দশম সর্গ―দণ্ডবর্গ।

জগতে দণ্ডের ভয় সকলেই করে,
থরহরি কাঁপে সবে শমনের ডরে;
মনে কর সর্ব্বজীবে আপনার মত,[১]
জীবহিংসা হ’তে হও বিরত সতত;
কোনও প্রাণীকে বধ ক’রোনা কখন
হ’য়োনা কখন কা’রো বধের কারণ॥১॥১২৯॥
আছয়ে দণ্ডের ভয় ধরায় সবার
নিজের জীবন হয়় প্রিয় সবাকার;
মনে করি সর্ব্বজীবে আপনার মত
জীব হিংসা হ’তে হও বিরত সতত;
কোনও প্রাণীকে বধ ক’রোনা কখন
হ’য়োনা কখন কা’রো বধের কারণ॥২॥১৩০॥

আত্মসুখ-অভিলাষী হইয়া যেজন
সুখাকাঙ্ক্ষী জীবগণে করয়ে হনন,
পরলোকে সুখ তা’র কখন না হয়;—
ধর্ম্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানিবে নিশ্চয়॥৩॥
আত্মসুখ-মোহে মত্ত হইয়া যেজন
সুখাকাঙ্ক্ষী-জীবে হিংসা না করে কখন,
সেই জন সুখলাভ করে পরকালে,
ধর্ম্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানিবে সকলে॥৪॥
পরুষ বচন কা’রো ব’লনা কখন,
করিবে কর্কশ বাক্য সেও প্রত্যর্পণ;
ক্রোধপূর্ণ বাক্য দেয় বেদনা অন্তরে,
দণ্ডদানে প্রতিদণ্ড স্পর্শিবে তোমারে॥৫॥
কাংস্যপাত্রে শব্দ করে আঘাতে যেমন—
তেমতি আঘাতে যদি না কর তর্জ্জন,
তাহ’লে যথার্থ শান্তি পাইবে সে দিন,
যথার্থ হইবে তুমি ক্রোধরিপুহীন॥

নাহিক বিরোধ তব কাহারো সহিত
এই জ্ঞান সার তত্ত্ব জানিও নিশ্চিত॥৬॥
গোপাল গো-পাল ল'য়ে যষ্টির তাড়নে
গোচারণ ক্ষেত্রে যথা যায় একমনে,
জরামৃত্যু সেইরূপ মানব জীবনে
তাড়না করিয়া চলে চরমের পানে॥৭॥
মূর্খ যবে অনুষ্ঠান করে পাপাচার
সে যেমন নাহি বুঝে কিছুই তাহার,—
সেরূপ দুর্ম্মেধা ব্যক্তি অগ্নিদাহ সম
ভোগ করে অবিরত যন্ত্রণা বিষম॥৮॥
নির্দ্দোষ জনের প্রতি যে করে অন্যায়,
দশবিধ গতির সে এক গতি পায়ঃ—
(১) কঠোর যন্ত্রণা ভোগ অথবা (২) মরণ
(৩) অঙ্গচ্ছেদ, (৪) উন্মাদ বা (৫) ব্যাধি নিদারুণ,
৬) বধ বন্ধনাদি কোন রাজার বিধান
(৭) সম্পদের নাশ কিম্বা (৮) জ্ঞাতির নিধন,

(৯) অশনি সম্পাত কিম্বা গৃহের পতন
(১০) অথবা মৃত্যুর পরে নরকে গমন।
―এই দশবিধ গতি নির্ব্বোধের তরে
যেজন পরের প্রতি অত্যাচার করে॥৯-১২॥(১৪০)
নগ্নচর্য্যা, জটাভার, পঙ্ক, অনশন
স্থণ্ডিল শয়ন[২] কিম্বা ধূলি বিমর্দ্দন,
স্পন্দহীন অবস্থিতি―কিছুই ইহার
না পারে শোধিতে, আশা অতৃপ্ত যাহার॥১৩॥
অলঙ্ক‌ৃত হইয়াও শান্ত যেইজন
ব্রহ্মচর্য্য ব্রত সদা করেন পালন,
প্রাণিহিংসা হ'তে যিনি হইয়া বিরত
শম আচরণ নিত্য করেন বিহিত,

তিনিই ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, তিনিই শ্রমণ
তিনিই ভিক্ষুর মধ্যে অগ্রগণ্য জন॥১৪॥
আছে কি পুরুষ কোন এহেন ধরায়
যেজন নিষিদ্ধ কার্য্যে বিরত লজ্জায়?
যাহার নিন্দার দিকে লক্ষ্য নাহি হয়?
―ভদ্র[৩] অশ্ব গ্রাহ্য যথা না করে কশায়॥১৫॥
কশাহত অশ্ব যথা হয় বেগবান,
উদ্যোগী কর্ম্মঠ তুমি হও সুপ্রধান!
শীল, শ্রদ্ধা, বীর্য্য আর সমাধির বলে
পূর্ণজ্ঞান, সদাচার, স্মৃতিমান হ’লে,
প্রভূত দুঃখের হাতে পাইবে নিস্তার
সতত পরমানন্দে যাপিবে সংসার॥১৬॥
মৃত্তিকা খননকারী মানব যেমতি
স্বেচ্ছায় বাহিত করে সলিলের গতি,

ইষুকার বাণ যথা করয়ে নমিত
সূত্রধার কাষ্ঠে করে স্বেচ্ছায় গঠিত,
সেইরূপ যিনি সাধু সুব্রত সুজন,
ইচ্ছামত আপনাকে করেন গঠন॥১৭॥[৪]


  1. অবিকল এই ভাবই নিম্নলিখিত শ্লোকে দৃষ্ট হয়ঃ―

    “আত্মৌপম্যেন ভূতেষু দয়াং কুর্ব্বন্তি সাধবঃ"

    হিতোপদেশ।
  2. স্থণ্ডিল শয়ন―ভূমিশয়ন। অনশনাদি ব্রত রক্ষা করিলেই মানুষ উন্নতিমার্গে অগ্রসর হয় না। যাহার আশার তৃপ্তি হয় নাই, কিছুতেই তাহাকে শোধন করিতে পারে না। আশার তৃপ্তিই উন্নতির উপায়।
  3. ভদ্র―সুশিক্ষিত, Well-trained
  4. তৃতীয় সর্গের প্রথম শ্লোক ও ৬ষ্ঠ সর্গের পঞ্চম শ্লোক দ্রষ্টব্য। সে সকল স্থলেও এই একই অর্থ প্রকাশিত হইয়াছে।