পল্লী-সমাজ/সপ্তম পরিচ্ছেদ

 “হাঁরে যতীন্‌, খেলা কর্‌ছিস, ইস্কুলে যাবিনে?” “আমাদের যে আজ কাল দু’দিন ছুটি দিদি!” মাসী শুনিতে পাইয়া কুৎসিত মুখ আরও বিশ্রী করিয়া বলিলেন, “মুখপোড়া ইস্কুলের মাসের মধ্যে পনরদিন ছুটি! তুই তাই ওর পিছনে টাকা খরচ করিস্‌, আমি হ’লে আগুন ধরিয়ে দিতুম।” বলিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেলেন। ষোল-আনা মিথ্যাবাদিনী বলিয়া যাহারা মাসীর অখ্যাতি প্রচার করিত, তাহারা ভুল করিত। এম্‌নি এক-আধটা সত্যকথা বলিতেও তিনি পারিতেন এবং আবশ্যক হইলে করিতেও পশ্চাৎপদ হইতেন না। রমা ছোট ভাইটিকে কাছে টানিয়া লইয়া, আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “ছুটি কেন রে, যতীন্‌?” যতীন দিদির কোল ঘেঁসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমাদের ইস্কুলের চাল ছাওয়া হচ্চে যে! তারপর চুণকাম হবে—কত বই এসেচে, চারপাঁচটা চেয়ার-টেবিল, একটা আলমারী, একটা খুব বড় ঘড়ি—একদিন তুমি গিয়ে দেখে এসো না, দিদি?” রমা অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, “বলিস্‌ কি রে! হাঁ, দিদি সত্যি। রমেশবাবু এসেচেন না—তিনি সব ক’রে দিচ্চেন।” বলিয়া বালক আরও কি কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সুমুখে মাসীকে আসিতে দেখিয়া রমা তাড়াতাড়ি তাহাকে লইয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। আদর করিয়া কাছে বসাইয়া প্রশ্ন করিয়া এই ছোট ভাইটির মুখ হইতে সে রমেশ ও ইস্কুল সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করিল। প্রত্যহ দুই এক ঘণ্টা করিয়া তিনি নিজে পড়াইয়া যান, তাহাও শুনিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁরে, যতীন্‌, তোকে তিনি চিনতে পারেন?” বালক সগর্ব্বে মাথা নাড়িয়া বলিল, “হাঁ—” “কি ব’লে তুই তাঁকে ডাকিস্‌?” এইবার যতীন একটু মুস্কিলে পড়িল। কারণ, এতটা ঘনিষ্ঠতার সৌভাগ্য এবং সাহস আজও তাহার হয় নাই। তিনি উপস্থিত হইবামাত্র দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ হেডমাষ্টার পর্য্যন্ত যেরূপ তটস্থ হইয়া পড়েন, তাহাতে ছাত্রমহলে ভয় এবং বিস্ময়ের পরিসীমা থাকে না। ডাকা ত দূরের কথা—ভরসা করিয়া ইহারা কেহ তাঁহার মুখের দিকে চাহিতেই পারে না। কিন্তু দিদির কাছে স্বীকার করাও ত সহজ নহে! ছেলেরা মাষ্টারদিগকে ‘ছোটবাবু’ বলিয়া ডাকিতে শুনিয়াছিল। তাই, সে বুদ্ধিখরচ করিয়া কহিল, “আমরা ছোটবাবু বলি।” কিন্তু তাহার মুখের ভাব দেখিয়া রমার বুঝিতে কিছুই বাকী রহিল না। সে ভাইকে আরও একটু বুকের কাছে টানিয়া লইয়া সহাস্যে কহিল, “ছোটবাবু কি রে! তিনি যে তোর দাদা হ’ন। বেণীবাবুকে যেমন ‘বড়দা’ ব’লে ডাকিস্‌, এঁকে তেম্‌নি ‘ছোটদা’ ব’লে ডাকতে পারিস্‌ নে?” বালক বিস্ময়ে আনন্দে চঞ্চল হইয়া উঠিল—“আমার দাদা হন তিনি? সত্যি বল্‌চ দিদি?” “তাই ত হয় রে”—বলিয়া রমা আবার একটু হাসিল। আর যতীনকে ধরিয়া রাখা শক্ত হইয়া উঠিল। খবরটা সঙ্গীদের মধ্যে এখনি প্রচার করিয়া দিতে পারিলেই সে বাঁচে। কিন্তু ইস্কুল যে বন্ধ! এই দুটো দিন তাহাকে কোনমতে ধৈর্য্য ধরিয়া থাকিতেই হইবে। তবে, যে সকল ছেলেরা কাছাকাছি থাকে, অন্ততঃ তাহাদিগকে না বলিয়াই বা সে থাকে কি করিয়া? সে আর একবার ছট্‌ফট্‌ করিয়া বলিল, “এখন যাব দিদি?” “এত বেলায় কোথায় যাবি রে?” বলিয়া রমা তাহাকে ধরিয়া রাখিল। যাইতে না পারিয়া যতীন খানিকক্ষণ অপ্রসন্নমুখে চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন দিদি?” রমা স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “এত দিন লেখাপড়া শিখ্‌তে বিদেশে ছিলেন। তুই বড় হ’লে তোকেও এম্‌নি বিদেশে গিয়ে থাক্‌তে হবে। আমাকে ছেড়ে পার্‌বি থাকতে, যতীন্‌?” বলিয়া ভাইটিকে সে আর একবার বুকের কাছে আকর্ষণ করিল। বালক হইলেও সে তাহার দিদির কণ্ঠস্বরে কি রকম একটা পরিবর্ত্তন অনুভব করিয়া বিস্মিতভাবে মুখপানে চাহিয়া রহিল। কারণ, রমা তাহার এই ভাইটিকে প্রাণতুল্য ভালবাসিলেও তাহার কথায় এবং ব্যবহারে এরূপ আবেগ উচ্ছ্বাস কখন প্রকাশ পাইত না।

 যতীন প্রশ্ন করিল, “ছোটদা’র সমস্ত পড়া শেষ হয়ে গেছে দিদি?” রমা তেমনি স্নেহকোমলকণ্ঠে জবাব দিল, “হাঁ ভাই, তাঁর সব পড়া সাঙ্গ হয়ে গেছে।” যতীন আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কি ক’রে তুমি জানলে?” প্রত্যুত্তরে রমা শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া মাথা নাড়িল। বস্তুতঃ এ সম্বন্ধে সে, কিংবা গ্রামের আর কেহ, কিছুই জানিত না। তাহার অনুমান যে সত্য হইবেই, তাহাও নয়, কিন্তু কেমন করিয়া তাহার যেন নিশ্চয় বোধ হইয়াছিল, যে ব্যক্তি পরের ছেলের লেখাপড়ার জন্য এই অত্যল্পকালের মধ্যেই এরূপ সচেতন হইয়া উঠিয়াছে, সে কিছুতেই নিজে মূর্খ নয়।

 যতীন এ লইয়া আর জের করিল না। কারণ, ইতিমধ্যে হঠাৎ তাহার মাথার মধ্যে আর একটা প্রশ্নের আবির্ভাব হইতেই, চট্ করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, “আচ্ছা দিদি, ছোটদা, কেন আমাদের বাড়ী আসেন না? বড়দা ত রোজ আসেন।” প্রশ্নটা ঠিক যেন একটা আকস্মিক তীক্ষ্ণ ব্যথার মত রমার সর্ব্বাঙ্গে বিদ্যুদ্বেগে প্রবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু, তথাপি হাসিয়া কহিল, “তুই তাকে ডেকে আন্‌তে পারিস্ নে?” “এখনি যাব দিদি?” বলিয়া তৎক্ষণাৎ যতীন উঠিয়া দাঁড়াইল। “ওরে কি পাগ্‌লা ছেলে রে তুই!” বলিয়া রমা চক্ষের পলকে তাহার ভয়ব্যাকুল দুই বাহু বাড়াইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। “খপর্‌দার, যতীন—কখ্‌খনো এমন কাজ করিস্‌নে, ভাই, কখ্‌খনো না।” বলিয়া ভাইটিকে সে যেন প্রাণপণ বলে বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া রাখিল। তাহার অতি দ্রুত হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করিয়া যতীন, বালক হইলেও, এবার বড় বিস্ময়ে দিদির মুখপানে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। একে ত, এমনধারা করিতে কখনও সে পূর্ব্বে দেখে নাই, তা’ ছাড়া ছোট বাবুকে ছোটদাদা বলিয়া জানিয়া যখন তাহার নিজের মনের গতি সম্পূর্ণ অন্য পথে গিয়াছে, তখন দিদি কেন যে তাঁহাকে এত ভয় করিতেছে, তাহা সে কোনমতেই ভাবিয়া পাইল না। এমন সময়ে মাসীর তীক্ষ্ণ আহ্বান কানে আসিতেই রমা, যতীনকে ছাড়িয়া দিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। অনতিকাল পরে’ তিনি স্বয়ং আসিয়া দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিলেন, “আমি বলি, বুঝি রমা ঘাটে চান কর্‌তে গেছে! বলি, একাদশী ব’লে কি এতটা বেলা পর্য্যন্ত মাথায় একটু তেলজলও দিতে হবে না? মুখ শুকিয়ে যে একেবারে কালীবর্ণ হয়ে গেছে।” রমা, জোর করিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, “তুমি যাও মাসী, আমি এখনি যাচ্ছি।” “যাবি আর কখন্‌?” বেরিয়ে দেখ্‌গে যা, বেণীরা মাছ ভাগ কর্‌তে এসেচে।” মাছের নামে যতীন ছুটিয়া চলিয়া গেল। মাসীর অলক্ষ্যে রমা আঁচল দিয়া মুখখানা একবার জোর করিয়া মুছিয়া লইয়া, তাঁহার পিছনে পিছনে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রাঙ্গণের উপর মহাকোলাহল। মাছ নিতান্ত কম ধরা পড়ে নাই—একটা ঝুড়ির প্রায় একঝুড়ি। ভাগ করিবার জন্য বেণী নিজেই হাজির হইয়াছেন। পাড়ার ছেলে-মেয়েরা আর কোথাও নাই—সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া গোলমাল করিতেছে।

 কাসির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই, “কি মাছ পড়ল হে বেণী!” বলিয়া লাঠি হাতে ধর্ম্মদাস প্রবেশ করিলেন। “তেমন আর কই পড়্‌ল!” বলিয়া বেণী মুখখানা অপ্রসন্ন করিল। জেলেকে ডাকিয়া কহিল, “আর দেরি করচিস্ কেন রে? শীগ্‌গীর ক’রে দুভাগ ক’রে ফেল না।” জেলে ভাগ করিতে প্রবৃত্ত হইল।

 “কি হচ্চে গো রমা? অনেকদিন আস্‌তে পারিনি। বলি, মায়ের আমার খবরটা একবার নিয়ে যাই”— বলিয়া গোবিন্দ গাঙুলী বাড়ী ঢুকিলেন। “আসুন”—বলিয়া রমা মুখ টিপিয়া একটুখানি হাসিল। “এত ভিড় কিসের গো?” বলিয়া গাঙুলী অগ্রসর হইয়া আসিয়া হঠাৎ যেন আশ্চর্য্য হইয়া গেলেন—“ইস্‌! তাই ত গা—মাছ বড় মন্দ ধরা পড়েনি দেখ্‌চি। বড়পুকুরে জাল দেওয়া হ’ল বুঝি?” এ সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সকলেই বাহুল্য মনে করিয়া মৎস্য-বিভাগের প্রতি ঝুঁকিয়া রহিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহা সমাধা হইয়া গেল। বেণী নিজের অংশের প্রায় সমস্তটুকুই চাকরের মাথায় তুলিয়া দিয়া ধীবরের প্রতি একটা গোপন চোখের ইঙ্গিত করিয়া, গৃহে প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিলেন; এবং মুখুয্যেদের প্রয়োজন অল্প বলিয়া রমার অংশ হইতে উপস্থিত সকলেই যোগ্যতা-অনুসারে কিছু-কিছু সংগ্রহ করিয়া ঘরে ফিরিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময় সকলেই আশ্চর্য্য হইয়া চাহিয়া দেখিল, রমেশ ঘোষালের সেই বেঁটে হিন্দুস্থানী চাকরটা তাহার মাথার সমান উঁচু বাঁশের লাঠি হাতে একেবারে উঠানের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই লোকটার চেহারা এম্‌নি দুষমনের মত যে, সকলের আগে সে চোখে পড়েই এবং একবার পড়িলেই মনে থাকে। গ্রামের ছেলে বুড়া সবাই তাহাকে চিনিয়া লইয়াছিল; এমন কি, তাহার সম্বন্ধে নানাবিধ আজগুবি গল্পও ধীরে ধীরে প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। লোকটা এত লোকের মাঝ্‌খানে রমাকেই যে কি করিয়া কর্ত্রী বলিয়া চিনিল, তাহা সেই জানে, দূর হইতে মস্ত একটা সেলাম করিয়া, ‘মা-জী’ বলিয়া সম্বোধন করিল, এবং কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার চেহারা যেমন হৌক, কণ্ঠস্বর সত্যই ভয়ানক;—অত্যন্ত মোটা এবং ভাঙা। আর একটা সেলাম করিয়া হিন্দি-বাঙ্গালা মেশানো ভাষায় সংক্ষেপে জানাইল, সে রমেশ বাবুর ভৃত্য এবং মাছের তিন ভাগের এক ভাগ গ্রহণ করিতে আসিয়াছে। রমা বিস্ময়ের প্রভাবেই হৌক বা তাহার সঙ্গত প্রার্থনার বিরুদ্ধে কথা খুঁজিয়া না পাওয়ার জন্যই হৌক—সহসা উত্তর দিতে পারিল না। লোকটা চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া বেণীর ভৃত্যকে উদ্দেশ করিয়া গম্ভীর গলায় বলিল, “এই যাও মাৎ”। চাকরটা ভয়ে চার পা পিছাইয়া দাঁড়াইল। আধমিনিট পর্য্যন্ত কোথাও একটু শব্দ নাই; তখন বেণী সাহস করিলেন। যেখানে ছিলেন, সেইখান হইতে বলিলেন, “কিসের ভাগ?” ভজুয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে একটা সেলাম দিয়া সসম্ভ্রমে কহিল, “বাবুজী, আপকো নাহি পুছা।” মাসী অনেক দূরে রকের উপর হইতে তীক্ষ্ণকণ্ঠে ঝন্‌ঝন্ করিয়া বলিলেন, “কি রে বাপু, মারবি না কি?” ভজুয়া একমুহূর্ত্ত তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল; পরক্ষণেই তাহার ভাঙা গলার ভয়ঙ্কর হাসিতে বাড়ী ভরিয়া উঠিল। খানিক পরে হাসি থামাইয়া যেন একটু লজ্জিত হইয়াই পুনরায় রমার প্রতি চাহিয়া কহিল, ‘মা-জী?’ তাহার কথায় এবং ব্যবহারে অতিশয় সম্ভ্রমের ভিতরে যেন অবজ্ঞা লুকান ছিল। রমা ইহাই কল্পনা করিয়া মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এবার কথা কহিল। বলিল, “কি চায় তোর বাবু?” রমার বিরক্তি লক্ষ্য করিয়া ভজুয়া হঠাৎ যেন কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। তাই যতদূর সাধ্য, সেই কর্ক্কশকণ্ঠ কোমল করিয়া তাহার প্রার্থনার পুনরাবৃত্তি করিল। কিন্তু করিলে কি হয়—মাছ ভাগ হইয়া যে বিলি হইয়া গিয়াছে। এতগুলা লোকের সুমুখে সে হীন হইতেও পারে না।—তাই কটুকণ্ঠে কহিল—“তোর বাবুর এতে কোন অংশ নেই। বল্‌ গে যা, যা’ পারে, তাই করুক্‌ গে।” “বহুৎ আচ্ছা, মা-জী।” বলিয়া ভজুয়া তৎক্ষণাৎ একটা দীর্ঘ সেলাম করিয়া বেণীর ভৃত্যকে হাত নাড়িয়া যাইতে ইঙ্গিত করিয়া দিল, এবং দ্বিতীয় কথা না কহিয়া নিজেও প্রস্থানের উপক্রম করিল। তাহার ব্যবহারে বাড়ীশুদ্ধ সকলেই যখন অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইয়া গেছে, তখন হঠাৎ সে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া রমার মুখের দিকে চাহিয়া হিন্দি-বাঙ্গালায় মিশাইয়া নিজের কঠোর কণ্ঠস্বরের জন্য ক্ষমা চাহিল, এবং কহিল, “মা-জী, লোকের কথা শুনিয়া পুকুর-ধার হইতে মাছ কাড়িয়া আনিবার জন্য বাবু আমাকে হুকুম করিয়াছিলেন! বাবু-জী কিংবা আমি কেহই আমরা মাছ-মাংস ছুঁই না বটে, কিন্তু”—বলিয়া সে নিজের প্রশস্ত বুকের উপর করাঘাত করিয়া কহিল, “বাবুজীর হুকুমে এই জীউ হয় ত পুকুরধারেই আজ দিতে হইত। কিন্তু রামজী রক্ষা করিয়াছেন; বাবুজীর রাগ পড়িয়া গেল। আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ভজুয়া, যা, মা-জীকে জিজ্ঞাসা ক’রে আয়, ও পুকুরে আমার ভাগ আছে কি না।” বলিয়া সে অতি সম্ভ্রমের সহিত লাঠিশুদ্ধ দুই হাত রমার প্রতি উত্থিত করিয়া নিজের মাথায় ঠেকাইয়া নমস্কার করিয়া বলিল, “বাবুজী বলিয়া দিলেন—আর যে যাই বলুক, ভজুয়া, আমি নিশ্চয় জানি, মা-জীর জবান থেকে কখনও ঝুটাবাত বা’র হবে না—সে কখনও পরের জিনিস ছোঁবে না।” বলিয়া সে আন্তরিক সম্ভ্রমের সহিত বারংবার নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া গেল।

 যাইবামাত্র বেণী মেয়েলি সরু গলায় আস্ফালন করিয়া কহিল, “এমনি ক’রে উনি বিষয় রক্ষে কর্‌বেন! এই তোমাদের কাছে প্রতিজ্ঞে কর্‌চি, আমি আজ থেকে গড়ের একটা শামুকগুগ্‌লিতেও ওকে হাত দিতে দেব না, বুঝ্‌লে না রমা!” বলিয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়া হিঃ—হিঃ—করিয়া টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। রমার কানে কিন্তু ইহার একটা কথাও প্রবেশ করিল না। ‘মা-জীর মুখ হইতে কখনো ঝুটাবাত বাহির হইবে না।’ ভজুয়ার এই বাক্যটা তখন তাহার দুই কানের ভিতর লক্ষ করতালির সমবেত ঝমাঝম্‌ শব্দে যেন মাথাটা ছেঁচিয়া ফেলিতেছিল। তাহার গৌরবর্ণ মুখখানি পলকের জন্য রাঙা হইয়াই এম্‌নি শাদা হইয়া গিয়াছিল, যেন কোথাও একফোঁটা রক্তের চিহ্ন পর্য্যন্ত নাই। শুদ্ধ এই জ্ঞানটা তাহার ছিল, যেন এ মুখের চেহারাটা কাহারও চোখে না পড়ে। তাই সে মাথার আচলটা আর একটু টানিয়া দিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।