চতুর্থ সর্গ—পুষ্পবর্গ ।

কেবা জয় করিবেক এই যে সংসার?
যমলােকে দেবলোকে কা’য় অধিকার?
সুনিপুণ মালাকর পুষ্পোদ্যানে গিয়া,
যেমতি সুন্দর পুষ্প লয় সে বাছিয়া,—
সংসার উদ্যানে, কেবা তেমতি আসিয়া
সুনির্দ্দিষ্ট-ধর্ম্মপদ [১] লইবে দেখিয়া?॥ ১॥ ৪৪॥

অনুরক্ত, বুদ্ধশিষ্য, ভক্ত যেই হয়,
সহজে করিবে এই সংসার বিজয়;
সুনিপুণ মালাকর পুষ্পোদ্যানে গিয়া,
সুন্দর কুসুম যথা লয় সে বাছিয়া,
সংসার উদ্যানে আসি তেমতি সেজন
 সুনির্দ্দিষ্ট ধর্ম্মপথ করে নির্ব্বাচন[২]॥ ২॥

ফেণবৎ ক্ষণধ্বংসী মানবের কায়,
অলীক রূপের ছটা—মরীচিকা প্রায়,―
এই জ্ঞান আছে যার' নিশ্চয় সেজন
কামের কুসুমশর করিয়া ছেদন,
অবাধে ধর্ম্মের পথে হয় অগ্রসর
মৃত্যুরাজ হ'তে তা'র নাহি কোন ডর॥ ৩॥

কামনার পুষ্প যেই করয়ে চয়ন
সতত ব্যাসক্ত চিও হয় যেইজন,
অবিলম্বে গ্রাসকরে তাহাকে শমন
বন্যা যথা সুপ্তগ্রামে করয়়ে প্লাবন॥ ৪॥
সতত ব্যাসক্তচিও হয় যেইজন,
কামনার পুষ্প যেই করয়ে চয়ন,
তাহার বাসনা তৃপ্ত হইতে না হ’তে
কাল তা’রে কবলিত করে আচম্বিতে॥ ৫॥
পুষ্পের বর্ণ বা গন্ধ নষ্ট না করিয়া,
অলি যথা মধু ল’য়ে যায় পলাইয়া,
মুনিগণ সেইরূপ সংসার মাঝার
বিচরিবে করি নিত্য স্বকার্য উদ্ধার॥ ৬॥
পরে কি করে, না করে, দেখি কাজ নাই,
আপনি কি কর সদা দেখিবে তাহাই॥ ৭॥ ৫০॥
যেমতি উজ্জলবর্ণ পুষ্প মনোহর,
গন্ধহীন হ’লে রূপ নিষ্কল তাহার,

তেমতি নিষ্ফলহয় উত্তম বচন
কার্য্যে যদি পরিণত না হয় কখন॥ ৮॥
যেমতি উজ্জ্বলবর্ণ পুষ্প মনোহর
গন্ধযুক্ত হ’লে রূপ সফল তাহার,
তেমতি উত্তম বাক্য সফল নিশ্চয়
যথাকার্য্যে পরিণত যবে তাহা হয়॥ ৯॥
রাশীকৃত পুষ্প হ’তে আমরা যেমন
বহুবিধ মাল্য পারি করিতে বচন,
তেমতি মানবজন্ম পরিগ্রহ করি
বহুল সুকার্য্য মোরা সাধিবারে পারি॥ ১০॥
তগর (টগর) মল্লিকা আর চন্দন-সুবাস
বায়ুর প্রতীপদিকে কভু নাহি বয়;
সাধু পুরুষের কিন্তু যশের সুবাস
সর্ব্বদিকে সমভাবে প্রবাহিত হয়॥ ১১॥
তগর চন্দন কিম্বা পদ্ম-সৌরভেতে
যশোগন্ধ অতিক্রম পারেনা করিতে॥ ১২॥

তগর চন্দন গন্ধ অল্পস্থানে রয়
সাধুর যশের বাস দেবলোকে বয়়॥ ১৩॥
পূর্ণজ্ঞানে মুক্তিপ্রাপ্ত অপ্রমত্ত নর
সুশীল সংযত যা’র স্বভাব সুন্দর,
হেন সাধু কোন্ পথে করেন বিহার
তাহার সন্ধান কভু নাহি জানে মার॥ ১৪॥
রাজপথে পরিত্যক্ত আবর্জ্জনা মাঝে
দিব্যামোদ-মনোহর কমল বিরাজে
সেইরূপ অপদার্থ লোকের মাঝারে
প্রজ্ঞাবান বৃদ্ধশিষ্য শোভে এ সংসারে॥ ১৫। ১৬॥


    বা কবিতা পুস্তক এরূপ অর্থ ও করা হইয়াছে। বর্ত্তমান শ্লোকে ধর্ম্মপদ বলিতে ধর্ম্মপথ বা ধর্ম্মের সোপান বুঝাইতেছে। পুস্তকের নামেরও সম্ভবতঃ ইহাই অর্থ। বুদ্ধঘোষ স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, বোধি জ্ঞান বা দিব্য জ্ঞান লাভ করিতে হইলে ক্রমে ক্রমে উন্নতিমার্গেয় ৩৭ টি সোপান বা অবস্থা অতিক্রম করিতে হয়। “ললিত বিস্তর” গ্রন্থে বুদ্ধদেব স্বয়ং এই মার্গদর্শক বা পথদর্শক নামে কথিত হইয়াছেন।

  1. পণ্ডিতেরা ধর্ম্মপদ শব্দের নানা অর্থ করিয়াছেন। পদশব্দে কবিতা ও বুঝায়; এজন্য ধর্ম্মপদ অর্থে ধর্ম্মবিষয়ক গাথা
  2. ধম্মপদ ও অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রন্থের অনেকস্থলে অতি প্রাচীন কালীয় হিন্দু ধম্মগ্রন্থের অনেক শ্লোকের পালি অনুবাদ দেখিতে পাওয়া যায়। আবার পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ কেহ কেহ বিবেচনা করেন যে পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থ অপেক্ষাকৃত আধুনিক; বৌদ্ধশাস্ত্র হইতে অনেক উপাখ্যান পালি হইতে কালক্রমে সংস্কৃতে ভাবা- ন্তরিত হইয়াছিল। পরে যখন ক্রমে ক্রমে পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি পুস্তক আরবীয় প্রভৃতি নানা বৈদেশিক ভাষায় অনুবাদিত হইতে লাগিল তখন বৌদ্ধমত ও বৌদ্ধ গল্পগুলি ক্রমে পাশ্চাত্য জগতে প্রবেশ লাভ করিল। সংস্কৃত শ্লোক পূর্ব্বে কিম্বা শ্লোকপালি পুর্ব্বে, এই কথা লইয়া অনেক তর্ক আছে, এস্থলে তাহার অবতারণায় প্রয়োজন নাই। সম্ভবতঃ সংস্কৃত হইতে পালিতে এবং পালি হইতে সংস্কৃতে এই উভয় প্রকারেই শ্লোক অনুবাদিত হইয়াছিল। বর্ত্তমান স্থলে মহাভারতান্তর্গত শান্তি পর্ব্বের একটি শ্লোকের ছায়া গৃহীত হইয়াছে। সেই মূল শ্লোকটি এইঃ—

    পুষ্পাণীব বিচিন্বন্তং অন্যত্র গত মানস
    অনবাপ্তেযু কামেষু মৃত্যুরভ্যেতি মানবম্‌॥