পাতা:অবরোধ বাসিনী.pdf/২২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 বেচারীরা বাজারের পথে চলিলেন; ভাগ্যে রাত্রি ছিল, -তাই রক্ষা! অর্থাৎ আমাদের তৎকালীন দুর্গতি দেখিবার জন্য লোকের ভিড় হয় নাই। আহা রে! সকলের পা ফুলিয়া ভারী হইল যে এক মণ,—দুই পা চলেন আর হোঁচট খান; বারবার পড়েন। একজন পথে বসিয়া একেবারে এলাইয়া পড়িলেন যে আর তিনি হাঁটিতে পারিবেন না। কেবল পায় ব্যথা নয়, আমাদের সর্ব্বাঙ্গে বেদনা হইয়া গেল। বেচারী বিবিদের লাঞ্ছনার অবধি ছিল না।

কিছুদূর যাইয়া দেখি, হাজার হাজার গোরা আর শিখ সৈন্য সারি বাঁধিয়া চলিয়া আসিতেছে। তাহা দেখিবামাত্র ভয়ে আমাদের প্রাণ উড়িয়া গেল। আরও চলচ্ছক্তি-বিহীন হইয়া পড়িলাম।

অবশেষে বহু কষ্টে কিছু দূর গিয়া ভাইজান চারটা গাধা সংগ্রহ করিলেন। শেষে গাধায় উঠিয়া বিবিরা রক্ষা পাইলেন।


অবরোধ বাসিনী - ৩৬

[৩৬]

শীতকাল। মাঘ মাসের শীত। সেই সময় কোথা হইতে এক ভালুকের নাচওয়ালা গ্রামে আসিল। গ্রামে কোন নূতন কিছু আসিলে প্রথমে তাহাকে জমীদার বাড়ীতে হাজিরা দিতে হয়। তদনুসারে ভালুকওয়ালা জমীদার বাড়ীতেই অতিথি হইয়াছে। প্রশস্ত দালানের উত্তর দিকের মাঠে প্রত্যেহ ভালুকের নাচ হয়,—গ্রামশুদ্ধ লোকে আসিয়া নাচ দেখে! কিন্তু বাড়ীর বউ ঝি সে নাচ দেখা হইতে বঞ্চিতা।

ছোট ছেলেরা এবং বুড়ী চাকরাণীকে আসিয়া গিন্নীদের নিকট গল্প করে।—ভালুকে খেমটা নাচ নাচে; থমকা নাচ নাচে। এমন করিয়া ভালুকওয়ালার সঙ্গে কুস্তি লড়ে; এমন করিয়া পাছাড় ধরে।—ইত্যাদি। এই সব গল্প শুনিয়া শুনিয়া কর্ত্তার দুইজন অল্পবয়স্কা পুত্রবধূর সাধ হইল যে একটু নাচ দেখিলেন। বেশী দূর যাইতে হইবে না, ছোট বউবিবির কামরার উত্তর দিকের জানালার ঝরোকা (খড়খড়ির পাখী) একটু তুলিলেই সুস্পষ্ট দেখা যায়।

যেই বধূদ্বয় ঝরোকা তুলিয়াছেন, অমনি তাঁহাদের চারি বৎসর বয়স্কা ননদ জোহরা দৌড়াইয়া আসিয়া বলিল যে, সেও দেখিবে। একজন তাহাকে কোলে তুলিয়া দেখাইতে লাগিলেন। জোহরা কখনও বাড়ীর উঠানে নামিয়া কুকুর বিড়াল পর্যøন্ত দেখে নাই,—এখন দেখিল একেবারে ভালুক! ভালুক কুস্তি লড়িতেছিল, তাহা দেখিয়া জোহরা চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িল! ভালুকের নাচ দেখা মাথায় থাকুক-এখন জোহরাকে লইয়া তাঁহারা ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।

জোহরা সজ্ঞান হইয়া বটে কিন্তু তাহার ভয় গেল না। রাত্রিকালে হঠাৎ চীৎকার করিয়া জাগিয়া উঠিয়া ভয়ে থরথর কাঁপে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন সুদূর সদর জেলা হইতে বহু অর্থ ব্যয়ে ডাক্তার থাকিতে হইল। ডাক্তার সাহেব সকল অবস্থা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, শিশু কোন প্রকারে ভয় পাইয়াছিল না কি? কথা গোপন থাকে না, জানা গেল ভালুকের নাচ দেখিয়া ভয় পাইয়াছিল।

এদিকে কর্ত্তা সন্ধান লইতে লাগিলেন, জোহরাকে-নাচ দেখাইল কে। খেলাই আন্না প্রভৃতি সকলে একবাক্যে অস্বীকার করিল যে তাহারা সাহেবজাদীকে ভালুকের নাচ দেখায় নাই। অবশেষে জানা গেল, বউ বিবিরা দেখাইয়াছেন। তখন তাঁহার ক্রোধ চরমে উঠিল। জোহরা মরে মরুক, তাহাতে কর্ত্তার তত আপত্তি নাই; কিন্তু এই যে বাড়ীময় রাষ্ট্র হইল যে, তাঁহার পুত্রবধূগণ বেগানা মরদের তামাসা দেখিতে গিয়াছিলেন, তিনি এ লজ্জা রাখিবেন কোথায়? ছি! ছি! ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী সিভিল সার্জ্জন ডাক্তারও শুনিয়া মৃদু হাসিলেন যে বউয়েরা ভালুকের নাচ দেখিতে গিয়াছিলেন।

লাজে খেদে ক্রোধে অধীর হইয়া কর্ত্তা বধূদের তলব দিলেন। মাথায় একহাত ঘোমটা টানিয়া শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বধূদ্বয় লজ্জায় অভিমানে থরথর কাঁপিতেছিলেন; (সেই মাঘ মাসের শীতও) ঘামিতেছিলেন আর পদতলস্থিত পাথরের মেঝেকে হয়ত বলিতেছিলেনঃ

“ওমা বসুন্ধরা! বিদর গো ত্বরা-
তোমাতে বিলীন হই!”