দেবী চৌধুরাণী (১৯৩৯)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বড় ধূম পড়িয়াছে। ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী আসিয়াছেন। কোন্ শ্বশুরবাড়ী, তাহা বলা বাহুল্য। সাগরের বাপের বাড়ী। তখনকার দিনে একটা জামাই আসা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। তাতে আবার ব্রজেশ্বর শ্বশুরবাড়ী সচরাচর আসে না। পুকুরে পুকুরে, মাছমহলে ভারি হুটাহুটি, ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। জেলের দৌরাত্ম্যে প্রাণ আর রক্ষা হয় না। জেলে-মাগীদের হাঁটাহাঁটিতে পুকুরের জল কালী হইয়া যাইতে লাগিল। মাছ চুরির আশায় ছেলেরা পাঠশালা ছাড়িয়া দিল। দই, দুধ, ননী, ছানা, সর, মাখনের ফরমাইসের জ্বালায় গোয়ালার মাথা বেঠিক্ হইয়া উঠিল; সে কখনও এক সের জল মিশাইতে তিন সের মিশাইয়া ফেলে, তিন সের মিশাইতে এক সের মিশাইয়া বসে। কাপড়ের ব্যাপারীর কাপড়ের মোট লইয়া যাতায়াত করিতে করিতে পায় ব্যথা হইয়া গেল; কাহারও পছন্দ হয় না, কোন্ ধুতি চাদর কে জামাইকে দিবে। পাড়ার মেয়ে মহলে বড় হাঙ্গামা পড়িল। যাহার যাহার গহনা আছে, তারা সে সকল সারাইতে, মাজিতে, ঘষিতে, নূতন করিয়া গাঁথাইতে লাগিল। যাহাদের গহনা নাই, তাহারা চুড়ি কিনিয়া, শাঁকা কিনিয়া, সোণা রূপা চাহিয়া চিন্তিয়া এক রকম বেশ-ভূষার যোগাড় করিয়া রাখিল—নহিলে জামাই দেখিতে যাওয়া হয় না। যাঁহাদের রসিকতার জন্য পশার আছে—তাঁহারা দুই চারিটা প্রাচীন তামাসা মনে মনে ঝালাইয়া রাখিলেন; যাহাদের পশার নাই, তাহারা চোরাই মাল পাচার করিবার চেষ্টায় রহিল। কথার তামাসা পরে হবে—খাবার তামাসা আগে। তাহার জন্য ঘরে ঘরে কমিটি বসিয়া গেল। বহুতর কৃত্রিম আহার্য্য, পানীয়, ফল-মূল প্রস্তুত হইতে লাগিল। মধুর অধরগুলি মধুর হাসিতে ও সাধের মিশিতে ভরিয়া যাইতে লাগিল।
কিন্তু যার জন্য এত উদ্যোগ, তার মনে সুখ নাই। ব্রজেশ্বর আমোদ আহ্লাদের জন্য শ্বশুরালয়ে আসেন নাই। বাপের গ্রেপ্তারির জন্য পরওয়ানা বাহির হইয়াছে—রক্ষার উপায় নাই। কেহ টাকা ধার দেয় না। শ্বশুরের টাকা আছে—শ্বশুর ধার দিলে দিতে পারে, তাই ব্রজেশ্বর শ্বশুরের কাছে আসিয়াছেন।
শ্বশুর বলিলেন, “বাপু হে, আমার যে টাকা, সে তোমারই জন্য আছে—আমার আর কে আছে, বল? কিন্তু টাকাগুলি যত দিন আমার হাতে আছে, তত দিন আছে,—তোমার বাপকে দিলে কি আর থাক্বে? মহাজনে খাইবে। অতএব কেন আপনার ধন আপনি নষ্ট করিতে চাও?”
ব্রজেশ্বর বলিল, “হৌক—আমি ধনের প্রত্যাশী নই—আমার বাপকে বাঁচান আমার প্রথম কাজ।”
শ্বশুর রুক্ষভাবে বলিলেন, “তোমার বাপ বাঁচিলে আমার মেয়ের কি? আমার মেয়ের টাকা থাকিলে দুঃখ ঘুচিবে—শ্বশুর বাঁচিলে দুঃখ ঘুচিবে না।”
কড়া কথায় ব্রজেশ্বরের বড় রাগ হইল। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “তবে আপনার মেয়ে টাকা লইয়া থাকুক। বুঝিয়াছি, জামাইয়ে আপনার কোন প্রয়োজন নাই। আমি জন্মের মত বিদায় হইলাম।”
তখন সাগরের পিতা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া ব্রজেশ্বরকে বিস্তর তিরস্কার করিলেন। ব্রজেশ্বর কড়া কড়া উত্তর দিল। কাজেই ব্রজেশ্বর তল্পী তল্লা বাঁধিতে লাগিল। শুনিয়া, সাগরের মাথায় বজ্রাঘাত হইল।
সাগরের মা জামাইকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। জামাইকে অনেক বুঝাইলেন। জামাইয়ের রাগ পড়িল না। তার পর সাগরের পালা।
বধূ শ্বশুরবাড়ী আসিলে দিবসে স্বামীর সাক্ষাৎ পাওয়া সেকালে যতটা দুরূহ ছিল, পিত্রালয়ে ততটা নয়। সাগরের সঙ্গে নিভৃতে ব্রজেশ্বরের সাক্ষাৎ হইল। সাগর ব্রজেশ্বরের পায় পড়িল, বলিল, “আর এক দিন থাক—আমি ত কোন অপরাধ করি নাই?”
ব্রজেশ্বরের তখন বড় রাগ ছিল—রাগে পা টানিয়া লইলেন। রাগের সময় শারীরিক ক্রিয়াসকল বড় জোরে জোরে হয়, আর হাতপায়ের গতিও ঠিক অভিমত রূপ হয় না। একটা করিতে বিকৃতি জন্য আর একটা হইয়া পড়ে। সেই কারণে, আর কতকটা সাগরের ব্যস্ততার কারণ, পা সরাইয়া লইতে প্রমাদ ঘটিল। পা একটু জোরে সাগরের গায়ে লাগিল। সাগর মনে করিল, স্বামী রাগ করিয়া আমাকে লাথি মারিলেন। সাগর স্বামীর পা ছাড়িয়া দিয়া কুপিত ফণিনীর ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিল। বলিল, “কি? আমায় লাথি মারিলে?”
বাস্তবিক ব্রজেশ্বরের লাথি মারিবার ইচ্ছা ছিল না,—তাই বলিলেই মিটিয়া যাইত। কিন্তু একে রাগের সময়, আবার সাগর চোখ মুখ ঘুরাইয়া দাঁড়াইল,—ব্রজেশ্বরের রাগ বাড়িয়া গেল। বলিলেন, “যদি মারিয়াই থাকি? তুমি না হয় বড়মানুষের মেয়ে, কিন্তু পা আমার—তোমার বড়মানুষ বাপও এ পা এক দিন পূজা করিয়াছিলেন।”
সাগর রাগে জ্ঞান হারাইল। বলিল, “ঝক্মারি করিয়াছিলেন। আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করিব।”
ব্র। পাল্টে লাথি মারবে না কি?
সা। আমি তত অধম নহি। কিন্তু আমি যদি ব্রাহ্মণের মেয়ে হই, তবে তুমি আমার পা—
সাগরের কথা ফুরাইতে না ফুরাইতে পিছনের জানেলা হইতে কে বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া, চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
সাগরের মুখে সেই রকম কি কথা আসিতেছিল। সাগর না ভাবিয়া চিন্তিয়া পিছন ফিরিয়া না দেখিয়া, রাগের মাথায় সেই কথাই বলিল, “আমার পা কোলে লইয়া চাকরের মত টিপিয়া দিবে।”
ব্রজেশ্বরও রাগে সপ্তমে চড়িয়া কোন দিকে না চাহিয়া বলিল, “আমারও সেই কথা। যত দিন আমি তোমার পা টিপিয়া না দিই, তত দিন আমিও তোমার মুখ দেখিব না। যদি আমার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, তবে আমি অব্রাহ্মণ।”
তখন রাগে রাগে তিনটা হইয়া ফুলিয়া ব্রজেশ্বর চলিয়া গেল। সাগর পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। এমন সময়ে সাগর যে ঘরে বসিয়া কাঁদিতেছিল, সেই ঘরে একজন পরিচারিকা, ব্রজেশ্বর গেলে পর সাগরের কি অবস্থা হইয়াছে, ইহা দেখিবার অভিপ্রায়ে ভিতরে প্রবেশ করিল, ছুতানতা করিয়া দুই একটা কাজ করিতে লাগিল। তখন সাগরের মনে পড়িল যে, জানালা হইতে কে কথা কহিয়াছিল। সাগর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুই জানেলা হইতে কথা কহিয়াছিলি?”
সে বলিল, “কই না?”
সাগর বলিল, “তবে কে জানেলায় দেখ্ ত।”
তখন সাক্ষাৎ ভগবতীর মত রূপবতী ও তেজস্বিনী এক জন স্ত্রীলোক ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। সে বলিল, “জানালায় আমি ছিলাম।”
সাগর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে গা?”
তখন সে স্ত্রীলোক বলিল, “তোমরা কি কেউ আমায় চেন না?”
সাগর বলিল, “না—কে তুমি?” তখন সেই স্ত্রীলোক উত্তর করিল, “আমি দেবী চৌধুরাণী।”
পরিচারিকার হাতে পানের বাটা ছিল, ঝন্ ঝন্ করিয়া পড়িয়া গেল। সেও কাঁপিতে কাপিতে আঁ—আঁ—আঁ—আঁ শব্দ করিতে করিতে বসিয়া পড়িল। কাঁকালের কাপড় খসিয়া পড়িল।
দেবী চৌধুরাণী তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, “চুপ রহো, হারামজাদি! খাড়া রহো।”
পরিচারিকা কাঁদিতে কাঁদিতে উঠিয়া স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। সাগরেরও গায়ে ঘাম দিতেছিল। সাগরের মুখেও কথা ফুটিল না। যে নাম তাহাদের কাণে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা ছেলে বুড়ো কে না শুনিয়াছিল? সে নাম অতি ভয়ানক।
কিন্তু সাগর আবার ক্ষণেক পরে হাসিয়া উঠিল। তখন দেবী চৌধুরাণীও হাসিল।