দ্বিতীয় সর্গ—অপ্রমাদ বর্গ।

অপ্রমাদ অমৃতের আকর সমান [১]
প্রমাদে মৃত্যুর পথ করে উদ্ঘাটন;
অপ্রমত্ত মানবের নাহিক মরণ
মৃতপ্রায় প্রমত্তের বিফল জীবন॥ ১॥ ২১॥
এই সত্য জানি গত প্রমাদ যাহার,
নির্ব্বাণ মার্গেতে যিনি করেন বিহার,

 ধ্যানশীল মহোৎসাহ দৃঢ়-পরাক্রম,
লভেন এহেন নর নির্ব্বাণ পরম॥ ২|৩॥
সদা জাগরিত যিনি, তীক্ষ্ণ যা’র স্মৃতি,
সতত পবিত্র কার্য্যে যায় দিবা-রাতি,
সতর্ক, সংযত যিনি ধর্ম্ম-সাধনায়,
অপ্রমত্ত সেজনের যশঃ বৃদ্ধি পায়॥ ৪॥
জাগরিত, অপ্রমত্ত, মেধাবী, সংযত,
প্রকৃতি দমনশীল যাহার সতত,
সংসার-সাগর মধ্যে করেন নির্ম্মাণ-
আপনার তরে তিনি দিব্য দ্বীপস্থান,—
সলিল-প্রবাহে তাহা নহে প্রতিহত
সুন্দর সে রক্ষাস্থল অটল নিয়ত॥ ৫॥

দুর্ব্বুদ্ধি চপলমতি মূর্খ যেই নর
প্রমাদের অনুবর্তী সেই নিরন্তর;
অপ্রমাদ সুবুদ্ধির অতি প্রিয়ন
শ্রেষ্ঠধন সম তিনি করেন রক্ষণ॥ ৬॥
প্রমাদের অনুবর্তী কভু নাহি হবে
কামরতি সন্তোগেতে মন নাহি দিবে;
অপ্রমত্ত ধ্যানশীল যারা অনুক্ষণ
বিপুল সুখেতে তারা সদা নিমগন॥ ৭॥
অপ্রমাদে প্রমাদের করি নিবারণ,
শােকশূন্য হন যিনি জ্ঞানী বিচক্ষণ;
জ্ঞানের প্রাসাদ-শিরে করি আরােহণ
শােকশীল নরে তিনি করেন দর্শন;—
ধীর ব্যক্তি বসি যথা পর্ব্বত শিখরে
দেখে নিম্নে কত নর যাতায়াত করে।
সেইরূপ ধীর জ্ঞানী দেখেন নিয়ত
মূর্খ নর জন্মজরা ভােগ করে কত! (৮)

দুর্ব্বল অশ্বকে যথা দ্রুত অশ্ববর
পশ্চাতে ফেলিয়া রাখি হয় অগ্রসর,
সেইরূপ যেইজন ধীর বুদ্ধিমান,
প্রমত্তের মাঝে তিনি অপ্রমত্ত র’ন।
নিদ্রিতের মাঝে তিনি থাকি জাগরিত
ধর্মপথে অগ্রসর হন অবিরত॥৯॥
ইন্দ্র শ্রেষ্ঠ দেব-লােকে অপ্রমাদ-বলে,
অপ্রমার শ্রেষ্ঠগুণ বিদিত ভূতলে;
অ প্রমাদ প্রশংসিত পণ্ডিত সমাজে,
প্রমাদের নিন্দাবাদ সর্বত্র বিরাজে॥১০॥৩০॥
অপ্রমাদরত ভিক্ষু পুরুষ প্রধান
প্রমাদের ভয়ে রয় সদা সাবধান;
অগ্নি যথা ছােট বড় গ্রন্থ সমুদায়
দগ্ধ করি নিরুদ্বেগে অগ্রসর হয়,—
ইন্দ্রিয় বন্ধন তথা করিয়া ছেদন
অবাধে করয়ে ভিক্ষু ধর্ম্ম আচরণ॥১১॥

অপ্রমাদরত ভিক্ষু পুরুষ প্রধান
প্রমাদের ভয়ে থাকে সদ। সাবধান;
ধর্ম্ম পথ হ’তে ভ্রষ্ট কখন না হয়
নির্ব্বাণ নিকটবর্তী সেই সদা রয়॥১২॥

  1. পণ্ডিতগণ অপ্রমাদ শব্দের নানাপ্রকার ব্যাখ্যা করিয়াছেন। একাগ্রতা বা ধ্যান (মোক্ষমূলর), মনোযোগিতা (চাইলডার্স), সতর্কতা (ফজ বোল) এবং ধর্ম্ম (গগার্লি) প্রভৃত বিভিন্ন অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে। প্রকৃত পক্ষে প্রমাদ বা প্রমত্ততাই মানুষের যাবতীয় উন্নতির অন্তরায়। যিনি সংসারের তুচ্ছ বিষয়ে আসক্ত বা প্রমত্ত নন, তাহার জন্য নির্ব্বাণ বা মুক্তিপথ পরিষ্কৃত হয়। এইশ্লোকে বুদ্ধঘোষ অমৃতশব্দ নির্ব্বাণ অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন।

     কথিত আছে যখন মহারাজ অশোকের সহিত বিখ্যাত শ্রমণ ন্যগ্রোধের সাক্ষাৎ হয়, তখন ন্যগ্রোধ তাঁহাকে ধম্মপদের এই অপ্রমাদবর্গ শুনাইয়াছিলেন। পরে এতদ্বারাই ক্রমশঃ অশােকেরক মতি পরিবর্ত্তিত হয় ও তিনি বৌদ্ধমতাবলম্বী হন। See Bishop Bigandet's Life and Legend of Gaudama p. 377.