নিষ্‌কৃতিলাভপ্রয়াস

নিষ্‌কৃতিলাভপ্রয়াস

নিষ্‌কৃতিলাভপ্রয়াস



নিষ্‌কৃতিলাভপ্রয়াস

শ্রী ঈ শ্ব র চ ন্দ্র বি দ্যা সা গ র প্র ণী ত

কলিকাতা

সংস্কৃত যন্ত্র

১২৯৫ সাল।



বিজ্ঞাপন


সপ্তদশ বৎসর অতীত হইল, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা শ্রীযুত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এম. এ., তর্কালঙ্কারপ্রণীত শিশুশিক্ষা উপলক্ষে, আমার উপর, পরস্বহারী বলিয়া, যে দোষারোপ করেন, তাহা হইতে নিষ্কৃতিলাভের অভিলাষে, তদ্বিষয়ে স্বীয় বক্তব্য, লিপিবদ্ধ করিয়া, পুস্তকাকারে মুদ্রিত ও প্রচারিত করিবার অভিপ্রায় ছিল। নানা কারণে, তৎকালে সে অভিপ্রায় সম্পন্ন করিতে পারি নাই; এবং, এত দিনের পর, আর তাহা সম্পন্ন করিবার অণুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বিশ্বস্ত লোকের মুখে শুনিতে পাই, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর আরোপিত দোষের উল্লেখ করিয়া, অদ্যাপি অনেক মহাত্মা আমায় নরকে নিক্ষিপ্ত করিয়া থাকেন। এজন্য, কতিপয় আত্মীয়ের অনুরোধপরতন্ত্র হইয়া, স্বীয় বক্তব্য মুদ্রিত ও প্রচারিত করিতে হইল।

 যে মহোদয়েরা, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, আমি পরস্বহারী বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট বিনীত বচনে আমার প্রার্থনা এই, অনুগ্রহ পূর্ব্বক, কিঞ্চিৎ ক্লেশ স্বীকার করিয়া, এই পুস্তকে একবার দৃষ্টিসঞ্চারণ করেন; তাহা হইলে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবেক, যোগেন্দ্রনাথ বাবু, উচিতনুচিতবিবেচনায় বিসর্জ্জন দিয়া, আমার উপর যে উৎকট দোষারোপ করিয়াছেন, তাহা কোনও মতে, সঙ্গত বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না।

 যোগেন্দ্রনাথ বাবু স্বীয় শ্বশুরের জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ জীবনচরিতে তিনি আমার বিষয়ে যাদৃশ বিসদৃশ অভিপ্রায়প্রকাশ করিয়াছেন, প্রসঙ্গক্রমে, এই পুস্তকের শেষভাগে, তাহাও পরিদর্শিত হইয়াছে।

 এই পুস্তকে বাবু দীননাথ বসু উকীলের দুইখানি পত্র প্রকাশিত, এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুই পত্রের আবশ্যক এক এক অংশ উদ্ধত হইয়াছে। পাছে কেহ এরূপ মনে করেন, এই সকল পত্র কৃত্রিম; এজন্য, লিথগ্রাফি প্রণালীতে মুদ্রিত ও পুস্তকের শেষে যোজিত হইল। যাঁহারা তাঁহদের হস্তাক্ষর জানেন, অন্ততঃ তাঁহারা, এই সকল পত্র কৃত্রিম বলিয়া, আমার উপর দোষারোপ করিতে পারিবেন না।

শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্ম্মা
 কলিকাতা
১ল। বৈশাখ, ১২৯৫ সাল।



নিষ্‌কৃতিলাভপ্রয়াস

 যৎকালে আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম; তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে, সংস্কৃত-যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। ঐ ছাপাখানায়, তিনি ও আমি, উভয়ে সমাংশভাগী ছিলাম। কতিপয় বৎসর পরে, তর্কালঙ্কার, মুরসিদাবাদে জজ পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হইয়া, কলিকাতা হইতে প্রস্থান করেন। কিছু দিন পরে, তিনি ডেপুটি মাজিষ্ট্রেটের পদে নিযুক্ত হয়েন।

 ক্রমে ক্রমে, এরূপ কতকগুলি কারণ উপস্থিত হইল যে, তর্কালঙ্কারের সহিত কোনও বিষয়ে সংস্রব রাখা উচিত নহে। এজন্য, উভয়ের আত্মীয় পটোলডাঙ্গানিবাসী বাবু শ্যামাচরণ দে দ্বারা, তর্কালঙ্কারের নিকট এই প্রস্তাব করিয়া পাঠাই, হয় তিনি, আমার প্রাপ্য আমায় দিয়া, ছাপাখানায় সম্পূর্ণ স্বত্ববান্‌ হউন, নয় তাঁহার প্রাপ্য বুঝিয়া লইয়া, ছাপাখানার সম্পর্ক ছাড়িয়া দিউন, অথবা উভয়ে ছাপাখানার যথাযোগ্য বিভাগ করিয়া লওয়া যাউক। তদনুসারে তিনি, আপন প্রাপ্য লইয়া, ছাপাখানার সম্পর্কত্যাগ স্থির করেন। অনন্তর, উভয়ের সম্মতিক্রমে, বাবু শ্যামাচরণ দে, পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, শ্রীযুত বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই তিন ব্যক্তি, হিসাব নিকাস ও দেনা পাওনা স্থির করিয়া দিবার নিমিত্ত, সালিস নিযুক্ত হয়েন, এবং খাতা পত্র দেখিয়া, হিসাব নিকাস ও দেনা পাওনার মীমাংসা করিয়া দেন। তাঁহাদের মীমাংসাপত্রের প্রতিলিপি তর্কালঙ্কারের নিকট প্রেরিত হইলে, তিনি পত্রদ্বারা শ্যামাচরণ বাবুকে জানান, আমি এক্ষণে যাইতে পারিব না; আদালত বন্ধ হইলে, কলিকাতায় গিয়া, আপন প্রাপ্য বুঝিয়া লইব। কিছু দিন পরে তাহার মৃত্যু হওয়াতে, তাঁহার পত্নী, কলিকাতায় আসিয়া, ছাপাখানা সংক্রান্ত স্বীয় পতির প্রাপ্য বুঝিয়া লয়েন।

 কলিকাতায়, মুরসিদাবাদে, ও কাঁদিতে কর্ম্ম করিবার সময়, তর্কালঙ্কারের পরিবার তাঁহার নিকটে থাকিতেন; তাহার বৃদ্ধা জননী বিল্বগ্রামের বাটীতে অবস্থিতি করিতেন। তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পর, তাঁহার পরিবার বিল্বগ্রামের বাটীতে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

 কিছু দিন পরে, তর্কালঙ্কারের মাতাঠাকুরাণী কলিকাতায় আগমন করিলেন, এবং নিরতিশয় শোকাভিভূত হইয়া, বিলাপ ও অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। তাঁহার দুইটি পুত্র হইয়াছিল। কনিষ্ঠটি, কিছু কাল পূর্ব্বে, কালগ্রাসে পতিত হয়েন। জ্যেষ্ঠ তর্কালঙ্কার জননীর জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন। জননীর দুর্ভাগ্যবশতঃ, তিনিও মানবলীলার সংবরণ করিলেন। এমন স্থলে, জননীর যেরূপ শোচনীয় অবস্থা ঘটে, তাহা অনায়াসেই সকলের অনুভবপথে আসিতে পারে। দুই তিন দিন পরে, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তর্কালঙ্কার আপনকার কিরূপ ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিলেন, মদন আমার কোনও ব্যবস্থা করিয়া যান নাই। বধূমাতা, আপন কন্যাগুলি লইয়া, স্বতন্ত্র আছেন। আমার দিনপাতের কোনও উপায় নাই; এজন্যে তোমার নিকটে আসিয়াছি। যদি তুমি দয়া করিয়া অন্ন বস্ত্র দাও, তবেই আমার রক্ষা; নতুবা আমায় অনাহারে প্রাণত্যাগ করিতে হইবেক। এই বলিয়া, তিনি রোদন করিতে লাগিলেন।

 তাঁহার কথা শুনিয়া, আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। বিশ্বস্ত লোকের মুখে শুনিয়াছিলাম, তর্কালঙ্কার যথেষ্ট টাকা রাখিয়া গিয়াছেন; অথচ তাঁহার বৃদ্ধা জননীকে, অন্ন বস্ত্রের জন্যে, অন্যের নিকটে ভিক্ষা করিতে হইতেছে। যাহা হউক, কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথনের পর, তিনি বলিলেন, মাস মাস দশ টাকা পাইলে, আমার দিনপাত হইতে পারে। এই সময়ে, রোগ, শোক, আহারক্লেশ প্ভৃতি কারণে, তাঁহার শরীর সাতিশয় শীর্ণ হইয়াছিল; অধিকন্তু, চক্ষুর দোষ জন্মিয়া, ভাল দেখিতে পাইতেন না। তিনি বলিলেন, শরীর সুস্থ থাকিলে, ও চক্ষুর দোষ না জন্মিলে, পাঁচ টাকা হইলেই আমার চলিতে পারিত। কিন্তু শরীরের ও চক্ষুর যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে একটি পরিচারিকা ব্রাহ্মণকন্যা না রাখিলে, আমার কোনও মতে চলিবেক না। আমার যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাঁহাতে আমি অধিক দিন বাঁচিব না; সুতরাং, অধিক দিন তোমায় আমার ভার বহিতে হইবেক না। এই সকল কথা শুনিয়া, আমি তাঁহাকে মাস মাস দশ টাকা দিতে সম্মত হইলাম; এবং, মাসে মাসে, তাঁহার নিকটে টাকা পাঠাইয়া দিতে লাগিলাম[১]

 কিছু দিন পরে, তিনি পুনরায় কলিকাতায় আগমন করিলেন। কি জন্যে আসিয়াছেন, এই জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি বলিলেন, বাবা! তুমি আমার অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ দূর করিয়াছ। আর এক বিপদে পড়িয়া, পুনরায় তোমায় জ্বালাতন করিতে আসিয়াছি। এই বলিয়া, তিনি অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলিতে লাগিলেন, অমুকের অত্যাচারে আমি আর বাটীতে তিষ্ঠিতে পারি না। বিশেষতঃ, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা আমাদের বাটীতে আসিলে, তাহাদের সমক্ষে, তিনি অকারণে আমার এত তিরস্কার করেন, যে প্রাণত্যাগ করিতে ইচ্ছা হয়। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে তোমার নিকটে আসিলাম। তখন আমি বলিলাম, মা! আপনকার এ অসুখের নিবারণ করা আমার ক্ষমতার বহির্ভূত। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথনের পর, আমি বলিলাম, আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহাতে আর আপনকার সংসারে থাকিবার কোনও অবশ্যকতা লক্ষিত হইতেছে না। আমার বিবেচনায়, অতঃপর কাশীবাস করাই আপনকার পক্ষে সর্ব্বাংশে শ্রেয়ঃ। আমার পিতৃদেব কাশীবাসী হইয়াছেন; যদি মত করেন, আপনাকে তাঁহার নিকটে পঠাইয়া দিই। তিনি বাসা স্থির করিয়া দিবেন; সর্ব্বদা তত্ত্বাবধান করিবেন; আপনকার পরিচর্য্যার নিমিত্ত, ব্রাহ্মণকন্যা স্থির করিয়া দিতে পরিবেন; তাঁহার নিকট হইতে মাস মাস দশ টাকা পাইবেন; যেরূপ শুনিতে পাই, তাহাতে মাসিক দশ টাকাতে, সেখানে সচ্ছন্দে দিনপাত করিতে পারিবেন। তিনি সম্মত হইলেন; তাঁহাকে কাশীতে পাঠাইয়া দিলাম। তিনি অদ্যাপি কাশীবাস করিতেছেন; এবং, আমার নিকট হইতে, মাস মাস, দশ টাকা পাইতেছেন।

 একদা, তর্কালঙ্কারের পত্নী ও বিধবা মধ্যমা কন্যা কুন্দমাল। কলিকাতায় আসিলেন। এক দিন কুন্দমালা, তাহার জননীর সমক্ষে, আমায় বলিল, দেখ, কাকা! পিতা অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন; মা বুঝিয়া চলিলে, আমাদের সচ্ছন্দে দিনপাত হইতে পারিত। কিন্তু উনি বিবেচনা করিয়া চলিতেছেন না, সকলই উড়াইয়া ফেলিতেছেন। আর কিছু দিন পরে, আমাদিগকে অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ পাইতে হইবেক। উঁহার অদৃষ্টে যাহা আছে, হউক; কিন্তু আমি অল্পবয়স্কা ও অনাথা; আমায় অধিক দিন বাঁচিতে হইবেক। আমার অদৃষ্টে কত কষ্টভোগ আছে, বলিতে পারিনা। এই বলিয়া, নিতান্ত শোকাকুল হইয়া, কুন্দমালা অশ্রুবিমোচন করিতে লাগিল। তদর্শনে আমার অন্তঃকরণে নিরতিশয় দুঃখ উপস্থিত হইল। তখন আমি কুন্দমালাকে বলিলাম, বাছা! রোদন করিও না; আমি যত দিন জীবিত থাকিব, তুমি অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ পাইবে না। আমি তোমাকে মাস মাস দশ টাকা দিব; তাহা হইলেই তোমার অনায়াসে দিনপাত হইতে পরিবেক। এই বলিয়া, সেই মাস অবধি, আমি কুন্দমালাকে, মাস মাস, দশ টাকা দিতে আরম্ভ করিলাম। সে অদ্যাপি, আমার নিকট হইতে, মাস মাস, দশ টাকা পাইতেছে।

 এস্থলে ইহাও উল্লিখিত হওয়া আবশ্যক, ছাপাখানা স্থাপিত হইবার কিছু দিন পরে, একটি সরকার নিযুক্ত করা আবশ্যক হয়। তর্কালঙ্কারের ভগিনীপতি মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অতিকষ্টে দিনপাত করিতেন, ইহা আমি সবিশেষ অবগত ছিলাম; এজন্য তাঁহাকে নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব করিলাম। তর্কালঙ্কার প্রথমতঃ সম্মত হইলেন না; অবশেষে, আমার পীড়াপীড়িতে, তাঁহাকে সম্মত হইতে হইল। মাধবচন্দ্র, মাসিক দশ টাকা বেতনে, নিযুক্ত হইলেন। কিছু কাল কর্ম্ম করিয়া, তাঁহার মৃত্যু হইলে, তর্কালঙ্কারের ভগিনী, কলিকাতায় আসিয়া, আমার নিকটে রোদন করিতে লাগিলেন, এবং সাতিশয় কাতর বচনে বলিলেন, দাদা! কাল কি খাইব, তাহার সংস্থান নাই। অতএব, দয়া করিয়া, আমার কোনও উপায় কর। নতুবা, ছেলে মেয়ে লইয়া, আমায় অনাহারে প্রাণত্যাগ করিতে হইবেক। তর্কালঙ্কারের ভগিনী যাহা বলিলেন, তাহা কোনও অংশে অপ্রকৃত নহে; এজন্য তর্কালঙ্কারের নিকট প্রস্তাব করিলাম, যত দিন তোমার ভাগিনেয়টি মানুষ না হয়, তাবৎ, ছাপাখানার তহবিল হইতে, তোমার ভগিনীকে মাস মাস দশ টাকা দিতে হইবেক। তর্কালঙ্কার, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক, সম্মত হইলেন। তাঁহার ভগিনী, ছাপাখানার তহবিল হইতে, মাস মাস দশ টাকা পাইয়া, দিনপাত করিতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে, তর্কালঙ্কার মুরসিদাবাদ হইতে লিখিয়া পাঠাইলেন, আমার ভগিনীকে, ছাপাখানার তহবিল হইতে, মাস মাস যে দশ টাকা দেওয়া হয়, তাহা আমি, আগামী মাস হইতে, রহিত করিলাম। এই সংবাদ পাইয়া, তাঁহার ভগিনী, কলিকাতায় আসিয়া, আমার নিকটে রোদন করিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, ছাপাখানার তহবিল হইতে আর আমি তোমায় টাকা দিতে পারিব না। আমি এইমাত্র করিতে পারি, আমার অংশের পাঁচ টাকা তুমি মাস মাস আমার নিকট হইতে পাইবে; ইহার অতিরিক্ত দেওয়া আমার ক্ষমতার বহির্ভূত। তিনি, তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া, বাটী গমন করিলেন। তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন, আমার নিকট হইতে, মাস মাস, পাঁচ টাকা পাইয়া, কোনও রূপে দিনপাত করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশাতেই, তদীয় পুত্রটির প্রাণত্যাগ ঘটে। তাঁহার মৃত্যুর পর, তদীয়া বিধবা কন্যা, যত দিন জীবিত ছিলেন, আমার নিকট হইতে মাস মাস দুই টাকা লইয়া, দিনপাত করিয়াছিলেন।

 এক দিন, তর্কালঙ্কারের জামাতা শ্রীযুত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, তর্কালঙ্কারের বিধবা মধ্যমা কন্যা কুন্দমালার উল্লেখ করিয়া, আমায় বলিলেন, মেজ দিদি বলেন, কাকা, দয়া করিয়া, আমায় মাস মাস দশ টাকা দিতেছেন; তাহাতে আমার দিনপাত হইতেছে। যদি তিনি, দয়া করিয়া, শিশুশিক্ষার তিন ভাগ আমায় দেন, তাহা হইলে আমাদের যথেষ্ট উপকার হয়। এই কথা শুনিয়া, আমি যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে বলিলাম, কুন্দমালাকে বলিবে, আমি, তাহার প্রার্থনা অনুসারে, শিশুশিক্ষার তিন ভাগ তাহাকে দিলাম। আজ অবধি, সে ঐ তিন পুস্তকের উপস্বত্বভোগে অধিকারিণী হইল। যোগেন্দ্রনাথ বাবু কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর আমায় বলিলেন, দেখুন, আপনি পুস্তক তিন খানি দয়া করিয়া তাঁহাকে দিতেছেন, এরূপ ভাবিবেন না। সালিসেরা যে মীমাংসাপত্র লিখিয়া দিয়াছেন, তাহাতে শিশুশিক্ষার কোনও উল্লেখ নাই; সুতরাং, শিশুশিক্ষা তর্কালঙ্কার মহাশয়ের উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি। এই কথা শুনিয়া, আমি চকিত হইয়া উঠিলাম; এবং, সহসা কিছুই অবধারিত বুঝিতে না পারিয়া, যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে বলিলাম, তবে শিশুশিক্ষার বিষয় আপাততঃ স্থগিত থাকুক। সবিশেষ অবগত না হইয়া, আমি এ বিষয়ে কিছু বলিতে ও করিতে পারিতেছি না। যদি এরূপ হয়, আমি পরকীয় সম্পত্তি অন্যায় রূপে অধিকার করিতেছি, তাহা হইলে, কেবল পুস্তক তিন খানি দিয়া, নিস্কৃতি পাইতে পারিব না; যে কয় বৎসর ঐ তিন পুস্তক আমার অধিকারে আছে, সেই কয় বৎসরের যে প্রকৃত উপস্বত্ব হইবেক, তাহাও, পুস্তকের সহিত, তর্কালঙ্কারের উত্তরাধিকারীদিগকে দিতে হইবেক। অতএব, তুমি কিছু দিন অপেক্ষ কর; আমি, এ বিষয়ের সবিশেষ তদন্ত করিয়া, প্রকৃত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, তোমায় জানাইব।

 এই কথা বলিয়া, সে দিন যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে বিদায় করিলাম; এবং, অনন্যমনাঃ ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া, উপস্থিত বিষয়ের তত্ত্বানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। সর্বাগ্রে সালিস মহাশয়দিগের মীমাংসাপত্র বহিষ্কৃত করিলাম; তাহাতে শিশুশিক্ষার কোনও উল্লেখ দেখিতে পাইলাম না। পরে, সালিস মহাশয়দিগকে, উপস্থিত বিষয় অবগত করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলাম, এ বিষয়ে আপনাদের কিছু স্মরণ হয় কি না। তাঁহারা বলিলেন, বহু বৎসর পূর্ব্বে, আমরা সালিসি করিয়াছিলাম; এক্ষণে তৎসংক্রান্ত কোনও বিষয়ের কিছুই স্মরণ হইতেছে না। অনেক ক্ষণ কথোপকথনের পর, শ্যামাচরণ বাবু বলিলেন, আমার ঠিক কিছুই মনে পড়িতেছে না; তবে আপাততঃ এই মাত্র স্মরণ হইতেছে, তুমি তোমাদের রচিত পুস্তকের বিষয়ে কোনও প্রস্তাব করিয়াছিলে। মদন, সে বিষয়ে, আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া, আমায় পত্র লিখিয়াছিলেন। যদি সে পত্র পাওয়া যায়, তাহা হইলে, বোধ করি, আর কোনও গোল থাকে না।

 আমি যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে কিছু দিন অপেক্ষা করিতে বলিয়াছিলাম। তিনি, তাহা না করিয়া, আমায় ভয় দেখাইয়া, সত্বর কার্য্যশেষ করিয়া লইবার অভিপ্রায়ে, বাগবাজারনিবাসী বাবু দীননাথ বসু উকীলের নিকটে গমন করিলেন। দীননাথ বাবু, তাঁহার মুখে যেরূপ শুনিলেন, তদনুসারে আমায় নিম্নদর্শিত পত্র লিখিলেন,

 Pundit Isswar Chunder Bidyasagar.

  My dear Sir,

 The widow and children of the late lamented Mudun mohun Turkalankar are in difficulty in consequence of your having stopped their allowance for profits in Turkalankar's works and preventing their publication by them. I hope you will please do something for them to avoid scandal and future botheration. The matter has been brought into my notice by persons interested for the family of Turkalankar and I have assured them that there will be no difficulty for them to get back their rights. Kindly try to settle the matter amicably as soon as possible lest it grows serious by delay.

 Hoping you are well

I remain

Yours V Sincerely

Dinonath Bose

17 May 71.

পত্রের অনুবাদ

“আপনি মদনমোহন তর্কলঙ্কারপ্রণীত পুস্তকের উপস্বত্ব হিসাবে তাঁহার পরিবারকে যাহা দিতেন, তাহা রহিত করিয়াছেন; এবং তাঁহাদিগকে ঐ পুস্তক ছাপাইতে দিতেছেন না; এজন্য তাঁহারা কষ্ট পাইতেছেন। আমি আশা করি, আপনি এ বিষয়ের নিম্পত্তি করিবেন; নতুবা আপনাকে দুর্নামগ্রস্ত ও উৎপাতে পতিত হইতে হইবেক। তর্কালঙ্কারপরিবারের হিতৈষী ব্যক্তিরা এ বিষয় আমার গোচর করিয়াছেন; এবং আমি তাঁহাদিগকে অবধারিত বলিয়াছি, তাঁহাদের অধিকার পুনঃপ্রাপ্ত হইতে তাঁহাদিগকে ক্লেশ পাইতে হইবেক না। আপনি দয়া করিয়া, যত সত্বর পারেন, এ বিষয়ের আপোশে নিম্পত্তি করিয়া ফেলিবেন; বিলম্ব করিলে আপনাকে কষ্ট পাইতে হইবেক”।

 আমি তর্কালঙ্কারের পরিবারকে, তাঁহার পুস্তকের উপস্বত্বছিসাবে, যাহা দিতাম, তাহা রহিত করিয়াছি, এবং তাঁহাদিগকে ঐ পুস্তক ছাপাইতে দিতেছি না; যোগেন্দ্রনাথ বাবু, কোন বিবেচনায়, দীননাথ বাবুর নিকট, এরূপ অলীক নির্দ্দেশ করিলেন, বলিতে পারি না। তর্কালঙ্কারের পরিবার, পুস্তকের উপস্বত্ব উপলক্ষে, আমার নিকট কখনও কোনও দাবি করেন নাই, এবং আমিও, পুস্তকের উপস্বত্ব বলিয়া, তাহাদিগকে কখনও কিছু দিই নাই। আর তাঁহারা ঐ পুস্তক ছাপাইতে চাহেন, আমার নিকট কখনও এরূপ কথার উত্থাপন হয় নাই। এমন স্থলে, আমি পুস্তকের উপস্বত্বদান রহিত করিয়াছি, এবং পুস্তক ছাপাইতে দিতেছি না, ইহা কিরূপে সম্ভবিতে পারে, মহামতি যোগেন্দ্রনাথ বাবু ব্যতীত অন্যের তাহা বুঝিবার অধিকার নাই। ফলকথা এই, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর এই নির্দ্দেশ সম্পূর্ণ অলীক ও কপোলকম্পিত। তিনি, তর্কলঙ্কারের মধ্যম কন্যা কুন্দমালার নাম করিয়া, আমার নিকটে, ভিক্ষাস্বরূপ, শিশুশিক্ষা প্রার্থনা করিবার পূর্ব্বে, কখনও, কোনও সুত্রে, কোনও আকারে, শিশুশিক্ষার কোনও উল্লেখ হয় নাই।

 যাহা হউক, দীননাথ বাবুর পত্র পাইয়া, আমি সাতিশয় উদ্বিগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। শ্যামাচরণ বাবুও, পত্রার্থ অবগত হইয়া, অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইলেন। সৌভাগ্যক্রমে, ইহার তিন চারি দিন পরেই, তর্কালঙ্কারের পত্র হস্তগত হইল। পত্রপাঠ করিয়া, সমস্ত বিষয় আমার ও শ্যামাচরণ বাবুর স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল। সে বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই—

 সালিস মহাশয়ের হিসাব নিকাসে প্রবৃত্ত হইলে, আমি তাঁহাদিগকে বলিয়াছিলাম, আপনাদিগকে দুই প্রকার হিসাব করিতে হইবেক; প্রথম এই, অন্যান্য পুস্তকের দ্যায়, আমাদের উভয়ের রচিত পুস্তকের ছাপার খরচ ধরিয়া লইয়া, ছাপাখানার হিসাব করিতে হইবেক; দ্বিতীয় এই, আমাদের রচিত পুস্তকের, ছাপার ও বিক্রয়ের খরচ বাদে, যে মুনাফা থাকিবেক, তাহার স্বতন্ত্র হিসাব করিতে হইবেক। ছাপাখানার মুনাফায় উভয়ে তুল্যাংশভাগী হইব; এবং, ছাপার ও বিক্রয়ের খরচ বাদে, কাপিরাইট হিসাবে, আমরা স্ব স্ব পুস্তকের উপসত্ব পাইব। শ্যামাচরণ বাবু পত্রদ্বারা তর্কালঙ্কারকে এই বিষয় এবং আর কতিপয় বিষয় জানাইলে, তর্কালঙ্কার তদুত্তরে এ বিষয়ে তাঁহাকে লিখিয়া পাঠান,—

 “Copyright বিষয়ে যে প্রশ্ন করিয়াছ তদ্বিষয়ে কয়েক কথা বক্তব্য আছে, আমি যে পর্য্যন্ত ছাপাখানার কার্য্য করিয়াছিলাম তৎকাল পর্য্যন্ত কাপিরাইটের কোন প্রসঙ্গ উপস্থিত ছিল না, এবং আমার যেন এইরূপ স্মরণ হইতেছে, বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল হইলেন তখনি মৃত মহাত্মা বীটন সাহেব তাঁহাকে ছাপাখানার ব্যবসায় বিষয়ক কি Hint দিয়াছিলেন অথবা দত্তবংশীয়েরা তাঁহার উপর কোন কলঙ্কারোপ না করিতে পারে এই বিবেচনা করিয়া ফলে আমার সে কথা ঠিক স্মরণ পড়িতেছে না, বিদ্যাসাগর ভায়া ছাপাখানার অংশীদার থাকিতে অনিচ্ছুক হইয়া প্রকাশ করিয়াছিলেন তিনি আর ছাপাখানার অংশ গ্রহণ করিবেন না, যে সকল পুস্তক তিনি রচনা করিয়া দিবেন, তাহার কাপিরাইট তিনি লইবেন, তদ্ভিন্ন অন্যান্য উপস্বত্বের ভাজন আমাকে করিবেন এইরূপ প্রস্তাব করিয়াছিলেন, ফলে বিদ্যাসাগরকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেই তিনি তাহার সবিস্তার বৃত্তান্ত তোমাদিগে জানাইতে পারিবেন, অতএব উক্ত সময় হইতে কাপিরাইটের হিসাব করা উচিত হয়, তাহার পূর্ব্বে যে কথা ছিল না ও হয় নাই, সে কথার নুতন প্রসঙ্গ করা উচিত হয় ন।”

 তর্কালঙ্কারের অভিপ্রায় অবগত হইয়া, সালিস মহাশয়েরা আমায় জিজ্ঞাসিলেন, এক্ষণে আমরা কিরূপ করিব, বল। আমি বলিলাম, তর্কালঙ্কার যেরূপ বলিতেছেন, তাহা, আমার বিবেচনায়, কোনও মতে, সঙ্গত ও ন্যায়ানুগত নহে। কিন্তু তাহাতে আপত্তি করিতে গেলে, কার্য্য শেষ হইবার পক্ষে, অনেক বিলম্ব ঘটিবেক। যত সত্বর হয়, তর্কালঙ্কারের সহিত সর্ব্বপ্রকার সংস্রব রহিত হওয়া আমার সর্ব্বতোভাবে প্রার্থনীয়। অতএব, আপনারা, তদীয় অভিপ্রায় অনুসারেই, সত্বর, কার্য্য শেষ করিয়া দিউন। তখন তাঁহারা বলিলেন, তবে তর্কালঙ্কার যে সময় হইতে কাপিরাইটের হিসাব করা উচিত হয় বলিতেছেন, তাহার পূর্ব্বে যে সকল পুস্তক লিখিত হইয়াছিল, তাহার একটি ফর্দ্দ, আর তাহার পরে যে সকল পুস্তক লিখিত হইয়াছে, তাহার একটি ফর্দ্দ করিয়া দাও। আমি দুইটি ফর্দ্দ করিয়া দিলাম। প্রথম ফর্দ্দে তর্কালঙ্কারের উল্লিখিত সময়ের পূর্ব্বে লিখিত পুস্তকের, দ্বিতীয় ফর্দ্দে ঐ সময়ের পরে লিখিত পুস্তকের বিবরণ রহিল। তর্কালঙ্কারের অভিপ্রায় অনুসারে, প্রথমফর্দ্দনির্দিষ্ট পুস্তক গুলি[২] ছাপাখানার সম্পত্তি বলিয়া পরিগণিত হইল; সুতরাং, ঐ সমস্ত পুস্তকের উপস্বত্ব ছাপাখানার উপস্বত্বের অন্তর্ভূত হইয়া গেল। এই সমবেত উপস্বত্বে উভয়ে তুল্যাংশভাগী হইয়াছিলাম।

 আমি, তর্কালঙ্কারের পত্র লইয়া, প্রথমতঃ, অনরবল জষ্টিস দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয়ের নিকটে উপস্থিত হইলাম, এবং সবিশেষ সমস্ত তাঁহার গোচর করিলাম। তিনি, তর্কালঙ্কারের পত্র পাঠ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, তর্কালঙ্কার যে সময় হইতে কাপিরাইটের হিসাব করা উচিত হয় বলিতেছেন, তাঁহার শিশুশিক্ষা তাহার পূর্ব্বে অথবা পরে লিখিত। আমি বললাম, শিশুশিক্ষা তাহার বহু বৎসর পূর্ব্বে লিখিত হইয়াছিল। তখন তিনি বলিলেন, তর্কালঙ্কারের মীমাংসা অনুসারে, শিশুশিক্ষা ছাপাখানার সম্পত্তি হইয়াছে; সে বিষয়ে তদীয় উত্তরাধিকারীদের আর দাবি করিবার অধিকার নাই; আপনি সেজন্য উদ্বিগ্ন হইবেন না। এইরূপে আশ্বাসিত ও অভয় প্রাপ্ত হইয়া, আমি বাবু দীননাথ বসু উকীলের নিকটে উপস্থিত হইলাম; এবং, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁহার গোচর করিয়া, তর্কালঙ্কারের পত্র খানি তাঁহার হস্তে দিলাম। পত্র পাঠ করিয়া, এবং বারংবার জিজ্ঞাসা দ্বারা সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, দীননাথ বাবু, কিঞ্চিৎ সন্ধুচিত ভাবে, কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর আমায় বলিলেন, যোগেন্দ্রনাথ বাবু যে এরূপ চরিত্রের লোক, তাহা আমি জানিতাম না। আপনি তর্কালঙ্কারের পরিবারকে তদীয় পুস্তকের উপস্বত্ব হিসাবে যাহা দিতেন, তাহা রহিত করিয়াছেন, এবং তাঁহাদিগকে ঐ পুস্তক ছাপাইতে দিতেছেন না, আমার নিকটে এরূপ অলীক নির্দ্দেশ করা, তাঁহার মত সুশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে, নিতান্ত অনুচিত কার্য্য হইয়াছে; আর, আমিও, তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া, আপনাকে ওরূপ পত্র লিখিয়া, নিতান্ত অন্যায় কার্য্য করিয়াছি। আপনি আমায় ক্ষমা করিবেন। তৎপরে তিনি আমায় বলিলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন; এজন্য আর আপনকার উদ্বিগ্ন হইবার কোনও কারণ দেখিতেছি না। তর্কালঙ্কারের মীমাংসা অনুসারে, তদীয় পরিবারের শিশুশিক্ষায় আর অধিকার নাই। আমি যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে এ বিষয়ে নিরস্ত হইতে বলিব, এবং তিনি যেরূপ বলেন, তাহ আপনাকে জানাইব।

 এইরূপে উভয় স্থানে অভয় প্রাপ্ত হইয়া, আমি যোগেন্দ্রনাথ বাবুকে, নির্দ্দিষ্ট দিনে, নির্দ্দিষ্ট সময়ে, পটোলডাঙ্গার শ্যামাচরণ বাবুর বাটীতে উপস্থিত হইতে বলিয়া পাঠাইলাম। যথাসময়ে তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, যোগেন্দ্রনাথ বাবু এবং তর্কালঙ্কারের শ্যালক শ্রীযুত বাবু রামনৃসিংহ বন্দ্যোপাধ্যায়, উভয়ে উপস্থিত আছেন। তাঁহাদিগকে তর্কালঙ্কারের পত্র দেখাইলাম। পত্র পাঠ করিয়া, যোগেন্দ্রনাথ বাবু, বিষণ্ণ বদনে, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; কিয়ৎ ক্ষণ পরে আমায় বলিলেন, তবে আপনি দয়া করিয়া যেরূপ দিতে চাহিয়াছিলেন, সেইরূপই দেন। আমি বলিলাম, তুমি কুন্দমালার নাম করিয়া প্রার্থনা করাতে, আমি, দ্বিরুক্তি না করিয়া, পুস্তক তিন খানি দিতে সম্মত হইয়াছিলাম। কিন্তু তৎপরে তোমরা যে ফেসাৎ উপস্থিত করিয়াছ, তাহাতে আর আমার দয়া করিবার ইচ্ছাও নাই, আবশ্যকতাও নাই। তোমরা উকীলের চিঠি দিয়াছ, নালিসের ভয় দেখাইয়াছ, এবং, আমি ফাঁকি দিয়া পরের সম্পত্তি ভোগ করিতেছি বলিয়া, নানা স্থানে আমার কুৎসা করিয়াছ। আমাদের দেশের লোক নিরতিশয় পরকুৎসাপ্রিয়; তোমার মুখে আমার কুৎসা শুনিয়া, সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন; এবং তত্ত্বানুসন্ধানে বিমুখ হইয়া, আমার কুৎসাকীর্ত্তন করিয়া, বিলক্ষণ আমোদ করিতেছেন। এমন স্থলে, আর আমার দয়া করিতে প্রবৃত্তি হইবেক কেন? তবে কুন্দমালাকে বলিবে, আমি তাহাকে, মাস মাস, যে দশ টাকা দিতেছি, অনেকে, তোমাদের আচরণদর্শনে সাতিশয় অসস্তুষ্ট হইয়া, তাহা রহিত করিবার নিমিত্ত আমায় পরামর্শ দিতেছেন। কিন্তু কুন্দমালা নিতান্ত অনাথা; আর, আমি যত দূর বুঝিতে পারিতেছি, এ বিষয়ে তাহার কোনও অপরাধ নাই। এজন্য, আমি তাহাকে মাস মাস যে দশ টাকা দিতেছি, তাহা দিব, কদাচ তাহা রহিত করিব না। এই বলিয়া, আমি তাঁহাদের নিকট হইতে চলিয়া গেলাম।

 ইহার কিছু দিন পরে, বাবু দীননাথ বসু উকীলের নিকট হইতে নিম্নদর্শিত পত্র পাইয়াছিলাম।

“পরমপূজনীয় শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগর

ভট্টাচার্য্য মহাশয় শ্রীচরণেষু

 প্রণাম শতসহস্র নিবেদনঞ্চ বিশেষঃ।—

মহাশয়ের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবার পরেই ৺মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের জামাতা আসিয়াছিলেন। তাঁহাকে সকল কথা কহাতে অনেক বাদানুবাদের পর তেঁহ অত্র বিষয় সালিস দ্বারা নিষ্পত্য করা ভাল বলিয়া প্রকাশ করাতে আমি তাঁহাকে তদ্বিষয় ধার্য্য ও তাহাতে আপনকার কিরূপ অভিরুচি হয় তাহা জানিবার কথা কহাতে তিনি তাহার স্থির করিয়া আমাকে কহিবেন বলিয়া যান। তদবধি আমি তাহার কোন সংবাদ না পাওয়ায় অত্র বিষয়ে কোন উত্তেজনা করি নাই। আমার নিজ মঙ্গল মহাশয়ের শারীরিক কুশলসংবাদে তুষ্ট রাখিবেন। ইহা নিবেদনেতি তারিখ ২৬ জ্যৈষ্ট।

সেবক শ্রীদীনাথ দাস বসু।
 মোঃ বাগবাজার।”

 যোগেন্দ্রনাথ বাবু সালিস দ্বারা নিষ্পত্তির কথা আমার নিকটে উপস্থিত করেন নাই। বোধ হয়, তর্কালঙ্কারের পত্র দেখিয়া, তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এ বিষয়ে নালিস অথবা সালিস দ্বারা নিষ্পত্তির চেষ্টা করিলে, ইষ্টসিদ্ধির কোনও সম্ভাবনা নাই; এই জন্যই, হতোৎসাহ হইয়া, আমার নিকটে সালিস দ্বারা নিষ্পত্তির প্রস্তাব উপস্থিত না করিয়া, “তবে আপনি দয়া করিয়া যেরূপ দিতে চাহিয়াছিলেন, সেইরূপই দেন”, এই প্রস্তাব করিয়াছিলেন। যাহা হউক, ইহার পর, যোগেন্দ্রনাথ বাবু, অথবা তর্কালঙ্কারপরিবারের অন্য কোনও হিতৈষী আত্মীয়, আমার নিকটে, আর কখনও, কোনও আকারে, শিশুশিক্ষা সংক্রান্ত কোনও কথার উত্থাপন করেন নাই।




 যোগেন্দ্রনাথ বাবু শ্বশুরপরিবারের হিতসাধনবাসনার বশবর্ত্তী হইয়া, আমার পক্ষে যাদৃশ ভদ্রতাপ্রকাশ করিয়াছেন, তাহা দর্শিত হইল। তিনি, শ্বশুরের গৌরববৰ্দ্ধনবাসনার বশবর্ত্তী হইয়া, আমার পক্ষে যাদৃশ ভদ্রতাপ্রকাশ করিয়াছেন, তৎপ্রদর্শনার্থ, বেতালপঞ্চবিংশতির দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন উদ্ধৃত হইতেছে।

 “১৯০৩ সংবতে, বেতালপঞ্চবিংশতি প্রথম প্রচারিত হয়। ২৫ বৎসর অতীত হইলে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা, শ্রীযুত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., তদীয় জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে,—

 “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহ তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমাজিত হইয়াছিল যে বোমাণ্টফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”।

 যোগেন্দ্রনাথ বাবু, কি প্রমাণ অবলম্বন পূর্ব্বক, এরূপ অপ্রকৃত কথা লিখিয়া প্রচারিত করিলেন, বুবিয়া উঠা কঠিন। আমি, বেতালপঞ্চবিংশতি মুদ্রিত করিবার পূর্ব্বে, শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও মদনমোহন তর্কলঙ্কারকে শুনাইয়াছিলাম। শুনাইবার অভিপ্রায় এই যে, কোনও স্থল অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হইলে, তাঁহারা স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন; তদনুসারে, আমি সেই সেই স্থল সংশোধিত করিব। আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, কোনও কোনও উপাখ্যানে একটি স্থলও তাঁহাদের অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হয় নাই; সুতরাং সেই সেই উপাখ্যানের কোনও স্থলেই কোনও প্রকার পরিবর্ত্ত করিবার আবশ্যকতা ঘটে নাই। আর, যে সকল উপাখ্যানে তাঁহারা তদ্রূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই উপাখ্যানে, স্থানে স্থানে, দুই একটি শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। বিদ্যারত্নতর্কালঙ্কার ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই করেন নাই। সুতরাং, বেতালপঞ্চবিংশতি তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর এই নির্দ্দেশ কোনও মতে সঙ্গত ও ন্যায়ানুগত হয় নাই। শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন অদ্যাপি বিদ্যমান আছেন। তিনি এক্ষণে সংস্কৃত কালেজে সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপক। এ বিষয়ে, তিনি আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে যে পত্র লিখিয়াছেন, ঐ উত্তরপত্র, আমার জিজ্ঞাসাপত্রের সহিত, নিম্নে নিবেশিত হইতেছে।

“অশেষগুণাশয়

   শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভ্রাতৃ প্রেমাস্পদেষু

 সাদরসম্ভাষণমাবেদনম্‌

 তুমি জান কি না বলিতে পারি না, কিছু দিন হইল, সংস্কৃত কালেজের ভূতপূর্ব্ব ছাত্র শ্রীযুত বাবু যোগেশ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে বোমাণ্টফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”। বেতালপঞ্চবিংশতি সম্প্রতি পুনরায় মুদ্রিত হইতেছে। যোগেন্দ্রনাথ বাবুর উক্তি বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তাহা ব্যক্ত করিব, স্থির করিয়াছি। বেতালপঞ্চবিংশতির সংশোধন বিষয়ে তর্কালঙ্কারের কত দূর সংস্রব ও সাহায্য ছিল, তাহা তুমি সবিশেষ জান। যাহা জান, লিপি দ্বারা আমায় জানাইলে, অতিশয় উপকৃত হইব। তোমার পত্র খানি, আমার বক্তব্যের সহিত, প্রচারিত করিবার অভিপ্রায় আছে, জানিবে ইতি।

ত্বদেকশর্ম্মশর্ম্মণঃ
কলিকাতা
শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্ম্মণঃ”
১০ ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।
“পরমশ্রদ্ধাস্পদ


  শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়

জ্যেষ্ঠভ্রাতৃপ্রতিমেষু

 শ্রীযুক্ত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. প্রণীত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত গ্রন্থে বেতালপঞ্চবিংশতি সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলাম। তিনি লিখিয়াছেন, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থ গুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।” এই কথা নিতান্ত অলীক ও অসঙ্গত; আমার বিবেচনায়, এরূপ অলীক ও অসঙ্গত কথা লিখিয়া প্রচার করা যোগেন্দ্র নাথ বাবুর নিতান্ত অন্যায় কার্য্য হইয়াছে।

 এতদ্বিষয়ের প্রকৃত বৃত্তান্ত এই—আপনি, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করিয়া, আমাকে ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলেন। শ্রবণকালে আমরা মধ্যে মধ্যে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতাম। তদনুসারে স্থানে স্থানে দুই একটি শব্দ পরিবর্ত্তিত হইত। বেতালপঞ্চবিংশতি বিষয়ে, আমার অথবা তর্কালঙ্কারের, এতদতিরিক্ত কোন সংস্রব বা সাহায্য ছিল না।

 আমার এই পত্র খানি মুদ্রিত করা যদি আবশ্যক বোধ হয়, করিবেন, তদ্বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি ইতি।

সোদরাভিমামিনঃ
কলিকাতা।
শ্রীগিরিশচন্দ্রশর্ম্মণঃ”
১২ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।

 যোগেন্দ্রনাথ বাবু স্বীয় শ্বশুরের জীবনচরিত পুস্তকে, আমার সংক্রান্ত যে সকল কথা লিখিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই এইরূপ অমূলক। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আর একটি স্থল প্রদর্শিত হইতেছে। তিনি ১৮ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন,—

 “সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হইল। এরূপ শুনিতে পাই, বেথুন তর্কালঙ্কারকে এই পদ গ্রহণে অনুরোধ করেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের যোগ্য বলিয়া বেথুনের নিকট আবেদন করায়, বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কেই ঐ পদে নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইলেন। এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে তর্কালঙ্কারের ন্যায় সদাশয় উদারচরিত ও বন্ধুহিতৈষী ব্যক্তি অতি কম ছিলেন। হৃদয়ের বন্ধুকে আপন অপেক্ষা উচ্চতর পদে অভিষিক্ত করিয়া তর্কালঙ্কার বন্ধুত্বের ও ঔদার্ঘ্যের পরা কাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন”।

 গ্রন্থকর্ত্তার অলৌকিক কল্পনাশক্তি ব্যতীত এ গল্পটির কিছুমাত্র মূল নাই। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রেয় অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হয়েন; ইঙ্গরেজী ১৮৫০ সালের নবেম্বর মাসে, মুরশিদাবাদের জজ পণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, সংস্কৃত কালেজ হইতে প্রস্থান করেন। তর্কালঙ্কারের নিয়োগ সময়েও, যিনি (বাবু রসময় দত্ত) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তর্কালঙ্কারের প্রস্থান সময়েও, তিনিই (বাবু রসময় দত্ত) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ফলতঃ, তর্কালঙ্কার যত দিন সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় মধ্যে, এক দিনের জন্যেও, ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয় নাই। সুতরাং, সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হওয়াতে, বেথুন সাহেব মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে উদ্যত হইলে, তর্কালঙ্কার, ঔদার্য্যগুণের আতিশয্য বশতঃ, আমাকে ঐ পদের যোগ্য বিবেচনা করিয়া, ও বন্ধুস্নেহের বশীভূত হইয়া, বেথুন সাহেবকে আমার জন্য অনুরোধ করাতে, আমি ঐ পদে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, ইহা কি রূপে সম্ভবিতে পারে, তাহা মহামতি যোগেন্দ্র নাথ বাবুই বলিতে পারেন।

 আমি যে সূত্রে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদে নিযুক্ত হই, তাহার প্রকৃত বৃত্তান্ত এই—মদনমোহন তর্কলঙ্কার, জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, মুরশিদাবাদ প্রস্থান করিলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। শিক্ষাসমাজের তৎকালীন সেক্রেটারি, শ্রীযুত ডাক্তর মোয়েট সাহেব, আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন[৩]। আমি, নানা কারণ দর্শাইয়া, প্রথমতঃ অস্বীকার করি। পরে, তিনি সবিশেষ যত্ন ও আগ্রহ প্রকাশ করাতে, আমি বলিয়াছিলাম, যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দেন, তাহা হইলে আমি এই পদ স্বীকার করিতে পারি। তিনি আমার নিকট হইতে ঐ মর্ম্মে একখানি পত্র লেখাইয়া লয়েন। তৎপরে, ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি সংস্কৃত কালেজে সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হই। আমার এই নিয়োগের কিছু দিন পরে, বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতা পদ পরিত্যাগ করেন। সংস্কৃত কলেজের বর্ত্তমান অবস্থা, ও উত্তরকালে কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত কালেজের উন্নতি হইতে পারে, এই দুই বিষয়ে রিপোর্ট করিবার নিমিত্ত, আমার প্রতি আদেশ প্রদত্ত হয়। তদনুসারে আমি রিপোর্ট সমপর্ণ করিলে, ঐ রিপোর্ট দৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ আমাকে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতা কার্য্য, সেক্রেটারি ও আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; ঐ দুই পদ রহিত হইয়া, প্রিন্সিপালের পদ নূতন সৃষ্ট হইল। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে, আমি সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল অর্থাৎ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলাম।

 যোগেন্দ্রনাথ বাবুর কল্পিত গল্পটির মধ্যে, “এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়,” এই কথাটি লিখিত আছে। যাহারা, বহু কাল অবধি, সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত আছেন, অথবা যাঁহারা কোনও রূপে সংস্কৃত কালেজের সহিত কোনও সংস্রব রাখেন, তাঁহদের মধ্যে কেহ কখনও এরূপ জনশ্রুতি কর্ণগোচর করেন নাই। যাহা হউক, যদিই দৈবাৎ ঐরপ অসম্ভব জনশ্রুতি, কোনও সূত্রে, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর কর্ণগোচর হইয়াছিল, ঐ জনশ্রুতি অমূলক অথবা সমূলক, ইহার পরীক্ষা করা তাঁহার আবশ্যক বোধ হয় নাই। অবশ্যক বোধ হইলে, অনায়াসে তাঁহার সংশয়চ্ছেদন হইতে পারিত; কারণ, আমার নিয়োগবৃত্তান্ত সংস্কৃত কালেজ সংক্রান্ত তৎকালীন ব্যক্তিমাত্রেই বিলক্ষণ অবগত আছেন। যোগেন্দ্রনাথ বাবু সংস্কৃত কালেজের ছাত্র; যে সময়ে তিনি আমার নিয়োগের উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন, বোধ হয়, তখনও তিনি সংস্কৃত কালেজে অধ্যয়ন করিতেন। যদি, সবিশেষ জানিয়া, যথার্থ ঘটনার নির্দ্দেশ করা তাঁহার অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, আমার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রকৃত বৃত্তান্ত তাঁহার অপরিজ্ঞাত থাকিত না।

 ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সংস্কৃত কালেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন[৪]। আমি, বিশিষ্ট হেতু বশতঃ, অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি[৫]। তদনুসারে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঐ পদে নিযুক্ত হয়েন। এই প্রকৃত বৃত্তান্তটির সহিত, যোগেন্দ্রনাথ বাবুর কল্পিত গল্পটির, বিলক্ষণ সৌসাদৃশ্য দৃশ্যমান হইতেছে।”

 আমি তর্কালঙ্কারের সংস্রবত্যাগে কৃতপ্রতিজ্ঞ হইলে, তিনি পটোলডাঙ্গার শ্যামাচরণ বাবুকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার কিয়ৎ অংশ উদ্ধৃত হইতেছে। এই উদ্ধৃত অংশ দৃষ্টিগোচর করিলে, আমি ও তর্কালঙ্কার, এ উভয়ের চাকরী বিষয়ে পরস্পর কিরূপ সম্পর্ক, তাহা অনায়াসে যোগেন্দ্রনাথ বাবুর হৃদয়ঙ্গম হইতে পারিবেক।

 “ভ্রাতঃ! ক্রমশঃ পদোন্নতি ও এই ডেপুটি মাজিষ্ট্রেটী পদপ্রাপ্তি যে কিছু বল, সকলি বিদ্যাসাগরের সহায়তা বলে হইয়াছে, অতএব তিনি যদি আমার প্রতি এত বিরূপ ও বিরক্ত হইলেন তবে আর আমার এই চাকরি করায় কাজ নাই, আমার এখনি ইহাতে ইস্তাফা দিয়া, তাঁহার নিকট উপস্থিত হওয়া উচিত হয়। শ্যাম হে! কি বলিব ও কি লিখিব, আমি এই সবডিভিজনে আসিয়া অবধি যেন মহাসাপরাধীর ন্যায় নিতান্ত ম্লান ও স্ফূর্ত্তিহীনচিত্তে কর্ম্মকাজ করিতেছি, অথবা আমার অসুখের ও মনোগ্লানির পরিচয় আর কি মাথা মুণ্ড জানাইব, আমার বাল্যসহচর, একহৃদয়, অমায়িক, সহোদরাধিক, পরম বান্ধব বিদ্যাসাগর আজি ৬ ছয় মাস কাল হইতে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করে নাই, আমি কেবল জীবন্মৃতের ন্যায় হইয়া আছি। শ্যাম! তুমি আমার সকল জান, এই জন্যে তোমার নিকট এত দুঃখের পরিচয় পাড়িলাম”।

  1. এই সমযে, তাঁহার আকার দেখিলে, তিনি অধিক দিন বাঁচিবেন, কিছুতেই এরূপ বোধ হইত না। কিন্তু কাশীতে গিয়া, অল্প দিনের মধ্যেই, তাঁহার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ ও হৃষ্টপুষ্ট হয়, এবং চক্ষুর দোষ এককালে অন্তর্হিত হইয়া যায়। বস্তুতঃ, তাঁহার আকারের এত পরিবর্ত্ত হইয়াছিল যে, এক বৎসর পরে, কাশীতে গিয়া, আমি তাঁহাকে কোনও মতে চিনিতে পারি নাই। তিনি, তাহা বুঝিতে পারিয়া, আমায় বলিলেন, বাবা! তুমি আমাকে চিনিতে পারিলে না, আমি মদনের মা। এই কথা শুনিয়া, কিয়ৎ ক্ষণ স্থির নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া, তাঁহাকে চিনিতে পরিলাম, এবং বলিলাম, আপনি, জু্য়াচরি করিয়া, আমাকে বিলক্ষণ ঠকাইয়াছেন। তিনি, কিঞ্চিৎ শঙ্কিত হইয়া, আমায় বলিলেন, বাবা! আমি কি জুয়াচুরি করিয়াছি। আমি বললাম, শুকনা হাড় ও কাণা চোখ দেখাইয়া, আপনি বলিয়াছিলেন, আমার যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমি অধিক দিন বাঁচিব না; সুতরাং, অধিক দিন, তোমায় আমার ভার বহিতে হইবেক না। কিন্তু এক্ষণে যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে অন্ততঃ আর বিশ বৎসর আপনি বাঁচিবেন। তখন ইহা বুঝিতে পারিলে, আমি আপনাকে মাস মাস দশ টাকা দিতে সম্মত হইতাম না। এই কথা শুনিয়া, তিনি হাস্য করিতে লাগিলেন। আঠার বৎসর হইল, তাঁহার সহিত এই কথোপকথন হইয়াছিল। তিনি অদ্যাপি বিদ্যমান রহিয়াছেন। এ দেশে থাকিলে, তিনি এত দিন জীবিত থাকিতেন, কোনও ক্রমে এরূপ প্রতীতি হয় না।
  2. তর্কালঙ্কারের লিখিত শিশুশিক্ষা তিন ভাগ; আমার লিখিত বেতালপঞ্চবিংশতি, বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত, বোধোদয়, উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ তিন ভাগ।
  3. এই সময়ে আমি ফোর্টউইলিয়ম কলেজে হেড রাইটর নিযুক্ত ছিলাম।
  4. এই সময়ে, আমি সংস্কৃত কালেজে আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত ছিলাম।
  5. এই সময়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কৃষ্ণনগর কালেজে প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।