ঝাঁশির রাণী/রাণীর বাল্য-বৃত্তান্ত
রাণীর বাল্য-বৃত্তান্ত।
মহারাষ্ট্র মধ্যে সাতারার নিকটবর্তী কৃষ্ণানদী তীরে ‘বাই' নামক একটা গ্রাম আছে। তথায় কৃষ্ণরাও নামক একটী ‘কহাডে’ ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। ইনি পেশোয়া-সরকারাধীনে মামলৎদারী কাজ করিতেন। বলবন্ত নামক ইহার একটা বীর্য্যশালী পুত্র ছিল। মহারাষ্ট্র-প্রভু শ্রীমন্ত পেশোয়া, কৃপা করিয়া ইহাকে আপনার খাশ-ফৌজের মধ্যে সরদারী-পদ প্রদান করেন। বলবন্তের দুই পুত্র মোরোপন্ত ও সদাশিব-রাও। ইহাদের মধ্যে, মোরোপন্ত, পিতার সঙ্গে পুণায় বাস করিতেন। ইনি, শ্রীমন্ত দ্বিতীয় বাজীরাও-সাহেবের সহোদর চিমাজী-আপ্পা-সাহেবের প্রসন্ন দৃষ্টিতে পড়িয়াছিলেন। ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে শ্রীমন্ত বাজীরাও ম্যাকম সাহেবের নিকট সমস্ত রাজ্যের ত্যাগ-পত্র লিখিয়া দিয়া, ৮ লক্ষ টাকার বার্ষিক বৃত্তি গ্রহণে স্বীকৃত হইয়া, অবশিষ্ট জীবিত-কাল ব্রহ্মবিত্ত (বিটুর) প্রদেশে অতিবাহিত করিবেন, এইরূপ স্থির করেন। এই সময়ে, আপ্পা-সাহেব দক্ষিণ-"প্রদেশে অবস্থিতি করিতেছিলেন। পুণার রেসিডেণ্ট সাহেব, তাঁহাকে বলিলেন, “দশ বিশ লক্ষ টাকার প্রদেশ তোমাকে দিতেছি, তুমি পুণা-রাজ্যের সংরক্ষণ-ভার গ্রহণ কর।” কিন্তু ইহাতে চিমাজী-আপ্লা- সাহেব সম্মত হইলেন না। পরে তিনি কাশীবাস করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করায়, ইংরাজ-সরকার তাহাকে কাশীতে পাঠাইয়া দিতে স্বীকৃত হইলেন। এই কথা-অনুসারে পেশোয়া-বাজীরাওর ছয়মাসকাল পরে, ইনিও রাজ্যত্যাগী হইয়া কাশীধামে গিয়া বাস করিলেন। ইহার সমভি- ব্যাহারে যে সকল লোকজন যায়, তাহার মধ্যে মোরোপন্ত একজন। মোরোপত্তও সপরিবারে কাশীধামে গিয়া বাস করিলেন। ইনি শ্রীমন্ত। আপ্পাজীর দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হইয়া ৫০ টাকা মাসিক বেতন পাইতেন। মোরাপন্তের পত্নীর নাম ভাগীরথী বাই। ইনি অতি সাধ্বী ও পতিপ্রাণ ছিলেন। ইনি, কাশীধামে অবস্থিতি কালে ১৮ নবেম্বর ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে একটা কন্যারত্ন প্রসব করেন। এই কন্যার নাম—মনুবাই। বলা বাহুল্য, ইনিই ঝশির ভাবী মহারাণী অতুলবীর্য্যবর্তী শ্রীমতী লক্ষ্মী বাই।
মনুবাইর বয়ঃক্রম তিন ও চারি বর্ষ না হইতেই ইহার মাতৃদেবী পরলোকরাসিনী হইলেন। এই সময়ে শ্রীমন্ত আপ্পা-সাহেবের মৃত্যু হওয়ায় মোরোপন্ত কাশীধাম ত্যাগ করিয়া ব্রহ্মাবর্তে গিয়া বাস করিতে বাধ্য হইলেন। আগাজীর সহোদর পেশোয়া বাজীরাও-সাহেব, স্বীয় ঔদার্যগুণে মোরোপকে আপনার নিকট আশ্রয় দিলেন। ব্রহ্মাবর্তে মোনরাপন্ত ও শ্রীমন্ত পেশোয়ার বাসস্থান প্রায় সংলগ্ন ছিল। মনুবাই পিতার অত্যন্ত আদরিণী ছিলেন। দুর্দৈবক্রমে মাতৃবিয়োগ হওয়ায়, কন্যার সমস্ত রক্ষণভার পিতার স্কন্ধে আসিয়া পড়িল। পিতৃসন্নিধানে থাকা-প্রযুক্ত মনুবাইকে প্রায় অষ্টপ্রহর পুরুষবর্গের মধ্যে অবস্থিতি করিতে হইত। এই দিব্যশ্রী ফুল্ল-কপোল বালিকাটা, পেশোয়ার সমস্ত অনুচরবর্গেরই আদরের সামগ্রী ছিল। ইহার উজ্জ্বল বিশালনেত্র ও গৌরবর্ণ মুখকান্তি দেখিয়া সকলেরই আনন্দোদয় হইত। বাজীরাও-সাহেবের অধীনস্থ রামচন্দ্র-পন্ত সুবেদার, বাবাভট, প্রভৃতি প্রমুখ-মণ্ডলী এই বালিকার সতেজবৃত্তি অবলোকন করিয়া কৌতুক-সহকারে ও আদরভরে ইহাকে “চ্ছবেলী” (ময়না) বলিয়া ডাকিতেন। শ্রীমন্ত বাজীরাও পেশোয়ার দত্তকপুত্র নানাসাহেব ও রাও-সাহেব এই দুইটী বালক এই সময় অল্পবয়স্ক হওয়ায় নানাপ্রকার খেলাধুলায় প্রবৃত্ত হইত; এই বালিকাটাও তাহাদের খেলায় যোগ দিবার উপক্রম করিত। এই বালবৃন্দের লীলা অবলোকন করিয়া শ্রীমন্ত। পেশোয়া অত্যন্ত আনন্দ উপলব্ধি করতেন। ঝাঁশিরাণীর সপত্নী মাতা শ্রীমতী চিমা বাই, রাণী ঠাকুরাণীর বাল্যজীবন-সম্বন্ধে এইরূপ বলেন; “বাল্যকালে, বিবাহের পূর্ব্বে, ঘুড়ি-ওড়ানো, চাকা-চালানো, মেয়েদের মধ্যে রাণী-সাজা, কাহাকে দাসী-করা, কাজ না করিলে কাহাকে বা দণ্ড দেওয়া ইত্যাদি বাল্যখেলা রাণীর পছন্দসই ছিল।” নানাসাহেব ও রাওসাহেব-ইহাদের বিদ্যাশিক্ষা দিবার জন্য, তৎকালের পদ্ধতি-অনুসারে, একজন শিক্ষক নিযুক্ত ছিল। এই শিক্ষক ইহাদিগকে বর্ণপরিচয়ে শিক্ষা দিতেন। এই সময়ে, মনুবাই ইহাদের সান্নিধ্যে থাকাযুক্ত তাহারও কতকটা বর্ণ-পরিচয় হইয়াছিল। নানাসাহেব ও রাওসাহেব যখন ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হইতেন, মনুবাইও তাহাদের সঙ্গে যাইত। নানাসাহেবকে তলবার-খেলা অভ্যাস করিতে দেখিয়া মনুবাইও তলবার ঘুরাইতে চেষ্টা করিত। নানাসাহেব হস্তী আরোহণ করিলে, মনুবাইও হাতীতে চড়িবার জন্য উৎসুক হইত। শ্রীমন্ত বাজীরাওর নিকট তখন একটা মাত্র হস্তী ছিল। একদিন পেশোয়া বাজীরাও, বালিকাকে লইয়া হাতীর উপর বসাইতে নানাসাহেবদিগকে আদেশ করিলেন। কিন্তু তাহারা কিছুতেই কথা শুনে না, বালিকাও জেদ ছাড়ে না। এই সময়ে, মোরোপন্ত অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মনুবাইকে বলিল “তোর অদৃষ্টে হাতী কোথা হইতে আসিবে?” এই কথা শুনিয়া সেই উজ্জ্বল-চেতা বালিকা উত্তর করিল “এক ছেড়ে দশটা হাতী আমার ভাগ্যে আছে।” এইরূপে তেজস্বী রাজকুমারদিগের সংসর্গে থাকিয়া বালিকা মনুবাইর পুরুষোচিত বিবিধ শিক্ষা লাভ হইয়াছিল।
মনু-বাইর বিবাহের বয়স উপস্থিত হইলে, তাহার পিতা মোরোপন্ত অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া যোগ্য পাত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক দিন, তিনি কন্যার জন্ম নক্ষত্র ও গ্রহাদির ফলাফল জানিবার জন্য তাহার জন্ম-পত্রিকা কোন উৎকৃষ্ট গ্রহাচার্য্যকে দেখাইতে মনস্থ করিলেন। দৈবক্রমে সেই সময়ে জ্যোতিঃশাস্ত্রপটু বেদশাস্ত্রবিদ তাতা-দীক্ষিত নামক এক পণ্ডিত শ্রীমন্ত বাজীরাও-সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া- ছিলেন। মোরোপন্ত স্বীয় কন্যার জন্ম-পত্রিকা তাঁহার সম্মুখে আনিয়া, তাহার ফলাফল গণনা করিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করিলেন। কোষ্ঠী দেখিয়া আচার্য-ঠাকুর বলিলেন, কন্যার গ্রহফল এতাদৃশ শুভ- দায়ক যে, সে একদিন রাণী' পদবী প্রাপ্ত হইবে। কিন্তু মোরোপন্ত ইহাতে বিশেষ হর্ষ প্রদর্শন না করিয়া কঁশি-প্রদেশে কোন যোগ্য বর পাওয়া যাইতে পারে কি না, সেই বিষয়ে দীক্ষিতকে জিজ্ঞাসা করিলেন। জ্যোতিষী পুনর্বার বলিলেন, “এই বালিকা নিশ্চয়ই রাণী হইবে। সম্প্রতি ঝুঁশির মহারাজ শ্রীমন্ত গঙ্গাধর-রাও-বাবা-সাহেবের স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে। সেইখানে যদি এই কন্যার বিবাহ ঘটিয়া যায়, তবেই গ্রহের ফলাফল সাক্ষাৎ উপলব্ধি হইবে।” এই অশাপ্রদ কথা শুনিয়া মোরোপন্ত শ্রীমন্ত বাজীরাও-সাহেবের দ্বারা, ঝুঁশির মহারাজ গঙ্গাধর-রাওর সমীপে এই বিবাহের প্রস্তাব করিবার নিমিত্ত, জ্যোতিষীকে নিযুক্ত করিলেন। তাত্যা-দীক্ষিত, ঝুঁশির অধিপতি গঙ্গাধর-রাও-বাবা-সাহেবের নিকট গিয়া এই কন্যার সৌন্দর্য্যমহিমা ও গ্রহানুকূল্যের ব্যাখ্যা করিলে, তিনি “বিবেচনা করিয়া দেখিব” এই মাত্র উত্তর করিলেন। পরে, বাজী-রাওর সাগ্রহ মধ্যস্থতা-প্রভাবে তিনি কন্যাকে দেখিবার জন্য রাজ্যের কোন সভাসদমণ্ডলীকে বিযুরে পাঠাইলেন। তাহারা প্রত্যাগত হইয়া বাবা- সাহেবের নিকট কন্যার গুণানুকীর্ত্তন করায় গঙ্গাধর-রাও-বাবাসাহেব কন্যার পাণিগ্রহণে কৃতসংকল্প হইলেন। বিবাহের দিনও স্থির হইল।
যে দিন সমারোহ-সহকারে নববধূ রাজব'টীতে প্রবেশ করিলেন, সেই সময়ে ঝঁশির সকল লোকই বলিতে লাগল, ইনি যেন মুর্তিমতী লক্ষ্মী অবতীর্ণ হইয়াছেন। সেই অবধি তিনি লক্ষ্মীবাই নামে প্রসিদ্ধ হইলেন। সামান্য বালিকা মনুবাই ঝুঁশির মহারাণী হইবে, ইহা কে জানিত!
“যন্মনােরথশতৈরগােচরং ন স্পৃশন্তি কবয়ােহপি যদিগরা।
স্বপ্নবৃত্তিরপি যত্র দুর্লভ লীলয়ৈব বিদধাতি তদ্বিধিঃ॥”