ধম্মপদ/ব্রাহ্মণ বর্গ

ষড়বিংশতিতম সর্গ―ব্রাহ্মণ বর্গ।[১]

ব্রাহ্মণ! কামনারাশি কর পরিহার,
বীর্য্যবলে রুদ্ধ কর প্রবাহ তৃষ্ণার;
বাসনার সর্ব্বনাশ করি সংসাধিত
নির্ব্বাণ বিষয়ে জ্ঞান লভহ ত্বরিত॥১॥৩৮৩॥
ইন্দ্রিয় সংযম আর চরম চিন্তন
পারগ এই দুই ধর্ম্মে যেই সুব্রাহ্মণ,
সংসারে তাহার আছে যা’ কিছু বন্ধন
সে সকল একেবারে হইবে খণ্ডন॥২॥
পার বা অপার যা’র নাহিক কখন,[২]
পারাপার-পরপারে উত্তীর্ণ যে জন,

নির্লিপ্ত বিগতস্পৃহ সেই নরবরে
ব্রাহ্মণ বলিয়া জানি সংসার ভিতরে॥৩॥
ধ্যানশীল পাপমুক্ত আসক্তিবর্জ্জিত
পাপাসক্তি বিরহিত একাকী সংস্থিত,
সমস্ত কর্ত্তব্য যা’র হয়েছে সাধন,
অর্হতের পদপ্রাপ্ত সেজন ব্রাহ্মণ॥৪॥
দীপ্তিমান দিবাকর দিবসে উল্লাসে,
দীপ্তি ফুটে চন্দ্রমার নিশা যবে আসে,
দীপ্তিমান ক্ষুদ্র নৃপ চতুরঙ্গ বলে,
দীপ্তিমান সুব্রাহ্মণ ধ্যানশীল হ’লে;
দিবানিশি সমভাবে সকল সময়
সতেজ বুদ্ধের প্রভা প্রকাশিত হয়॥৫॥

পাপমুক্ত নরবরে ব্রাহ্মণ বলিবে
আচার সম্পন্ন জনে শ্রমণ জানিবে;
আত্মপাপ দুর করি ভ্রমণেতে রত
প্রব্রজিত ভিক্ষু বলি সেজন বিদিত॥৬॥
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণে কভু না করে প্রহার
প্রহৃত হইলে কোপ না করে প্রচার;
প্রহারকারীকে ধিক্! শত ধিক্ আর
প্রহারে মনের মধ্যে কোপ হয় যা’র॥৭॥
প্রিয় বস্তু হ’তে চিত্ত নিবৃত্ত যে করে
অল্পলাভ নহে তাহা ব্রাহ্মণের তরে;
যে বস্তু হইতে চিত্ত বিনিবৃত্ত হয়[৩]
তাহা হ’তে দুঃখ আর হয় না উদয়॥৮॥৩৯০॥

কায়মনোবাক্যে পাপ নাহিক যাহার
ব্রাহ্মণ বলিয়া খ্যাত সংযত সে নর॥৯॥
অগ্নিহোত্র সাধুজনে ব্রাহ্মণ যেমতি
নিয়মিত ভক্তিভরে করয়ে প্রণতি,
বুদ্ধ উপদেশ তথা যা’র কাছে পাবে
প্রণাম করিও তা’কে অতি ভক্তিভাবে॥১০॥
জটাজুট কিম্বা গোত্র জাতির কারণ
কাহারো “ব্রাহ্মণ”-আখ্যা না হয় কখন,
সত্য আছে—ধর্ম্ম আছে—যাহার ভিতর,
শুচিশুদ্ধ সুব্রাহ্মণ সেই নরবর॥১১॥
তাই বলি হে নির্ব্বোধ! এই কথা সার—
জটাজুট মৃগচর্ম্মে কি ফল তোমার?
অন্তর তোমার পূর্ণ পাপ-মলীমসে
বাহ্য দেহ মার্জ্জনায় কি হইবে শেষে?॥১২॥
ধূলিমাথা জীর্ণবস্ত্র অঙ্গে আবরণ
কৃশাঙ্গে ধমনী রাশি ভাসে অগণন,

একাকী অরণ্যে যিনি যোগ ধ্যানে রত
আমি বলি সেইজন ব্রাহ্মণ প্রকৃত॥১৩॥
ব্রাহ্মণী-জঠরে কিম্বা ব্রাহ্মণের কুলে
জন্মিলেই নাহি ধরি সুব্রাহ্মণ ব’লে,
পাপে কলুষিত যদি হয় সেইজন
সে সদা ডাকিয়া বলে “আমিই ব্রাহ্মণ”,
কিন্তু যে নিষ্পাপী আর আসক্তি রহিত
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি জানিব নিশ্চিত॥১৪॥
সর্ব্ববিধ সংযোজন[৪] করিয়া ছেদন
ত্রাসশূন্য হ’য়ে যেই করে বিচরণ,
আসক্তি রহিত সেই মুক্ত নরবরে
ব্রাহ্মণ বলিয়া জানি সংসার ভিতরে॥১৫॥
ক্রোধ তৃষ্ণা আদি যত কুদৃষ্টি সকলে
যেজন ছেদন করে আপনার বলে,

সেইত অবিদ্যারাশি অতিক্রম ক’রে
ব্রাহ্মণ বলিয়া খ্যাত বিশ্বের ভিতরে॥১৬॥
বধ বন্ধনের প্রতি দ্বেষ নাহি ক’রে
যেজন করয়ে সহ্য বিশুদ্ধ অন্তরে,
দশবল[৫] সমন্বিত ক্ষমা পরায়ণ
সেই জ্ঞানিজনে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥১৭॥
ক্রোধশূন্য, ব্রতশীল, সদাচারে রত,
শাস্ত্রজ্ঞান পারদর্শী যেই সুসংযত
অন্তিম শরীরধারী[৬] যেজন এবার
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি করিব প্রচার॥১৮॥৪০০॥
নির্লিপ্ত পঙ্কজপত্রে সলিলের প্রায়
অথবা সূচ্যগ্রস্থিত সর্ষপের ন্যায়,

সংসারের কামভোগে যেই নহে রত
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি জানিব নিশ্চিত॥১৯॥
সংসারে জানিয়া স্বীয় দুঃখের বিনাশ
পাপমুক্ত ভয়শূন্য যে করে নিবাস
মানব মণ্ডলী মধ্যে ধন্য যেই জন
সেই জ্ঞানী জনে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥২০॥
মেধাবী, গম্ভীর, প্রাজ্ঞ হয় যেই নর,
সত্যাসত্য পথ চিন্তা সর্ব্বদা যাহার
পরমপদের পথে সেই অগ্রসর
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি করি সমাদর॥২১॥
গৃহী কিম্বা ভিক্ষু এই দু’য়ের সহিত
সর্ব্ববিধ ভাবে যিনি সম্বন্ধ রহিত,
সংসারেতে অনাসক্ত অল্পেচ্ছু যে জন
তাহাকে সাদরে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥২২॥
ব্যস্ত ত্রস্ত স্থিতিশীল, সবল দুর্ব্বল—
সর্ব্বভূতে সম প্রীতি যা’র অবিরল,

দণ্ড দিয়া না করে যে কা’রো বিনাশন
অথবা না হয় কা’রো বধের কারণ,
হেন শান্ত, ক্ষমাশীল, মানব প্রধান
ব্রাহ্মণ বলিয়া সদা লভয়ে সম্মান॥২৩॥
শত্রু প্রতি মিত্রভাব যেজন দেখায়,
দণ্ড বিধাতার প্রতি সন্তুষ্ট যে হয়,
সংসার বন্ধনে নাই আসক্তি যাহার
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি করিব প্রচার॥২৪॥
সূচ্যগ্রেতে অবস্থিত সর্ষপ সমান
কপটতা রাগদ্বেষ আর অভিমান
যাহার অন্তর মধ্যে নাহি পায় স্থান
তাহাকে ব্রাহ্মণ বলি করিব আহ্বান॥২৫॥
বাক্য যা’র কা’রো পক্ষে বৃথা নাহি যায়,
যা’র বাক্যে সবাকার জ্ঞান বৃদ্ধি পায়,
অকর্কশ সত্য কথা কহে যেই জন,
জগতে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥২৬॥

দীর্ঘহ্রস্ব, ক্ষুদ্রস্থূল, শুভাশুভ আর
অপ্রদত্ত আছে যাহা সংসার মাঝার,[৭]
যেই জন সে সকল না করে গ্রহণ
তাহাকে নিশ্চিত আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥২৭॥
ইহলোকে পরলোকে কোনও প্রকার
বিদ্যমান নাহি কিছু আকাঙ্ক্ষা যাহার,
আশাশূন্য, পাপমুক্ত হয় যেই জন
সংসারে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥২৮॥
মনোমধ্যে তৃষ্ণা যা’র কিছুই না রয়
জ্ঞানবলে ছিন্ন যা’র হ’য়েছে সংশয়
পবিত্র পরমপদ করায়ত্ত যা’র
ব্রাহ্মণ বলিয়া করি তাহাকে প্রচার॥২৯॥
ইহলোকে পাপপুণ্য সমান যাহার
উভয়ে আসক্তি যেই করে পরিহার

শোক দুঃখ বিনির্ম্ম‌ুক্ত শুদ্ধ যেই জন
সংসারে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৩০॥
চরিত্র চন্দ্রমা সম নির্ম্মল যাহার,
পবিত্র কলুষশূন্য প্রসন্ন অন্তর,
সর্ব্বভাবে তৃষ্ণাশূন্য হয় যেইজন
সংসারে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৩১॥
বিঘ্নময়, সুদুস্তর সংসার মাঝারে
মোহের তমসা পারে যাইতে যে পারে,
পারগত, ধ্যানরত, নিষ্কম্প যে জন
যতেক সংশয় রাশি করয়ে ছেদন,
চরমে পরমা প্রীতি লভয়ে যে নর
ব্রাহ্মণ বলিয়া তাকে করি সমাদর॥৩২॥
সংসারে কামনারাশি দিয়া বিসর্জ্জন,
গৃহশূন্য ভিক্ষুবেশে ভ্রমে যেই জন,
কামসুখ পরিত্যাগী ধন্য সেই নর
ব্রাহ্মণ বলিয়া তায় করিব আদর॥৩৩॥

সংসারের তৃষ্ণাজাল দিয়া বিবর্জ্জন
গৃহশূন্য ভিক্ষুবেশে ভ্রমে যেই জন,
তৃষ্ণাসুখ পরিত্যাগী ধন্য সেই নর
ব্রাহ্মণ বলিয়া তা’র করিব আদর॥৩৪॥
জীবনের প্রতি নাই আসক্তি যাহার
পঞ্চকামগুণ যেই করে পরিহার
সকল বন্ধন মুক্ত হয় যেই জন
সংসারে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৩৫॥
আসক্তি বা অনাসক্তি ত্যজিয়া উভয়,
অক্লেশে শান্তিতে যার দিন গত হয়,
সর্ব্বলোক জয়ী সেই নর পুণ্যবান
ব্রাহ্মণ বলিয়া তায় করিব আহ্বান॥৩৬॥
জীবের জনম মৃত্যু উৎপত্তি বিলয়
বিশেষ প্রকারে যার সুবিদিত রয়,
অনাসক্ত, জ্ঞানবান, সুগত[৮] যে জন
সাদরে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৩৭॥

গতি যা’র দেব, নর, গন্ধর্ব্ব, কিন্নর―
কেহই জানে না কিছু সংসার ভিতর,
ক্ষীণতৃষ্ণ লোকপূজ্য যেই মহাজন
সাদরে তাহাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৩৮॥৪২০॥
পূর্ব্ব বা পশ্চাতে মধ্যে কিছু নাই যা’র
কোনও পদার্থে আশা না হয় সঞ্চার,
অনাসক্ত, সাধুচিত্ত সেই নরবর;
ব্রাহ্মণ বলিয়া তা’য় করিব আদর॥৩৯॥
নির্ভীক বৃষভতুল্য, যেই মহাবীর;
প্রবল ইন্দ্রিয়-জয়ী যাহার শরীর
সর্ব্বজ্ঞ মহর্ষিতুল্য, নিষ্কম্প অন্তর
জ্ঞানবলে ধৌত যার মনের বিকার,
জ্ঞানবৃদ্ধ বুদ্ধ হেন যেই নরবর
ব্রাহ্মণ বলিয়া তা'য় করি সমাদর॥৪০॥
পূর্ব্বজন্ম স্মৃতি মনে যে মুনির রয়,
দিব্য চক্ষে হেরে যেই স্বর্গ বা নিরয়,

ধরায় হবে না যা’র জনম আবার;
সর্ব্ব কর্ম্ম সম্পাদিত হ’য়েছে যাহার,
অভিজ্ঞ, বিষয়-জ্ঞান-সম্পন্ন যেজন,
তাহাকে সাদরে আমি বলিব ব্রাহ্মণ॥৪১॥৪২৩॥[৯]

সম্পূর্ণ।

  1. এস্থলে ব্রাহ্মণ শব্দ জাতিবাচক নহে। ইহা দ্বারা ব্রহ্মচারী ভক্তকে বুঝাইতেছে। বীল সাহেব এই সর্গের “ব্রহ্মচারী” বলিয়াই আখ্যা দিয়াছেন।
  2. অপার―বাহ্য ষড়ায়তন অর্থাৎ বাহ্যজগতের প্রতি আসক্তি! পার=আধ্যাত্মিক ষড়ায়তন অর্থাৎ অন্তর্জগতের প্রতি যে আসক্তি।
  3. “It advantages a Brahman not a little if he holds his mind back from the pleasures of life, when all wish to injure has vanished, pain will cease.” Max Müller.
  4. আসক্তি। Fetters.
  5. দশবল যথাঃ―অধিমুক্তি বল, প্রতিসংখ্যান বল, ভাব বল, ক্ষান্তি বল, জ্ঞান বল, প্রহাণ বল, সমাধি বল, প্রতিভান বল, পুণ্য বল এবং প্রতিপত্তি বল।
  6. অর্থাৎ যাহার আর জন্ম হইবে না।
  7. বড় ছোট, দীর্ঘ হ্রস্ব যাহাই হউক, অদত্ত বস্তু গ্রহণ করিবে না।
  8. সুখী, সদ্ভাবে যাহার জীবন গত হইয়াছে, রূপরসাদি পঞ্চ বিষয়ে যাহার আসক্তি নাই।
  9. চীনদেশীয় ধম্মপদে ইহার পরে (১) নির্ব্বাণ, (২) জন্ম মৃত্যু (৩) ধর্ম্মের লাভ ও (৪) মহামঙ্গল নামক আরও চারিটি অধ্যায় সন্নিবিষ্ট আছে।