নকল রাণী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 আমি ব্রাহ্মণমণ্ডলীর মধ্যে উপবেশন করিয়া উত্তমরূপে আহারাদি সমাপনান্তর আপনার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর আর সেই রাত্রিতে প্রত্যাগমন করিলেন না; পর দিবস অতি প্রত্যুষে তিনি বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও আমাকে কহিলেন, “আমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, আমি ঠিক তাহাই সম্পন্ন করিয়াছি। সকলে যখন আহার করিতে বসিল, সেই সময় আমি একটি ঘরের ভিতর অন্ধকার মধ্যে লুকাইয়া রহিলাম। আমি যে ঘরে লুকাইয়া ছিলাম, ঠিক তাহার পার্শ্বের ঘরেই কমলা থাকিতেন। দেখিলাম, একে একে বাটীর সব গোলমাল মিটিয়া গেল। রাত্রি হইতে চলিল। রজনী দ্বিযাম অতিক্রম করেন। রাজভবন নিস্তব্ধ, বৈঠকখানাঘরের আলোক নির্ব্বাণোম্মুখ, জনপ্রাণীর সাড়া শব্দ নাই। ধরিত্রী ঝিল্লীরবে পরিপুর্ণ, এমন সময় রাজভবনের প্রকোষ্ঠে দুইটি মনুষ্যমূর্ত্তি কি বলাবলি করিতেছে। প্রথমটি আমাদের কমলাদেবী আর দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম শঙ্করদাস। শঙ্করদাসকে দেখিতে খুব বলিষ্ঠ, বয়স ২৯৷৩০, যুবক, একরকম দেখিতে মন্দ নহে। এই শঙ্করদাস রাণীর নিকট অনেক দিন আছে, জাতিতে উগ্রক্ষত্রিয়, নিবাস ঠিক কোথায়, তাহা জানি না, বড়ই বিশ্বাসী কর্ম্মাচারী। রাণী কিছুক্ষণ পরে শঙ্করের দিকে চাহিয়া বলিলেন,—

 “দেখ শঙ্করদাস! যদি তুমি আমার পথ নিষ্কণ্টক করিতে পার, তবে তুমি যা বল, সব শুনিতে প্রস্তুত আছি।”

 শঙ্কর কহিল,—“কেন না পারিব!”

 শঙ্করদাস রাণীর প্রণয়-লাভাশায় গোড়াগুড়ি মনে মনে এক রকম উন্মত্ত—মাঝে মাঝে দুএকটা রসিকতার কথাও যে না বলিত, এমন নহে, রাণী তাহাতে অসন্তোষ বা বিরক্তিভাব বাহিরে কিছুমাত্র প্রকাশ করিতেন না। আজ রাণীর আশাব্যঞ্জক কথা শুনিয়া কহিল,—

 “যাহা বলিবেন, এখনি করিতে প্রস্তুত আছি।”

 রাণী। ঐ সন্ন্যাসীকে খুন।

 শঙ্কর। কোন্ সন্ন্যাসী?

 রা। যাহার সহিত বৈঠকখানায় কথা কহিয়া তৎক্ষণাৎ চলিয়া আসিলাম, দেখ নাই?

 শ। দেখিয়াছি, সে কে?

 রা। কেন, তুমি ঐ ভণ্ড তপস্বীকে কি চিনিতে পার নাই? আমি ওর ভয়ে কাশী এলুম, তবু ও আমার সঙ্গে সঙ্গে ফির‍্ছে, ওর নাম অমরচাঁদ, বড় বদমায়েস।

 অমরচাঁদের নাম শুনিয়া শঙ্করদাস স্তম্ভিত হইল, জিজ্ঞাসিল,—

 “অমরচাঁদকে চেনেন?”

 রা। হাঁ, চিনি।

 শ। অমরচাঁদ কি আপনার শত্রু?

 রা। যদি এই পৃথিবীতে আমার কেহ শত্রু থাকে, তবে সে আমরচাঁদ।

 শ। কেন—কারণ কি, শুনিতে পাই না?

 রা। এখন শুনিবার সময় নয়।

 শ। তাহাকে কি আজিই নিকেশ করিতে হইবে?

 রা। হাঁ, পারিলে ভাল হয়।

 শ। যদি করিতে পারি, তাহা হইলে কি হইবে?

 রা। তোমার সঙ্গে—।

 শঙ্করদাস জালে পড়িল।

 কমলা পুনরায় কহিলেন, “আর আমার এই অসীম ধনের অর্দ্ধেক তোমাকে তৎক্ষণাৎ দিব। যদি আমাকে চাও, ও আমার এই অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হইতে চাও, তবে যাহা বলিলাম, তাহা অবিলম্বে সম্পন্ন কর।”

 শঙ্কর। ভয় কি-শঙ্কর দাস থাকিতে অমরচাঁদকে ভয়? নিশ্চয় বলিতেছি, সে আর এ পৃথিবীতে নাই, তাহার প্রাণবায়ু বায়ুতে মিশাইয়াছে, কল্য সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে তাহার নাম-গন্ধ পর্য্যন্ত এই পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইবে।

 কমলা একটু মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন,—

 “তোমার সহিত অমরচাঁদের তুলনাই হয় না।”

 শ। আচ্ছা, আমি আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।

 রা। শীঘ্র বল, বিলম্বে কার্য্যহানি।

 শ। অমরচাঁদের দ্বারা আপনি কি কোন প্রকার অত্যাচারিত হইয়াছিলেন?

 কমলা দেবীযর চক্ষুর্দ্বয় হইতে যেন অগ্নিকণা বর্ষণ হইল। বলিলেন, “ও আমার যম! আমাকে খেতে এসেছে, যেখানে যাই, সঙ্গে সঙ্গে। কাশীতেও এসেছে আমাকে খেয়ে ফেল‍্বার জন্যে।”

 শ। সে আপনার জীবননাশ কেন করিবে?

 “বুঝিতে পার নাই?” একটু হাসিয়া কমলা একটী অতি প্রকাণ্ড কটাক্ষ শঙ্কর দাসের উপর নিক্ষেপ করিলেন, শঙ্কর সে তেজ সহ্য করিতে পারিল না। সে তেজে খোদ শঙ্করকে খাই খাই ডাক ছাড়িতে হইয়াছিল, সে তেজে আজ শঙ্কর দাস সহিবে? পারিল না, গলিয়া গেল। ভ্যাবা গঙ্গারামেযর মত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—

 ও ব্যক্তির নাম যথার্থই কি অমরচাঁদ, না আর কোন নাম আছে?

 রা। হাঁ— উহার নাম অমরচাঁদ। আমার ভয়ানক শত্রু, নাম করিলে শরীর কাঁপিয়া উঠে, উহার ভয়ে আমার আহার নিদ্রা নাই, উহার মরণ হইলে আমি নিরাপদ।

 শ। ইহার ভিতর যে কি বিশেষ কারণ আছে, তাহা ত সম্যকরূপে বুঝিতে পারিলাম না।

 রা। যখন আমি দেশ থেকে আসি, তখন হইতেই ও আমার পেছু পেছু। ও লোকটা মলেই বাঁচি, যখনই তোমার সহিত দেখা হইয়াছে, তোমাকে চিনিয়াছি—মনে মনে ভাবি, কত সুখ, কত সুখ জীবন থাকিলে—এক একবার ভাবি, এ প্রাণ আর রাখিব না, কিন্তু আমার সুখ মনে হইলেই সে চিন্তা সব কোথায় চলিয়া যায়।

 শ। এ কি যথার্থ সত্য যে, তুমি আমার।

 রা। এখন বুঝলে, কেন আমি সব কথা প্রকাশ করিয়া বলি না? ও লোকটা কখন কোন্ বেশে যে উপস্থিত হয়, নির্ণয় করা কঠিন।

 শ। ভয়ের কোন কারণ নাই, ও লোক কোথায় থাকে, বা যায়—সেদিকে আমার দৃষ্টি রহিল।

 শঙ্করের কথাগুলি শুনিয়া কমলা একটু অন্যমনস্কভাবে থাকিলেন ও দরজার পরদা টানিয়া অন্য একটি প্রকোষ্ঠে চলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পরে নিভাজ রৌপ্য বিনির্ম্মিত দুটী হাতবাক্স লইয়া উপস্থিত! আসিয়া কহিলেন, “শঙ্কর! আমাকে কি কেউ কোন বিষয়ে সন্দেহ করে?”

 শ। কই, আমি ত কোথাও কিছু শুনি নাই।

 রা। তুমি কি মনে কর?

 শ। আমি—আমি!

 রা। যাহাই হউক, আমি শুনিয়াছি, তুমি ঋণজালে বড়ই জড়ীভূত, উত্তমর্ণগণ তোমাকে জ্বালাতন করে, এমন কি, পথে ঘাটে দেখা পেলে অপমান করিতেও ত্রুটী করে না।

 শ। সে কথা বলে কি আর জানাব।

 রা। এই লও— তোমাকে ৫০০ শত মুদ্রা দিলাম,—কেমন, ইহাতেই হইবে বোধ হয়?

 শ। যথেষ্ট হইবে।

 কমলা পুনরপি কহিলেন,—“আমি যদি এই প্রকার শত সহস্র মুদ্রা প্রত্যহ ব্যয় করি, তথাপি আমার ধনের কিছুমাত্র ক্ষয় হইবে না। এই যে অতুল ঐশ্বর্য্য দেখিতে পাইতেছ, এ সমস্তই আমার মৃত স্বামীর—বলিতে বলিতে কমলার কণ্ঠশ্বাস যেন রুদ্ধ হইয়া আসিল; সুনীল বিশাল নেত্রদ্বয় হইতে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু পড়িল। যুবতী আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, কাঁদিয়া ফেলিলেন। তখন তাঁহাকে দেখিলে বোধ হইবে, কত যে অন্তর্দাহনে কমলার হৃদয় ব্যথিত—অতীত স্মৃতি আসিয়া হৃদয়ের গূঢ়তম প্রদেশে প্রবেশ করিল, জালা বাড়িল। শাস্তি—শান্তি ত নাই, তবে কি না সর্ব্বশক্তিমান্ ভগবান ভিন্ন কেউ বলিতে পারে না।

 বাষ্পগদগদরে কমলা আর বলিতে লাগিলেন,—“দেখ শঙ্কর! আমার পিতার আমিই একমাত্র সন্তান, তিনিও অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী ছিলেন, তাঁহার সমস্ত ধন আমি প্রাপ্ত হইয়াছি। আমার ধনের ইয়ত্তা নাই, লোকে যে আমাকে রাণী বলে, তা অনেক রাজা অপেক্ষা আমার ঐশ্বর্য্য বেশী, এমন কি আর—” বলিতে পারিলেন না।

 শঙ্করদাস এতক্ষণ পর্যন্ত নির্ব্বতনিষ্কম্প প্রদীপের গায় দাঁড়াইয়া কমলার কথাগুলি শুনিতেছিল, হঠাৎ চট‍্কা ভাঙ্গা মত হইয়া বলিল, “গত বিষয়ের উল্লেখ করিয়া আর দুঃখ প্রকাশ করিবার প্রয়োজন নাই। তবে বলিবার এইটুকু আছে যে, এত সঙ্গতির অধিকারিণী হইয়া একটা হাঘুরে সন্ন্যাসীকে ভয়?”

 কমলা বলিলেন, “ও কথা ত তোমাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, এখনকার সে সময় নয়, আমাকে নিরাপদ কর, তখন—।”

 শ। নিরাপদ—নিরাপদ! তাহাকে অদ্যই জন্মের মত পৃথিবী হইতে বিতাড়িত করিব।

 রা। তাই হ'লেই হ’ল—যে দিন তুমি তার মৃতদেহ দেখাইতে পারিবে,—সেই দিন তৎক্ষণাৎ তোম।র সহিত—

 আর ভাল কথা, তুমি তাহাকে চিনিতে পারিবে? আজ সে ছদ্মবেশে সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করিয়া আমাদের এখানে আসিয়াছিল, তোমার পক্ষে তাহাকে চেনা বড়ই কঠিন হইরে। আমি বলি শুন, অমরচাঁদ ঐরূপ ছদ্মবেশে প্রায়ই এখানে সেখানে বেড়ায়, দেখো, খুব সাবধানে উহার সঙ্গ লইও, যেন হিতে বিপরীত না হয়।

 শ। সে বিষয়ে কোন চিন্তা নাই, যাহাকে একবার দেখিব, তাহাকে কি আর এ জন্মে ভুলিব!

 “তবে শঙ্কর, তুমি যাও, শয়ন কর গে, রাত্রি ঢের হইয়াছে, আমিও যাই। দেখো, যত শীঘ্র পার, এই কার্য্য সম্পন্ন করেো” এই বলিয়া কমলা শয়নপ্রকোষ্ঠে চলিয়া গেলেন। শঙ্করও নিজ কক্ষে শয়ন করিতে চলিয়া গেল। আমিও সুযোগমতে ঐ বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া আসিলাম।