নকল রাণী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া বহু কষ্টের পর কমলার গ্রাম প্রাপ্ত হইলাম। সেই স্থানে গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, বাস্তবিকই কমলার স্বামী সরোজকান্ত রাত্রিকালে শ্বশুরবাটী হইতে নিরুদ্দেশ হন, কিন্তু তাঁহার কর্ম্মস্থানে বা নিজ বাড়ীতে প্রত্যাগমন করেন নাই। এই ঘটনার কিছু দিবস পরেই, কমলার পিতার মৃত্যু হয়, ও কমলা ঐ গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া পবিত্র কাশীধামে গিয়া বাস করিতেছে। গ্রামে এই কথা রাষ্ট যে, সে তাহার স্বামীকে হত্যা করিয়া পুলিসের ভয়ে কাশীবাসী হইয়াছে। ঐ স্থান হইতে এই অবস্থা অবগত হইয়া, আমি কাশীতে গমন করিলাম। রাস্তায় একজন সন্ন্যাসীর সহিত আমার হঠাৎ সাক্ষাৎ হইল; তিনি আমার নিকট সমস্ত কথা গল্পচ্ছলে অবগত হইয়া, আমাকে এই মোকর্দ্দমার অনুসন্ধানে বিশেষরূপ সাহায্য করিতে স্বীকার করিলেন। তিনি সন্ন্যাসী হইয়া কেন যে আমাকে এই কার্য্যে সাহায্য করিতে আপনা হইতে সম্মত হইলেন, তাহা কোন প্রকারে আমি কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ও পাঠকগণও জানিতে পারিবেন। আমরা উভয়ে কাশীতে দশাশ্ব- মেধ ঘাটে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সেইস্থানে আজ বড় ধূম, কেবল দীয়তাং ভুজ্যতাং। দশাশ্বমেধ ঘাটের ত্রিতল বাটী লোকে লোকারণ্য; যে যাহা খাইতে চাহিতেছে, সে অহা তৎক্ষণাৎ পাইতেছে। কাঙ্গাল গরিব দুই হাত তুলিয়া “জয় রাণী-মার জয়!” শব্দে দিক‍্দিগন্ত কাঁপাইয়া সহর্ষমনে চলিয়া যাইতেছে। বাহির-বাটীতে বড় ভিড়, কার সাধ্য সেই জনস্রোত ঠেলিয়া অগ্রসর হয়। কিন্তু এমনি বন্দবস্তের সহিত কার্য্য সমাধা হইতেছে যে, কাহাকেও বিশেষ কষ্টভোগ করিতে হইতেছে না। প্রাতঃকাল হইতে সমস্ত দিন প্রায়ই এইভাবে চলিল। এখন অপরাহ্ণ, বেলা ৫টা বাজে। শীতকাল। একে একে লোকজন জমিতে আরম্ভ হইল। সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় আমি সেই জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর সহিত সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। সন্ন্যাসীকে ভাল করিয়া দেখিলে প্রাচীন বলিয়া বোধ হয় না, জোর ৩৪৷৩৫ বৎসর বয়ঃক্রম হইবে। কেন না, সেই অন্ধকারের সমষ্টি শ্মশ্রুগুম্ফ ও জটাভার এখনও শেত বর্ণ ধারণ করে নাই—যেমন তেমনই রহিয়াছে। সন্ন্যাসী বহির্বাটীর দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“ওহে বাপু! তোমাদের রাণীজীর নাম শুনিয়া, অনেকদূর হইতে আসিয়াছি, একবার তাঁহার সহিত দেখা করা আবশ্যক।”

 দ্বারবান কহিল,—“আজ্ঞে! হাঁ! কেন না দেখা হইবে! অবশ্যই হইবে।”

 সন্ন্যাসী।—তুমি যে বেশ লোক হ্যা, কৈ, তুমি ত আমাকে রাজবাটীর দরওয়ানের মত চোক দুটী লাল করিয়া কথা কহিলে না?”

 দ্বার। আজ্ঞে, আপনাদের মত লোকের উপর—আপনাদের কেন, কোন লোকের উপরই কড়া হুকুম নাই।

 স। এমন সদাশয়া রাণী ত কখনও দেখি নাই।

 দ। মহাশয়! আমি আজ আট দিন এই রাণীজীর কাছে চাকরি করিতেছি, আমিও—

 স। আচ্ছা রাণীজীর নাম কি? বাড়ী কোথায়, জান?

 দ। শুনিয়াছি, সুখগড়ে বাড়ী, নাম—কমলা।

 স। এখানে কতদিন হইল আসিয়াছেন?

 দ। প্রায় দশদিন।

 স। সঙ্গে কত লোক?

 দ। তা ঠিক জানি না, তবে দেখিতেছি, চাকর বাকর সব এই স্থানেই নিযুক্ত হইয়াছে।

 স। তাঁহার সহিত কখন দেখা হইবে?

 দ। আহারের সময়।

 স। সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীকে তিনি নিজে থাকিয়া খাওয়ান?

 দ। হাঁ।

 স। দেখা কোথায় হইবে?

 দ। কেন, উপরের বৈঠকখানায়।

 এমন সময়ে উপর হইতে কে ডাকিল,—“সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী, যাঁহারা আছেন, রাণীজীর আদেশ—তাহার উপরে আসুন।”

 স। তবে বাপু উপরে যাইবার পথটা দেখাইয়া দাও।

 দ্বারবানের দ্বারা পথ প্রদর্শিত হইলে সন্ন্যাসী ঠাকুর উপরের বৈঠকখানায় উঠিলেন, আমিও তাঁহার সঙ্গ পল্পিত্যাগ করিলাম না। উঠিয়াই অবাক!—দেখিলাম, ইতিমধ্যেই টিকিধারী ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ ও দণ্ডী-সন্ন্যাসী প্রভৃতি আপন আপন স্থান অধিকার করিয়া বসিয়া আছেন। সুতরাং আমরা কোনরূপ বাঙ‍্নিষ্পত্তি না করিয়া সভার একপার্শে উপবেশন করিলাম। দেখিতে দেখিতে ৮টা বাজিয়া গেল। সকলে বলাবলি করিতে লাগিল, এইবার রাণী আসিবেন। বাস্তবিক কিছুক্ষণ পরে এক অপরূপ রূপলাবণ্যবতী যুবতী সথিদ্বয় সমভিব্যাহারে সভাস্থলে আসিয়া গললগ্নীকৃতবাসে সভাস্থ দণ্ডী সন্ন্যাসী এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে প্রণাম করিলেন। যুবতীকে দেখিলেই রাণী বলিয়াই বোধ হয়। বয়স আন্দাজ ২৪৷২৫, অতিমধুরস্বরে বিনয়াবনত হইয়া সকলের সহিত আলাপ করিতে লাগিলেন। আমার সঙ্গী সন্ন্যাসী একবার রাণীজীর মুখের দিকে তাকাইয়া মুখ হেঁট করিলেন।

 রাণী কমলাও সন্ন্যাসীকে দেখিয়া যেন ভীতচকিত হইলেন, মুখ-জ্যোতি যেন তিরোহিত হইল। মুখে হাসি আছে, অথচ যেন নাই। বেশী কোন কথা আর না কহিয়া ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “ইহাদের সুব্যবস্থা করিয়া দাও, আমি কিছু পরে আবার আসিব।” এই বলিয়া তিনি সখিদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। এদিকে জলযোগের ব্যাপার উপস্থিত। একটা সারগোল পড়িয়া গেল। যে যার পাতা লইয়া বসিল। কিন্তু আমাদের সন্ন্যাসী ঠাকুরের বরাত বড়ই মন্দ এই ভিড়ের ভিতর তিনি যে কোথায় চলিয়া গেলেন, তাহা কেহই জানিতে পারিল না, কিন্তু আমি জানিতাম, আমারই উপদেশমত তিনি কোন কার্য্যোদ্ধার মানসে কোন স্থানে গমন করিলেন। তাঁহার অদৃষ্টে রাজভোগ জুটিল না।