দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/বিংশ পরিচ্ছেদ

বিংশ পরিচ্ছেদ
প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে

 বিমুক্তিলাভ করিয়া, বিমলার প্রথম কার্য্য বীরেন্দ্রসিংহকে সংবাদ-দান; উর্দ্ধশ্বাসে বীরেন্দ্রের শয়নকক্ষাভিমূখে ধাবমান হইতেন।

 অর্দ্ধপথ যাইতে না যাইতেই “আল্লা—ল্লা—হে।” পাঠান-সেনার চীৎকারধ্বনি তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল।

 “এ কি পাঠান-সেনার জয়ধ্বনি?” বলিয়া বিমলা ব্যাকুলিত হইলেন। ক্রমে অতিশয় কোলাহল শ্রবণ করিতে পাইলেন;—বিমলা বুঝিলেন, দুর্গবাসীরা জাগরিত হইয়াছে।

 ব্যস্ত হইয়া বীরেন্দ্রসিংহের শয়নকক্ষে গমন করিয়া দেখেন যে, কক্ষমধ্যেও অত্যন্ত কোলাহল; পাঠান-সেনা দার-ভগ্ন করিয়া কমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে; বিমলা উঁকি মারিয়া দেখিলেন যে, বীরেন্দ্রসিংহের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ, হস্তে নিষ্কোষিত অসি, অঙ্গে রুধিরধারা। তিনি উন্মত্তের ন্যায় অসি ঘূর্ণিত করিতেছেন। তাঁহার যুদ্ধোদ্যম বিফল হইল; একজন মহাবল পাঠানের দীর্ঘ তরবারির আঘাতে বীরেন্দ্রের অসি হস্তচ্যুত হইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইল; বীরেন্দ্রসিংহ বন্দী হইলেন।

 বিমলা দেখিয়া শুনিয়া হতাশ হইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। এখনও তিলোত্তমাকে রক্ষা করিবার সময় আছে। বিমলা তাঁহার কাছে দৌড়িয়া গেলেন। পথিমধ্যে দেখিলেন, তিলোত্তমার কক্ষে প্রত্যাবর্ত্তন করা দুঃসাধ্য; সর্বত্র পাঠান-সেনা ব্যাপিয়াছে। পাঠানদিগের যে দুর্গজয় হইয়াছে, তাহাতে আর সংশয় নাই।

 বিমলা দেখিলেন, তিলোত্তমার ঘরে যাইতে পাঠান-সেনার হস্তে পড়িতে হয়, তিনি তখন ফিরিলেন। কাতর হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, কি করিয়া জগৎসিংহ আর তিলোত্তমাকে এই বিপত্তি-কালে সংবাদ দিবেন। বিমলা একটা কক্ষমধ্যে দাঁড়াইয়া চিন্তা করিতেছেন এমত সময়ে কয়েকজন সৈনিক অন্যঘর লুঠ করিয়া, সেই ঘর লুঠিতে আসিতেছে দেখিতে পাইলেন। বিমলা অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া ব্যস্তে কক্ষস্থ একটা সিন্ধুকের পার্শ্বে লুকাইলেন। সৈনিকেরা আসিয়া ঐ কক্ষস্থ দ্রব্যজাত লুঠ করিতে লাগিল। বিমলা দেখিলেন, নিস্তার নাই, লুঠেরা সকল যখন ঐ সিন্ধুক খুলিতে আসিবে, তখন তাহাকে অবশ্য ধৃত করিবে। বিমলা সাহসে নির্ভর করিয়া কিঞ্চিৎকাল অপেক্ষা করিলেন এবং সিন্ধুকপার্শ্ব হইতে সাবধানে সেনাগণ কি করিতেছে, দেখিতে লাগিলেন। বিমলার অতুল সাহস; বিপৎকালে সাহস বৃদ্ধি হইল। যখন দেখিলেন যে, সেনাগণ নিজ নিজ দস্যুবৃত্তিতে ব্যাপৃত হইসাছে, তখন নিঃশব্দপদবিক্ষেপে সিন্ধুকপার্শ্ব হইতে নির্গত হইয়া, পলায়ন করিলেন। সেনাগণ লুঠে ব্যস্ত, তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। বিমলা প্রায় কক্ষদ্বার পশ্চাৎ করেন, এমন সময়ে একজন সৈনিক আসিয়া পশ্চাৎ হইতে তাঁহার হস্তধারণ করিল। বিমলা ফিরিয়া দেখিলেন, রহিম সেখ্! সে বলিয়া উঠিল, “তবে পলাতক! আর কোথায় পলাবে?”

 দ্বিতীয়বার রহিমের করকবলিত হওয়াতে বিমলার মুখ শুকাইয়া কিন্তু সে ক্ষণকালমাত্র; তেজস্বিনী বুদ্ধির প্রভাবে তখনই মুখ আবার হর্ষোৎফুল্ল হইল। বিমলা মনে মনে কহিলেন, “ইহারই দ্বারা স্বকর্ম্ম উদ্ধার করিব।” তাহার কথার প্রত্যুত্তরে কহিলেন,—“চুপ কর, আস্তে, বাহিরে আইস”—এই বলিয়া বিমলা রহিম সেখের হস্ত ধরিয়া বাহিরে টানিয়া আনিলেন; রহিমও ইচ্ছাপূর্ব্বক আসিল। বিমলা তাকে নির্জ্জনে পাইয়া বলিলেন, “ছি ছি ছি! তােমার এমন কর্ম্ম! আমাকে রাখিয়া তুমি কোথায় গিয়াছিলে? আমি তােমাকে না তল্লাস করিয়াছি এমন স্থান নাই।”

 বিমলা আবার সেই কটাক্ষ সেখ্জীর প্রতি নিক্ষেপ করিলেন।

 সেখ্জীর গোসা দূর হইল; বলিল,—“আমি সেনাপতিকে জগৎসিংহের সংবাদ দিবার জন্য তল্লাস করিয়া বেড়াইতেছিলাম, সেনাপতির নাগাল না পাইয়া, তোমার তল্লাসে ফিরিয়া আসিলাম; তােমাকে ছাদে না দেখিয়া নানা স্থানে তল্লাস করিয়া বেড়াইতেছি।”

 বিমলা কহিলেন,—“আমি তােমার বিলম্ব দেখিয়া মনে করিলাম, তুমি আমাকে ভুলিয়া গেলে; এজন্য তােমার তল্লাসে আসিয়াছিলাম। এখন আর বিলম্বে কাজ কি? তােমাদের দুর্গ অধিকার হইয়াছে; এই সময়ে পলাইবার উদ্যোগ দেখা ভাল।”

 রহিম কহিল, “আজ না, কাল প্রাতে; আমি না বলিয়া কি প্রকারে যাইব? কাল প্রাতে সেনাপতির নিকট বিদায় লইয়া যাইব।”

 বিমণা কহিলেন, “তবে চল, এই বেলা আমার অলঙ্কারাদি যাহা আছে, হস্তগত করিয়া রাখি; নচেৎ আর কোন সিপাহী লুঠ করিয়া লইবে।”

 সৈনিক কহিল, “চল।” রহিমকে সমভিব্যাহারে লইবার তাৎপর্য্য এই যে, সে বিমলাকে অন্য সৈনিকের হস্ত হইতে রক্ষা করিতে পারিবে। বিলার সতর্কতা অচিরাৎ প্রমাণীকৃত হইল! তাহারা কিয়দ্দূর যাইতে না যাইতেই আর একদল অপহরণাসক্ত সেনার সম্মুখে পড়িল। বিমলাকে দেখিবামাত্র তাহারা কোলাহল করিয়া উঠিল— “ওরে বড় শিকার মিলেছে রে!”

 রহিম বলিল,—“আপন আপন কর্ম্ম কর ভাই সব, এদিকে নজর করিও না।”

 সেনাগণ ভাব বুঝিয়া ক্ষান্ত হইল। একজন কহিল, “রহিম! তোমার ভাগ্য ভাল। এখন নবাব মুখের গ্রাস না কাড়িয়া লয়।”

 রহিম ও বিমলা চলিয়া গেল। বিমলা রহিমকে নিজ শয়নকক্ষের নীচের কক্ষে লইয়া গিয়া কহিলেন, “এই আমার নীচের ঘর; এই ঘরের রে যে সামগ্রী লইতে ইচ্ছা হয় সংগ্রহ কর; ইহার উপরে আমার গুইবার ঘর, আমি তথা হইতে অলঙ্কারাদি লইয়া শীঘ্র আসিতেছি।” এই বলিয়া তাহাকে একগোছ চাবি ফেলিয়া দিলেন।

 রহিম কক্ষে দ্রব্য-সামগ্রী প্রচুর দেখিয়া হৃষ্টচিত্তে সিন্ধুক পেটায় খুলিতে লাগিল। বিমলার প্রতি আর তিলার্দ্ধ অবিশ্বাস রহিল না। বিমলা কক্ষ হইতে বাহির হইয়াই ঘরের বহির্দ্দিক শৃঙ্খল বন্ধ করিয়া কুলুপ দিলেন। রহিম কমধ্যে বন্দী হইয়া রহিল।

 বিমলা তখন উর্দ্ধশ্বাসে উপরের ঘরে গেলেন। বিমলা ও তিলোত্তমার প্রকোষ্ঠ দুর্গের প্রান্তভাগে; সেখানে এ পর্যন্ত অত্যাচারী সেনা আইসে নাই; তিলোত্তমা ও জগৎসিংহ কোলাহলও শুনিতে পাইয়াছেন কি না সন্দেহ। বিমলা অকস্মাৎ তিলোত্তমার কক্ষধ্যে প্রবেশ না করিয়া, কৌতুহলপ্রযুক্ত দ্বারমধ্যস্থ এক ক্ষুদ্ররন্ধ্র হইতে গােপনে তিলােত্তমার ও রাজকুমারের ভাব দেখিতে লাগিলেন। যাহার যে স্বভাব! এ সময়েও বিমলার কৌতূহল! যাহা দেখিলেন, তাহাতে কিছু বিস্মিত হইলেন।

 তিলােত্তমা পালঙ্কে বসিয়া আছেন, জগৎসিংহ নিকটে দাঁড়াইয়া নীরবে তাঁহার মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিতেছেন। তিলােত্তমা রােদন করিতেছেন, জগৎসিংহও চক্ষু মুছিতেছেন।

 বিমলা ভাবিলেন, “এ বুঝি বিদায়ের রােদন।”