একটু সবিস্তারে আলোচনা করা যাক্। মনে রাখ্বেন আজকালকার এই “জাতিভেদ” কথাটা আমরা সৃষ্টি করেছি, এটা পুরাতন নয়, পুরাতন সংস্কৃত গ্রন্থে এর উল্লেখ মাত্র নেই। সে সকল পুস্তকে বর্ণভেদ বর্ণাশ্রম প্রভৃতির কথা দেখা যায়। গীতায় আছে—“চাতুর্ব্বণ্যম্ ময়া সৃষ্টম্ গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।” আমাদের দেশে বহুপূর্ব্বে আর্য্য ও অনার্য্য এই দুই শ্রেণীর লোক ছিল। ঋগ্বেদসংহিতা পড়্লে তাদের আচার ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়। ইন্দ্র বরুণ প্রভৃতি তখন আর্য্যদের দেবতা ছিলেন। আর্য্যেরা প্রার্থনা কর্তেন,— “হে ইন্দ্র, হে বরুণ, তোমাদের প্রচুর সোমরস প্রদান করেছি, পান ক’রে প্রসন্ন হও—এবং কৃষ্ণকায় অনার্য্য দস্যু বধ কর।” অনার্য্যেরা কৃষ্ণকায় ও কদাচারী ছিল। আর্য্যেরা ছিল সভ্য এবং গৌরবণ। এদেশে তখন জাতিভেদের মূলে ছিল বর্ণভেদ। আর্য্যেরা যখন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে উত্তর-ভারতের নদীবহুল সমতলক্ষেত্রে ক্রমে বসতিবিস্তার কর্তে লাগ্ল, তখন কৃষ্ণকায় আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধ্ল এবং পরাজিত হ’য়ে তারা একে একে পর্ব্বতে জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ কর্লে। ভীল, কোল, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতিরা তাদের বংশধর। আমেরিকা দেশেও এইরূপ ঘটনা ঘটেছে। পরাক্রান্ত য়ুরোপীয় জাতির সংঘর্ষণে ও আওতায় রেড ইণ্ডিয়ান প্রভৃতি হীনজাতি টিক্তে না পেরে, বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা কর্বার চেষ্টা করেছে।
যে দেশে বর্ণভেদ ছাড়া জাতিভেদের অন্য কোন ভিত্তি ছিল না, সে দেশে এই হাজার রকম জন্মগত জাতির উৎপত্তি কিরূপে হ’ল? নানা জাতিতে বিভক্ত বর্ত্তমান হিন্দু সমাজটিকে বিধাতা ঠিক এইরূপে তৈরী ক’রে শৃঙ্খল দিয়ে বেঁধে দ্যুলোক থেকে ভূলোকে নামিয়ে দিয়েছেন, অথবা এই ভূলোকেই এইরূপ জাতিভেদের সৃষ্টি হয়েছে?