ত্রয়োদশ সর্গ—লোকবর্গ।

হীন ধর্ম্ম অনুগামী না হবে কখন
ক’রোনা প্রমত্তভাবে জীবন যাপন
মিথ্যা দর্শনের মতে ক'রোনা নির্ভর[১]
তুষিতে ধরার লোক হ’য়োনা তৎপর॥১॥১৬৭॥
অলস হ’য়োনা, উঠ, কর সদ্ধর্ম্মে আশ্রয়
ইহ পরকালে সদা ধর্ম্মচারী সুখে রয়॥২॥
সুচরিতধর্ম্ম ভবে কর আচরণ

পাপধর্ম্মে কভু তুমি নাহি দিবে মন
সংসারে আসিয়া যেই ধর্ম্মচারী হয়
ইহ পরলোকে সেই সুখেতে কাটায়॥৩॥
মরীচিকা, জলবিম্ব দেখে যে প্রকার
সেরূপ যদ্যপি কেহ দেখে এ সংসার,
যমরাজ তা’রে নাহি করিবে দর্শন
সেজন শমনজয়ী অতি সাধুজন॥৪॥১৭০॥
দেখহ বিচিত্র ধরা রাজপথপ্রায়
সমাসক্ত নহে জ্ঞানী, মূর্খে শোক পায়॥৫॥
প্রথমে প্রমত্ত থাকি' অপ্রমত্ত হ’লে
মেঘমুক্ত শশিসম জগৎ উজলে॥৬॥
পূর্ব্বকৃত পাপ, পুণ্যে আবৃত হইলে,
মেঘমুক্ত শশিসম জগৎ উজলে॥৭॥
ইহলোক হয় ঘোর অন্ধকারময়
অল্প লোক ভালরূপ দেখিবারে পায়;
জালমুক্ত পক্ষী যথা স্বর্গপানে ধায়

জ্বালামুক্ত অল্পলোক স্বরগেতে যায়॥৮॥
সাধুরা আদিত্য-পথে করেন গমন[২]
খদ্ধি দ্বারা করে লোক শূন্যে আরোহণ
দলবল সহ মারে করি পরাজয়[৩]
ধীরগণ ধরা হ’তে শূন্যে নীত হয়॥৯॥
উল্লঙ্ঘন ক’রেছে যে নীতিমাত্র সার
মিথ্যাবাদী, পরলোকে আস্থা নাই যা’র,
তাহার অকার্য্য পাপ নাহিক ধরায়
পাপীর অধম সেই জানিবে নিশ্চয়॥১০॥

দেবলোক নাহি পায় কৃপণ যেমন,
দানকার্য্যে প্রশংসা না করে মূর্খজন;
দানের প্রশংসা হয় জ্ঞানীর সদন
তাই তিনি পরলোকে নিত্যসুখী হন॥১১॥
পৃথিবীর ঐকরাজ্য, স্বরগ গমন
অথবা সকল লোকে প্রভুত্বস্থাপন
এ সব অপেক্ষা পুণ্যে যদি কোন নর
নির্ব্বাণের পথে ক্রমে হন অগ্রসর[৪]
তাহার কার্য্যের ফল হয় মহত্তর
সকলে জানিবে ইহা ধরণী উপর॥১২॥

  1. মূলে মিথ্যা দৃষ্টি আছে; মিথ্যা দৃষ্টি বা মিথ্যাদর্শন অর্থে মিথ্যাতত্ত্ব বুঝাইতেছে। দৃষ্টি বা দর্শন কথা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। চাইল‍্ডার্স সাহেব এ স্থলে “false doctrine” কথা দ্বারা অনুবাদ করিয়াছেন।
  2. এখানে মূলে “হংসগণ আদিত্য পথে যায়” এইরূপ আছে। আদিত্য পথের অর্থ (১) সূর্য্যের পথ বা শূন্যপথ এবং (২) স্বর্গের পথ, এই উভয়ই হইতে পারে। হংস শব্দের অর্থও পক্ষিবিশেষ এবং সাধুজন—এই উভয়ই হয়। অতএব উপরোক্ত পংক্তির দুই প্রকার অর্থ সম্ভব। এ স্থলে প্রকৃত অর্থ এই যে, হংসগণ যেরূপ শূন্যমার্গে উড্ডীন হয়, সাধুগণও সেইরূপ স্বর্গপথে বিচরণ করেন।
  3. প্রথম সর্গের সপ্তম শ্লোকের টীকা দ্রষ্টব্য।
  4. বৌদ্ধধর্ম্মে সাধন বিষয়ে চারিটী মার্গ আছেঃ—(১) স্রোতাপত্তি অর্থাৎ স্রোতে আসিয়া পড়া বা নির্ব্বাণের পথ পাওয়া, (২) সকৃদাগামিত্ব অর্থাৎ যাহা লাভ করিলে সংসারে দ্বিতীয়বার মাত্র জন্মলাভ করিতে হয়, তদধিক আর আসিতে হয়না। (৩) অনাগামিত্ব অর্থাৎ যে মার্গ লাভ করিলে সংসারের জন্ম জরা আর ভোগ করিতে হয় না এবং (৪) অর্হত্ত্ব বা নির্ব্বাণ। বর্ত্তমান শ্লোকে অর্থ এই যে নির্ব্বাণের পথে আসিতে পারিলে যে ফল লাভ হয়, তদপেক্ষা পৃথিবীর ঐকরাজ্য বা একচ্ছত্রী রাজত্বও প্রধান নহে।