দেবী চৌধুরাণী (১৯৩৯)/তৃতীয় খণ্ড/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

 প্রফুল্ল সাগরকে দেখিতে চাহিল। ব্রজেশ্বরের ইঙ্গিত পাইয়া গিন্নী সাগরকে আনিতে পাঠাইলেন। গিন্নীরও সাধ, তিনটি বৌ একত্র করেন।

 যে লোক সাগরকে আনিতে গিয়াছিল, তাহার মুখে সাগর শুনিল, স্বামী, আর একটা বিবাহ করিয়া আনিয়াছেন—বুড়ো মেয়ে। সাগরের বড় ঘৃণা হইল। “ছি! বুড়ো মেয়ে!” বড় রাগ হইল, “আবার বিয়ে?—আমরা কি স্ত্রী নই?” দুঃখ হইল, “হায়! বিধাতা কেন আমায় দুঃখীর মেয়ে করেন নাই—আমি কাছে থাকিতে পারিলে, তিনি হয় ত আর বিয়ে করিতেন না।”

 এইরূপ রুষ্ট ও ক্ষুণ্ণভাবে সাগর শ্বশুরবাড়ী আসিল। আসিয়াই প্রথমে নয়ান বৌয়ের কাছে গেল। নয়ান বৌ, সাগরের দুই চক্ষের বিষ; সাগর বৌ, নয়ানেরও তাই। কিন্তু আজ দুই জন এক, দুই জনের এক বিপদ্। তাই ভাবিয়া সাগর আগে নয়নতারার কাছে গেল।

 সাপকে হাঁড়ির ভিতর পূরিলে, সে যেমন গর্জ্জিতে থাকে, প্রফুল্ল আসা অবধি নয়নতারা সেইরূপ করিতেছিল। একবার মাত্র ব্রজেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল—গালির চোটে ব্রজেশ্বর পলাইল, আর আসিল না। প্রফুল্লও ভাব করিতে গিয়াছিল, কিন্তু তারও সেই দশা ঘটিল। স্বামী সপত্নী দূরে থাক্, পাড়া প্রতিবাসীও সে কয় দিন নয়নতারার কাছে ঘেঁসিতে পারে নাই। নয়নতারার কতকগুলি ছেলে মেয়ে হইয়াছিল। তাদেরই বিপদ্ বেশী। এ কয় দিন মার খাইতে খাইতে তাদের প্রাণ বাহির হইয়া গেল।

 সেই দেবীর শ্রীমন্দিরে প্রথম সাগর গিয়া দেখা দিলেন। দেখিয়া নয়নতারা বলিল, “এসো, এসো। তুমি বাকী থাক কেন? আর ভাগীদার কেউ আছে?”

 সাগর। কি! আবার না কি বিয়ে করেছে?

 নয়ন। কে জানে, বিয়ে কি নিকে, তার খবর আমি কি জানি?

 সাগর। বামনের মেয়ের কি আবার নিকে হয়?

 নয়ন। বামন, কি শূদ্র, কি মুসলমান, তা কি আমি দেখ্‌তে গেছি?

 সাগর! অমন কথাগুলো মুখে এনো না। আপনার জাত বাঁচিয়ে সবাই কথা কয়।

 নয়ন। যার ঘরে অত বড় কনে বৌ এলো, তার আবার জাত কি?

 সাগর। কত বড় মেয়ে? আমাদের বয়স হবে?

 নয়ন। তোর মার বয়সী।

 সাগর। চুল পেকেছে?

 নয়ন। চুল না পাক্‌লে আর রাত্রি দিন বুড়ো মাগী ঘোম্‌টা টেনে বেড়ায়?

 সা। দাঁত পড়েছে?

 ন। চুল পাক্‌লো, দাঁত আর পড়ে নি?

 সা। তবে স্বামীর চেয়ে বয়সে বড় বল?

 ন। তবে শুন্‌চিস্ কি?

 সা। তাও কি হয়?

 ন। কুলীনের ঘরে এ সব হয়।

 সা। দেখতে কেমন?

 ন। রূপের ধ্বজা! যেন গালফুলো গোবিন্দের মা।

 সা। যে বিয়ে ক’রেছে, তাকে কিছু বল নি?

 ন। দেখ্‌তে পাই কি? দেখতে পেলে হয়। মুড়ো ঝাঁটা তুলে রেখেছি।

 সা। আমি তবে সে সোণার প্রতিমাখানা দেখে আসি।

 ন। যা, জন্ম সার্থক কর্‌গে, যা।

 নূতন সপত্নীকে খুঁজিয়া, সাগর তাহাকে পুকুর-ঘাটে ধরিল। প্রফুল্ল পিছন ফিরিয়া বাসন মাজিতেছিল। সাগর পিছনে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হ্যাঁ গা, তুমি আমাদের নূতন বৌ?”

 “কে, সাগর এয়েছ?” বলিয়া নূতন বৌ সমুখ ফিরিল।

 সাগর দেখিল, কে। বিস্ময়াপন্না হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী রাণী!”

 প্রফুল্ল বলিল, “চুপ্। দেবী মরিয়া গিয়াছে।”

 সা। প্রফুল্ল?

 প্র। প্রফুল্লও মরিয়াছে।

 সা। কে তবে তুমি?

 প্র। আমি নূতন বৌ।

 সা। কেমন ক’রে কি হলো, আমায় সব বল দেখি।

 প্র। এখানে বলিবার জায়গা নয়। আমি একটি ঘর পাইয়াছি, সেইখানে চল, সব বলিব।

 দুই জনে দ্বার বদ্ধ করিয়া, বিরলে বসিয়া, কথোপকথন হইল। প্রফুল্ল সাগরকে সব বুঝাইয়া বলিল। শুনিয়া সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “এখন গৃহস্থালীতে কি মন টিঁকিবে? রূপার সিংহাসনে বসিয়া, হীরার মুকুট পরিয়া, রাণীগিরির পর কি বাসনমাজা, ঘরঝাঁট দেওয়া ভাল লাগিবে? যোগশাস্ত্রের পর কি ব্রহ্মঠাকুরাণীর রূপকথা ভাল লাগিবে? যার হুকুমে দুই হাজার লোক খাটিত, এখন হারির মা, পারির মার হুকুম-বর্‌দারি কি তার ভাল লাগিবে?”

 প্র। ভাল লাগিবে বলিয়াই আসিয়াছি। এই ধর্ম্মই স্ত্রীলোকের ধর্ম্ম; রাজত্ব স্ত্রীজাতির ধর্ম্ম নয়। কঠিন ধর্ম্মও এই সংসারধর্ম্ম; ইহার অপেক্ষা কোন যোগই কঠিন নয়। দেখ, কতকগুলি নিরক্ষর, স্বার্থপর, অনভিজ্ঞ লোক লইয়া আমাদের নিত্য ব্যবহার করিতে হয়। ইহাদের কারও কোন কষ্ট না হয়, সকলে সুখী হয়, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। এর চেয়ে কোন্ সন্ন্যাস কঠিন? এর চেয়ে কোন্ পুণ্য বড় পুণ্য? আমি এই সন্ন্যাস করিব।

 সা। তবে কিছু দিন আমি তোমার কাছে থাকিয়া তোমার চেলা হইব।

 যখন সাগরের সঙ্গে প্রফুল্লের এই কথা হইতেছিল, তখন ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে ব্রজেশ্বর ভোজনে বসিয়াছিলেন। ব্রহ্মঠাকুরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেজ, এখন কেমন রাঁধি?”

 ব্রজেশ্বরের সেই দশ বছরের কথা মনে পড়িল। কথাগুলি মূল্যবান্—তাই দুই জনেরই মনে ছিল।

 ব্রজ বলিল, “বেস্।”

 ব্রহ্ম। “এখন গোরুর দুধ কেমন? বেগড়ায় কি?

 ব্রজ। বেস্ দুধ।

 ব্রহ্ম। কই, দশ বৎসর হলো—আমায় ত গঙ্গায় দিলি না?

 ব্রজ। ভুলে গিছিলেম।

 ব্রহ্ম। তুই আমায় গঙ্গায় দিস্ নে। তুই বাগ্দী হয়েছিস্।

 ব্রজ। ঠান্‌দিদি! চুপ্ ও কথা না।

 ব্রহ্ম। তা দিস্, পারিস্ ত গঙ্গায় দিস্। আমি আর কথা কব না। কিন্তু ভাই, কেউ যেন আমার চরকা টরকা ভাঙ্গে না।