ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 আমার বয়ঃক্রম ১৬ বৎসর হইল, এই বৎসর প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হইবে। মনে মনে আমার পিতা মাতা আশা করিতে লাগিলেন যে, আমি বৎসরের শেষে ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইব, এবং নিয়মিত মাসিক বৃত্তি পাইব। আমারও মন হইতে সেই আশা মুহূর্ত্তের নিমিত্ত তিরােহিত হইল না; কারণ আমি বাল্যকাল হইতে পিতা, মাতা, শিক্ষক ও আত্মীয় স্বজন প্রভৃতি সকলের মুখেই শুনিতাম, ‘আমার মত বুদ্ধিমান বালক অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়।’ এই সকল কথা শুনিতে শুনিতে আমার মনে ক্রমেই ধারণা হইয়াছিল যে, আমি যতদূর বিদ্যাভ্যাস করিয়াছি, তাহা অন্যের অসাধ্য; আর যত পড়ি, বা না পড়ি, পরীক্ষায় নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হইব, এবং মাসিক বৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া পিতা মাতার বহুকাল-সেবিতা আশালতাকে ফলবতী করিব।

 এই সময়ে ঘটনাক্রমে ঐ শ্রেণীতে আমার একজন সঙ্গী মিলিল। ইহাঁর নাম কেদারনাথ বসু। কেদারনাথ ৫ বৎসর একই শ্রেণীতে পড়িতেছেন। প্রত্যেক বৎসরেই পরীক্ষা দেন, কিন্তু তাঁহার নিজের দোষেই হউক বা তাঁহার পরীক্ষকের দোষেই হউক, একবারও উত্তীর্ণ হইতে পারেন না। কেদার অতিশয় গল্প-পটু। তাঁহার গল্প একবার শুনিতে আরম্ভ করিলে, শেষ না করিয়া কাহারও উঠিয়া যাইতে ইচ্ছা হয় না; বরং তাঁহার হাবভাব দেখিয়া—মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলি শুনিয়া, হাসিতে হাসিতে পেটের ভিতর বেদনা উপস্থিত হয়। তাঁহার গল্প যিনি একবার শুনিয়াছেন, তিনি মুহূর্ত্তের জন্যও তাঁহাকে ভুলিতে পারিবেন না। ইহা ব্যতীত তিনি অতি উত্তম গান করিতে ও বাজাইতে পারিতেন। তাঁহার গান ও গল্প শুনিবার নিমিত্ত বালকগণ তাঁহাকে অতিশয় যত্ন করিত এবং তিনিও সকল সময়েই অনুরোধ রক্ষা করিতেন। বর্ত্তমান গায়ক-মণ্ডলীর মত তাঁহার অহঙ্কার বা আপত্তি ছিল না।

 কেদারের কিন্তু দুইটী মহৎ দোষ ছিল, তাহা বালকগণ অবগত ছিল না, আমিও পূর্ব্বে তাহার কিছুমাত্র বুঝিতে সমর্থ হই নাই। তিনি সকলকে লুকাইয়া কখন কখন একটু একটু মদ্য পান করিতেন এবং প্রায়ই সন্ধ্যার পর, কখনও বা অবকাশ-মত দিবাভাগে তাঁহার কোন বন্ধুর বাটীতে যাইবেন বলিয়া বাটী হইতে বহির্গত হইতেন, কিন্তু সেই সময় কেদারকে তাঁহার কোনও বন্ধুর বাটীতে দেখা যাইত না; বরং দুই এক দিবস সন্ধ্যার পর তাঁহাকে কখন হাড়কাটা গলিতে, কখন চিৎপুর রাস্তায়, কখন বা সোণাগাছিতে কেহ কেহ দেখিয়াছেন, এরূপ শুনা গিয়াছে। কেদার সর্ব্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকিতেন। কি গ্রীষ্মকাল, কি বর্ষাকাল, সকল সময়েই তাঁহার পায়ে বিলাতী বার্ণিস করা চক্‌চকে জুতা ও পরিষ্কার সাদা মােজা দেখা যাইত। তাঁহার গায়ে যে কামিজটা ও কোঁচান চাদর খানি থাকিত, তাহা কেহ কখন একটুমাত্র অপরিষ্কার দেখে নাই। সােণার বােতামগুলি ও চেন ছড়াটি সকল সময়েই ঝক্‌ঝক্‌ করিত। কেদারের মস্তকের চুলগুলি সতত দুইভাগে বিভক্ত থাকিত, ও তাহা হইতে সুগন্ধি গোলাপের গন্ধ ভুর্ ভুর্ করিয়া সর্ব্বদা বাহির হইত।

 গত তিন বৎসর হইতে আমার হৃদয়ে যে সর্ব্বনাশের বীজ রােপিত হইয়াছিল, তাহা ক্রমে অঙ্কুরিত হইয়া পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। কেদারের সহিত অল্পে অল্পে আমার যে প্রকার বন্ধুতা ও ভালবাসা স্থাপিত হইয়াছিল, এখন ক্রমে ক্রমে তাহা আরও গাঢ়তর হইতে লাগিল। কেদার আমার সহিত যেরূপ ভাবভঙ্গী দেখাইতে লাগিলেন, আমার উপর সতত যেরূপ দয়া প্রকাশ করিতে লাগিলেন, সর্ব্বদা যেরূপ আমার উপকারের চেষ্টায় মন ও প্রাণ অর্পণ করিতে লাগিলেন, তাহাতে আমি মুহূর্ত্তের জন্যও বুঝিতে পারিলাম না যে, কেদার হইতে আমার কোনও রূপ অনিষ্ট সংঘটিত হইবে, অথবা তাঁহার দ্বারা আমার সর্ব্বনাশের দ্বার উদ্ঘাটিত হইবে।

 ক্রমে ক্রমে কেদার আমার একজন পরম বন্ধু হইয়া উঠিলেন। অবিরত উভয়ে একত্রে থাকিতে ইচ্ছা হইল। এমন কি কেদার যদি এক দিবস স্কুলে না আসিতেন, দিবস যদি তাঁহাকে দেখিতে না পাইতাম, তাহা হইলে সেই দিবস আমার মনে কি প্রকার কষ্ট হইত,—তাহা আমিই জানিতাম। যে পর্য্যন্ত তাঁহাকে পুনরায় দেখিতে না পাইতাম, সেই পর্য্যন্ত কষ্টের লাঘব হইত না।

 এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইয়া গেল, ক্রমে আমরা উভয়েই উভয়ের বাটীতে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলাম; একত্রে শয়ন, একত্রে উপবেশন ও একত্রে ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। সন্ধ্যার সময় কখন ইডেন উদ্যানে যাইয়া মনােহর বাদ্য শ্রবণ করিতে করিতে কলিকাতা নগরীর প্রায় সমস্ত প্রধান প্রধান ইংরাজ, বাঙ্গালী, মুসলমান, ইহুদি প্রভৃতির সহিত পদচারণ করিতে লাগিলাম; কখন বিডন্ স্কোয়ার, ওয়েলিংটন স্কোয়ার প্রভৃতি স্থানে গমন করিয়া, হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান প্রভৃতির ধর্ম্ম-বিবাদ শ্রবণ করিতে লাগিলাম; এবং কখন বা কলনাদিনী ভাগিরথীর তীরে বসিয়া প্রকৃতির সায়ংকালীন মনােহর শােভা সন্দর্শন করিতে করিতে দিনযাপন করিতে লাগিলাম।