দেবী চৌধুরাণী (১৯৩৯)

 বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ

দেবী চৌধুরাণী

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

[১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত]

সম্পাদক:
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীসজনীকান্ত দাস

বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ
২৪৩।১, অপার সারকুলার রোড
কলিকাতা

 বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ হইতে

 শ্রীমন্মথমোহন বসু কর্ত্তৃক

 প্রকাশিত

মূল্য এক টাকা
ভাদ্র, ১৩৪৬

শনিরঞ্জন প্রেস

২৫।২ মোহনবাগান রো
কলিকাতা হইতে
শ্রীপ্রবোধ নান কর্ত্তৃক

মুদ্রিত

বিজ্ঞপ্তি

 ১২৪৫ বঙ্গাব্দের ১৩ই আষাঢ়, মঙ্গলবার, (১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দ, ২৬এ জুন) রাত্রি ৯টায় কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা সাহিত্য-পঞ্জীতে সেটি স্মরণীয় দিন—ঐ দিন আকাশে কিন্নর-গন্ধর্বেরা নিশ্চয়ই দুন্দুভিধ্বনি করিয়াছিল—দেববালারা অলক্ষ্যে পুষ্পবৃষ্টি করিয়াছিল—স্বর্গে মহোৎসব নিষ্পন্ন হইয়াছিল। এই বৎসরের ১৩ই আষাঢ় বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম-শতবার্ষিকী। এই শতবার্ষিকী সুসম্পন্ন করিবার জন্য বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ নানা উদ্যোগ-আয়োজন করিতেছেন—দেশের প্রত্যেক সাহিত্য-প্রতিষ্ঠানকে এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিকদিগকে উৎসবের অংশভাগী হইবার জন্য আমন্ত্রণ করা হইতেছে। সারা বাংলা দেশে বেশ সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। বঙ্গের বাহিরেও নানা স্থান হইতে সহযোগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাইতেছে।

 পরিষদের নানাবিধ আয়োজনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য—বঙ্কিমচন্দ্রের যাবতীয় রচনার একটি প্রামাণিক ‘শতবার্ষিক সংস্করণ’-প্রকাশ। বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র রচনা—বাংলা ইংরেজী, গদ্য পদ্য, প্রকাশিত অপ্রকাশিত, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, চিঠিপত্রের একটি নির্ভুল ও Scholarly সংস্করণ প্রকাশের উদ্যম এই প্রথম—১৩০০ বঙ্গাব্দের ২৬এ চৈত্র তাঁহার লোকান্তরপ্রাপ্তির দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর পরে—করা হইতেছে; এবং বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ যে এই সুমহৎ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, তজ্জন্য পরিষদের সভাপতি হিসাবে আমি গৌরব বোধ করিতেছি।

 পরিষদের এই উদ্যোগে বিশেষভাবে সহায়ক হইয়াছেন, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রামের ভূম্যধিকারী কুমার নরসিংহ মল্লদেব বাহাদুর। তাঁহার বরণীয় বদান্যতায় বঙ্কিমের রচনা প্রকাশ সহজসাধ্য হইয়াছে। তিনি সমগ্র বাঙালী জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হইলেন। এই প্রসঙ্গে মেদিনীপুরের জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীযুক্ত বিনয়রঞ্জন সেন মহাশয়ের উদ্যমও উল্লেখযোগ্য।

 শতবার্ষিক সংস্করণের সম্পাদন-ভার ন্যস্ত হইয়াছে শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাসের উপর। বাংলা সাহিত্যের লুপ্ত কীতি পুনরুদ্ধারের কার্যে তাঁহারা ইতিমধ্যেই যশস্বী হইয়াছেন। বর্তমান সংস্করণ সম্পাদনেও তাঁহাদের প্রভূত নিষ্ঠা, অক্লান্ত অধ্যবসায় এবং প্রশংসনীয় সাহিত্য-বুদ্ধির পরিচয় মিলিবে। তাঁহারা বহু অসুবিধার মধ্যে এই বিরাট্ দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের পক্ষ হইতে আমি উভয়কে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ জানাইতেছি।

 যাঁহারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সম্পাদকদ্বয়কে বঙ্কিমের সাহিত্য-সৃষ্টি ও জীবনীর উপকরণ দিয়া সাহায্য করিতেছেন, তাঁহাদের সকলের নামোল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। আমি এই সুযোগে সমবেতভাবে তাঁহাদিগকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।

 গ্রন্থপ্রকাশ সম্বন্ধে সংক্ষেপে এই মাত্র বক্তব্য যে, বঙ্কিমের জীবিতকালে প্রকাশিত যাবতীয় গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণ হইতে পূর্ব পূর্ব সংস্করণের পাঠভেদ নির্দেশ করিয়া ও স্বতন্ত্র ভূমিকা দিয়া এই সংস্করণ প্রস্তুত হইতেছে। বঙ্কিমের যে সকল ইংরেজী-বাংলা রচনা আজিও গ্রন্থাকারে সংকলিত হয় নাই, অথবা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত আছে, এবং বঙ্কিমের চিঠিপত্রাদি—এই সংস্করণে সন্নিবিষ্ট হইতেছে।

 বিজ্ঞপ্তি এই পর্যন্ত। বঙ্কিমের স্মৃতি বাঙ্গালীর নিকট চিরোজ্জ্বল থাকুক।

 ১৩ই আষাঢ়, ১৩৪৫
শ্রীহীরেন্দ্রনাথ দত্ত 
 কলিকাতা
সভাপতি, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ 

ভূমিকা

 ‘দেবী চৌধুরাণী’ প্রকাশের সময় বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই আমাদের জানাইয়াছেন—“ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং ঐতিহাসিকতার ভাণ করি নাই। ...দেবী চৌধুরাণীরও ঐরূপ [অর্থাৎ ‘আনন্দমঠে’র মত] একটু ঐতিহাসিক মূল আছে।...‘দেবী চৌধুরাণী’ গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরাণীর সম্বন্ধ বড় অল্প। দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক, গুড্‌ল্যাড্ সাহেব, লেফ্‌টেনাণ্ট ব্রেনান্, এই নামগুলি ঐতিহাসিক।...দেবী চৌধুরাণীকে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বিবেচনা না করিলে বড় বাধিত হইব।”

 এ কথা সত্য। নাম ও তারিখ ধরিয়া দেখিতে গেলে এই উপন্যাসে ইতিহাসকে মানিয়া চলা হয় নাই। প্রকৃত ভবানী পাঠক এক জন ভোজপুরী অর্থাৎ আরা জেলার বিহারী ব্রাহ্মণ। তাহার সহযোগী এবং ততোধিক বড় ডাকাতের সর্দ্দার মজ্‌নুন্ সাহ, মেওয়াতী অর্থাৎ বর্ত্তমান আলোয়ার রাজ্যের লোক; বাঙ্গলায় তাহার জন্ম হয় নাই, এবং মৃত্যুর পর তাহার দেহ বাঙ্গলা হইতে সেই সুদূর মেওয়াতে কবর দিবার জন্য পাঠান হয়, বাঙ্গলার হেয় জমিতে নহে। তাহাদের অনুচরগণ রাজপুত, কেহই বাঙ্গালী নহে—“Not a Bengal(i) rabble, but a number of well-armed Rajputs.” (১৭৭৬ এবং ১৭৮৭ সনের সরকারী রিপোর্ট)। ভবানী পাঠক ১৭৮৭ সনের জুলাই মাসে ইংরেজ সিপাইদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা যায়, স্ব ইচ্ছায় ধরা দিয়া দ্বীপান্তরে যাইবার পর নহে (আর, তখন আন্দামানে কয়েদী পাঠান প্রথা আরম্ভ হয় নাই)। ফলতঃ ওয়ারেন হেষ্টিংস পদত্যাগ করিবার কয়েক বৎসর পরে এই সব ডাকাতদের দমন হয় এবং “দেবী”ও অদৃশ্য হন। দেবী চৌধুরাণী নিজ দল ভাঙ্গিবার কয়েক বৎসর আগে গুড্‌ল্যাড্ রঙ্গপুর ছাড়েন।

 কিন্তু যে চিত্রপটের সামনে এই গ্রন্থের ঘটনাবলী অভিনীত হইয়াছে, অর্থাৎ ইহার সামাজিক আব-হাওয়া, একেবারে সত্য। খাঁটি বাঙ্গালীরাও ডাকাতি করিত। চলন্-বিলের ধারে একটি গ্রামের এক বিখ্যাত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-বংশের পুরুষেরা নৌকাযোগে ডাকাতি করিতে করিতে যে নিজের নূতন জামাইকে হত্যা করেন এবং তাহার অনুতাপে ঐ পাপ-ব্যবসায় ছাড়িয়া দেন, তাহার কথা রাজশাহী-পাবনা জেলায় লোক-প্রসিদ্ধ।

 আর, হেষ্টিংস লাট হইবার পর (১৭৭২) এ দেশের দশা যেরূপ ছিল, বঙ্কিম তাহার অক্ষরে অক্ষরে সত্য বর্ণনা করিয়াছেন। বঙ্কিম মহা পণ্ডিত ছিলেন, বহু বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার পড়াশোনা ছিল, এবং গভীর চিন্তার সাহায্যে পঠিত জ্ঞানকে তিনি পরিপাক করিয়াছিলেন। মনে রাখিতে হইবে, যে ‘দেবী চৌধুরাণী’র জন্য কাল ও স্থান, সে দুইটিই বিদ্রোহের সম্পুর্ণ উপযোগী করিয়া বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। কাল, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের দেশব্যাপী শান্তি ও শৃঙ্খলিত শাসন-পদ্ধতি অস্ত গিয়াছে, অথচ নবীন ব্রিটিশ শাসন দেশে স্থাপিত হয় নাই—এই দুই মহাযুগের সন্ধিস্থল; রাজনৈতিক গোধূলি অরাজকতার বিশেষ সহায়ক। আর স্থান, সীমান্ত প্রদেশ; ‘আনন্দমঠে’ বন্য ঝাড়খণ্ডের প্রবেশদ্বার বীরভূম জেলা, ‘সীতারামে’ সমুদ্রের প্রায় ধারে কোণঠেষা ভূষণা পরগণা, আর ‘দেবী চৌধুরাণী’তে রঙ্গপুর জেলা। মুঘলযুগে মোঙ্গোল জাতীয় কোচ ও আহোম রাজ্য তখন বর্ত্তমান রঙ্গপুর জেলার উত্তরের ও পুবের অনেকাংশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল; কখন আগাইত, কখন পিছাইত, সুতরাং যুদ্ধ, অন্ততঃ লুঠতরাজ নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। সুবা বাঙ্গলার কেন্দ্রস্থ জেলাগুলিতে যেমন নিয়মবদ্ধ শাসন ও “সম্রাটের শান্তি” সজোরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সীমান্ত পরগণাগুলিতে তাহা ছিল না। মহামতি বার্ক একটি সুন্দর উপমা দিয়া দেখাইয়াছেন যে, বিস্তৃত সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড হইতে প্রেরিত রক্তের বেগ অতি দূরবর্ত্তী আঙ্গুলের ডগায় পৌঁছিতে পৌঁছিতে অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া পড়ে। বীরভূম, ভূষণা, রঙ্গপুরেও তাহাই হইত। এই চিরসত্য বঙ্কিমের সৃষ্ট বিদ্রোহীদের পথ সুগম করিয়া দেয়, তাঁহাকে কষ্টকল্পনার আশ্রয় লইতে হয় নাই।

 আর তখন বাঙ্গলা দেশের রাজস্ব-বন্দোবস্তেও অরাজকতা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। টোডরমলের জমি মাপিয়া প্রজার নিকট হইতে খাজনা-নির্দ্ধারণের ব্যবস্থা (জব্‌তী) বাঙ্গলার কোন অংশে প্রচলিত হইবার সময় পায় নাই; সর্ব্বত্রই এক এক জন জমিদারের নিকট থোকে টাকা লইয়া বাঙ্গলার সুবাদার, তথা দিল্লীর বাদশাহ সন্তুষ্ট থাকিতে বাধ্য হইতেন। তাহাও আবার সব জেলায় নহে। মানসিংহের বঙ্গবিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চলে মাত্র নিয়মিতভাবে ও নির্দ্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায় হইত। রাজশাহী (অর্থাৎ সমস্ত রাজশাহী ও পাবনা এবং বগুড়ার দক্ষিণ অংশ লইয়া) ইসলাম খাঁর সময়ে সম্পুর্ণ বশীভূত হইল, এবং ঘোড়াঘাট (অর্থাৎ বর্ত্তমান বগুড়া, দিনাজপুর ও রঙ্গপুর, এই তিনটি জেলার সীমানার মিলন-স্থানকে কেন্দ্র করিয়া তাহার চারি দিকে একটা বৃত্ত টানিলে যতটা জমি তাহার মধ্যে পড়ে, তাহা,) আরও পরে রীতিমত সরকারী খাজনা দিতে আরম্ভ করিল। ময়মনসিংহ জেলাটা তাহারও এক শত বৎসর পরে মুর্শিদ কুলী খাঁর প্রবল শাসনে নিয়মিত-রাজস্ব-প্রদায়ী জেলা হইল, এবং সেটা তাঁহার প্রতিষ্ঠিত নূতন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের পরিশ্রমে। এইরূপে রাষ্ট্রীয় শান্তি ও সুশাসন বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সুবা বাঙ্গলার মোট রাজস্ব বাড়িতে লাগিল; মুর্শিদ কুলী খাঁ প্রথমে আকবরী জমা ছাড়াইয়া উঠেন, আলীবর্দ্দী তাহার উপর রাজকর কয়েক লাখ বাড়াইয়া দেন, এবং সর্ব্বশেষে হতভাগ্য মির কাসিম ইংরেজদের শোষণের ফলে মোট খাজনার পরিমাণ অসম্ভব রকম বেশী করিয়া তোলেন।

 কিন্তু নবাবের শাসনশক্তি যেই পলাসী ও উদুয়ানালার যুদ্ধের ফলে ভাঙ্গিয়া পড়িল, অথচ যখন ইংরেজেরা বণিকত্ব ত্যাগ করিয়া দেশশাসনের দায়িত্ব লইতে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন, কোন রকমে খাজনার টাকা আদায় হইলেই তাঁহারা সন্তুষ্ট, ঠিক সেই সময়, সর্ব্বপ্রথমে সীমান্ত জেলাগুলিতে শান্তি গেল, অরাজকতা তন্দ্রা হইতে জাগিল, প্রজা দরিদ্র হইল, খাজনা কোথা হইতে আসিবে? মির কাসিমের বর্দ্ধিত হারের জমা আদায় করা মনুষ্যের সাধ্যাতীত হইল। তখন সরকারী তহসিলদারগণ প্রজাদের মারপিট এবং নিজেদের উদর পূরণের জন্য লুঠ আরম্ভ করিয়া দিল। ঠিক যেমন অযোধ্যা রাজ্য যত দিন অকর্ম্মণ্য নবাবদের অধীন ছিল, তত দিন কোন জেলায় খাজনা আদায় করিতে হইলে সিপাহীর পল্টন পাঠান আবশ্যক হইত, কখন কখন দুই একটা তোপও—এখানেও সেইরূপ হইল।

 ‘দেবী চৌধুরাণী’তে বর্ণিত যুগে ইংরেজেরা জমির অস্থায়ী বন্দোবস্ত করিতেন, নিলামে সর্ব্বোচ্চ দরে এক এক বৎসরের জন্য (পরে একবার ৫ বৎসরের জন্য জমিদারী ইজারা দেওয়া হইত। ইতিহাস-পাঠক সর্ব্বদেশেই দেখিয়াছেন যে, এই কুপ্রথার ফল ভীষণ প্রজাপীড়ন, চাষের হ্রাস, জমিদারদের সর্ব্বনাশ এবং রাজারও নিয়মিত বার্ষিক আয়ে দ্রুত অবনতি। দেশের এই দুর্দ্দশার চিত্র বঙ্কিম ঠিক আঁকিয়াছেন, ইহার কোন অংশ কল্পিত বা অতিরঞ্জিত নহে। কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) আর যাহাই করুক না কেন, অনেক বৎসর ধরিয়া মফঃস্বলে শান্তি, প্রজার সুখ, এবং রাজস্বের নির্দ্দিষ্টতা আনিয়া দেয়। কিন্তু তাহা যখন ঘটে, তখন “দেবী চৌধুরাণী মরিয়াছে” এবং প্রফুল্ল এক পাল “বড় ডব্‌ডবে চোখ, গালফোলা” জমিদার-শাবক পালন করিতে ব্যস্ত; ডাকাত-রাণীর বজরা ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে—তখন আর তাহার আবশ্যকতা নাই।

 আর একটা কথা বলা আবশ্যক। ঐ নিরস্ত্র বজরাটা যেরূপে ইংরেজ সিপাইদের ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া লেফ্‌টেনাণ্ট ব্রেনান্‌কে বন্দী করিল, তাহা অসম্ভব মনে হইবে কি? জলের মধ্যে লাঠির কাছে সঙ্গীনের পরাজয় কি “বঙ্কিমের বিকৃত মস্তিষ্কের” কল্পনা মাত্র, যেমন একজন অতি প্রসিদ্ধ লেখক ‘আনন্দমঠে’ শান্তির ঘোড়াচড়াকে বর্ণনা করিয়াছেন? সেই যুগে ভারতের সত্য ইতিহাসে ঠিক এইরূপ ঘটনা দুই জায়গায় দেখিতে পাই। ডাঙ্গা ও জলের সন্ধিস্থলে, যেমন নদীর ঘাটে, শিক্ষিত ইংরেজ সৈন্য বড় অসুবিধায় পড়ে, সেরূপ কুস্থানে অল্পক্ষণ দ্রুতগামী যুদ্ধে লাঠি শড়কিই বিজয়ী হয়; ডাঙ্গায় রীতিমত স্থলযুদ্ধে নহে, নৌকায় করিয়া পুরাপুরি জলযুদ্ধেও নহে। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৬৭৯ সনে খান্দেরী দ্বীপের উপর নামিতে গিয়া ছোট নৌকার আরোহী ইংরেজ সেনানী লেফ্‌টেনাণ্ট থর্প এবং আর দুই জন ইংরেজ মারা যায় এবং অনেক ইংরেজ মারাঠাদের হাতে বন্দী হয়। আর একটি দৃষ্টান্ত আছে—১৭৪৮ সনের ১৭ই ফেব্রুয়ারি এন্‌সাইন্ ইংলিশ নামক কর্ম্মচারী কাসিমবাজার হইতে জলপথে কলিকাতায় চারি লাখ টাকার অধিক মূল্যের মাল লইয়া যাইবার সময় কাটোয়ার নিকট কম জলে পৌঁছিলে মারাঠা সৈন্যেরা অতি সহজে বিনা রক্তপাতে তাঁহার সব মাল লুঠিয়া লয় এবং সাহেবকে নিরস্ত্র করে। আমার Shivaji, p. 274 এবং Bihar & Orissa during the Fall of the Mughal Empire, p. 98-এ ইহার বিস্তৃত বিবরণ আছে।

 এই সময়কার রঙ্গপুরের ঘটনা সম্বন্ধে সরকারী কাগজপত্র হইতে নিম্নলিখিত কয়টি কথামাত্র জানা যায়—

“In [June] 1787, Lieutenant Brennan was employed against a notorious leader of dacoits, named Bhawani Pathak. He despatched a native officer with 24 sepoys, who surprised Pathak with 60 of his followers, in their boats. A fight took place in which Pathak himself and three of his lieutenants were killed and eight wounded, besides 42 taken prisoners. We catch a glimpse from the Lieutenant’s report of a female dacoit, by name Devi Chaudhurani, also in league with Pathak. She lived in boats, had a large force of barkandazes in her pay, and committed dacoities on her own account, besides receiving a share of the booty obtained by Pathak. Her title of Chaudhurani would imply that she was a zamindar, probably a petty one, else she need not have lived in boats for fear of capture.

 On receiving Lieut. Brennan’s report, the Collector of Rangpur wrote to him, on 12th July 1787... “I cannot at present give you any orders with respect to the female dacoit mentioned in your letter. If on examination of [the] Bengal[i] papers which you have sent it shall appear that there are sufficient grounds for apprehending her... I shall send you such orders as may be necessary.”

 ইহাই হইল ‘দেবী চৌধুরাণী’র ঐতিহাসিক তথ্য, অর্থাৎ তথ্যের একান্ত অভাব। কিন্তু এই জাতীয় কচকচির উপর কোন মহাকাব্যের মূল্য একেবারেই নির্ভর করে না। ‘আনন্দমঠ’ ‘সীতারাম’ ‘দেবী চৌধুরাণী’তে বঙ্কিম কাব্য-রচনা করিতে বসিয়াছিলেন—‘রাজসিংহ’ এ তিনটি অপেক্ষা অনেক অধিকমাত্রায় ঐতিহাসিক হইলেও তাহাকে কাব্য বলা ভুল হইবে, যদি “কাব্য” বলিতে জীবনের অন্তস্তলের পর্য্যালোচন, “a criticism of life” (ম্যাথু আর্নল্‌ডের ব্যাখ্যা) বুঝি। এই তিনখানি মহাগ্রন্থে ইতিহাস লেখা, এমন কি, ঐতিহাসিক দৃশ্যপট আঁকা পর্য্যন্ত বঙ্কিমের উদ্দেশ্য ছিল না; মানবের হৃদয়কে দিব্য জ্যোতিতে আলোকিত করা, তাহাকে উর্দ্ধতম স্তরে তুলিয়া দেওয়া, এই ছিল তাঁহার প্রতিভার কাজ। এই ‘দেবী চৌধুরাণী’-গ্রন্থের সর্ব্বপ্রথম ছত্রেই তিনি অধ্যাপক সীলীর বাণী উদ্ধৃত করিয়া প্রচার করিতেছেন—“The substance of religion is Culture; the fruit of it, the Higher Life.”

 অর্থাৎ স্বর্গের ও মর্ত্তের মধ্যে সম্বন্ধ বজায় রাখাই মানবজীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধি, এবং প্রকৃত আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুশীলন, সংযম ও আত্মত্যাগ—এই তিনটি বহুদিন ধরিয়া সাধনা করিলে তবে ঐ সিদ্ধিতে উপনীত হওয়া যায়। প্রফুল্লের জীবন তাহার চরম দৃষ্টান্ত, শান্তি এবং শ্রীও এই সাধনার ভিতর দিয়া গিয়াছিল, কিন্তু ফলে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যই বঙ্কিমের শিল্প-কৌশলের প্রমাণ।

 শান্তি, প্রফুল্ল, শ্রী—এ তিন জন নায়িকাকে দূর হইতে দেখিলে একই ছাঁচে ঢালা বলিয়া ভ্রম হওয়া সহজ। তিন জনই অনুপমা সুন্দরী, আবার তাহাদের “বাহির অপেক্ষা ভিতর আরও সুন্দর, আরও মধুর” [‘দেবী চৌধুরাণী’, ১-১৪]; “হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার ভাগিনী, কঠিন কার্য্যের সহায়, সঙ্কটে মন্ত্রী, বিপদে সাহসদায়িনী, জয়ে আনন্দময়ী” [‘সীতারাম,’ ১-১০]; “[আমাকে বীরব্রত] শিখাইলে ত” [‘আনন্দমঠ’, ৩-৩]। তিন জনই অতি দরিদ্রের কন্যা, পিতৃহীনা অসহায়া, অল্পবয়সে বিবাহিতা, কিন্তু তিন জনেই স্বামিসঙ্গ-বঞ্চিতা। তিন জনকেই জীবনে প্রায় একই রকম অসাধারণ ঘটনার মধ্য দিয়া চলিতে হইল;—সেই কঠিন দারিদ্র্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, সধবা হইয়া বিধবার মত ব্রহ্মচারিণী, নিজগৃহ পর্য্যন্ত নাই, দেশপর্য্যটন, শারীরিক বল ও ব্যায়াম অভ্যাস, গীতাপাঠ, নিষ্কামধর্ম্ম শিক্ষা,—এই সবগুলি দিয়া যৌবনে তাহাদের চরিত্র গড়িয়া উঠিল। পাড়াগেঁয়ে বাঙ্গালী ভদ্রঘরের কোমলা নারী, শেষে বিদ্রোহী সন্তানবীর, ডাকাতের সর্দ্দার, “সিংহবাহিনী মূর্ত্তি” বা ভৈরবী হইয়া দাঁড়াইল। অতি দীর্ঘকাল দুঃখে দহিয়া, দৈন্য সহিয়া, · আত্মসংযম করিয়া তবে তাহারা এত শক্ত হইল। এর মধ্যে শান্তির শরীরগঠন ও যোগশিক্ষা আগেই হইয়া গিয়াছিল, আর দুইটির হইল “মহাপুরুষ”-জাতীয় জীবের অধীনে আসিয়া। তিন জনের অভিজ্ঞতা একই, শুধু অভিজ্ঞতা-সঞ্চয়ের সময়ে পার্থক্য।

 অথচ এই তিনটি বিরহিণীর চরিত্র এক ছাঁচে ঢালা নহে। এত দুঃখ দৈন্যের মধ্যেও পরিত্যক্তা শান্তিকে কেহ কখন কাঁদিতে দেখে নাই (‘আনন্দমঠ’ ২-৭ বাদে)। সে কাঁদিয়াছিল শুধু একদিন, গ্রন্থ শেষে (৪-৭) সেই পূর্ণিমার রাত্রে, শেষ যুদ্ধের পর—

“বিজন বনে তমসা নিশীথে
মৃত পতি লয়ে কোলে সাবিত্রী দুঃখিনী”

যে জন্য কাঁদিয়াছিল।

 আর প্রফুল্ল? তাহার প্রথম প্রথমকার কান্না দেখিয়া নয়ান বউয়ের বিষাক্ত বর্ণনা মনে পড়ে—

 সাগর। দেখতে কেমন?

 নয়ন।...যেন গালফুলো গোবিন্দের মা। (৩-১৩)।

কিন্তু সেই প্রফুল্লই যখন নিশ্চয় জানিল যে, শ্বশুর কিছুতেই তাহাকে বাড়ীতে স্থান দিবেন না, তখন, “প্রফুল্লের মাথায় বজ্রাঘাত হইল। সে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। কাঁদিল না—চুপ করিয়া রহিল।” (১-৩)। আবার পরদিন যখন সতীন তীক্ষ্ণ ছুরি মারিয়া বলিল, “দিদি, ঠাকুর তোমার কথার কি উত্তর দিয়াছেন, শুনেছ?—ঠাকুর বলিয়াছেন, [তোমাকে] চুরি ডাকাতি করিয়া খাইতে বলিও”— তখনও প্রফুল্ল কাঁদিল না, “দেখা যাবে” বলিয়া নীরবে বিদায় লইল। (১-৬)। জ্বলন্ত লোহা হাতুড়ির আঘাত পাইয়া শক্ত হইতে আরম্ভ করিল।

 ইহার অতি অল্পকাল পরে, তাহার শিক্ষা আরম্ভ হইবার ঠিক পূর্ব্বে, সে একবার কাঁদিয়াছিল বটে, কিন্তু সেটা গার্হস্থ্য জীবনের শেষ আশাকে বিদায় দিবার জন্য নয় কি?

 প্রফুল্ল। মেয়েমানুষের ভক্তির কি শেষ আছে?

 নিশি। মেয়েমানুষের ভালবাসার শেষ নাই। ভক্তি এক, ভালবাসা আর।

 প্রফুল্ল। আমি তা আজও জানিতে পারি নাই। আমার দুই নূতন।

 প্রফুল্লের চক্ষু দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। নিশি বলিল, “বুঝিয়াছি বোন্, তুমি অনেক দুঃখ পাইয়াছ।” নিশি তখন বুঝিল, ঈশ্বর ভক্তির প্রথম সোপন পতি-ভক্তি। (১-১৩)

 কিন্তু দশ বৎসরের কঠোর ব্রহ্মচর্য্য-সাধনা ও আত্মসংযমের ফলে এই কোমল বাঙ্গালীর মেয়ে নিষ্কাম ধর্ম্ম শিখিয়াছে, অশ্রু সম্বরণ করিতে পারে। অবশেষে যখন ভাবিল যে, আজ জীবনান্তে ব্রজেশ্বরের দেখা পাইয়াছে, তখন “প্রফুল্লের দশ বছরের বাঁধা বাঁধ ভাঙ্গিয়া, চোখের জলের স্রোত ছুটিল” (৩-২)। সে যে তখন মৃত্যুকে বরণ করিয়া লইয়াছে; শ্বশুরের মানরক্ষা করিবার জন্য, শত শত অনুচরকে বৃথা যুদ্ধ হইতে বাঁচাইবার জন্য, নিজে হইতে সাহেবদের কাছে ধরা দিবে, বিষ খাইয়া মরিবে; এই তো জীবনের শেষ দিন আসিয়াছে; আজিকার দিন সেই পূর্ব্বের দশ বৎসরের জীবন হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে চলিবে।

 ফলতঃ প্রফুল্লকে অন্তরে গৃহিণী করিয়া বঙ্কিম সৃষ্টি করিয়াছেন; শান্তি ছিল বনের পাখী, ঘরের খাঁচা তাহার জন্য নয়; শ্রী গৃহিণী হইতে পারিত, হইতে পারিলে সুখী হইত, কিন্তু জ্যোতিষে বিশ্বাসের ফলে কঠোর আত্মত্যাগ করিয়া নিজেকে জোর করিয়া ঘর-সংসার হইতে দূরে টানিয়া ফেলিল। নিশি সহজেই প্রফুল্লকে ধরিয়া ফেলিয়াছিল—

 নিশি বলিল, “এই কি মা, তোমার নিষ্কাম ধর্ম্ম? এই কি সন্ন্যাস?

 ...ও সকল ব্রত মেয়েমানুষের নহে। যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মত হইতে হইবে। আমাকে কাঁদাইবার জন্য ব্রজেশ্বর নাই। আমার ব্রজেশ্বর বৈকুণ্ঠেশ্বর একই।... তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।”

 দেবী। ‘সে পথ খোলা থাকিলে, আমি এ পথে আসিতাম না।’ (২-৮)।

 প্রফুল্ল জানিত যে, স্ত্রীজীবনের পূর্ণ বিকাশ রূপে নহে, অর্থ-লাভে প্রতাপ-চালনে বা ভোগে নহে, কেবল মাতৃত্বে। বৃক্ষের অভিব্যক্তির শেষ এবং সর্ব্বোচ্চ স্তর ফলে,—পাতায় নহে, ফুলে নহে, গন্ধে নহে। তাই প্রফুল্ল ঘরে ফিরিল।

 আর শ্রী? সেও গৃহিণী হইবার উপযুক্ত মন প্রাণ লইয়াই জগতে আসিয়াছিল; পরিত্যাগকারী, পর-হইয়া-যাওয়া, স্বামীর জন্য তাহারও প্রাণ পাগল—

 শ্রী—“আমি ঈশ্বর জানি না—স্বামীই জানি। ... স্বামী ছাড়িয়া আমি ঈশ্বরও চাহি না। যে দিন বালিকা-রয়সে তিনি আমায় ত্যাগ করিয়াছিলেন, সে দিন হইতে আমিও তাঁহাকে রাত্রিদিন ভাবিয়াছিলাম।... কেবল মনে মনে দেবতা গড়িয়া তাঁকে আমি এত বৎসর পূজা করিয়াছি।” (‘সীতারাম’, ১-১৪)।

 অর্থাৎ শ্রীও প্রফুল্লের শেষ পরিণতিতে পৌঁছিয়া সন্ন্যাসিনীত্ব গৃহিণীত্বে লুপ্ত করিতে পারিত; কিন্তু করিল না; দূরে রহিল, সীতারামের কাছে ধরা দিল না। কেন? তাহার অদৃষ্ট, সীতারামের অদৃষ্ট,—অর্থাৎ যাহা মানুষ আগে হইতে দেখিতে পায় না, এমন একটা শক্তি সমস্ত পুরুষকার, সমস্ত হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা আগ্রহ ব্যর্থ করিয়া দিল। সেই ধ্বংসকারী বন্যার স্রোতে এ দুই জন তো ভাসিল, আর ভূষণারাজ্য লোপ পাইল, চন্দ্রচূড় বিফল হইলেন, শত শত নিরপরাধ কুলবধূ পর্য্যন্ত এই প্রলয়ে ডুবিল। ইহাই প্রাচীন গ্রীক ট্রাজেডির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল,—যাহা অদৃষ্টে আছে, তাহা ঘটিবেই ঘটিবে, তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইলে মানবের শত চেষ্টা, সহস্র বুদ্ধি, হৃদয়ের রক্তদান, সকলই বিফল হইবে, যেমন ভাগীরথী-স্রোতে ঐরাবতও ভাসিয়া যায়। অদৃষ্টের বাণী আসিল যে, যদি রাজা লেয়াস্ রাণী জোকাষ্টাকে লইয়া ঘর-সংসার করেন, তবে তাঁহাদের পুত্র পিতৃহন্তা ও মাতৃগামী হইবে। ইহার বিরুদ্ধে সব চেষ্টা ও আয়োজন করা হইল, কিন্তু মানবগণ জানিল না, বুঝিল না, কেমন করিয়া, এই ভবিতব্য অবশেষে ঘটিল; আর তাহার ফলে লেয়াস্ অপঘাতে মারা গেলেন, জোকাষ্টা আত্মহত্যা করিল, তাহাদের অদৃষ্টের শাপে দগ্ধ পুত্র ইডিপাস নিজের চোখ উপড়াইয়া ফেলিলেন। কিন্তু তাহাতেও অদৃষ্টের কোপের প্রলয় থামিল না,—ইডিপাসের দুই পুত্র কাটাকাটি করিয়া মরিল, দেবী-প্রতিমা কন্যা এণ্টিগনী মরিল, সেই কন্যার প্রেমিক মরিল, দেশ পর্য্যন্ত অভিশপ্ত, যুদ্ধে ছারখার হইল, এবং এই পাপের জের আরও এক পুরুষ পর্য্যন্ত চলিল, [“এপিগনী”]। সফোক্লিসের নাট্য-প্রতিভা এই সত্যকে সাহিত্যে চির অমর করিয়া রাখিয়া গিয়াছে।

 সেই মত, শ্রী নিজকে জোর করিয়া সীতারাম হইতে দূরে রাখিল বটে, কিন্তু “প্রিয়প্রাণহন্ত্রী” হইলই হইল, এক অভাবনীয় অদৃষ্টপূর্ব্ব প্রকারে। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’তে অদৃষ্টের খেলা নাই, সেখানে পুরুষকারই জয়ী। এই অন্তঃস্থিত মহাপার্থক্য ‘সীতারাম’ হইতে ঐ আর দুইখানি উপন্যাসের কার্য্যকলাপ ও ফলাফল পৃথক্ জাতীয় করিয়া দিয়াছে।

 শান্তি বনের পাখী, অবশেষে বনে—অর্থাৎ “হিমালয়ের উপর কুটীর প্রস্তুত করিতে” (৪-৭) উড়িয়া গেল। শ্রী প্রলয়ের স্রোতে “কোথায় অন্ধকারে মিশিয়া গেল, কেহ জানিল না” (সীতারাম, ৩-২৩)।

 আর প্রফুল্ল, সে ঘরে ফিরিল।

 সাগর—“এখন গৃহস্থালীতে মন টিঁকিবে? রূপার সিংহাসনে বসিয়া, হীরার মুকুট পরিয়া রাণীগিরির পর কি বাসনমাজা, ঘরঝাঁট দেওয়া ভাল লাগিবে? যোগশাস্ত্রের পর কি ব্রহ্মঠাকুরাণীর রূপকথা ভাল লাগিবে?”

 প্রফুল্ল—“ভাল লাগিবে বলিয়াই আসিয়াছি। এই ধর্ম্মই স্ত্রীলোকের ধর্ম্ম।...কঠিন ধর্ম্মও এই সংসারধর্ম্ম; ইহার অপেক্ষা কোন যোগ কঠিন নয়।...আমি এই সন্ন্যাস করিব।”...সে  যে অদ্বিতীয় মহামহোপাধ্যায়ের শিষ্যা—নিজে পরম পণ্ডিত—সে কথা দূরে থাকুক, কেহ জানিল না যে, তাহার অক্ষর-পরিচয়ও আছে। (৩-১৩-১৪)।

একজন মহাকবি,—ইংরেজ, কিন্তু ঋষির মত দিব্যদ্রষ্টা—চাতক পক্ষীকে দেখিয়া বলিয়াছেন, “তুমিই প্রকৃত জ্ঞানী, তুমি স্বর্গ ও মর্ত্তের মধ্যে সম্বন্ধ রক্ষা করিয়াছ”—

Type of the wise, who soar but never roam,
True to the kindred points of heaven and home.

 প্রফুল্লের জীবনও এই চরম সামঞ্জস্যের দৃষ্টান্ত; নিষ্কাম ধর্ম্মে, দশ বৎসর ব্যাপী ব্রহ্মচর্য্যে গঠিত “দেবী”ই আদর্শ গৃহিণী হইতে পারেন। তাই বঙ্কিম বলিতেছেন—

 “এসো, প্রফুল্ল! একবার লোকালয়ে দাঁড়াও—আমরা তোমাকে দেখি। একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি, ‘আমি নূতন নহি, আমি পুরাতন। ... কতবার আসিয়াছি, তোমরা আমায় ভুলিয়া গিয়াছ, তাই আবার আসিলাম।”

 এই চিরন্তন প্রফুল্ল ১৭৭৬-১৭৮৬ সনের বঙ্গদেশ হইতে অনেক দূরে, অনেক উপরে।

শ্রীযদুনাথ সরকার 

ভূমিকা

(সম্পাদকীয়)

 ইতিহাসের দিক্ দিয়া ‘দেবী চৌধুরাণী’ সম্বন্ধে যাহা কিছু জ্ঞাতব্য, সার্ শ্রীযদুনাথ সরকার তাঁহার ভূমিকায় তাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। প্রফুল্ল-চরিত্রে যে নারীজীবনের পূর্ণ বিকাশ প্রদর্শিত হইয়াছে, ‘সীতারামে’র শ্রী ও ‘আনন্দমঠে’র শান্তির সহিত তুলনামূলক আলোচনা করিয়া তিনি তাহাও দেখাইয়াছেন।

 ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রকাশিত হয়। ইহার কিছু কাল পরে একটি পারিবারিক দুর্ঘটনায় তাঁহার জীবনে বিশেষ পরিবর্ত্তন উপস্থিত হয়; নিছক শিল্পসৃষ্টির জন্য গল্প রচনা হইতে তিনি বিরত হন। এখন হইতে ১৮৮২ সালের মধ্যে তিনি ‘রাজসিংহ’ নামে একটি “ক্ষুদ্র কথা” মাত্র লিখিয়াছিলেন। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে অর্থাৎ মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে বঙ্কিমচন্দ্র ‘রাজসিংহ’কে বর্ত্তমান বৃহৎ রূপ দিয়াছিলেন। ১৮৮২ সাল হইতে ১৮৯৪ সালে মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি মাত্র তিনখানি উপন্যাস, রচনা করিয়াছিলেন। এই উপন্যাস তিনখানি (‘আনন্দমঠ’—১৮৮২; ‘দেবী চৌধুরাণী’—১৮৮৪; ‘সীতারাম’—১৮৮৭) তাঁহার পূর্ব্বেকার সকল গল্প উপন্যাস হইতে স্বতন্ত্র, একটা বিশেষ উদ্দেশ্য লইয়া লিখিত। যে ‘অনুশীলনতত্ত্ব’ লইয়া তিনি শেষজীবনে অবিরত মাথা ঘামাইতেন, উপন্যাসচ্ছলে তাহারই সহজ প্রচারের জন্য তিনি এই তিনটি উপন্যাসের আয়োজন করিয়াছিলেন। তিনি নিজেই এগুলিকে ‘অনুশীলনতত্ত্ব’ প্রচারের একটা “কল” বলিয়া গিয়াছেন। এই তিনখানি উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের “ত্রয়ী” নামে প্রসিদ্ধ।

 স্মরণ রাখিতে হইবে, পাদরি হেস্টির সহিত ‘স্টেটস্‌ম্যানে’ বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুধর্ম্মসংক্রান্ত তর্কযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ‘দেবী চৌধুরাণী’ রচনার সূত্রপাত হয়। অনুশীলনধর্ম্ম সম্বন্ধে তাঁহার বক্তব্যকে দৃষ্টান্তসহযোগে সুপরিস্ফুট করিয়া তুলিবার এই সুযোগ বঙ্কিমচন্দ্র পরিত্যাগ করেন নাই।

 বঙ্কিমচন্দ্রের “ত্রয়ী” লইয়া এখন পর্য্যন্ত যত আলোচনা হইয়াছে, তন্মধ্যে স্বর্গীয় বিপিনচন্দ্র পাল এবং পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিপিনচন্দ্রের আলোচনা নানা সাময়িক পত্রিকার পৃষ্ঠায় ছড়াইয়া আছে। তন্মধ্যে অধুনালুপ্ত ‘নারায়ণ’ ও ‘বঙ্গবাণী’র নাম করা যাইতে পারে। পাঁচকড়িবাবুর “বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রয়ী” প্রবন্ধ ১৩২২ সালের বৈশাখ সংখ্যা ‘নারায়ণে’ মুদ্রিত হইয়াছিল। আমরা সেই প্রবন্ধ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি—

 বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরাণী এবং সীতারাম লিখিয়া বাঙ্গালীর কলঙ্কাপনোদন করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। এই তিনখানা উপন্যাসে বাঙ্গালীর বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে, বাঙ্গালীকে দেশাত্মবোধে প্রবুদ্ধ করিবার চেষ্টা হইয়াছে। “বন্দে মাতরম্” বাঙ্গালার গান, সমগ্র ভারতবর্ষের নহে; এই তিনখানা উপন্যাসে কেবল বাঙ্গালার বাঙ্গালীর কথা আছে, ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের ইঙ্গিত মাত্র নাই। এই তিনখানা উপন্যাস বাঙ্গালার পরিচায়ক, বাঙ্গালিত্বের পরিচায়ক, সমগ্র ভারতবর্ষের নহে। আনন্দমঠের সন্ন্যাসীরা সবাই বাঙ্গালী, দেবীচৌধুরাণী বাঙ্গালী কুলাঙ্গনা, সীতারাম বাঙ্গালী ভৌমিক, চন্দ্রচূড় বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ। এই তিনখানা উপন্যাসই বাঙ্গালীকে বাঙ্গালা দেশের ও বাঙ্গালী জাতির প্রতি দৃষ্টি দিতে শিখাইয়াছে। “বন্দে মাতরম্” গানই বাঙ্গালীকে বঙ্গভূমিকে মা বলিয়া ডাকিতে শিখাইয়াছে। ...

 এই তিনখানি উপন্যাসে, বাঙ্গালীর প্রকৃতির আধারে বঙ্কিমচন্দ্র সমষ্টি, ব্যষ্টি এবং সমন্বয়ের অনুশীলন-পদ্ধতি পরিস্ফুট করিয়াছেন। আনন্দমঠে সমষ্টির বা সমাজের ক্রিয়া দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন; দেবীচৌধুরাণীতে ব্যক্তিগত সাধনার উন্মেষ-প্রকরণ বুঝাইবার প্রয়াস পাইয়াছেন; সীতারামে সমাজ ও সাধক সম্মিলিত হইলে কেমন করিয়া একটা State বা স্বতন্ত্র শাসন সৃষ্ট হইতে পারে, তাহার পর্য্যায় দেখাইয়াছেন। ... সন্ন্যাসীর গৈরিক লেখা তাঁহার শেষ তিনখানি উপন্যাসে যেন উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্বাস ছিল যে, বাঙ্গালায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, এই দুই জাতি ছাড়া সমাজের কোনরূপ ভাঙ্গা গড়া হয় নাই। তাই তিনি এই তিনখানি উপন্যাসে বাঙ্গালার ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের চিত্র উজ্জ্বল করিয়া অঙ্কিত করিয়াছেন। আনন্দমঠে মহেন্দ্র সিংহ সন্তান বটে, কিন্তু তিনি সন্ন্যাস পান নাই। দেবীচৌধুরাণী ব্রাহ্মণকন্যা; সীতারাম কায়স্থ ভৌমিক ও সেনাপতি। আনন্দমঠে তিনি ঠিক সাম্প্রদায়িক ভাবে সমাজের সংস্কার চেষ্টা করিয়াছেন; দেবীচৌধুরাণীতে শক্তিকে সর্ব্বসিদ্ধির আধারভূতা করিয়া বঙ্গীয় মানবতার উন্মেষ সাধনে চেষ্টা করিয়াছেন; সীতারাম উপন্যাসে শক্তি বিরূপা হইলে, পুরুষ মোহান্ধ হইলে, কেমন বাড়া ভাতে ছাই পড়ে, তাহা দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। এই তিনখানা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙ্গালিত্বের শ্লাঘা ও অপহ্লব ফুটাইয়া দেখাইয়াছেন, কিছুই ঢাকিতে চেষ্টা করেন নাই।

 বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ‘দেবী চৌধুরাণী’র যে মূলগত বিশ্লেষণ করিয়াছেন, তদ্দ্বারা বঙ্কিমের মনোগত অভিপ্রায় আমাদের নিকট অনেকটা উদ্ঘাটিত হইয়াছে। তিনি বলিতেছেন—

 দেবীচৌধুরাণী উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার culture বা অনুশীলন তত্ত্বের সাহায্যে একটা মানুষ গড়িতে চেষ্টা করিয়াছেন। এবার ground বা চিত্রের ক্ষেত্র রচিবার প্রয়াসটা বেশ পরিস্ফুট। দেবীচৌধুরাণীর ক্ষেত্র অতি সুন্দর না হইলেও মনোহর বটে। দেবীচৌধুরাণী যেন বৈষ্ণবের হাতের শক্তি-মূর্ত্তি—কমলা নহে, ভৈরবী নহে, কালীও নহে; অথচ তিনের সমন্বয়ে এক অপূর্ব্ব বৈষ্ণবঠাকুরাণী। যখন শক্তি-মূর্ত্তি, তখন পুরুষ সম্মুঢ়; ব্রজেশ্বর পিতৃশাসনে সম্মুঢ়, প্রফুল্লর রূপে সম্মুঢ়। এই পুরুষের তৃপ্তি-তুষ্টি সাগর বৌ, বিরক্তি ও বিধৃতি নয়ান বৌ এবং ঐশ্বর্য্য ও আকাঙ্ক্ষা প্রফুল্ল বা দেবীচৌধুরাণী। প্রফুল্লকে সর্ব্বৈশ্বয্য-শালিনী করিতে যাইয়া কবি গোলে পড়িয়াছেন। প্রফুল্লকে এক রাত্রির জন্য স্বামিসঙ্গে সুখী করিয়া কবি সর্ব্বৈশ্বর্য্যের পথে একটা কণ্টক বিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। তাহার পরিণাম দেবীরাণীর ব্রজেশ্বরের গৃহে আসিয়া বাসন মাজা—ঘরসংসার দেখা। যেমন কর্ম্মী তেজস্বী ব্রাহ্মণ ডাকাতের হাত দিয়া কবি দেবীরাণীকে গড়িয়া তুলিলেন, সে গড়নের ফলে পুরুষ ব্রজেশ্বর সোনা হইয়া যাইবার কথা। কিন্তু কবি প্রফুল্লের সংস্পর্শে ব্রজেশ্বরের মানবতার উন্মেষ-ভঙ্গী দেখান নাই। যেন প্রফুল্ল আসাতেই নয়ান বৌয়ের ঝগড়া থামিল, সাগর বৌয়ের অভিমান দূর হইল, আর ব্রজেশ্বর যেন “নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোয়ং সনাতনঃ” পুরুষের হিসাবে, প্রফুল্লের প্রতি কৃতজ্ঞ হইয়া, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—প্রফুল্ল, সাগর ও নয়ান বৌ—এই তিন গুণে বিচরণ করিতে লাগিলেন। এই তিনের সমাধান করিলেন প্রফুল্ল, সংসারে একটা negative সুখের বা স্বস্তির লহর তুলিলেন প্রফুল্ল, ফলভাগী হইল ব্রজেশ্বর। এই টুকুর জন্য প্রফুল্লকে ব্যাকরণ, অলঙ্কার, দর্শন, বিজ্ঞান, সবই শিখিতে হইল, কুস্তী করিতে হইল, লাঠি খেলিতে হইল, নানা ভঙ্গীতে ত্যাগের মক্স করিতে হইল, দেবীরাণীর দোকানদারী বসাইতে হইল, ডাকাতের দলের সর্দ্দার হইতে হইল! ভবানী পাঠকের গুরুগিরির পর্য্যবসান হইল সাদামাঠা গৃহস্থের কুলাঙ্গনার ঘর-গৃহস্থলীর কার্য্যে— বাসনমাজায় ও সপত্নী বশীকরণে। আদিরসের কবি আদিরসটুকু ভুলিতে পারেন নাই, domesticityর লোভটুকু সামলাইতে পারেন নাই। এতটা শিক্ষার পরেও প্রফুল্ল বৈষ্ণবী হইতে পারিলেন না, তান্ত্রিক মতে শাক্ত ভৈরবী হইতেও পারেন নাই।...কিন্তু প্রফুল্ল-চরিত্র অপূর্ব্ব; উহা বাঙ্গালার নহে, অথচ বেশ বাঙ্গালীয়ানা মাখান। উহা বাঙ্গালীর ঘরে কখনও ছিল না, বাঙ্গালীর ঘরে কখনও হইবে না।

 জাজপুর হইতে বদলি হইয়া বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখে হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিট্রেট হন। জাজপুরেই ‘দেবী চৌধুরাণী’ রচনার সূত্রপাত। শচীশচন্দ্রের ‘বঙ্কিম-জীবনী’তে (৩য় সংস্করণ, পৃ. ১৩১-৩৩) এই সময়ের একটি ডাকাতির উল্লেখ অছে, বঙ্কিমচন্দ্র যাহার অভিজ্ঞতা ‘দেবী চৌধুরাণী’তে প্রয়োগ করিয়াছেন। ওয়েস্ট্‌মেকট সাহেব তখন হাওড়ার ম্যাজিট্রেট। বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত তাঁহার সুরু হইতেই খিটিমিটি বাধিয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র কলিকাতায় বউবাজার স্ট্রীটে বাসা লইয়া, সেখান হইতে হাওড়া যাতায়াত করিতেন। সঞ্জীবচন্দ্র-সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শনে’র অবস্থা তখন কাহিল, মার্চ মাস পর্য্যন্ত (১২৮৯, চৈত্র) কোনও রকমে বাহির হইয়া তাহা বন্ধ হইয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শনে’ নবজীবন সঞ্চার করিবার জন্য কলিকাতার বউবাজারের বাসায় বসিয়া ‘দেবী চৌধুরাণী’ রচনা করিতে থাকেন। কিন্তু তাঁহার সকল চেষ্টা সত্ত্বেও ‘বঙ্গদর্শন’কে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন নাই। ১২৯০ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক হইতে আবার বাহির হইয়া মাঘে উহা চিরতরেই বন্ধ হইয়া যায়, ‘দেবী চৌধুরাণী’র দ্বিতীয় খণ্ড মাত্র শেষ হয়। ওয়েস্ট্‌মেকট সাহেবের হুকুমে বাধ্য হইয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে হাওড়ায় বসবাস করিতে হয়। ‘দেবী চৌধুরাণী’ পুস্তকাকারে বাহির হয় ১২৯১ সালের বৈশাখ মাসে—পুস্তকাকারে বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিতীয় খণ্ডের অনেক পরিবর্ত্তন সাধন করেন।

 বিপিনচন্দ্র পাল ও পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতীত ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়[] পূর্ণচন্দ্র বসু, গিরিজাপ্রসন্ন রায় চৌধুরী, হারাণচন্দ্র রক্ষিত, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত, জয়ন্তকুমার দাশগুপ্ত প্রভৃতিও ‘দেবী চৌধুরাণী’ লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ পুস্তকে অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দেবী চৌধুরাণী’কে রোমান্স পর্য্যায়ে ফেলিয়া আলোচনা করিয়াছেন।

 বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং ‘দেবী চৌধুরাণী’র ইংরেজী অনুবাদ করিয়াছিলেন। এই অনুবাদ পাণ্ডুলিপি আকারেই ছিল। এই পাণ্ডুলিপির কিয়দংশ মাত্র পাওয়া গিয়াছে এবং সেই অংশটুকু রঞ্জন পাবলিশিং হাউস কর্ত্তৃক প্রকাশিত শ্রীবিমলচন্দ্র সিংহ-সম্পাদিত ‘বঙ্কিমপ্রতিভা’ (১৩৪৫) পুস্তকের 63-86 পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হইয়াছে। ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে অমৃতসর হইতে তুলসীরাম এবং ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্ণৌ হইতে জে. প্রসাদ ইহার হিন্দুস্থানী অনুবাদ প্রকাশ করেন। ভি. অম্মল মাদ্রাজ হইতে ‘দেবীচন্দ্রপ্রভা’ নাম দিয়া ইহার তামিল অনুবাদ, এবং মস্‌লিপটম হইতে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে সি. ভাস্কর রাও ইহার তেলুগু অনুবাদ এবং ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মহীশূর হইতে বি. ভেঙ্কটাচার্য্য ইহার কানাড়ী অনুবাদ প্রকাশ করেন।

 ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে কেদারনাথ বিশ্বাস ‘ভবানীপাঠক’ নাম দিয়া ‘দেবী চৌধুরাণী’র এক অতি অক্ষম পরিশিষ্ট প্রকাশ করেন।

  1. “যে সময়ের কথা বলিতেছি, ঠিক সেই সময়ে, অথবা তাহার কিছু পূর্ব্বে বঙ্কিমবাবুর “দেবী চৌধুরাণী” প্রকাশিত হয়। আমি ঐ পুস্তকের একটি সুদীর্ঘ সমালোচনা করি। তাহা আমাদের পাক্ষিকেই প্রকাশিত হয়। আর কোন কাগজেই দেবী চৌধুরাণীর অত বড় বিস্তৃত সমালোচনা প্রকাশিত হয় নাই। ভূদেববাবু ঐ সমালোচনা পাঠ করিয়া প্রীত হইয়াছিলেন এবং “এডুকেশন গেজেটে” “উচ্চ অঙ্গের সমালোচনা” বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। বঙ্কিমবাবুও তাঁহার পুস্তকের ঐ সমালোচনা দেখিয়া সবিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন এবং কোনও বন্ধুর নিকট সমালোচকের তত্ত্ব লইয়াছিলেন।”
    —ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়, ‘নারায়ণ', বৈশাখ ১৩২২, পৃ. ৬৬৫-৬।

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

 ১৫১

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৫ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।