পাতা:অপু-পথের পাঁচালী-অপরাজিত.pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

একটা মমতা হয়। রথের চাকা মাটিতে পুতিয়া গিয়াছে—দুই হাতে প্রাণপণ সেই চাকা মাটি হইতে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন-সেই নিরস্ত্র, অসহায়, বিপন্ন কর্ণের অনুরোধ মিনতি উপেক্ষা করিয়া অজুন তীর ছুড়িয়া তঁহাকে মারিয়া ফেলিলেন ! মায়ের মুখে এই অংশ শুনিতে শুনিতে দুঃখে৷ অপুর শিশুহৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিত, চোখের জল বাগ মানিত না-চোখ ছাপাইয়া তাহার নরম তুলতুলে গাল বাহিয়া গড়াইয়া পড়িত-সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুঃখে৷ চোখের জল পড়ার যে আনন্দ, তাহা তাহার মনোরাজ্যে নব অনুভূতির সজীবত্ব লইয়া পরিচিত হইতে লাগিল ! জীবন-পথে যেদিক মানুষের চোখের জলে, দীনতায়, মৃত্যুতে, আশাহত ব্যর্থতায়, বেদনায় করুণ-পুরোনো বইখানার ছেড়া পাতার ভরপুর গন্ধে, মায়ের মুখের মিষ্ট সুরে, রৌদ্রভরা দুপুরের মায়া-আঙ্গুলি-নির্দেশে, তাহার শিশুদৃষ্টি অস্পষ্টভাবে সে পথের সন্ধান পাইত। বেলা পড়িলে মা গৃহকার্ষে উঠিয়া গেলে, সে বাহিবে আসিয়া রোয়াকে দাড়াইয়া দূরের সেই অশ্বখ গাছটার দিকে এক এক দিন চাহিয়া দেখে-হয়তো কড়া চৈত্র-বৈশাখের বৌদ্রে গাছটার মাথা ধোয়া ধোয়া অস্পষ্ট, নয় তো বৈকালের রাঙা রোদ অলসভাবে গাছটার মাথায় জড়াইয়া আছে--- সকলের চেয়ে এই বৈকালের রাঙা-রোদ-মাখানো গাছটার দিকে চাহিয়াই তাহার মন কেমন করিত। কর্ণ যেন ঐ অশখ গাছটার ওপাবে আকাশের তলে, অনেক দূরে কোথায় এখনও মাটি হটতে রথের চাকা দুই হাতে প্রাণপণে টানিয়া তুলিতেছে-‘রোজই তোলে-রোজই তোলে—মহাবীর, কিন্তু চিরদিনের কৃপার পাত্র কর্ণ। • • •বিজয়ী বীর অজুন নহে-যে রাজ্য পাইল, মান পাইল, রথের উপর হইতে বাণ ছুডিয়া বিপন্ন শক্রকে নাশ করিল ; বিজয়ী কর্ণ যে মানুষের চিরকালের চোখেব জলে জাগিয়া রহিল, মানুষের বেদনার অনুভূতিতে সহচর হইয়া বিরাজ করিল-সে। এক এক দিন মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হয় যুদ্ধ জিনিসটা মহাভারতে বড় কম লেখা আছে। ইহার অভাব পূর্ণ করিবার জন্য এবং আশ মিটাইয়া যুদ্ধ জিনিসটা উপভোগ করিবার জন্য সে এক উপায় বাহির করিয়াছে। একটা বাখ্যারি কিংবা হালকা কোন গাছের ডালকে অস্ত্রীস্বরূপ তাতে লইয়া সে বাড়ীর পিছনে বঁাশবাগানের পথে অথবা বাহিরের উঠানে ঘুরিয়া বেড়ায় ও আপন মনে বলে-তারপর দ্রোণ তো একেবারে দশ বাণ ছুড়লেন, অজুন করলেন কি, একেবারে দুশোটা বাণ দিলে মেরে । তারপর-ও-সে কি যুদ্ধ। কি যুদ্ধ! বাণের চোটে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল ! ( এখানে সে মনে মনে যতগুলি বাণ হইলে তাহায়