‘আত্মগৌরব তাহাকে পর্বতের মত অক্ষুন্ন রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ সে প্রথম দেখিয়াছে যে, তাহারই আত্মগৌরব তাহাকে প্রতারিত করিয়াছে, আত্মা বিদ্রোহী হইয়াছে, মন বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। মেরিকে সে ভালবাসিত, কারণ মেরিও তাহাকে ভালবাসিত ; এটা বেশ কথা ; তার পর সে রাগ করিল, কথা না শুনিয়া অবাধ্য হইয়া পড়িল, আর তাহার ভালবাসা নাই-লিও মনে স্থির করিল সেও আর বাসিবে না, তবে একটা পদার্থকে এতদিন পরে বিনাশ করিতে হইলে ক্লেশ বোধ হয়, লিওরও ক্লেশ বোধ হইয়াছিল, কিন্তু সে যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করিল যে, স্ত্রীচরিত্র সহজে বুঝা যায় না, মেরিকেও সে এজন্য বুঝিতে না পারিয়া ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল, যাহা হউক এখন সংশোধন করিলেই হইবে । সে আপনাকে শোধরাইয়া লইল, তবে মধ্যে মধ্যে দুঃখ হয়, মধ্যে মধ্যে হাসিও পায়, এমন হইয়াই থাকে, এজন্য কোন ক্ষতি নাই । সে আপনাকে সংযত করিয়া, জগতের যাবতীয় দুর্ভাবনা, দুঃখ, ক্লেশ দূর করিয়া দিয়া, পরম আনন্দে সমস্ত অন্তরাত্মা এই পুস্তকখানির উপর ন্যস্ত করিয়া হৃষ্টচিত্তে ‘ইভা’’র চরিত্র গড়িতেছিল। লিখিয়া শেষ করিতে পারিতেছিল না— গুণের কথা লিখিতে বুঝি স্বৰ্গও ফুরাইয়া যাইবে, রূপের মাধুরী বর্ণনা করিতে বুঝি স্বয়ং সজীব প্রকৃতিদেবীকে টানিয়া আনিয়া ইভার চতুর্দিকে জড়াইয়া দিতে হইবে ; তাহার হৃদয়ের প্রবৃত্তিগুলি আঁকিবার আনন্দে লিওর আহার-নিদ্রা ত্যাগ হইয়াছিল, এই এক মাস ধরিয়া দারুণ পরিশ্রমেও এক তিল ক্লান্তি বোধ করে নাই, তথাপি এ চিত্র শেষ হইতেছে না, মনে হয় যদি অব্যক্ত, অজানিত দুটো কথা কেহ বলিয়া দিতে পারিত-সে দেবী-হৃদয়ের গোটা-দুই গুপ্তকথা কিছুতেই বুদ্ধিতে আসিতেছিল না, তাহা যদি পরিষ্কৃত হইত। তাহা হইলে এ স্বৰ্গচিত্র কোন স্বগীয় দেবীর হস্তে পরমানন্দে সমৰ্পণ করিয়া লিও তাহার এ জীবনের সমস্ত বাসনা, সমস্ত আশা কাগজ কলম যাহা কিছু আছে সমস্তই উৎসর্গ করিয়া নিতান্ত নিশ্চিত মনে বাকী জীবনটা চুপ করিয়া বসিয়া কাটাইয়া দিতে পারিত। আজ প্রাতঃকাল হইতে লিও এই লিখিত চিত্রখানি ভাল করিয়া দেখিতেছিল ;
পাতা:অভাগীর স্বর্গ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৪
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।