।

 আ। তবে ত আপনার দাদার যথেষ্ট শত্রু আছে দেখিতেছি। যখন জ্ঞাতিগণের সহিত আপনাদের বিবাদ, তখন তাঁহারাই যে আপনাদের শত্রু তাহা ত বেশ বোঝা যাইতেছে। আপনাদের জ্ঞাতিবর্গের বাড়ী কোথায়?

 শ। আজ্ঞে আমাদের বাড়ী হইতে প্রায় অর্দ্ধক্রোশ দুরে। তাঁহাদের বাড়ী শোভাবাজারের নিকট।

 আ। সেই বাড়ীই কি আপনাদের পৈত্রিক সম্পত্তি?

 শ। আজ্ঞে হাঁ—মোকদ্দমায় পরাজিত হইলে দাদা স্ব-ইচ্ছায় সে বাড়ী ত্যাগ করিয়াছিলেন। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহার কয়েকখানি ভাড়াটীয়া বাড়ী আছে। তিনি পৈত্রিক বাড়ী ত্যাগ করিয়া বাগবাজারে নিজ বাটিতে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করেন।

 আ। আপনি অবশ্য সেই বাড়ীতেই থাকেন?

 শক্তিসাধন কোন উত্তর করিলেন না দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। আমি তাঁহাকে পুনরায় ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি সেবারেও কৌশলে আমার কথাটা চাপা দিলেন। আমি কারণ বুঝতে পারিলাম না। আমার সন্দেহ যেন উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল। আমি তখন তাঁহার দিকে চাহিয়া কিছু কর্কশ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কোথায় বাস করেন?

 আমার প্রশ্নে যুবক চমকিত হইলেন। কিন্তু সেবার আর কথাটা চাপা দিতে পারিলেন না। তাঁহার মুখ আরক্তিম ভাব ধারণ করিল, তিনি মস্তক অবনত করিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে আমি কাশীপুরে বাস করি।”

 আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, ইহার ভিতরে কোন গূঢ় রহস্য আছে। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে এই মাত্র যে বলিলেন, আপনার দাদাই আপনার অন্নদাতা ছিলেন? কথাটা ভাল বুঝিতে পরিলাম না।”

 লজ্জার হাসি হাসিয়া শক্তিসাধন উত্তর করিলেন, যদিও আমি কাশীপুরে বাস করি, তত্রাপি প্রতিদিন দুই বেলা দাদার বাড়ীতে গিয়া আহারাদি করিতাম। আমাকে না খাওয়াইয়া দাদা কিম্বা তাঁহার স্ত্রী আহার করিতেন না।”

 আ। আপনার বাড়ীতে কে থাকে?

 শ। আজ্ঞে আমি একাই থাকি।

 আমার সন্দেহ আরও বাড়িতে লাগিল। শক্তিশাধন বাবুর কথা আমি তখনও ভালরূপ বুঝিতে পারিলাম না। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে বাড়ীখান কাহার?”

 লজ্জিত হইয়া অতি ধীরে ধীরে শক্তিসাধন বলিলেন, “আজ্ঞে সেখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী।”

 আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছুক্ষণ পূর্ব্বে বলিয়াছিলেন যে, আপনার জ্যেষ্ঠের কয়েকখানি ভাড়াটিয়া বাড়ী আছে, তাঁহারই আয় হইতে তিনি পরিবারবর্গের ভরণপোষণ করিয়া থাকেন। যদি তাহাই হয়, তবে আপনি কেন স্বতন্ত্র ভাড়টিয়া বাড়ীতে থাকেন? বাড়ীর ভাড়া কত?

 শ। আজ্ঞে পনের টাকা মাত্র।

 আ। আপন কি কার্য্য করেন?

 শক্তিসাধন লজ্জায় কোন উত্তর করিলেন না, মস্তক অবনত করিয়া রহিলেন। আমি পুনরায় ঐ প্রশ্ন করিলাম, তখন তিনি অতি কষ্টে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে কোন কার্য্য করি না। আমি নিষ্কর্মা—কেবল দাদার গলগ্রহ ছিলাম।”

 আ। বাড়ীভাড়াও তিনিই দিতেন?

 শ। আজ্ঞে হাঁ—তিনি প্রতি-মাসে আমার ব্যয়ের জন্য কিছু করিয়া অর্থ দিতেন।

 আমি কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলাম না। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি আপন জ্যেষ্ঠের সঙ্গে বাড়ীতে থাকেন না কেন? যখন তিনি আপনার সকল ভারবহন করিতেছেন, তখন তিনি আপনাকে এক বাড়ীতে রাখেন না কেন?

 শক্তিসাধনের মুখ সহসা পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। তিনি সহসা কোন উত্তর করিলেন না। মস্তক অবনত করিয়া একমনে কি ভাবিতে লাগিলেন।

 এমন সময় কোচম্যানের চীৎকারধ্বনি আমাদের কর্ণগোচর হইল। শক্তিসাধন চমকিয়া উঠিলেন এবং গাড়ী হইতে মুখ বাহির করিয়া তাঁহার জ্যেষ্ঠের বাড়ী দেখাইয়া দিলেন, কোচম্যান সত্বর নির্দ্দিষ্ট স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। আমি অগ্রে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম, শক্তিসাধন পরে নামিলেন এবং কোচম্যানকে ভাড়া দিয়া আমাকে লইয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন।