ধম্মপদ/প্রকীর্ণক বর্গ

একবিংশতিতম সর্গ—প্রকীর্ণক বর্গ[১]

জ্ঞানী যদি হীন সুখ করিয়া বর্জ্জন
বারেক পরম সুখ করেন দর্শন

ত্যাজিয়া সামান্য সুখ তাহ’লে নিশ্চয়
বিপুল নির্ব্বাণ সুখ করেন আশ্রয়॥১॥২৯০॥
পরজনে দুঃখ দিতে আত্মসুখ তরে
এ সংসারে যেই জন অভিলাষ করে,
সংসৃষ্ট হইয়া সেই বৈরসংসর্গেতে
মুক্তি নাহি পায় কভু বৈরিতা হইতে॥২॥
যদ্যপি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করি পরিহার,
অকর্ত্তব্য কর্ম্ম কেহ করেন আচার,
অহঙ্কার প্রমত্ততা পূর্ণ চিত্ত যা’র
অসাধুতা দিন দিন বৃদ্ধি পায় তা’র॥৩॥
কায়গত স্মৃতি[২] যা’র হয় সমাহিত
অকর্ত্তব্য ত্যজি যিনি কর্তব্যে নিরত
স্মৃতিমান্ জ্ঞানী হেন যে জন পণ্ডিত
পাপ তা’র ক্রমে ক্রমে হয় অন্তমিত॥৪॥

মাতা পিতা আর দুই ক্ষত্রিয় রাজারে
যেই জন নিহনন করে একবারে
বিনাশ করিয়া আর রাজ্য সানুচর
নিষ্পাপ ব্রাহ্মণ সেই করয়ে বিহার॥৫॥[৩]
মাতা পিতা আর দুই ব্রাহ্মণ রাজারে
হনন করিয়া আর ব্যাঘ্র পঞ্চকেরে
ব্রাহ্মণ নিষ্পাপ ভাবে বিচরণ করে॥৬॥[৪]

বুদ্ধশিষ্য দিবানিশি যিনি অনুক্ষণ
বুদ্ধগত স্মৃতি ল’য়ে করেন যাপন,
জাগ্রত উত্তমরূপে এ ভবে সেজন॥৭॥

বুদ্ধশিষ্য দিবানিশি যিনি অনুক্ষণ
ধর্ম্মগত স্মৃতি ল’য়ে করেন যাপন,
প্রবুদ্ধ প্রকৃষ্টরূপে এ ভবে সেজন॥৮॥
বুদ্ধশিষ্য দিবানিশি যিনি অনুক্ষণ
সঙ্ঘারাম-স্মৃতি লয়ে করেন চিন্তন,
প্রকৃত জাগ্রত ভবে হয় সেইজন॥৯॥
যে সব গৌতমশিষ্য ভবে সর্ব্বক্ষণ
কায়গত স্মৃতি লয়ে করেন চিন্তন
এ ভবে জাগ্রত সত্য হয় সেই জন॥১০॥
গৌতমের যেই শিষ্য দিবসে নিশায়
সম্যক্ নিরত র’ন সদা অহিংসায়,
জাগ্রত বলিয়া সত্য জানিবে তাহায়॥১১॥৩০০॥
যেই বুদ্ধশিষ্য সদা ভাবনায় রত
ধ্যানপরায়ণ শিষ্য সেই ত জাগ্রত॥১২॥
অপূত প্রব্রজ্যা হয় নিরানন্দ ময়
মনঃকষ্টে গৃহে বাস দুঃখের বিষয়।

সংসারে যাহারা তব সমকক্ষ নয়
সহবাস দুঃখকর তা’দের নিশ্চয়;
দুঃখের অধীন সদা পর্য্যাটক যত;
দীর্ঘ পর্য্যটন দুঃখে হয়ো না পতিত॥১৩॥
শ্রদ্ধাবান্ সচ্চরিত্র যেই নরবর,
যশোভোগে সমর্পিত জীবন যাঁহার,
যখন যে দেশে তিনি করেন গমন
সর্ব্বত্র সকলে তা’র করয়ে পূজন॥১৪॥
তুষার মণ্ডিত শুভ্র পর্ব্বতের মত
সাধুগণ দূর হ’তে হন প্রকাশিত;
নিশায় নিক্ষিপ্ত শর যথা অলক্ষিত
দুষ্টজন সেইরূপ নহে প্রকাশিত॥১৫॥
একাসনে উপবিষ্ট হন যেইজন,
একাকী শয়নে যিনি করেন শয়ন,
করেন আলস্য ত্যজি একাকী ভ্রমণ,

সতত আত্মাকে তিনি করিয়া দমন
তৃষ্ণান্তে[৫] পরম প্রীতি করেন অর্জ্জন॥১৬॥


  1. প্রকীর্ণক= বিবিধ বিষয়ক, miscellaneous.
  2. দেহ ও দেহ যাহা দ্বারা গঠিত সেই সকল উপাদান সম্বন্ধে চিন্তা।
  3. বুদ্ধঘোষের টীকায় এইরূপ ব্যাখ্যা আছেঃ―মাতা = তৃষ্ণা পিতা = অহঙ্কার, দুইটি ক্ষত্রিয় রাজা (two valiant kings) = দুইটি বিরোধী মত (১) শাশ্বত দৃষ্টি অর্থাৎ সকল পদার্থই অনাদি এবং অনন্ত এই মত এবং (২) উচ্ছেদ দৃষ্টি অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে জীবের বিনাশ বিষয়ক মত। সানুচর রাজ্য = চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, কায়, মন, রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ও ধর্ম্ম এই দ্বাদশ আয়তনকে ভবরাজ্যের অনুচর বলে। ইহাদের বিনাশ না হইলে নির্ব্বাণ হয় না। See the Explanation given by D'Alwis and লঙ্কাবতার সূত্র quoted by Beal.
  4. পাঁচটি ব্যাঘ্র―কাম, অহঙ্কার, হিংসা, আলস্য ও সন্দেহ―ধর্ম্মজীবনের এই পঞ্চবিধ অন্তরায় এস্থলে পাঁচটি ব্যাঘ্র (the tigers of obstruction against final beatitude) নামে কীর্ত্তিত হইয়াছে। চাইল্‌ডর্স সাহেব বলেনঃ―"In my judge- ment this verse is intended to express in a terrible manner the Buddhist doctrine that the Arhat can not commit a serious sin” অর্থাৎ এইস্থলে অতিশয় দৃঢ়ভাবে এই বৌদ্ধমত প্রচারিত হইয়াছে যে কোন অর্হৎ কোনপ্রকার ভীষণ পাপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারেন না। মোক্ষমুলর এরূপও মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে প্রকৃত সাধু ব্যক্তি কোন পাপ করিলেও তিনি পাপযুক্ত হন না―ইহাই এই দুইটি শ্লোকের তাৎপর্য্য। কিন্তু আমরা লঙ্কাবতার সূত্রের তৃতীয় সর্গে যে গল্প বর্ণিত দেখিতে পাই তাহাতে মহামতি বোধিসত্ত্ব যখন বুদ্ধদেবকে জিজ্ঞাসা করেন যে সাধু ব্যক্তি যদি মহাপাপে লিপ্ত হন তবে তাঁহাকে নরকে পতিত না হইবার কি কথা আছে? সেই কথার উত্তর দিতে গিয়া এরূপ কোন কথা বলেন নাই যদ্দারা বুঝিতে হইবে যে সাধু ব্যক্তি পাপানুষ্ঠান করিলেও নির্দ্দোষ থাকেন। সেই স্থলেই সুস্পষ্ট উল্লিখিত আছে যে পিতা মাতা বলিতে তৃষ্ণা ও অহঙ্কারকে বুঝাইতেছে। See Beal's Introduction to Chinese Dhammapadam p.7.
  5. মূলে “বনান্তে” কথা আছে; সেস্থলে বন বলিতে ইন্দ্রিয় লালসাই বুঝা যায়। ২০শ সর্গের ১১ শ্লোক দ্রষ্টব্য।