১৭

 সাহেব চলিয়া গেলে আজ একটুখানি সকাল-সকাল আফিসের ছুটি দিয়া উভয়ে ফয়ার মাঠের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। পাঁচটায় মিটিং শুরু হইবার কথা, তার আর বিলম্ব মাই। এই দিকটার গাড়ি মিলে না, সুতরাং একটু দ্রুত না গেলে সময়ে পৌঁছানো যাইবে কি না সন্দেহ। পথের মধ্যে অপূর্ব্ব কথাবার্ত্তা প্রায় কিছুই বলিল না। তাহার জীবনের আজ একটা বিশেষ দিন। আশঙ্কা ও আনন্দের উত্তেজনার তাহার মনের মধ্যে ঝড় বহিতেছিল। কারিকর ও কুলি-মজুরদের সম্বন্ধে কতক একখানা পুস্তক হইতে এবং কতক রামদাসের নিকট সে যোগাড় করিয়া লইয়াছিল, সেই সমস্ত মনে মনে সাজাইয়া গুছাইয়া অপূর্ব্ব নিঃশষে মহড়া দিতে দিতে চলিতে লাগিল। ১৮৬৩ সালে বোম্বাইয়ের কোন্‌খানে সর্ব্বপ্রথমে তুলার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তারপরে সেইগুলা বাড়িয়া বাড়িয়া আাজ তাহাদের সংখ্যা কত দাঁড়াইয়াছে, তখন কুলি-মজুরদের কিরূপ শোচনীয় অবস্থা ছিল, কিরূপ দিন-রাত্রি মেহন্নত করিতে হইত এবং এই লইয়া কবে বিলাতের তুলার কলের মালিকদের সহিত ভারতবর্ষীয় মালিকদের প্রথম বিবাদের সূত্রপাত হয় এবং কারখানা আইন কোন সনের কোন তারিখে কি কি বাধা অতিক্রম করিয়া পাশ হইয়া এদেশে প্রথম প্রচলিত হয় এবং সর্ত্ত তাহাতে কি ছিল এবং কখনই বা সেই আইন পরিবর্ত্তিত হইয়া কিরূপ দাঁড়াইয়াছে, তখনকার ও এখানকার বিলাতের ও ভারতবর্ষের মজুরির হারে পার্থক্য কতখানি, ইহাদের সঙ্ঘবদ্ধ করিবার কল্পনা কবে এবং যে উদ্ভাবন করিয়াছিল, তাহার কথা কি দাঁড়াইয়াছে, সে-দেশের ও এ-দেশের শ্রমিকগণের মধ্যে সুনীতি ও দুর্নীতির তুলনামূলক আলোচনা করিলে কি দেখা যায় এবং সংসারে লাভ-ক্ষতির পরিমাণ তাহাতে কোথায় নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে ইত্যাদি সংগ্রহমালার কোথাও না খেই হারাইয়া যায় এই ভয়ে সে আপনাকে আপনি বার বার সতর্ক করিল। তাহার স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ ছিল, বক্তৃতার মাঝখানে হঠাৎ যে ভুলিয়া যাইবে না, অনেকগুলা এক্‌জামিন ভাল করিয়া পাশ করার ফলে এ ভরসা তাহার ছিল। সুতরাং মুখ দিয়া তাহার এই সকল নিরতিশয় সারগর্ভ বাক্যধারা কখনো বা উচ্চসপ্তকে, কখনো বা গম্ভীর খাদে, কখনো বা হুঙ্কার শব্দে গর্জ্জিয়া গর্জ্জিয়া এক সময়ে যখন সমাপ্ত হইবে তখন বিপুল শ্রোতৃমণ্ডলীর করতালিধ্বনি হয়ত বা সহজে থামিতেই চাহিবে না। সুমিত্রার প্রসন্ন দৃষ্টি সে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। আর ভারতী! এইটুকু সময়ে এতখানি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সে যে কি করিয়া আয়ত্ত করিল ইহারই আনন্দিত বিস্ময়ে মুখ তাহার সমুজ্জ্বল ও চোখের দৃষ্টি সজল হইয়া একমাত্র তাহার মুখের ’পরে নিপতিত হইয়াছে, কল্পনায় প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে পাইরা অপূর্ব্বর শিরার রক্ত সবেগে বহিতে লাগিল। তাহার দ্রুত পদক্ষেপের সমান তালে পা ফেলিয়া চলা তলওয়ারকরের পক্ষে আজ যেন দুরূহ হইয়া পড়িল। তাহারা মাঠে পৌঁছিয়া দেখিল তথায় তিল ধারণের স্থান নাই, লোক জমিয়াছে যে কত তাহার সংখ্যা হয় না। সেদিনকার বক্তা হিসাবে অপূর্ব্বকে যাহারা চিনিতে পারিল তাহারা পথ ছাড়িয়া দিল, যাহারা চিনিত না তাহারও দেখা-দেখি সরিয়া দাঁড়াইল। বিপুল জনতার মাখানে মাচা বাঁধা। ডাক্তার আজিও ফিরেন নাই, তাই শুধু তিনি ছাড়া পথের দাবীর সকল সভাই উপনীত। বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া কোনমতে ভিড় ঠেলিয়া অপূর্ব্ব তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। মাচার উপরে একখান। বেঞ্চ তখনও খালি ছিল, চোখের ইঙ্গিতে নির্দ্দেশ করিয়া সুমিত্রা সেইখানে তাহাদের অভ্যর্থনা করিলেন। মাচার পুরোভাগে দাঁড়াইয়া পাঞ্জাবী একজন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বক্তৃতা দিতেছিল, বোধ করি সে জবাব-পাওয়া মিস্ত্রী কিংবা এমনি কিছু একটা হইবে, অপূর্ব্বদের অভ্যাগমে ক্ষণকাল মাত্র বাধা পাইয়া পুনশ্চ দ্বিগুণ তেজে চীৎকার করিতে লাগিল। ভাল বক্তার কাছে জনতা যুক্তিতর্ক চাহে না, যাহা মন্দ তাহা কেন মন্দ এ খবরে তাহাদের আবশ্যক হয় না, শুধু মন্দ যে কত অসংখ্য বিশেষণ যোগে ইহাই শুনিয়া তাহারা চরিতার্থ হইয়া যায়। পাঞ্জাবী মিস্ত্রীর প্রচণ্ড বলার মধ্যে বোধ করি এই গুণটাই পর্য্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকায় শ্রোতার দল যে কিরূপ চঞ্চল হইর। উঠিয়াছিল তাহাদের মুখ দেখিয়াই তাহা বুঝা যাইতেছিল।

 অকস্মাৎ কি যেন একটা ভয়ানক বিঘ্ন ঘটিল। মাঠের কোন এক প্রান্ত হইতে অগণিত চাপা-কণ্ঠে সন্ত্রাস কলরব উঠিল এবং পরক্ষণেই দেখা গেল বহু লোক ঠেলা-ঠেলি করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। এবং তাহাকেই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া পিষিরা মাড়াইয়া প্রকাণ্ড বড়-বড় ঘোড়ায় চড়িয়া বিশ-পঁচিশজন গোরা পুলিশ কর্ম্মচারী দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। তাহাদের একহাতে লাগাম এবং অন্যহাতে চাবুক,—কোমরবন্ধে পিস্তল ঝুলিতেছে। তাহাদের কাঁধের লোহার জাল ঝক্ ঝক্ করিতেছে এবং রাঙা মুখ ক্রোধে ও অস্তমান সূর্য্যকিরণে একেবারে সিঁদুরের মত লাল হইয়া উঠিয়াছে। যে ব্যক্তি বক্তৃতা দিতেছিল তাহার বজ্রকণ্ঠ হঠাৎ কখন নীরব হইল এবং মঞ্চ হইতে নীচের ভিড়ের মধ্যে চক্ষের পলকে সে যে কি করিয়া কোথায় অদৃশ্য হইল জানা গেল না।

 সর্দ্দার গোরা মঞ্চের ধার ঘেঁষিয়া আসিয়া কর্কশকণ্ঠে কহিল, মিটিং বন্ধ করিতে হইবে।

 সুমিত্রা এখনও আরোগ্য লাভ করিতে পারে নাই, তাহার উপবাস-ক্লিষ্ট মুখের ’পরে পাণ্ডুর ছায়া পড়িল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

 সে কহিল, হুকুম।

 কার হুকুম?

 গভর্ণমেণ্টের।

 কিসের জন্য?

 স্ট্রাইক করার জন্য মজুরদের ক্ষ্যাপাইয়া তোলা নিষেধ।

 সুমিত্রা বলিল, বৃথা ক্ষেপিয়ে দিয়ে তামাসা দেখবার আমাদের সময় নেই। ইউরোপ প্রভৃতি দেশের মত এদের দলবদ্ধ হওয়ায় প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেওয়াই এই মিটিংএর উদ্দেশ্য।

 সাহেব চমকিয়া কহিল, দলবদ্ধ করা? ফার্ম্মের বিরুদ্ধে! সে তো এদেশে ভয়ানক বে-আইনি। তাতে নিশ্চয় শান্তিভঙ্গ হতে পারে।

 সুমিত্রা কহিল, নিশ্চয়, পারে বই কি! যে দেশে গভর্ণমেণ্ট মানেই ইংরাজ ব্যবসায়ী এবং সমস্ত দেশের রক্ত শোষণের জন্যই যে দেশে এই বিরাট যন্ত্র খাড়া করা—

 বক্তব্য তাহার শেষ হইতে পাইল না, গোরার রক্তচক্ষু আগুন হইয়া উঠিল। ধমক দিয়া বলিল, দ্বিতীয়বার এ-কথা উচ্চারণ করলে আমি অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব।

 সুমিত্রার আচরণে এতটুকু চাঞ্চল্য প্রকাশ পাইল না, শুধু ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া মুচকিয়া একটু হাসিল। কহিল, সাহেব, আমি অসুস্থ এবং অতিশয় দুর্ব্বল। না হলে তবু দ্বিতীয়বার কেন, এ কথা একশবার চীৎকার করে এই লোকগুলিকে শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার শক্তি নেই। এই বলিয়া সে আবার একটু হাসিল।

 এই পীড়িত রমণীর সহজ শান্ত হাসিটুকুর কাছে সাহেব মনে মনে বোধ হয় লজ্জা পাইল, অল্ রাইট। আপনাকে সাবধান করে দিলাম। ঘড়ি খুলিয়া কহিল, মিটিং বন্ধ করবার আমার হুকুম আছে, কিন্তু ভেঙ্গে দেবার নেই। দশ মিনিট সময় দিলাম, দু’চার কথায় এদের শান্তভাবে যেতে বলে দিন। আর কখনো যেন এরূপ না হয়।

 কিছুদিন হইতে প্রায় উপবাসেই সুমিত্রার দিন কাটিতেছিল। সকলের নিষেধ সত্ত্বেও সে আজ সামান্য একটু জ্বর লইয়াই সভায় উপস্থিত হইয়াছিল, কিন্তু এখন ক্লান্তি ও অবসাদ তাহাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল। চৌকির পিঠে মাথা হেলান দিয়া সে অস্ফুটে ডাকিয়া কহিল, অপূর্ব্ববাবু, দশ মিনিট মাত্র সময় আছে,—হয়ত তাও নেই। চীৎকার করে সকলকে জানিয়ে দিন সঙ্ঘবদ্ধ না হ’লে এদের আর উপায় নেই। কারখানার মালিকেরা আজ আমাদের যে অপমান করলে মানুষ হলে এরা যেন তার শোধ নেয়। বলিতে বলিতে তাহার দুর্ব্বল কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া পড়িল, কিন্তু সভানেত্রীর এই আদেশ শুনিয়া অপূর্ব্বর সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হইয়া উঠিল। বিহ্বলনেত্রে সুমিত্রার প্রতি চাহিয়াই কহিল, উত্তেজিত করা কি বে-আইনি হবে না?

 সুমিত্রা বিস্মিত মৃদুকণ্ঠে বলিল, পিস্তলের জোরে সভা ভেঙ্গে দেওয়াই কি আইনসঙ্গত? বৃথা রক্তপাত আমি চাইনে, কিন্তু এই কথাটা সকল শক্তি দিয়ে আপনি শুনিয়ে দিন আজকের অপমান শ্রমিকেরা যেন কিছুতে না ভোলে।

 পথের দাবীর অন্য চার-পাঁচজন পুরুষ সভ্য যাহারা মঞ্চের পরে আসীন ছিল চেহারা দেখিয়াই মনে হয় তাহারা সামান্য এবং তুচ্ছ ব্যক্তি। হয়ত কারিকর কিংবা এমনি কিছু হইবে। অপূর্ব্ব নূতন হইলেও সমিতির শিক্ষিত এবং বিশিষ্ট সভ্য। এতবড় জনতাকে সম্বোধন করিবার ভার তাই তাহার প্রতি পড়িয়াছে। অপূর্ব্ব শুষ্ককণ্ঠে কহিল, আমি ত হিন্দী ভাল জানিনে।

 সুমিত্রা কথা কহিতে পারিতেছিল না, তথাপি কহিল, যা জানেন তাতেই দু’কথা বলে দিন অপূর্ব্ববাবু, সময় নষ্ট করবেন না।

 অপূর্ব্ব সকলের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। ভারতী মুখ ফিরাইয়া ছিল, তাহার অভিমত জানা গেল না, কিন্তু জানা গেল সর্দ্দার-গোরার মনে ভাব। তাহার সহিত অত্যন্ত কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং অত্যন্ত কঠিন চোখা-চোখি হইল। বলিবার জন্য অপূর্ব্ব উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার ঠোঁট নড়িতে লাগিল, কিন্তু সেই কম্পিত ওষ্ঠাধর হইতে বাঙলা ইংরাজি হিন্দী কোন ভাষাই ব্যক্ত হইল না। কেবল একান্ত পাণ্ডুর মুখের ’পরে ব্যক্ত যাহা হইল, তাহা আর যাহারই হোক পথের দাবীর সভ্যদের জন্যে নহে।

 তলওয়ারকর উঠিয়া দাঁড়াইল। সুমিত্রাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, আমি বাবুজির বন্ধু। আমি হিন্দী জানি। আদেশ পাই ত ওর বক্তব্য আমি চেঁচিয়ে সকলকে শুনিয়ে দিই। ভারতী মুখ ফিরাইয়া চাহিল, সুমিত্রা বিস্মিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া স্থির হইয়া রহিল এবং এই দুইটি নারীর উন্নদ্ধ চোখের সম্মুখে লজ্জিত, অভিভূত, বাক্যহীন অপূর্ব্ব স্তব্ধ নতমুখে জড়বস্তুর মত বসিয়া পড়িল।

 রামদাস ফিরিয়া দাঁড়াইল, এবং তাহার দক্ষিণে বামে ও সম্মুখের বিক্ষুব্ধ, ভীত, চঞ্চল জনসমষ্টিকে সম্বোধন করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিল, ভাইসব। আমার অনেক কথা বলবার ছিল, কিন্তু এরা গায়ের জোরে আমাদের মুখ বন্ধ করচে। এই বলিয়া সে আঙ্গুল দিয়া সুমুখের পুলিশ-সওয়ারগণকে দেখাইয়া বলিল, এই ডালকুত্তাদের যারা আমাদের বিরুদ্ধে, তোমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে তারা তোমাদেরই কারখানার মালিকেরা! তারা কিছুতেই চায় না যে কেউ তোমাদের দুঃখ-দুর্দ্দশার কথা তোমাদের জানায়। তোমরা তাদের কল চালাবার, বোঝা বইবার জানোয়ার! অথচ তোমরাও ত তাদেরি মত মানুষ, তেমনি পেট ভরে খাবার, তেমনি প্রাণ খুলে আনন্দ করবার জন্মগত অধিকার তোমরাও যে ভগবানের কাছ থেকে পেয়েচ এই সত্যটাই এরা সকল শক্তি, সকল শঠতা দিয়ে তোমাদের কাছ থেকে গোপন রাখতে চায়। শুধু একবার যদি তোমাদের ঘুম ভাঙে, কেবল একটিবার মাত্র যদি এই সত্য কথাটা বুঝতে পার যে, তোমরাও মানুষ, তোমরা যত দুঃখী, যত দরিদ্র, যত অশিক্ষিতই হও তবুও মানুষ, তোমাদের মানুষের দাবী কোন ওজুহাতে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, তা হলে, এই গোটা-কতক কারখানার মালিক তোমাদের কাছে কতটুকু? এই সত্য তোমরা কি বুঝবে না? এ যে কেবল ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের আত্মরক্ষার লড়াই! এতে দেশ নেই, জাত নেই, ধর্ম্ম নেই, মতবাদ নেই —হিন্দু নেই, মুসলমান নেই,—জৈন, শিখ, কোন কিছুই নেই,—আছে শুধু ধনোন্মত্ত মালিক, আর তার অশেষ প্রবঞ্চিত অভুক্ত শ্রমিক। তোমাদের গায়ের জোরকে তারা ভয় করে, তোমাদের শিক্ষার শক্তিকে তারা অত্যন্ত সংশয়ের চোখে দেখে, তোমাদের জ্ঞানের আকাঙ্খায় তাদের রক্ত শুকিয়ে যায়। অক্ষম, দুর্ব্বল, মূর্খ, দুর্নীতিপরায়ণ তোমরাই যে তাদের বিলাস-ব্যসনের একমাত্র পাদপীঠ! ভাই, মাত্র তোমাদের জীবনধারণটুকুর বেশি তিলার্দ্ধ যে তারা স্বেচ্ছায় কোনদিন দেবে না—এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করা কি তোমাদের এতই কঠিন। আর সেই কথা মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করার অপরাধেই কি আজ এই গোরাগুলোর কাছে আমাদের লাঞ্ছনাই সার হবে! দরিদ্রের এই বাঁচবার লড়াইয়ে তোমরা কি সকল শক্তি দিয়ে যোগ দিতে পারবে না?

 সর্দ্দার-গোরা এদেশে যেটুকু হিন্দি-ভাষার জ্ঞানলাভ করিয়াছিল তাহাতে বক্তৃতার অর্থ প্রায় কিছুই বুঝিল না, কিন্তু সমবেত শ্রোতৃবর্গের মুখে চোখে উত্তেজনার চিহ্ন লক্ষ্য করিয়া নিজেও উত্তেজিত হইয়া উঠিল। তাহার রিস্টওয়াচের প্রতি বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিল, আর পাঁচ মিনিট মাত্র সময় আছে, আপনি শেষ করুন।

 তলওয়ারকর কহিল, শুধু পাঁচ মিনিট! তার বেশী এক মুহূর্ত্তও নয়! তবুও এই অমুল্য ক’টি মিনিট আমি কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। ভাই বঞ্চিতের দল! তোমাদের কাছে আমার মিনতি—আমাদের তোমরা অবিশ্বাস কোরো না। শিক্ষিত বলে, ভদ্র-বংশের বলে, কারখানায় দিন-মজুরি করিনি বলে আমাদের সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে নিজেদের সর্ব্বনাশ তোমরা নিজেরাই করো না। তোমাদের ঘুম ভাঙাবার প্রথম শঙ্খধ্বনি সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে আমরাই করে এসেচি। আজ হয়ত না বুঝতেও পার, কিন্তু নিশ্চয়ই জেনো এই পথের দাবীর চেয়ে বড় বন্ধু এদেশে তোমাদের আর কেউ নেই। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও কঠিন হইয়া আসিতেছিল, তথাপি প্রাণপণে চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল, আমি বহুদিন তোমাদের মধ্যে কাজ করে এসেছি, আমাদের তোমরা চেনো না, কিন্তু আমি তোমাদের চিনি। যাদের তোমরা মনিব বলে জানো, একদিন আমি তাদেরই একজন ছিলাম। তারা কিছুতেই তোমাদের মানুষ হ’তে দেবে না। কেবল পশুর মত করে রেখেই তোমাদের মনুষ্যত্বের অধিকার তারা আটকে রাখতে পারে, আর কোন মতেই না—এই কথাটা তোমাদের আজ না বুঝলেই নয়। তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াশক্ত— তাদের মুখ থেকে এই সকল অপবাদই তোমরা চিরদিন শুনে এসেচ। তাই, যখনই তোমরা দাবী জানিয়েচ, তখনই তোমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মুলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকে দায়ী করে তারা তোমাদের সর্ব্বপ্রকার উন্নতিকে নিবারিত করে এসেচে। কেবল এই মিথ্যেই তোমাদের তারা অনুক্ষণ বুঝিয়ে এসেচে ভাল না হলে কারও উন্নতিই কোনদিন হতে পারে না। কিন্তু, আজ আমি তোমাদের অসঙ্কোচে একান্ত অকপটে জানতে চাই ঐ উক্তি তাদের কখনই সম্পূর্ণ সত্য নয়! তোমাদের চরিত্রই শুধু তোমাদের অবস্থার জন্য দায়ী নয়; তোমাদের এই প্রবঞ্চিত হীন অবস্থাও তোমাদের চরিত্রের জন্য দায়ী। তাদের অসত্যকে আজ তোমাদের নির্ভয়ে প্রতিবাদ করতেই হবে। প্রবলকণ্ঠে তোমাদের ঘোষণা করতেই হবে কেবল টাকাই সবটুক নয়। বলিতে বলিতে তাহার নীরস কণ্ঠ অত্যন্ত প্রখর হইয়া উঠিল, কহিল, বিনাশ্রমে সংসারে কিছুই উৎপন্ন হয় না—তাই, শ্রমিকও ঠিক তোমাদেরই মত মালিক,—ঠিক তোমাদেরই মত সকল বস্তু, সকল কারখানার অধিকারী। এমনি সময়ে কে একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক সর্দ্দার-গোরার কানে কানে কি একটা কথা বলিতেই তাহার রক্ত-চক্ষু জ্বলন্ত অঙ্গারের মত উগ্র হইয়া উঠিল। সে গর্জ্জন করিয়া বলিল, স্টপ! এ চলবে না। এতে শান্তি ভঙ্গ হবে।

 অপূর্ব্ব চমকিয়া উঠিল। রামদাসের জামার খুঁট ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল,—থামো, রামদাস থামো। এই নিঃসহায় নির্বান্ধব বিদেশে যে তোমার স্ত্রী আছে,—তোমার ছোট্ট একফোঁটা মেয়ে আছে।

 রামদাস কর্ণপাতও করিল না। চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল, এরা অন্যায়কারী! এরা ভীরু! সত্যকে এরা কোনমতেই তোমাদের শুনতে দিতে চায় না! কিন্তু এরা জানে সত্যকে গলা টিপে মারা যাবে না। সে চিরঞ্জীবী! সে অমর! গোরা ইহার অর্থ বুঝিল না। কিন্তু অকস্মাৎ সহস্র লোকের সর্ব্বাঙ্গ হইতে ঠিকরিয়া আসিয়া যেন তীক্ষ্ণ উত্তাপের ঝাঁঝ তাহার মুখে লাগিল। সে হুঙ্কার দিয়া উঠিল, এ চলবে না। এ রাজদ্রোহ!

 চক্ষের পলকে পাঁচ-ছয়জন ঘোড়া হইতে লাফাইয়া পড়িয়া রামদাসের দুই হাত ধরিয়া তাহাকে সবলে টানিয়া নীচে নামাইল। তাহার দীর্ঘ দেহ ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের মাঝখানে এক মুহূর্ত্তে অন্তর্হিত হইল, কিন্তু তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর তাহার কিছুতেই চাপা পড়িল না—এই বিক্ষুব্ধ বিপুল জনতার একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রাপ্ত পর্য্যন্ত ধ্বনিত হইতে লাগিল,—ভাইসকল, কখনো হয়ত আর আমাকে দেখরে না, কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাবার মর্য্যাদা যদি না মনিবের পায়ে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে থাকো ত এত বড় উৎপীড়ন, এত বড় অপমান তোমরা সহ্য ক’রো না।

 কিন্তু তাহার কথা শেষ না হইতেই যেন দক্ষযজ্ঞ বাধিয়া গেল। ঘোড়া ছুটিল, চাবুক চলিল এবং অবমানিত অভিভূত সমস্ত শ্রমিকের দল উর্দ্ধশাসে পলায়ন করিতে কে যে কাহার ঘাড়ে পড়িল এবং কে যে কাহার পদতলে গড়াইতে লাগিল তাহার ঠিকানা রহিল না।

 জনকয়েক দলিত পিষ্ট আহত লোক ছাড়া সমস্ত মাঠ জনশূন্য হইতে বিলম্ব ঘটিল না। কোন মতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে যাহারা তখনও চলিয়াছিল তাহাদেরই প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া সুমিত্রা স্তব্ধ হইয়া রহিলেন এবং তাহারই অনতিদূরে বসিয়া অপূর্ব্ব ও আর একজন নির্ব্বাক নতমুখে তেমনি বিমূঢ়ের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।

 যে ব্যক্তি গাড়ি ডাকিতে গিয়াছিল, মিনিট-দশেক পরে গাড়ি লইয়া আসিলে সুমিত্রা নিঃশব্দে ভারতীর হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন। নিজে হইতে কথা না কহিলে তাঁহার চিন্তার ব্যাঘাত করিতে কেহ তাঁহাকে ব্যর্থ প্রশ্ন করিত না। বিশেষতঃ আজ তিনি অসুস্থ, শ্রান্ত এবং উৎপীড়িত।

 ভারতী ফিরিয়া আসিয়া কহিল, চলুন।

 অপূর্ব্ব মুখ তুলিয়া চাহিল, ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় আমাকে যেতে বলেন?

 ভারতী কহিল, আমার বাড়িতে।

 অপূর্ব্ব কয়েক মুহূর্ত্ত চুপ করিয়া রহিল। শেষে আস্তে আস্তে বলিল, আপনারা ত জানেন সমিতির আমি অযোগ্য। ওখানে আর ত আমার ঠাঁই হতে পারে না।

 ভারতী প্রশ্ন করিল, তাহলে কোথায় এখন যাবেন? বাসায়?

 বাসায়? একবার যেতে হবে,— এই বলিয়াই অপূর্ব্বর চক্ষু সজল হইয়া আসিল; তাহা কোনমতে সংবরণ করিয়া বলিল, কিন্তু এই বিদেশে আর একটা জায়গায় যে কি করে যাব আমি ভেবে পাইনে ভারতী!

 সুমিত্রা গাড়ির মধ্যে হইতে ক্ষীণকণ্ঠে ডাকিয়া কহিলেন, তোমরা এসো।

 ভারতী পুনশ্চ কহিল, চলুন।

 অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া বলিল, পথের দাবীতে আমার স্থান নেই।

 ভারতী হঠাৎ যেন তাহার হাত ধরিতে গেল, কিন্তু সামলাইয়া লইয়া এক মুহূর্ত্ত তাহার মুখের ’পরে দুই চক্ষের সমগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া চুপি চুপি কহিল, পথের দাবীতে স্থান নাও থাকতে পারে, কিন্তু আর একটা দাবী থেকে আপনাকে স্থানচ্যুত করতে পারে সংসারে এমন ত কিছু নেই, অপূর্ব্ববাবু!

 গাড়ি হইতে সুমিত্রা পুনশ্চ অসহিষ্ণু কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তোমাদের আসতে কি দেরি হবে ভারতী?

 ভারতী হাত নাড়িয়া গাড়োয়ানকে যাইতে ইঙ্গিত করিয়া কহিল, আপনি যান, এটুকু আমরা হেঁটেই যাব।

 পথে চলিতে চলিতে অপূর্ব্ব হঠাৎ বলিয়া উঠিল, তুমি আমার সঙ্গে চল ভারতী!

 ভারতী কহিল, সঙ্গেই ত যাচ্ছি।

 অপূর্ব্ব বলিল, সে নয়। তলওয়ারকরের স্ত্রীর কাছে আমি কি করে যাব, কি গিয়ে তাঁকে বলব, কি তাঁর উপায় করব আমি ত কোন মতেই ভেবে পাইনে। রামদাসকে এখানে সঙ্গে আনবার দুর্ব্বদ্ধি আমার কেন হল?

 ভারতী চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, এই বিদেশে হঠাৎ কি সর্ব্বনাশই হয়ে গেল! আমি ত কূল-কিনারা দেখতে পাইনে।

 ভারতী কোন মন্তব্যই প্রকাশ করিল না। উভয়ে কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিবার পরে অপূর্ব্ব উপায়হীন দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হইয়া সহসা গর্জ্জিয়া উঠিল, আমার দোষ কি? বার বার সাবধান করে দিলেও কেউ যদি গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলে তাকে বাঁচাবো আমি কি করে? আমি কি বলেছিলাম যা তা বক্তৃতা দিতে। স্ত্রী আছে মেয়ে আছে, ঘর-সংসার আছে এ হুঁস যার নেই—সে মরবে না তো মরবে কে? খাটুক আবার দু-বছর জেল!

 ভারতী বলিল, আপনি কি তাঁর স্ত্রীর কাছে এখন যাবেন না?

 অপূর্ব্ব তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, যেতে হবে বই কি। কিন্তু সাহেবকেই বা কাল কি জবাব দেব? তোমাকে কিন্তু বলে রাখচি ভারতী, সাহেব একটা কথা বললেই আমি চাকরি ছেড়ে দেব।

 দিয়ে কি করবেন?

 বাড়ি চলে যাব। এদেশে মানুষ থাকে?

 ভারতী বলিল, তাঁর উদ্ধারেরও চেষ্টাও করবেন না?

 অপূর্ব্ব থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, চল না একজন ভাল ব্যারিস্টারের কাছে যাই ভারতী। আমার প্রায় এক হাজার টাকা আছে,—এতে হবে না? আমার ঘড়িটড়িগুলো বিক্রী করলে হয়ত আরও পাঁচ-ছ’শ টাকা হবে। চল না যাই!

 ভারতী বলিল, কিন্তু তাঁর স্ত্রীর কাছে যাওয়া যে সর্ব্বাগ্রে প্রয়োজন অপূর্ব্ববাবু। আমার সঙ্গে আর যাবেন না, এইখান থেকেই একটা গাড়ি নিয়ে স্টেশনে চলে যান, তাঁর কি চাই, কি অভাব, অন্ততঃ একটা খবর দেওয়া যে বড় দরকার।

 অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল; কিন্তু তথাপি সঙ্গে সঙ্গেই চলিতে লাগিল; ভারতী বলিল, এটুকু আমি একাই যেতে পারব, আপনি ফিরুন।

 জবাব দিতে বোধ হয় অপূর্ব্বর বাধিতেছিল, কিন্তু ক্ষণেক মাত্র। তাহার পরেই কহিল, আমি একলা যেতে পারব না।

 ভারতী বলিল, বাসা থেকে তেওয়ারীকে না হয় সঙ্গে নেবেন।

 না, তুমি সঙ্গে চল।

 আমার যে জরুরী কাজ আছে।

 তা হোক, চল।

 কিন্তু কেন আমাকে এত করে জড়াচ্ছেন অপূর্ব্ববাবু?

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল।

 ভারতী তার মুখের দিকে চাহিয়া একটুখানি হাসিল, কহিল, আচ্ছা চলুন আমার সঙ্গে। নিজের কাজটুকু আগে সেরে নিই।

 পথের মধ্যে ভারতী সহসা একসময়ে কহিল, যে আপনাকে চাকরি করতে বিদেশে পাঠিয়েচে সে আপনাকে চেনে না। তিনি মা হলেও, না। তেওয়ারী দেশে যাচ্চে, আমি নিজে গিয়ে উদ্যোগ করে তার সঙ্গে আপনাকেও বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

 অপূর্ব্ব মৌন হইয়া রহিল। ভারতী বলিল, কই, উত্তর দিলেন না যে বড়?

 অপূর্ব্ব কহিল, উত্তর দেবার কিছু ত নেই। মা বেঁচে না থাকলে আমি সন্ন্যাসী হতুম।

 ভারতী আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, সন্ন্যাসী? কিন্তু মা তো বেঁচে আছেন।

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। দেশের পল্লীগ্রামে আমাদের একটা ছোট বাড়ি আছে, মাকে আমি সেইখানেই নিয়ে যাব।

 তারপরে?

 আমার যে এক হাজার টাকা আছে তাই দিয়ে একটা ছোট মুদির দোকান খুলবো। আমাদের দুজনের চলে যাবে।

 ভারতী কহিল, তা যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এর দরকার হল কিসে?

 অপূর্ব্ব বলিল, আজ আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি। শুধু মা ছাড়া সংসারে আমার দাম নেই। ভগবান করুন এর বেশি যেন না আমি কারো কাছে কিছু চাই।

 ভারতী পলকমাত্র তাহার মুখের পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা আপনাকে বুঝি বড্ড ভালবাসেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। চিরকাল মার দুঃখে দুঃখেই কাটলো, কেবল ভয় হয় তা আর যেন না বাড়ে। আমার সকল কাজে-কর্ম্মে আমার আধখানা যেন মা হয়ে আমার আর আধখানাকে দিবারাত্রি আঁকড়ে ধরে থাকে। এ থেকে আমি এক মুহূর্ত্ত ছাড়া পাইনে, ভারতী, তাই আমি ভীতু, তাই আমি সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র। এই বলিয়া তাহার মুখ দিয়া সহসা দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

 ইহার জবাব ভারতী দিল না, কেবল হাতবানি তাহার ধীরে ধীরে অপূর্ব্বর হাতের মধ্যে ধরা দিয়া নীরবে পথ চলিতে লাগিল।

 সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, অপূর্ব্ব উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, রামদাসের পরিবারের কি উপায় করবে ভারতী? শুধু দাসী ছাড়া এদেশে তাদের দেশের লোক বোধ করি কেউ নেই। থাকলেই বা কেউ কি তাদের ভার নেবে?

 ভারতী নিজেও কিছু ভাবিয়া পায় নাই, শুধু সাহস দেবার জন্যই কহিল, চলুন ত দিয়ে দেখি। উপায় একটা হবেই।

 অপূর্ধ্ব বুঝিল ইহা ফাঁকা কথা। তাহার মন কোন সান্ত্বনাই মানিল না, কহিল, তোমাকে হয়ত সেখানে থাকতে হবে।

 কিন্তু আমি ত ক্রীশ্চান, তাঁদের কি কাজেই বা লাগবো?

 তা বটে। কথাটা নূতন করিয়া অপূর্ব্বর বিঁধিল।

 উভয়ে বাসার আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেছে। এই রাত্রে কেমন করিয়া যে কি হইবে চিন্তা করিয়া মনে মনে তাহাদের ভয় ও উদ্বেগের সীমা ছিল না। নীচের ঘর খোলা ছিল, ভিতরে পা দিয়াই ভারতী দেখিতে পাইল ওদিকের খোলা জানালার ধারে ইজিচেয়ারে কে একজন শুইয়া আছে। সে মুখ তুলিয়া চাহিতেই ভারতী চিনিতে পারিয়া উল্লাসে কলরব করিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু, কখন এলেন আপনি? সুমিত্রাদিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে?

 না।

 অপূর্ব্ব কহিল, ভয়ানক কাণ্ড হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু, আমাদের একাউণ্টেণ্ট রামদাস তলওয়ারকরকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

 ভারতী বলিল, ইন্‌সিনে তাঁর বাসা। সেখানে স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে, তাঁরা এখনও কিছুই জানেন না।

 অপূর্ব্ব বলিল, অত দূরে এই অন্ধকার রাতে—কি ভয়ানক বিপদই ঘটলো ডাক্তারবাবু।

 ডাক্তার হাই তুলিয়া সোজা হইয়া বসিয়া হাসিলেন, ভারতীকে কহিলেন, আমি বড় শ্রান্ত, আমাকে একটু চা তৈরী করে খাওয়াতে পারো ভাই?

 ভারতী বলিল, পারি, কিন্তু আমাদের যে এখুনি বেরোতে হবে ডাক্তারবাবু।

 কোথায়?

 ইন্‌সিনে। তলওয়ারকরবাবুর বাসায়।

 কোন প্রয়োজন নেই।

 অপূর্ব্ব সবিস্ময়ে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, প্রয়োজন নেই কি রকম ডাক্তারবাবু? তাঁর বিপন্ন পরিবারের ব্যবস্থা করা, অন্ততঃ একটা খোঁজ-খবর নেওয়া ত প্রয়োজন বলেই মনে হয়।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু সে ভার আমার; আপনারা বড় জোর এই অন্ধকারে সারারাত্রি ধরে ইন্‌সিনের বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারবেন,—শেষ পর্য্যন্ত হয়ত বাড়িটাও চিনে বার করতে পারবে না। এই বলিয়া তিনি পুনরায় হাস্য করিয়া কহিলেন, তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি বসুন, এবং ভারতী চা তৈরী করে আনুক। কিন্তু আপনার বুঝি চলে না? তা বেশ, হোটেলের বামুনঠাকুর পবিত্রভাবে কিছু খাবার তৈরী করে দিয়ে যাক, আহারাদি করে বিশ্রাম করুন।

 ভারতী নিশ্চিন্ত ও প্রফুল্লচিত্তে চা তৈরী করিতে উপরে যাইতেছিল, কিন্তু অপূর্ব্ব কিছুই বিশ্বাস করিল না। ডাক্তারের সমস্ত কথা-বার্ত্তাই তাহার কাছে হেঁয়ালির মত ঠেকিয়া অতিশয় খারাপ বোধ হইল। ভারভীকে উদ্দেশ করিয়া ক্ষুণ্ণকণ্ঠে বলিল, এই রাত্রে কষ্ট করা থেকে তুমি বেঁচে গেলে, কিন্তু আমার দায়িত্ব ঢের বেশি। যত রাত্রিই হোক আমাকে সেখানে যেতেই হবে।

 তাহার মন্তব্য শুনিয়া ভারতী থমকিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু তখনই ডাক্তারের চোখের দিকে চাহিয়া স্বচ্ছন্দমনে কাজে চলিয়া গেল।

 ডাক্তারবাবু একখণ্ড মোমবাতি জ্বালাইয়া পকেট হইতে কয়েকখানা চিঠি বাহির করিয়া জবাব লিখিতে বসিলেন। মিনিট দশেক নীরবে অপেক্ষা করিয়া অপূর্ব্ব বিরক্ত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, চিঠিগুলো কি অত্যন্ত জরুরি?

 ডাক্তার মুখ না তুলিয়া কহিলেন, হ্যাঁ।

 অপূর্ব্ব বলিল, ওদিকে একটা ব্যবস্থা হওয়াও ত কম জরুরি নয়। আপনি কি তাঁর বাসায় কাউকে পাঠাবেন না?

 ডাক্তার কহিলেন, এত রাত্রে? কাল সকালের পূর্ব্বে বোধ হয় আর লোক পাওয়া যাবে না।

 অপূর্ব্ব বলিল, তাহলে তার জন্যে আর আপনি চিন্তিত হবেন না, সকালে আমি নিজেই যেতে পারবো। তারতীকে নিষেধ না করলে আমরা যেতে পারতাম এবং আামার মনে হয় সেইটেই সবচেয়ে ভাল হতো।

 ডাক্তারের চিঠি লেখায় বাধা পড়িল না, কারণ তিনি মুখ তুলিবারও অবকাশ পাইলেন না, শুধু বলিলেন, আবশ্যক ছিল না।

 অপূর্ব্ব অন্তরের উষ্মা যথাসাধ্য চাপিয়া কহিল, আবশ্যকতার ধারণা এ ক্ষেত্রে আপনার এবং আমার এক নয়। আমার সে বন্ধু।

 ভারতী চায়ের সরঞ্জাম লইয়া নীচে আসিল এবং পেয়ালা দুই চা তৈরী করিয়া দিয়া কাছে বসিল। ডাক্তারের চিঠি লেখা এবং চা খাওয়া দুই কাজই একসঙ্গে চলিতে লাগিল। মিনিট দুই-তিন নিঃশব্দে কাটিবার পরে সহসা ভারতী অভিমানের সুরে বলিয়া উঠিল, আপনি সদাই ব্যস্ত। দুদণ্ড যে আপনার কাছে বসে কথা শুনবো সে সময়টুকুও আমরা পাইনে।

 ডাক্তারের অন্যমনস্ক কানের মধ্যে গিয়া রমণীর এই অভিমানের সুর বাজিল, তিনি চায়ের পেয়ালা হইতে মুখ সরাইয়া হাসিমুখে কহিলেন, করি কি ভাই, এই দুটোর ট্রেনেই আবার রওনা হতে হবে।

 সংবাদ শুনিয়া ভারতী চকিত হইল এবং অপূর্ব্বর মনের সংশয় তাহার বন্ধুর সম্বন্ধে একেবারে ঘনীভূত হইয়া উঠিল। ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, একটা রাতও কি আপনি বিশ্রামের অবকাশ পাবেন না ডাক্তারবাবু?

 ডাক্তার চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া কহিলেন, আমার শুধু একটি দিনের অবসর আছে ভাই ভারতী, সে কিন্তু আজও আসেনি।

 ভারতী বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সে কবে আসবে?

 ডাক্তার ইহার উত্তর দিলেন না।

 অপূর্ব্বর মনের মধ্যে কেবল একটা কথা তোলা-পাড়া করিতেছিল, সে তাহারই সূত্র ধরিয়া বলিল, সমিতির সভ্য না হয়েও রামদাস যে শাস্তি ভোগ করতে যাচ্চে তা অসাধারণ।

 ডাক্তার কহিলেন, শাস্তি নাও হতে পারে।

 অপূর্ব্ব কহিল, না হয় ত সে তার ভাগ্য। কিন্তু যদি হয় সমস্ত অপরাধ আমার। আমিই তাকে এনেছিলাম।

 প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু মুচকিয়া হাসিয়া চুপ করিলেন।

 অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, দেশের জন্য যে ব্যক্তি দু বছর জেল খেটেছে, অসংখ্য বেতের দাগ যার পিঠ থেকে আজও মোছেনি, এই বিদেশে স্ত্রী-পুত্র যার শুধু তারই মুখ চেয়ে আছে তার এতবড় সাহস অসামান্য। ওর আর তুলনা নেই।

 তাহার বন্ধুর প্রতি উচ্ছ্বসিত এই অকৃত্রিম প্রশংসা-বাক্যের মধ্যেও একটা গোপন আঘাত ছিল, কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইল। ডাক্তার মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিলেন, তাতে আর সন্দেহ কি অপূর্ব্ববাবু। পরাধীনতার আগুনে বুকের মধ্যে যার অহোরাত্র জ্বলে যাচ্ছে, এ ছাড়া তার তো উপায় নেই। সাহেবের দোকানের বড় চাকরি বা ইন্‌সিনের বাসায় স্ত্রী-পুত্র-পরিবার কিছুই তাকে ঠেকাতে পারে না,—এই তার একটিমাত্র পথ।

 দুশ্চিন্তা ও তীব্র সংশয়ে অপূর্ব্বর বুদ্ধি ও জ্ঞান আচ্ছন্ন হইয়া না থাকিলে সে এত বড় ভুল করিতে পারিত না। ডাক্তারের উক্তিকে সে শ্লেষ কল্পনা করিয়া হঠাৎ যেন ক্ষেপিয়া গেল। কহিল, আপনি তাঁর মহত্ত্ব অনুভব না করতে পারেন, কিন্তু সাহেবের দোকানের চাকরি তলওয়ারকরের মত মানুষকে ছোট করে দিতে পারে না। আমাকে আপনি যত ইচ্ছে ব্যঙ্গ করুন, কিন্তু রামদাস কোন অংশেই আপনার ছোট নয়। এ আপনি নিশ্চিত জানবেন।

 ডাক্তার আশ্চর্য্য হইয়া কহিলেন, আমি নিশ্চিতই জানি। তাঁকে আমি ছোট বলিনি অপূর্ব্ববাবু!

 অপূর্ব্ব কহিল, বলেছেন। তাঁকে এবং আমাকে আপনি পরিহাস করেছেন। কিন্তু আমি জানি জন্মভূমি তার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। সে নির্ভীক! সে বীর! আপনার মত সে লুকিয়ে বেড়ায় না। আপনার মত পুলিশের ভয়ে ছদ্মবেশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে না। আপনি ত ভীরু।

 প্রচণ্ড বিস্ময়ে ভারতী অবাক হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু আর সে সহিতে পারিল না। দৃপ্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আপনি কাকে কি বলছেন অপূর্ব্ববাবু? হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন কি?

 অপূর্ব্ব কহিল, না পাগল হইনি। উনি যেই হোন, রামদাস তলওয়ারকরের পদধূলির যোগ্য ন’ন, একথা আমি মুক্তকণ্ঠে বলব। তার তেজ, তার বাগ্মিতা, তার নির্ভীকতাকে ইনি মনে মনে ঈর্ষা করেন। তাই তোমাকে যেতে দিলেন না, তাই আমাকে কৌশলে বাধা দিলেন।

 ভারতী উঠিয়া দাঁড়াইল। আপনাকে অপরিসীম যত্নে সংযত করিয়া সহজকণ্ঠে কহিল, আপনাকে আমি অপমান করতে পারব না, কিন্তু এখান থেকে আপনি যান অপূর্ব্ববাবু। আপনাকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম। ভয়ে যার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, সে উন্মাদের এখানে ঠাঁই নেই। আপনার কথাই সত্য, পথের দাবীতে আপনার স্থান হবে না। এর পরে আর কোন ছলে কোনদিন আমার বাসায় ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।

 অপূর্ব্ব নিরুত্তরে উঠিয়া দাঁড়াইতেই ডাক্তার তাহার হাত ধরিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, আর একটু বসুন অপূর্ব্ববাবু, এই অন্ধকারে একলা যাবেন না। আমি স্টেশনে যাবার পথে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাব।

 অপূর্ব্বর চেতনা ফিরিয়া আসিতেছিল, সে পুনরায় অধোমুখে বসিয়া পড়িল।

 ভুক্তাবশিষ্ট বিস্কুটগুলি ডাক্তার পকেটে পুরিতেছিলেন দেখিয়া ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, ওকি হচ্চে আপনার?

 রসদ সংগ্রহ করে রাখচি ভাই।

 সত্য সত্যই আজ রাত্রে যাবেন না কি?

 নইলে কি মিথ্যামিধ্যিই অপূর্ব্ববাবুকে ধরে রাখলাম? সবাই মিলে এমন অবিশ্বাস করলে আমি বাঁচি কি করে বল ত? এই বলিয়া তিনি কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করিতে ভারতী অভিমান করিয়া কহিল, আজ আপনার যাওয়া হবে না, আপনি বড় ক্লান্ত। তা ছাড়া সুমিত্রাদিদি অসুস্থ, আপনি কেবলি কোথায় চলে যাবেন,—একটা কথা শুনতে পাইনে, একটা উপদেশ নিতে পাইনে, পথের দাবী একলা আমি চালাই কি করে বলুন ত? আমিও তাহলে যেখানে খুশি চলে যাব!

 লেখা চিঠিগুলো ডাক্তার তাহার হাতে দিয়া হাসিয়া কহিলেন, একখানি তোমার, একখানি সুমিত্রার, অন্যখানি তোমাদের পথের দাবীর! আমার উপদেশ বল, আদেশ বল, সবই এর মধ্যে পাবে।

 চিঠিগুলি মুঠোর মধ্যে লইয়া ভারতী মুখ মলিন করিয়া বলিল, এবার কি আপনি বেশিদিনের জন্য যাচ্চেন?

 দেবা ন জানন্তি,—বলিয়া ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন।

 ভারতী কহিল, আমাদের মুস্কিল হয়েছে, না মুখ দেখে, না কথা শুনে আপনার মনের কথা জানবার জো আছে। ঠিক করে বলে যান কবে ফিরবেন?

 ঐ-যে বললাম, দেশ না জানন্তি—

 না তা হবে না, সত্যি করে বলুন কবে ফিরবেন?

 এত তাগাদা কেন বলত?

 ভারতী কহিল, কি জানি এবার কেমন যেন ভয় করছে। মনে হচ্ছে যেন সব ভেঙে চুরে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। বলিতে বলিতে সহসা তাহার চক্ষু অশ্রুপরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

 তাহার মাথার উপর হাত রাখিয়া ডাক্তার রহস্যভরে কহিলেন, হবে না গো, হবে না,—সব ঠিক হয়ে যাবে। বলিয়াই হঠাৎ ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, কিন্তু এই মানুষটির সঙ্গে এমন মিছি-মিছি ঝগড়া করলে কিন্তু সত্যিই কাঁদতে হবে তা বলে রাখচি। অপূর্ব্ববাবু রাগ করেন বটে, কিন্তু ভাল যাকে বাসেন তাকে ভালবাসতেও জানেন। মানুষের মধ্যে যে হৃদয়বস্তুটি আছে সে আমাদের সংসর্গে এখনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়নি। ফুটন্ত পদ্মটির মত ঠিক তাজা আছে।

 ভারতী কি একটা জবাব দিতে যাইতেছিল, কিন্তু অপূর্ব্ব হঠাৎ মুখ তুলিতেই তাহার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার নিজের মুখ বন্ধ হইয়া গেল।

 এমন সময়ে দ্বারের কাছে আসিয়া একখানা ঘোড়ার গাড়ি থামিল এবং অনতিকাল মধ্যেই দুইজন লোক প্রবেশ করিল। একজনের পরিধানে আগাগোড়া সাহেবী পোষাক, ডাক্তার ভিন্ন বোধ করি সকলেরই অপরিচিত; আর একজন রামদাস তলওয়ারকর। অপূর্ব্বর মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু কলরব করিয়া সে বন্ধুকে সংবর্দ্ধনা করিতে গেল না। রামদাস অগ্রসর হইয়া ডাক্তারের পদধুলি গ্রহণ করিল। অপূর্ব্বর কাছে ইহা অদ্ভুত ঠেকিল। কিন্তু ডাক্তারের মুখের প্রতি সে শুধু নীরবে নেত্রপাত করিয়া নীরব হইয়াই রহিল।

 ইংরাজি পোষাক পরা লোকটি ইংরাজীতেই কথা কহিলেন, বলিলেন, জামিনের জন্যই এত বিলম্ব ঘটিল। কেস বোধ হয় গভর্ণমেণ্ট চালাবে না।

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তার মানে গভর্ণমেণ্টকে তুমি আজও চেননি কৃষ্ণ আইয়ার।

 এই কথায় রামদাস সহাস্যে যোগ দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাঠ থেকে থানা পর্য্যন্ত আপনাকে সকল সময়েই সঙ্গে দেখেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কখন যে অন্তর্হিত হয়েছিলেন সেইটাই জানতে পারিনি।

 ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, অন্তর্দ্ধানের গভীর কারণ ঘটেছিল রামদাসবাবু। এমন কি রাতারাতি এখান থেকেও অন্তর্হিত হতে হ’ল। রামদাস কহিল, সেদিন রেলওয়ে স্টেশনে আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, জানি। কিন্তু সোজা বাসায় না গিয়ে এত রাত্রে এখানে কেন?

 রামদাস কহিল, আপনাকে প্রণাম করতে। পুনার সেণ্ট্রাল জেলে আমি যাবার পরেই আপনি চলে গেলেন। তখন সুযোগ পাইনি। নীলকান্ত যোশীর কি হ’ল জানেন? সে তো আপনার সঙ্গে ছিল।

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ। ব্যারাকের পাঁচিল টপকাতে পারলে না বলে সিঙ্গাপুরে তার ফাঁসি হ’ল।

 অপূর্ব্বর কাছে এই সকল অচিন্ত্যনীয়, অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের মত বোধ হইতে লাগিল। সে আর থাকিতে না পারিয়া অকস্মাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু, আপনারও কি তাহলে ফাঁসি হতো?

 ডাক্তার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিলেন। এই হাসি দেবিৱা অপূর্ব্বর মাথায় চুল পর্য্যন্ত শিহরিয়া উঠিল।

 রামদাস উৎসুক হইয়া কহিল, তার পরে?

 ডাক্তার বলিলেন, একবার এই সিঙ্গাপুরেই আমাকে বছর তিনেক আটক থাকতে হয়েছিল, কর্ত্তৃপক্ষরা আমাকে চেনেন। তাই সোজা-রাস্তাটা এড়িয়ে ব্যাঙ্ককের পথে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে টেভয়ে এসে পৌঁছুলাম। জোর কপাল! হঠাৎ বনের মধ্যে একটা হাতীর বাচ্চাও ভগবান পাইয়ে দিলেন। সেটা সঙ্গে থাকায় বরাবর ভারি সুবিধে হয়ে গেল। শেষে হাতীর বাচ্চা বিক্রী করে দেশী জাহাজে নারকেল চালানের সঙ্গে নিজেকে চালান দিয়ে মাস তিনেকের মধ্যে একেবারে আরাকানে এসে পাড়ি জমালাম। খাসা থাকা গিয়েছিল রামদাসবাবু, হঠাৎ থানার মধ্যে আজ পরম বন্ধুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা সাক্ষাৎ। ভি. এ. চেলিয়া তাঁর নাম, বড্ড স্নেহ করেন আমাকে। বহুদিনের অদর্শনে খুঁজতে খুঁজতে একেবারে সিঙ্গাপুর থেকে বুর্ম্মা মুলুকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভাবে বোধ হয় খোঁজ পেয়েচেন। তবে, ভিড়ের মধ্যে তেমন নজর দিতে পারেননি, নইলে পৈতৃক গলাটার,—এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে গিয়া অকস্মাৎ অপূর্ব্বর মুখের দিকে চাহিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিলেন,—এ কি অপূর্ব্ববাবু? কি হ’ল আপনার?

 অপূর্ব্ব, দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া আপনাকে সামলাইবার চেষ্টা করিতেছিল। তাহার কথা শেষ না হইতেই সে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া সবেগে ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।