তিতাস একটি নদীর নাম/এক/তিতাস একটি নদীর নাম

 এক 

তিতাস একটি নদীর নাম

 তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।

 স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।

 ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।

 মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া-যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনোদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।

 তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।

 কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারিদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোঘল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে—উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্‌ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।

 তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই।

 ঝরণা থেকে জল টানিয়া, পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনোকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনোকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোন্‌কালে কোন্‌ অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল; বাঁ তীরটা একটু মচ্‌কাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শতশত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে—মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূর-পাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমণীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক—কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি।


 অনেক নদী আছে বর্ষার অকুণ্ঠ প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোন হদিস থাকে না, সবদিক একাকার। কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটা নদী ছিল। সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে। ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আর একখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায়। ছেলে-কোলে নারীরাও যাইতে পারে। নৌকাগুলি অচল হয়। মাঝিরা কোমরে দড়ি বাঁধিয়া সেগুলিকে টানিয়া নেয়। এপারে ওপারে ক্ষেত। চাষীরা দিনের রোদে তাতিয়া কাজ করে। এপারের চাষী ওপারের জনকে ডাকিয়া ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করে। ওপারের চাষী ঘাম মুছিয়া জবাব দেয়। গরুগুলি নামিয়া স্নান করিতে চেষ্টা করে। অবগাহন স্নান। কিন্তু গা ডোবে না। কাক-স্নান করা মাত্র সম্ভব হয় কোন রকমে। নারীরা কোমরজলে গা ডুবাইবার চেষ্টায় উবু হয়। দুই হাতে ঢেউ তুলিয়া নীচু-করা ঘাড়ে-পিঠে জল দিয়া স্নানের কাজ শেষ করে। শিশুদের ডুবিবার ভয় নাই বলিয়া মায়েরা তাদের জলে ছাড়িয়া দিয়াও নিরুদ্বেগে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, আর এক পয়সা দামের কার্বলিক সাবানে পা ঘসে। অল্প দূরে ঘর। পুরুষমানুষে ডাক দিলে এখান হইতে শোনা যাইবে; তাই ব্যস্ততা নাই।

 কিন্তু সত্যি কি ব্যস্ততা নাই? যে-মানুষটা এক-গা ঘাম লইয়া ক্ষেতে কাজ করিয়া বাড়ি গেল, তার ভাত বাড়িয়া দিবার লোকের মনে ব্যস্ততা থাকিবেইত। দুপুরে নারীরা ঘাটে বেশি দেরি করে না। কিন্তু সকালে সন্ধ্যায় দেরি করে। পুরুষেরা এজন্য কিছু বলে না। তারা জানে এ নদী দিয়া কোনো সদাগরের নৌকার আসা-যাওয়া নাই।

 শীতে বড় কষ্ট। গম্ গম্ করিয়া জলে নামিতে পারে না। জল খুব কম। সারা গা তো ডোবেই না; কোমর অবধিও ডোবে না। শীতের কন্‌কনে ঠাণ্ডা জলে হুম্ করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে। মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ। চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে। এতদিন যে জলটুক্ অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায়। ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না। গরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয়। মাঘের মাঝামাঝি সর্‌ষে ফুলে আর কড়াই-মটরের সবুজিমায় দুই পারে নক্‌সা করা ছিল। নদীতেও ছিল একটু জল। জেলেরা তিন-কোণা ঠেলা-জাল ঠেলিয়া চাঁদা পুঁটি টেংরা কিছু-কিছু পাইত। কিন্তু চৈত্রের খরায় এ সবের কিছুই থাকে না। মনে হয় মাঘমাসটা ছিল একটা স্বপ্ন। চারিদিক ধু-ধু করা রুক্ষ্মতায় কাতরায়। লোকে বিচলিত হয় না। জানে তারা, এ সময় এমন হয়।


 তিতাসের তেরো মাইল দূরে এমনি একটা নদী আছে। নাম বিজয় নদী। তিতাসের পারের জেলেদের অনেক কুটুম বিজয় নদীর পারের পাড়াগুলিতে আছে। তিতাসের পারের ওরা ওই নদীর পারের কুটুম-বাড়িতে অনেকবার বেড়াইতে গিয়াছে। বিয়ের কনের খোঁজে গিয়াছে। সে-সব গাঁয়ে তারা দেখিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয়। একদিক দিয়া জল শুকায় আর একদিক দিয়া মাছেরা দমবন্ধ হওযার আশঙ্কায় নাক জাগাইয়া হাঁপায়। মাছেদের মত জেলেদেরও তখন দম বন্ধ হইতে থাকে। সামনে মহাকালের শুষ্ক এক কঙ্কালের ছায়া দেখিয়া তারা একসময় হতাশ হইয়া পড়ে। যারা বর্ষার সময় চাঁদপুরের বড় গাঙ্‌এ নৌকা লইয়া প্রবাস বাহিতে গিয়াছিল, তারা সেখানে নিকারীর জিম্মায় নাও জাল রাখিয়া রেলে চড়িয়া আসিয়া পড়ে। তাদের কোন চিন্তা থাকে না। হাতের টাকা ভাঙিয়া এই দুর্দিন পার করে। কিন্তু যারা বর্ষায় ঘরের মায়া ছাড়িয়া বাহির হয় নাই তারাই পড়ে বিপদে। নদী ঠন্‌ঠনে। জাল ফেলিবে কোথায়। তিন-কোণা ঠেলাজাল কাঁধে ফেলিয়া আর-এক কাঁধে গলা-চিপা ডোলা বাঁধিয়া এ-পাড়া সে-পাড়ায় টই-টই করিয়া ঘুরিতে থাকে, কোথায় পানা পুকুর আছে মালিকহীন ছাড়া-বাড়িতে। চার পারে বন বাদাড়ের ঝুপড়ি। তারই ঝরাপাত পড়িয়া, পচিয়া, ভারি হইয়া তলায় শায়িত আছে। তারই উপর দিয়া ভাসিয়া উঠিয়া ছোট মাছেরা ফুট দেয়। গলা-জল শুকাইয়া কোমর-জল, কোমর-জল শুকাইয়া হাঁটু-জল হইয়াছে। মাছেদের ভাবনার অন্ত নাই। কিন্তু অধিক ভাবিতে হয় না। গোপালকাছা-দেওয়া দীর্ঘাকার মালো কাঁধের জাল নামাইয়া শ্যেন-দৃষ্টিতে তাকাইতে তাকাইতে এক সময় খেউ দিয়া তুলিয়া ফেলে। মাছেদের ভাবনা এখানেই শেষ হয়, কিন্তু মাছ যারা ধরিল তাদের ভাবনার আর শেষ হয় না। তাদের ভাবনা আরও সুদূর-প্রসারী। সামনের বর্ষাকাল পর্যন্ত।


 বর্ষাকালের আর খুব বেশি দেরি নাই। সঙ্কট অবসানের সম্ভাবনায় অনেক মালো উদ্বেগের পাহাড় ঠেলিয়া চলিয়াছে, হাতে ঠেলা-জাল লইয়া চুনোপুঁটি যা পায় ধরিয়া পোয়া দেড়-পোয়া চাউলের যোগাড় করিতেছে। কিন্তু গৌরাঙ্গ মালোর দিন আর চলিতে চায় না। একদিন অনেক খানাডোবায় খেউ দিয়া কিছুই পাইল না, নামিলে টগবগ করিয়া পচা জলের ভুরভুরি উঠে, আর খেউ দিলে তিনচারিটা ব্যাঙ্ জাল হইতে লাফাইয়া এদিকে ওদিকে পড়িয়া যায়।

 উঠানের একদিকে একটা ডালিম গাছ। পাতা শুকাইয়া গিয়াছে। গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ লাগাইয়াছিল। বউ যৌবন থাকিতেই শুখাইয়া গিয়াছিল। গাল বসিয়া, বুক দড়ির মত সরু হইয়া গিয়াছিল। বুকের স্তনদুটি বুকেই বসিয়া গিয়াছিল তার। তারপর একদিন সে মরিয়া গিয়াছিল। সে মরিয়া গিয়া গৌরাঙ্গকে বাঁচাইয়াছে। তার কথা গৌরাঙ্গসুন্দরের আর মনে পড়ে না। তারই মত শুকাইয়া-যাওয়া তারই হাতের ডালিম গাছটা চেখে পড়িতে আজ মনে পড়িয়া গেল। উঃ, বউটা মরিয়া কি ভালই না করিয়াছে! থাকিলে, আজ তার অবস্থা হইত ঠিক নিত্যানন্দদাদার মত।

 নিত্যানন্দ থাকে উত্তরের ঘরে। তার বউ আছে। আর আছে একটি ছেলে, একটি মেয়ে। নিত্যানন্দ-পরিবারের দিকে চাহিয়া গৌরাঙ্গ শিহরিয়া উঠে! একপেটের ভাবনা নিয়াই বাঁচি না, দাদা চারিটা পেটের ভাবনা মাথায় করিয়া কেমন তামাক খাইতেছে। তার যেন কোন ভাবনাই নাই।

 সত্যি নিত্যানন্দর আর কোন ভাবনা নাই। যতই ভাবিয়াছে, দেখিয়াছে কোন কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। বৌ ঝিমাইতেছে। ছেলেমেয়ে দুইটা নেতাইয়া পড়িয়া কিসের নির্ভরতায় অক্ষম নিত্যানন্দর মুখের দিকে চাহিয়া আছে। আর নিত্যানন্দ কোন উপায় না দেখিয়া কেবল তামাক টানিতেছে।

 পশ্চিমের ভিটায় গৌরাঙ্গসুন্দরের ঘর। ডালিম গাছে কাঁধের জাল ঠেকাইয়া দিয়া ডোলাটা ছুঁড়িয়া ফেলিল দাওয়ার একদিকে। দক্ষিণ ও পূর্বদিকের ভিটা খালি। তাদের দুই কাকা থাকিত। এক কাকা মরিয়া গিয়াছে এবং তার ঘর বেচিয়া তার শ্রাদ্ধ করিতে হইয়াছে। আরেক কাকা ঘর ভাঙ্গিয়া লইয়া আরেক গাঁয়ে ছাড়িয়া গিয়াছে।

 গৌরাঙ্গ অকারণে খেঁকাইয়া উঠিল, 'খালি তামুক খাইলে পেট ভর্‌ব?’

 “কি খামু তবে?’

 না, লোকটার কেবল পেটই শুখায় নাই। মাথাও শুখাইয়া গিয়াছে।

 ‘চল যাই বুধাইর বাড়ি।’

 নয়ানপুরে বোধাই মালো টাকায় সব মালোদের চেয়ে বড়। বাড়িতে চার পাঁচটা ঢেউটিনের ঘর। দুই ছেলে রোজগারী লোক। বোধাই হাতীর মত মোটা ও কাল। শরীরেও হাতীর মত জোর। তার কারবার অন্য ধরণের। বড় বড় দীঘি ইজারা নিয়া মাছের পোনা ফেলে। মাছ বাড়িতে থাকে, আর তারা তিন বাপ বেটায় লোকজন লইয়া জাল ফেলে, মাছ তোলে, মাছ চালান দেয়। এ কাজে বোধাই অনেক লোকজন খাটায়। নদীতে জল না থাকিলে, মালোরা যখন দুই চোখে অন্ধকার দেখে তখন তারা যায় বোধাইর বাড়িতে।


 কিন্তু তিতাসে কত জল! কত স্রোত! কত নৌকা! সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ।

 আর বিজয়-নদীর তীরে-তীরে যে-মালোরা ঘর বাঁধিয়া আছে, তাদের কত কষ্ট। নদী শুখাইয়া গেলে তাদের নৌকাগুলি অচল হইয়া থাকে আর কাঠ-ফাটা রোদে কেবল ফাটে।

 তিতাস-তীরের মালোরা যারা সেখানে বেড়াইতে গিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় দেখিয়া আসিয়াছে। রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখিতে দেখিতে ফিরতি-পথে তারা অনেকবার ভাবিয়াছে, তিতাস যদি কোনোদিন এই রকম করিয়া শুখাইয়া যায়! ভাবিয়াছে এর আগেই হয়ত তাদের বুক শুখাইয়া যাইবে। ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ পাশের জনকে নিতান্ত খাপছাড়াভাবে বলিয়াছে: ‘বিজ্‌নার পারের মালোগুষ্টি বড় অভাগা রে ভাই, বড় অভাগা!’

 যারা বিজয় নদীর দশা দেখে নাই, বছরের পর বছর কেবল তিতাসের তীরেই বাস করিয়াছে, তারা এমন করিয়া ভাবে না। তারা ভাবে তিন-কোণা ঠেলা-জাল আবার একটা জাল! তারে হাঁটু-জলে ঠেলিতে হয়, উঠে চিংড়ির বাচ্ছা। হাত তিনেক তো মোটে লম্বা। বিজয়ের বুকে তা-ই ডোবে না। তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে। এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত। ওদের মতো ঠেলা-জাল ঘাড়ে করিয়া গ্রামগ্রামান্তরের খানাডোবা খুঁজিয়া মরিতে হইত দুই আনা আর দশ পয়সার মোরলা ধরিবার জন্য।

 জেলেদের বৌ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা—বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে। যে-সব নদীর নাম মেঘনা আর পদ্মা। কি ভীষণ! পাড় ভাঙ্গে। নৌকা ডোবায়। কি ঢেউ। কি গহীন জল। চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে! কত কুমীর আছে সে-সব নদীতে। তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন। রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে। এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া! তিতাস কত শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বৌরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্তমনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে।


 বাংলার বুকে জটার মতো নদীর প্যাঁচ। শাদা, ঢেউ-তোলা জটা। কোন্ মহাস্থবিরের চুম্বন-রস-সিক্ত বাংলা। তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ-খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে। এ সবই নদী।

 সব গুলি নদীর রূপ এক নয়। উহাদের ব্যবহার এবং উহাদের সহিত ব্যবহার তাও বিভিন্ন রকমের। সবগুলি নদীই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কাজে আসে। কিন্তু এ কাজে আসার নানা ব্যতিক্রম আছে। বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া। উহার বিশাল বুকে জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে। নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে। মাছ ধরে। সব বিষয়ে একটা কঠোর রূপ এখানে প্রকটিত। তীরে তীরে বালুচর, তাল নারিকেল সুপারির বাগ। স্রোতের খরায় তীরের মাটি কাটে, ধ্বসে। ঢেউয়ের আঘাতে তীরগুলি ভাঙ্গিয়া খসিয়া পড়ে। গৃহস্থালি ভাঙ্গে। খেতখামার ভাঙ্গে, তাল-নারিকেল, সুপারির গাছগুলি সারি বাঁধিয়া ভাঙ্গিয়া পড়ে। ক্ষমা নাই। ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায় করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ.. সে-ই এক ধরণের শিল্প।

 শিল্পের আরেকটা দিক আছে। সৌম্য শান্ত করুণ স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প। এ শিল্পের শিল্পী মহাকালের তাণ্ডবনৃত্য আঁকিতে পারে না। পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না। এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে।

 এ-শিল্পী যে-ছবি আঁকে তা বড় মনোরম। তীর-ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট পল্লী। তারপর জমি। তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম। মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি। তারপর পল্লী। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে। বৌ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয়। পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে। অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একেব পর এক। কোনোটাতে ছই থাকে, কোনোটাতে থাকে না। কোনো কোনো সময় ছাইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে। বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়; তখন ছইয়ের এ-পারে ও-পারে থাকে বউয়েরই শাড়ি-কাপড়ের বেড়া। স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়িতে যায়, তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না। থাকে না তার মাথায় ঘোমটা। ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে সে। স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাহিরে আসে না।

 তারা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় অনেক হাসি-কান্নার ঢেউ বুকে লইয়া। যে বৌ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল। এরা সব ভিন্ জাতের বৌ। বামুন, কায়েত, নানা জাতের। জেলেদের বৌরা জেলে-নৌকাতেই যায়। তারা অত সুন্দরীও নয়। অত তাদের আবরুরও দরকার হয় না। কিন্তু ওরা খুব সুন্দরী। জেলের ছেলেরা কপালের দোষ দেয়। অমন সুন্দর বৌ তাদের জীবনে কোনদিন আসিবে না। ভালো করিয়া চায় তারা। ভালো করিয়া চাহিতে পারিলে প্রায়ই ছইয়ের ফাঁক দিয়া, বাতাসে শাড়িটা একটু সরিয়া গেলে, চকিতে তারই ফাঁক দিয়া, টুকটুকে একখানা মুখ আর এক জোড়া চোখ চোখে পড়িবে। বৌয়ের অভিভাবক ছইয়ের দুই মুখে গুঁজিয়া দিয়াছে শাড়ির বেড়া; তাতে বৌকে সকলে দেখিতে পারে না, কিন্তু বৌ সকলকে দেখিতে পায়। তিতাসের জলে অনেক মাছ। মালোর ছেলের স্ফুর্তি রসাইয়া ওঠে। জালের দিকে চোখ রাখিয়াই গাহিয়া ওঠে, ‘আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালুয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সূতা রে, নছিবে এই ছিল।’ বৌ ঠিক শুনিতে পাইবে।

 গ্রামের পর খাল। নৌকাখানা সেখানে ঢুকিয়া পড়ে। সাপের জিহ্বার মত চকিতে সে-খাল গ্রামখানাকে ঘুরিয়া কোথায় পলাইয়া গিয়াছে। হয়ত আরো দূরে গিয়াছে। আরো কয়েকখানি গ্রামের পাশ দিয়া জের টানিতে টানিতে গিয়া, তারই কোনটাতে বৌকে লইয়া যাইবে। খালের পাড়েই বাড়ি। ছোট্ট ছেলে-পিলেরা তৈরি হইয়া আছে, বৌকে কি করিয়া চমকাইয়া দিবে। তৈরি হইয়া আছে হয়ত আরও কেউ। খালটা এইখানে শুখাইয়া গিয়াছে। এইখানে নৌকা হইতে উঠিয়া বৌকে খানিকটা হাটিয়া যাইতে হইবে। শিল্পী শান্ত সবুজ সুন্দর রঙে ক্ষেতগুলির বুকে-বুকে যে নক্সা আঁকিয়া রাখিয়াছে তাহারই আল দিয়া বৌকে হাঁটিতে হইবে। তিতাসের তীরে না থাকার কি কষ্ট। যে-বৌয়ের যাওয়ার বাড়ি একেবারে তিতাসের তীরে, কর্ম-চঞ্চল ঘাটখানাতে তার নৌকা লাগে। দশ-জোড়া নারীর চোখের দরদে স্নান করিয়া সে বৌ নৌকা থেকে নামে। তারপর বাপের বাড়ি হইলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট ভাইবোনদের বুকে চাপিয়া ধরে। আর স্বামীর বাড়ি হইলে পিঠের কাপড় সুদ্ধ টানিয়া তুলিয়া ঘোমটা বড় করে, তারপর আগে-পিছে দুই-চারিজন নারীর মাঝখানে থাকিয়া ধীরে ধীরে জড়িত পায়ে ঘাটের পথটুকু অতিক্রম করে।

 পথটুকু অতিক্রম করিয়া জমিলা বাহির-বাড়ির মসজিদ-লগ্ন মক্তবের কোণে পা দিয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিল। তার স্বামী মাঝির সঙ্গে তখনও কেরায়া নিয়া দরদস্তুর করিতেছে। দুই-এক আনা ফেলিয়া দিলেই মাঝি খুশি হইয়া চলিয়া যায়। বুড়া মাঝি। যা খাটিয়াছে! সঙ্গে মাত্র দুই ননদ। তাও ননদের ছোট সংস্করণ! সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে। ভয় করে না বুঝি! লোকটা যেন কি! তাদের অসিতে বলিয়া নিজে অসিতেছে না। বাড়ির পথে বড় বড় ঘাস। সাপ বাহির হইয়াছে হয়ত। ব্যাঙ্ মনে করিয়া এখনই জমিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে যদি ছোবল দেয়!

 ছমির মিয়া হিসাবী লোক। কাউকে এক পয়সা ঠকায় না। বেহুদা কাউকে এক পয়সা বেশিও দেয় না। সব কাজ ওজন করিয়া করে। মাঝি হার মানিয়া নৌকায় গিয়া উঠিলে, ছমিরের মনে অনাহূত এক ছোপ প্রসন্নতা রঙ গুলাইয়া দিল। আজ তার কিসের রাত! এ রাতে কেউ কোন দিন মাঝিকে ঠকায়! কেউ যেন না ঠকায়!

 মাঝি দশ মিনিট ঝগড়া করিয়া যাহা পায় নাই, এক মিনিট চুপ করিয়া তাহার চারিগুণ পাইল। চক্‌চকে সিকিটা শাদা নদীর খোলসা অল্প আলোকে ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া লগিতে ঠেলা দিল।

 ছমির কাছে আসিলে জমিলার মনে হইল—এতক্ষণ এতগুলি সাপ তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটিকে ঘিরিয়া কিল্‌বিল্ করিতেছিল, এখন সব কয়টা সরিয়া পড়িয়াছে। কি ভাল তার মানুষটি!

 কিন্তু তার চাইতেও ভাল একজনকে সে দেখিয়া আসিয়াছে সেই মালোপাড়ার ঘাটে। বড় ভাল লাগিয়াছে তার মানুষটাকে। প্রথম দৃষ্টিতেই সে তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সেও কি তেমনি ভালবাসে নাই? কেমন অনুরাগের ভরে চাহিয়াছিল। আর কেমন মানুষ গো! একবার দেখিয়াই মনে হইল যেন কতবার দেখিয়াছি। বেলা ফুরাইতেছে। একটু একটু বাতাস বহিতেছে। আর সেই বাতাসে আমার শাড়ির বেড়া খুলিয়া গেল, আর তখনই তাকে আমি দেখিতে পাইলাম। যদি না খুলিত, তবে ত দেখিতেই পাইতাম না। এমনি কত লোককে যে আমরা দেখিতে পাই না। অথচ দেখিতে পাইলে এমনি করিয়া আপন হইয়া যাইত। আমরা কি আর দেখি? যে দেখাইবার, সে-ই দেখায়! তা না হইলে সে যখন জলে ঢেউ খেলাইয়া কলসী ডুবাইল, ঠিক সেই সময়ে আমার শাড়ির বাঁধন খুলিল কেন? বর্ষায় আমার বাপ ওদের গাঁয়ে ভিজা নালিতার আঁটি-বোঝাই নৌকা লইয়া যায়, পাট ছাড়াইবার জন্য। আবার যখন বাপের বাড়ি যাইব, বাপকে বলিয়া রাখিব, এই রকম এই রকম মেয়েটি, দেখিতে ঠিক আমার মত। তার বাপকে বলিয়া দেখিও, আমার মেয়ে তোমার মেয়ের সঙ্গে সই পাতিতে চায়, তুমি রাজি আছ কিনা।


 আগে যা বলিতেছিলাম।

 —এ শিল্পী মহাকালের তাণ্ডব-নৃত্য আঁকিতে পারে না। পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ-শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না। এ শিল্পী মেঘনা-পদ্মা-ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করে।

 এ শিল্পী যে ছবি আঁকে তা বড় মনোরম। তীর ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের পর জমি। অগ্রহায়ণে পাকা ধানের মরসুম। আর মাঘে সর্ষেফুলের হাসি। তারপর আবার গ্রাম। লতাপাতা গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা সবুজ গ্রাম। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে সব জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুসনুদুস শিশু ছেলেমেয়েকে চুবাইয়া তোলে। আর বৌ-ঝিয়েরা কলসী লইয়া ডুব দেয়। অল্প একটু দূর দিয়া নৌকা যায় একের পর এক।…


 তিতাস একটি নদীর নাম। এ নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ তার তীরের লোকেরা জানে না। জানিবার চেষ্টা কোনদিন করে নাই, প্রয়োজন বোধও করে নাই। নদীর কত ভাল নাম থাকে—মধুমতী, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সরস্বতী, যমুনা। আর এর নাম তিতাস। সে কথার মানে কোনোদিন অভিধানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। কিন্তু নদী এ-নামে যত প্রিয়, ভালো একটা নাম থাকিলে তত প্রিয় হইতই যে, তার প্রমাণ কোথায়!

 ভালো নাম আসলে কি? কয়েকটা আখরের সমষ্টি বৈত নয়। কাজললতা মেয়েটিকে বৈদুর্যমালিনী নাম দিলে, আর যাই হোক, এর খেলার সাথীরা খুশি হইবে না। তিতাসের সঙ্গে নিত্য যাদের দেখাশুনা, কোনো রাজার বিধান যদি এর নাম চম্পকবতী কি অলকনন্দা রাখিয়া দিয়া যায়, তারা ঘরোয়া আলাপে তাকে সেই নামে ডাকিবে না, ডাকিবে তিতাস নামে।

 নামটি তাদের কাছে বড় মিঠা। তাকে তারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাই এর নামের মালা তাদের গলায় ঝুলানো।

 শুরুতে কে এই নাম রাখিয়াছিল, তারা তা জানে না। তার নাম কেউ কোনোদিন রাখিয়াছে, এও তারা ভাবে না। ভাবিতে বা জানিতেও চায় না। এ কোনোদিন ছিল না, এও তারা কল্পনা করিতে পারে না। কবে কোন্ দূরতম অতীতে এর পারে তাদের বাপ পিতামহেরা ঘর বাঁধিয়াছিল একথা ভাবা যায় না। এ যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়া এখানে বহিয়া চলিয়াছে। এ সঙ্গী তাদের চিরকালের। এ না হইলে তাদের চলে না। এ যদি না হইত, তাদের চলিতও না। এ না থাকিলে তাদের চলিতে পারে না। জীবনের প্রতি কাজে এ আসিয়া উঁকি মারে। নিত্যদিনের ঝামেলার সহিত এর চিরমিশ্রণ।


 নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে। কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহিয়াছে! তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে। কত মানুষ মরিয়াছে। কত মানুষ বিশ্রী ভাবে মরিয়াছে—কত মানুষ না খাইয়া মরিয়াছে—কত মানুষ ইচ্ছা করিয়া মরিয়াছে—আর কত মানুষ মানুষের দুষ্কার্যের দরুণ মরিতে বাধ্য হইয়াছে। আবার শত মরণকে উপেক্ষা করিয়া কত মানুষ জন্মিয়াছে। তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে। তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের কত কান্নার রোল উঠিয়াছে। কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে। কত বুকের কত আগুন, কত চাপা বাতাস তার জলে নিবিয়াছে। কতকাল ধরিয়া এ-সব সে নীরবে দেখিয়াছে, দেখিয়াছে আর বহিয়াছে। আবার সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে। ভাবী নিগ্রহের নিগড়ে আবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিষ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।

 ওরা কারা? ওরা মালোদের ছেলেরা। আর মালোদের মেয়েরা। ওরা তারা নয় যাদের দেয়াল-ঘেরা বাড়ি, সামনে আছে পুষ্করিণী, পাশে আছে কুয়া, যাদের আঙ্গিনার পার থেকেই শুরু হইয়াছে পথ—সে-পথ গিয়াছে শহরের দিকে, পাশের গাঁগুলিতে এক একটা শাখাপথ ঢুকাইয়া দিয়া। সে পথে ঘোড়ার গাড়ি চলে।

 আর মালোদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে-সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে। সে-সব পথ ছোট ছোট। পথের এধার থেকে বুকের শিশু কাঁদিয়া উঠিলে ওধার থেকে মা টের পায়। এধারের তরুণীর বুকের ধুক্‌ধুকানি ওধারের নৌকার মাচানে বসিয়া মালোদের তরুণরা শুনিতে পায়। এপথ অতি খর্ব। দীর্ঘপথ গিয়াছে মাঝ-তিতাসের বুক চিরিয়া। সেপথে চলে কেবল নৌকা।


 তিতাস সাধারণ একটা নদী মাত্র। কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না। কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই। কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই?

 পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে। সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য। এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে। হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে। হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে! কিন্তু মুছিয়া নিয়া সবই নিজের বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে। হয়ত কোনোদিন কাহাকেও সেগুলি দেখাইবে না, জানাইবে না। কারো সেগুলি জানিবার প্রয়োজনও হইবে না। তবু সেগুলি আছে। যে-আখর কলার পাতায় বা কাগজের পিঠে লিখিয়া অভ্যাস করা যায় না, সে-আখরে সে-সব কথা লেখা হইয়া আছে। সেগুলি অঙ্গদের মতো অমর। কিন্তু সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ। কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই!

 আর সত্য তিতাস-তীরের লোকেরা! তারা শীতের রাতে কতক কতক কাঁথার তলাতে ঘুমায়। কতক জলের উপর কাঠের নৌকায় ভাসে। মায়েরা, বোনেরা আর ভাই-বৌয়েরা তাদের কাঁথার তলা থেকে জাগাইয়া দেয়। তারা এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে। দেখে, ফরসা হইয়াছে; তবে রোদ আসিতে আরও দেরি আছে। নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না। জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে–দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া। তারা সে ধোঁয়ার নিচে হাত ডোবায়, পা ডোবায়। অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয়। কাঁথার নিচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে তারা যে কি করিত।


 শরতে আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না। কিন্তু তিতাসের বুকে থাকে ভরা-জল। তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে সাপলা সালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া, আর বাড়ন্ত বর্ষাল ধান নিয়া থাকে অনেক জল। ধানগাছ আর সাপলা সালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে। তারপর শরৎ শেষ হইয়া আসে। কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে। বাড়তি জল শুখাইয়া গিয়া তিতাস তার স্বাভাবিক রূপ পায়। যে-মাটি একদিন অথৈ জলের নিচে থাকিয়া মাখনের মত নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয়। আসে হেমন্ত।

 হেমন্তের মুমূর্ষু অবস্থায় কখন ধানকাটার মরসুম শুরু হইয়া গিয়াছিল। পারে সব খানেই গ্রাম নাই। এক গ্রাম ছাড়াইয়া আরেক গ্রামে যাইতে মাঝে পড়ে অনেক ধানজমি। জমির চাষীরা ধানকাটা শেষ করিয়া ভারে ভারে ধান এদিক ওদিকের গ্রামগুলিতে বহিয়া নিয়া চলে। তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না। থাকে একটু দূরে। একটু ভিতরের দিকে। সেখান হইতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায়। তীরের যেখানে যেখানে বালিমাটির চর, সেখানে তারা আলুর চাষ করে। এ মাটিতে সকরকন্দ আলু ফলায় অজস্র।


 জোবেদ আলীর জোয়ান ছেলেরা ওপারে আলু লাগাইয়া তিন ভাইয়ে এক-সমানে আলী আলী আলী বলিয়া তাদের লম্বা ডিঙ্গিখানা ভাসাইয়া তাতে উঠিয়া পড়িল। বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। হালের চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড় পার করাইতে হইবে। সে কাজ করিবে তাদের মুনীস-দুইজন। সারা বছর তারা জোবেদ আলীর বাড়িতে জন খাটে। খায় দায়, মাহিনা পায়। সারাদিন—ভোর হইতে রাত-অবধি খাটে, রাতের খানিকটা সময় গিয়া নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করিয়া আসে। দিনমানে আর দেখা হয় না। পরিবারেরাও এর বাড়ি ওর বাড়ি ধান ভানিয়া পাট গুটাইয়া কিছু-কিঞ্চিৎ উপায় করে। এইভাবে দিন গুজরায় তারা। কাজেই জোবেদ আলীর ছেলেরা যখন আলী আলী আলী বলিয়া নৌকায় নদী পার হইতে থাকে, মুনীস-দুইজন তখন চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড়ের অনিচ্ছুক দেহমন শীতের জলে নামাইয়া মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া গরুদের ল্যাজে ধরিয়া আল্লা আল্লা মোমিন বলিয়া সাঁতার দেয়। সকালে এপার হইতে ওপার যাইবার বেলা লাঙ্গল কাঁধে করিয়া সর্ষে ক্ষেতগুলির আলের উপর দিয়া গিয়াছে। তীর-অবধি সর্ষেফুলের হলদে জৌলুষে হাসিয়া উঠিয়াছিল। মনে হইয়াছিল কে বুঝি তিতাসের কাঁধে নক্সা-করা উড়ানি পরাইয়া রাখিয়াছে। অর্বাচীন গরুগুলি পাছে তাতে মুখ দেয়, তার জন্য কত না ছিল সতর্কতা। এখন এ-পারে উঠিয়া গায়ের জল মুছিতে মুছিতে চারিদিক আঁধার হইয়া আসে। আঁধারে সব একাকার, গরু কোথায় মুখ দিবে! দিনের শ্রমে শ্রান্ত গরু। আর শ্রান্ত এ দুইজন মানুষ সারাদিন অসুরের বল নিয়া ক্ষেতে খাটিয়াছে। এবার বাড়িতে যাইবে। তাই এত ব্যস্ততা। কিন্তু কার বাড়িতে যাইবে! তাদের প্রভু জোবেদ আলীর বাড়িতে। নিজের বাড়িতে নয়। পাখিরাও এ সময় নিজের বাসায় যায়। তারা যাইবে মুনিবের বাড়িতে। গিয়া গোয়ালে গরু বাঁধিবে। ঘাস কাটিবে। মাড় দিবে, খইল ভুষি দিবে। জোতদার চাষীর বাড়িতে কত কাজ। এটা সেটা টুকিটাকি কাজ করিতে করিতে হাজারগণ্ডা কাজ হইয়া যায়। প্রকাণ্ড চওড়া উঠান। চার ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর। বাহিরের দিকে গোয়ালসুদ্ধ আরো তিন-চারিটা ঘর। দড়ি পাকানো হইতে বেড়াবাঁধা পর্যন্ত এই এতবড় বাড়িতে কত কাজ যে এই দুইজনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকে। কাজ করিতে করিতে রাত বাড়িয়া চলে। এক সময় ডাক আসে—‘অ করমালী অ বন্দালী খাইয়া যাও!’

 খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দেআলী বলে, “ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম ঝাগুর মাছের ঝোল। আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাকভাত আজ জুটল নি, কি জানি?’

 করমালী বলে, ‘বন্দালী ভাই, কইছ কথা মিছা না। তোমার আমার ঘরের মানুষ! তোমার আমার ঘরই নাই, তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয়—থাকি; ফজরে উইঠ্যা মুনিবের বাড়ি গিয়া ঘুমের আলস ভাঙ্গি। ঘরের সাথে এইত সমন্দ। —কি খায়, কি পিন্ধে কোনোদিন নি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পারছি না তখন তোমার আমার কিসের ঘর আর কিসের মানুষ।’

 বন্দেআলী খানিক ভাবিয়া নিয়া বলে, ‘বেবাকই বুঝি করমালী ভাই। তবু মুনিবের ঘরে পঞ্চ সামিগ্রী দিয়া খাইবার সময় ঘরের কথা মনে হয়; গলায় ভাত আইটকা যায় আর খাইতে পারি না।’

 শুনিয়া করমালী বলে, ‘আমার কিন্তু তাও মনে পড়ে না। হ, আগে মাঝে মাঝে পড়ত। এখন দেখি, পড়ে না যে, ইটাই ভাল।’

 একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বন্দেআলী বলে, ‘সারাদিনের মেহ্‌নতে নাস্তানাবুদ হইয়া ঘরে যাই, গিয়া দেখি ছিঁড়া চাটাইয়ে শুইয়া আছে। ঝুপ কইরা তার পাশে শুইয়া পড়ি; জাগাই না। —একদিন তার একখান হাত আইয়া আমার বুকের উপর পইড়া যায়। হাতখান হাতে লইয়া দেখি, কি শক্ত! কড়া পড়ছে, পরের বাড়ির ধান ভানতে ভানতে।’

 করমালীর বউ ধান ভানে না। লোকের বাড়ি-বাড়ি কাঁথা সেলাই করিয়া দেয়। কাঁথা সেলাইয়ের ধুম পড়িয়াছে। তার মোটে অবসর নাই। ডান হাতের সূঁচের ফোঁড় বাঁ হাতের আঙ্গুলের ডগায় তুলিতে তুলিতে আঙ্গুলে হাজার কাটাকুটি দাগ পড়িয়াছে। করমালী প্রায়ই ঘরে গিয়া দেখে বিছানা খালি।

 একটু বিমর্ষ হাসি হাসিয়া করমালী বলিল, ‘বন্দালী ভাই, তুমি ত গিয়া দেখ, বউ ঘুমাইয়া রইছে। আমি ছিঁড়া খাঁথায় গাও এলাইয়া দিয়া পথের পানে চাইয়া থাকি। সে তখন পরের বাড়ির খাঁথা সিলাই করে, আর সে সূঁইচের ফোঁড় আমার বুকে আইয়া বিন্ধে। তার আইতে আইতে রাইত্ গহীন হয়—আগ-আন্ধাইরা রাইত্–দেখি আন্ধাইর গিয়া চাঁদ উঠ্‌ছে—ভাঙা বেড়ার ফাঁকে দিয়া রোশনি ঢুকে, কেডায় যেমুন ফক ফক কইরা হাসে!’

 কথা শেষ হইলেও করমালীর মুখের ম্লান হাসিটুকু মিলাইয়া যায় না। বন্দেআলীর বুক ছাপাইয়া আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হয়। কোনোরকমে সেটা চাপা দিতে দিতে বলে, ‘করমালী ভাই, আছ ভাল। কামে-কাজে থাক, খাও দাও। তার কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে খালি শুইবার সময়। আমার হইছে বিষম জ্বালা! উঠতে বইতে খালি মনে হয় তারে আমি দুখ দিতাছি। একটু সুখ না, শান্তি না—আমরা কি অভাইগ্যা ভাই করমালী?’

 করমালী প্রায় দার্শনিক নির্লিপ্ততার সঙ্গে বলিল, ‘আমার ভাই অত কথায় কথায় শ্বাস পড়ে না! তুমি আমি বড় মুনিবের কাম করি, ভাল খাই! বউরা ছোট মুনিবের কাম করে, ভাল খাইতে পারে না।—আম্‌রার জমি নাই, জিরাত নাই, পরের জমি চইয়া চইয়া জান কাবার করি। যদি জমি থাকত তা’ আইলে বৌরা নিজেরার ঘরে খাটত, তোমারে আমারে মুনিবের মত দেখত।’

 বন্দেআলীর মন এই ধরণের চিন্তায় সায় দেয় না! সে ভাবে, করমালীর প্রেমিক মন বড় নিষ্ঠাহীন। তার মতে স্ত্রীর প্রতি প্রেম ভালবাসা এসবের বুঝি কোনো দাম নাই। হাঁ দাম নাই-ই তো। তার মতো ভূমিহীন চাষীর কাছে এসবের কোনো দাম নাই। জীবনে যদি বসন্ত আসে তবেই এসবের দাম চোখে ধরা পড়ে। তাদের জীবনে বসন্ত আসে কই!


 আসে বসন্ত। এই সময় মাঠের উপর রঙ্ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়িঘর তারা জেলে। তিতাসে মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাদের বাড়িপিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। বসন্ত তাদের মনে রঙের মাতন জাগায়।

 বসন্ত এমনি ঋতু—এই সময় বুঝি সকলের মনেই প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ্ মাখিয়া সাজে—তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে, তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ্ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ্, পাতায় পাতায় রঙ্। রঙ্ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বৌ-ঝিরা ছোট থালিতে আবির নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখানা আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবির নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবির-মাখানো জায়গাটুকুর উপর রাখে। এই সময়ে বৌ জোকার দেয়। সে-আবিরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনো আকাশ বড় রঙিন। —তিতাসের বুকের আরসিতে যে-আকাশ নিজের মুখ দেখে, সেই আকাশ।

 চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাসে বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল চষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, ক্ষেত উপচাইয়া তার জল ধারা-স্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে-জলের রঙ্ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুইএক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদামাখা ঠাণ্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্দ। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে সহজে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন-না-মানা দাপাদাপিতে কত সুখ! খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম।