পাতা:অতিথি (প্রথম বর্ষ ১৯৩০).pdf/৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাদ্র ]
উপমা

গুলিও অপরের মধ্যে দেখিলে যেন অনেকখানি হাঁফ্ ছাড়িয়া বাঁচি। পোষাক-পরিচ্ছদ সম্বন্ধেও আমরা এই কথাটা নির্ভয়ে বলিতে পারি। আমাদের মনের যে-দিক্‌টা চিরদিনই নূতনকে শ্রদ্ধা, প্রীতি, আগ্রহের চোখে দেখে, যে-দিকটা কোনো কিছু নূতন, অভাবনীয়ের মধ্যে তৃপ্তি, স্ফর্তি হইতে আনন্দ পাইয়া থাকে, যে দিকটা আহারে, পরিচ্ছদে পড়াশুনায়, চাল-চলনে প্রয়াসী, সে দিকটাও একা, নিজের মধ্যে কেমন সঙ্কোচ অনুভব করে। অপরের মধ্যে সাদৃশ্যের ভিতর দিয়া আপনার-পরিচয় তাহার কেমন এক সাহস, কেমন এক অনুপ্রেরণা।

 আমাদের কথা-বার্তার বেলায়ও ঐ কথা। কথাগুলিকে শুধু ছাড়িয়া দিতে কেমন-যেন বাধো-বাধে ঠেকে; কেমন যেন লজ্জা অমুভব করি। তাই আমরা মেঘকে ডান মেলিতে, ঢেউকে খেলিতে, বাতাসকে নাচিতে দেখি।

 আমাদের অস্তরের ভাবগুলিও বাহিরের ঘটনাবলীর মধ্যে তাহদের সাদৃশ্য দেখিয়া শক্তি সঞ্চার করে। মিলনচঞ্চল হৃদয় তাই আপনাকে ‘প্রভাত-পবন-ধূত-শিশির,'[১] ঘূর্ণা-ক্ষুব্ধ সমুদ্র, অশনি-ভীত বিহঙ্গম' ভাবিয়া বসে।

 এই সাদৃশ্য-অনুসন্ধানই উপমা-উৎপত্তির একটা কারণ!

 আবার, আমাদের মনে দুইটী বিপরীত ভাব অহরহ কাজ করিয়া যায়: একটী সঙ্কোচের, অপরটী বিস্তারের। একটী টানিয়া, ওটাইয়া, তাৎপর্য বাহির করিয়া সম্যক্ উপলদ্ধির মাঝে সন্তুষ্ট হইতে চায়; অপরটী ছাড়িয়া, বিশালতা, ব্যাপকতা দিয়া অসীম রহস্যের মাঝে হারা হইতে পারিলে বাঁচে। মনে কর, কাহাকে প্রশ্ন করা গেল, 'অমুক লেখকের লেখাটা কেমন?' সে তৎক্ষণাৎ ভালো কি মন্দ, একটা কিছু বলিবে। আর তাহার প্রতি যদি সে নিতান্ত উদাসীন না হয়, তাহা হইলে সে বলিবে, ‘অমুকের লেখা?…তা’র দোষ-গুণ?...তার যা আছে তা' এই-এই; আর যা নেই, তা'ও এই আঙুল-ক'টার
মধ্যে।' অগস্ত্য মুনির এক গণ্ডুষে সমুদ্র-পানের মত, স্বল্প বোধগম্য কথার মধ্যে ভাব চিন্তা বন্দী রাখিতে মানুষ প্রায়ই অভ্যস্ত। এবং সেই-গুলি তাহার পক্ষে কম সঞ্চয় নয় কাজ-কর্মে, আসর-বাসরে সে-গুলি উদ্ধার করিয়া বাহবা পাইয়া থাকে; সে গুলির আদর এত বেশী! তাই ছেলে বেলা হইতে শুনিয়াই আসিতেছে, 'Mercy is twice blessed,'…'কণ্টকনৈকম কণ্টকম,’…'উদারচরিতানাম বসুধৈব কুটুম্বকম,'…"যাঞ্চা মোঘা বরমধিগুণে নাধমে লব্ধকাম'…মন্ত্রের সাধন, কিংবা শরীর পাতন'…'জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে’…ইত্যাদি।…অপর ধরণটী ইহাতে বিদ্রোহী হইয়া উঠে: সে বলে, ‘ভাবগুলিকে কথা দিয়া ছাড়িয়া দাও। বাঁধিয়া চাপা দিয়া গৌরব নেবার চেষ্টা কেন?…সে তখন বিচরণের বিশালক্ষেত্রের অঙ্গুসন্ধানে লাগিয়া যায়: একটী ভাব আর একটি সীমাহীন ভাবের মধ্যে আনিয়া বাড়াইবার তখন চেষ্টা চলে। সেই-খানে উপমার সৃষ্টি, আর তাহার গৌরব, সৌন্দর্য সেই ধর্ম। কালিদাস হইতে দু'টি শ্লোক উদাহরণ-স্বরূপে উদ্ধৃত করা যাক্।

 
‘আসার-সিক্ত-ক্ষিতি-বাষ্প-যোগাদ
মামক্ষিণোদ্ যত্র বিভিন্ন-কোশৈঃ।
বিড়ম্বামানা নব-কন্দলৈন্তে
বিবাহ-ধূমারুণ-লোচনশ্রীঃ॥
‘ক্বচিৎ প্রভা চান্দ্রমসী তমোভি
ছায়াবিলীনৈঃ শবলীক্বতেব।
অন্যত্র শুভ্রা শরদভ্র লেখা
রন্ধে বিবলক্ষ্য-নভঃপ্রদেশা॥’

 এখানে প্রথমটীতে বিবাহ-ধূম ও অরুণ-লোচনের অবতারণা করিয়া, আর দ্বিতীয়টাতে আলো-অন্ধকারের এবং আকাশ ও শরৎ-মেঘ আনিয়া ভাবের পরিসর যত-দূর সম্ভব হৃদয়ঙ্গমও করি; কিন্তু তবু ইহাদের নাগাল পাই না, সীমা স্পর্শ করিতে পারি না। তবু মানিয়া লইলাম,

  1. শেলীর কবিতা