পাতা:অপু-পথের পাঁচালী-অপরাজিত.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তার মা বলে, আচ্ছা থামো, আর দুলো না খোকা, হয়েচে, হয়েচে, খুব হয়েচে। কখনো কখনো কাজ করিতে করিতে সর্বজয়া কান পাতিয়া শুনিত, খোকার বেড়ার ভিতর হইতে কোন শব্দ আসিতেছে না-যেন সে চুপ করিয়া গিয়াছে। তাহার বুক ধড়াসা করিয়া উঠিত-শেয়ালে নিয়ে গেল না তো? সে ছুটিয়া আসিয়া দেখিত খোকা সাজি-উপুড-করা এক রাশ চাপা ফুলের মত মাটির উপর বে-কায়দায় ছোট হাতখানি রাখিয়া কখন ঘুমাইয়া পডিয়াছে, চারিদিক হইতে নালাসে পিপড়ে, মাছি ও সুড়সুডি পিপডের দল মহালোভে ছুটয়া আসিতেছে, খোকার পাতলা পাতলা রাঙা ঠোঁট দুটা ঘুমের ঘোরে যেন একটু একটু কাঁপিতেছে, ঘুমের ঘোরে সে যেন মাঝে মাঝে ঢোক গিলিয়া জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলিতেছে-যেন জাগিয়া উঠিল, আবার তখনই এমন ঘুমাইয়া পডিতেছে যে নিঃশ্বাসের শব্দটিও পাওয়া যাইতেছে না।

সকাল হইতে সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা হইতে অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহদের বাঁশ"- বাগানের ধারে নির্জন বাড়ীখানি দশ মাসের শিশুর অর্থহীন আনন্দ-গীতি ও অবোধ কলহাস্যে মুখরিত থাকে।

মা ছেলেকে স্নেহ দিয়া মানুষ করিয়া তোলে, যুগে যুগে মায়ের গৌরব-গাথা তাই সকল জনমনের বার্তায় ব্যক্ত। কিন্তু শিশু যা মাকে দেয়, তাই কি কম? সে নিঃস্ব আসে বটে, কিন্তু তার মন-কাড়িয়া-লাওয়া-হাসি, শৈশবতারল্য, চাদছানিয়া-গড়া মুখ, আধ-আধ্য আবোল-তাবোল বকুনির দাম কে দেয়? ওই তার ঐশ্বর্য, ওরই বদলে সে সেবা নেয়, রিক্ত হাতে ভিক্ষুকের মত নেয় না।

এক একদিন যখন হরিহর বাজারের হিসাব কি নিজের লেখা লইয়া ব্যস্ত আছে-সর্বজয়া ছেলেকে লইয়া গিয়া বলে, ওগো, ছেলেটাকে একটু ধরে না? মেয়েটা কোথায় বেরিয়েচে-ঠাকুরঝি গিয়েচে ঘাটে-ধর দিকি একটু -আমি নাইবো না, ছেলে ঘাডে করে বসে থাকলেই হবে? হরিহর বলে-উহু, ওসব গোলমাল এখন এখানে নিয়ে এসে না, বড় ব্যস্ত। সবজয়ী রাগিয়া ছেলেকে ফেলিয়া রাখিয়া চলিয়া যায়। হরিহর হিসাবপত্র লিখিতে লিখিতে হঠাৎ দেখে ছেলে তার চটিজুতার পাটটা মুখে দিয়া চিবাইতেছে! হরিহর জুতাখানা কাডিয়া লইয়া বলে-আঃ, দ্যাখে বাধিয়ে গেল এক কাণ্ড, আছি। একটা কাজ নিয়ে।

হঠাৎ একটা চড়ুই পাখী আসিয়া রোয়াকের ধারে বসে। খোকা বাবার মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়। সেদিকে দেখাইয়া হাত নাড়িয়া বলে—জে-জে-জে-

হরিহরের বিরক্তি দূর হইয়া গিয়া ভারি মমতা হয়।